ভূমিকা: শক্তি বা Power হল আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাজনীতির মূলকথা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক অনেকাংশে ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। শক্তি বা ক্ষমতা ছাড়া কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সর্বপ্রধান লক্ষ্য হল নিজ দেশের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য শক্তি অর্জন করা। জাতীয় শক্তি বা ক্ষমতার সঙ্গে সংযুক্ত থাকে বিবিধ উপাদান। এই সমস্ত উপাদান রাষ্ট্রের সামর্থ্যের সূচক। বিভিন্ন উপাদানকে যথােপযুক্তভাবে সদ্ব্যবহার করে জাতীয় শক্তি বাড়িয়ে তােলা যেতে পারে। পামার ও পারক্সি জাতীয় শক্তির উপাদানসমূহকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছেন। এইসব উপাদানসমূহের মধ্যে জনসংখ্যা ও প্রাকৃতিক সম্পদ বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।

জনসংখ্যার ভিত্তিতে মানবসম্পদ গড়ে ওঠে। লোক সংখ্যা এবং তার উৎপাদনশীলতাকে মানবসম্পদ হিসেবে মনে করা হয়। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামরিক শক্তির স্বার্থে লােকবলের প্রয়ােজনীয়তা অনস্বীকার্য। জনসংখ্যার দুটি দিক রয়েছে। যথা সংখ্যাগত দিক এবং গুণগত দিক।

[1] সংখ্যাগত দিক: সংখ্যাগত দিক একটি দেশের জাতীয় শক্তির উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে।

  • প্রথমত, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য সৈন্য প্রয়ােজন। যে-কোনাে রাষ্ট্রই জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষিত করার জন্য সেনাবাহিনীর উপর নির্ভর করে।
  • দ্বিতীয়ত, অর্থনীতির ক্ষেত্রেও বিশাল জনসংখ্যার উপকারিতা অনস্বীকার্য। উৎপাদন ব্যবস্থা কি অক্ষুন্ন রাখার জন্য বিশাল জনসংখ্যা পর্যাপ্ত শ্রমিকের নিরবচ্ছিন্ন জোগানদাতা হিসেবে কাজ করে।
  • তৃতীয়ত, জনসংখ্যার ঘাটতিতে দেশের জাতীয় শক্তি বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে কোনাে রাষ্ট্রের জাতীয় শক্তি বিচার করতে গিয়ে জনসংখ্যাকে একেবারে উপেক্ষা করলে ভুল হবে।

আমেরিকা ও রাশিয়ার জনসংখ্যা কম হলে তারা পৃথিবীর বৃহৎ শক্তিতে পরিণত হতে পারত কি না, তা নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, কেন-না সামরিক শক্তি এবং অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট জনসংখ্যারও প্রয়ােজন আছে।

[2] গুণগত দিক: গুণগত দিক বলতে জাতীয় চরিত্র, জাতীয় মনোবল এবং কূটনৈতিক উৎকর্ষ প্রভৃতিকে বােঝায়। রুশদের অধ্যবসায়, আমেরিকানদের উদ্ভাবনী শক্তি, ব্রিটিশদের অসাধারণ বোধ শক্তি এবং জার্মানদের শৃঙ্খলা পরায়ণতা হল জাতীয় চরিত্র। এ ছাড়া, জাতীয় শক্তি গঠনের ক্ষেত্রে জাতীয় মনােবলের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। হ্যান্স জে মরগেনথাউ বলেছেন, কেবল যুদ্ধ ও শান্তির সময় জাতীয় মনােবল যে সরকারের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানায় তা নয়, এটি সবসময়ই সক্রিয় থাকে। তার মতে, উৎকৃষ্ট মানের কূটনীতি জাতীয় শক্তির একটি উল্লেখযােগ্য উপাদান। যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর নিপুণতা যেমন জয়ের পথ প্রশস্ত করে তেমনি শান্তির সময় কূটনীতিবিদদের কর্মকুশলতা ও নৈপুণ্য জাতীয় শক্তি বৃদ্ধি করে। বলাবাহুল্য যে, একটি দেশ শিল্পোন্নত না হলে এবং সামরিক বাহিনীতে আধুনিক অস্ত্র ব্যবহার না করলে কেবল জনসংখ্যা দিয়ে দেশকে ক্ষমতাবান করা যায় না।

প্রাকৃতিক সম্পদ নিঃসন্দেহে কোনাে দেশের জাতীয় শক্তির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যে সম্পদগুলি প্রকৃতি থেকে পাওয়া যায় সেইগুলিকেই প্রাকৃতিক সম্পদ বলা যেতে পারে। বস্তুত এটিকে জাতীয় শক্তির স্থায়ী উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয়। যে সম্পদগুলি আমরা প্রকৃতি থেকে পাই সেগুলির মধ্যে অন্যতম হল খনিজ সম্পদ, প্রাণীজ সম্পদ, বনজ সম্পদ, জলজ সম্পদ ও কৃষিজ সম্পদ।

[1] খনিজ সম্পদ: একটি দেশের খনিজ সম্পদের বিপুল ভাণ্ডার সেই দেশের প্রতিরক্ষা, শিল্পোন্নতি ও আর্থিক শক্তি বৃদ্ধিতে বিশেষভাবে সাহায্য করে থাকে। অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে খনিজ তেল, উন্নত মানের ইস্পাত, প্লুটোনিয়াম ও ইউরেনিয়াম বিশেষভাবে প্রয়ােজন। এ ছাড়া প্রথাগত খনিজ সম্পদ কয়লা, তামা, সিসা, টিন প্রভৃতি জাতীয় সম্পদকে সমৃদ্ধ করে থাকে। বিগত শতাব্দীতে শিল্পোন্নত দেশগুলি কয়লাভিত্তিক শিল্প স্থাপন করে গােটা বিশ্বকে আর্থিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে উন্নত প্রযুক্তিবিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে ইউরেনিয়ামকে শিল্পের কাজে ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে ব্যবহার করার ফলে গােটা বিশ্বের রাজনীতি নতুনভাবে পরিচালিত হয়েছে। বিশেষত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গ্রেট ব্রিটেনের পরিবর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ আণবিক অস্ত্রে বলীয়ান হয়ে উঠে গােটা দুনিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। এছাড়া পরিশ্রম ও অপরিশ্রুত খনিজ তেল কে নিয়ন্ত্রণ করার প্রবণতাকে কেন্দ্র করে বিশ্বরাজনীতিতে নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন খনিজ তেল সমৃদ্ধ দেশ হওয়া সত্ত্বেও তারা মধ্যপ্রাচ্যের আরবদেশগুলির তৈলকূপের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে বিবাদে জড়িয়ে পড়ল। আবার তৈলসমৃদ্ধ রাষ্ট্রগুলি ওপেক (OPEC) গঠন করে অবস্থা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করল।

[2] প্রাণীজ সম্পদ: রাষ্ট্রের শক্তি বৃদ্ধির জন্য খনিজ সম্পদের পাশাপাশি প্রাণীজ সম্পদের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। বিশেষত গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, ঘোড়া প্রভৃতি পশুগুলি যেমন একদিকে দেশবাসীর খাদ্যের অভাব পূরণ করছে, অপরদিকে পাহাড়, পর্বত, নদী নালা, মরুভূমি প্রভৃতিতে যানবাহনের মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। ঘোড়া, খচ্চর, কুকুর প্রভৃতি জন্তুগুলি দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িয়ে আছে।

[3] বনজ সম্পদ: প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে বনজ সম্পদ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সাধারণভাবে বন থেকে জাত দ্রব্যকে বনজ সম্পদ বলা হয়। একদিকে গভীর অরণ্য দেশকে বহিরাক্রমণ থেকে রক্ষা করে, অপরদিকে দেশে বৃষ্টিপাত স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। দেশের বৃষ্টিপাত পরিমাণমতাে হলে কৃষকরা চাষ করে খাদ্য সম্পদকে সমৃদ্ধ করে তােলে।

[4] জলজ সম্পদ: প্রাকৃতিক সম্পদের আর-একটি অন্যতম উপাদান জলজ সম্পদ। কোনাে দেশে মিষ্টি জলের প্রকৃতিগত ভাণ্ডার থাকলে, সেই দেশের কৃসিজ সম্পদে স্বনির্ভরশীল হয়ে ওঠে। আবার দেশবাসী এই জলকে পানীয় হিসেবে ব্যবহার করে, ফলে কোনাে সমস্যা দেখা দেয় না। আবার আধুনিক জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্পব্যবস্থায় এই জলকে খুব সহজেই ব্যবহার করা যায়।

[5] কৃষিজ সম্পদ: প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হল কৃষিজ সম্পদ। সাধারণভাবে কৃষিজ সম্পদ বলতে খাদ্যবস্তুকে বােঝায়। আবার বিভিন্ন অর্থকরী ফসল যেমন পাট, রবার, কার্পাস তুলাে, পশম এগুলিও কৃষিজ সম্পদ। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি দেশ খাদ্য বস্তুতে স্বনির্ভরশীল হলে সেই রাষ্ট্র অবশ্যই গােটা দুনিয়ায় শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খাদ্যবস্তুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে জাতীয় শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু বিশ্বরাজনীতিতে এমন অনেক দেশের সন্ধান পাওয়া যায়, যে দেশগুলিতে খাদ্যে ঘাটতি লক্ষ করা যায়। বলা যেতে পারে, কোনাে দেশে খাদ্যের অভাব আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্থায়ী দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত হয়। এর ফলে সেই দেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে জাতীয় শক্তিতে পরিণত হওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং এই দেশগুলিকে আমদানিকৃত খাদ্য বস্তুর উপর নির্ভরশীল হতে হয়। ফলস্বরূপ দেশটির পক্ষে স্বাধীনভাবে বিদেশনীতি নির্ধারণ করা সম্ভব হয় না।

উপসংহার: এই সমস্ত সম্পদগুলিকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে একটি শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে না পারলে কোনাে দেশই বৃহৎ জাতীয় শক্তি হিসেবে বিশ্বের দরবারে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে না। বলাবাহুল্য, রাষ্ট্রগুলি প্রাকৃতিক সম্পদকে যথাযথভাবে ব্যবহার করে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাতীয় শক্তির আত্মপ্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়। সুতরাং প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে একটি দেশ জাতীয় শক্তি হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।