অথবা, তুমি কী মনে কর যে জাতীয়তাবাদ বিশ্বসভ্যতার প্রতি হুমকিস্বরূপ? যুক্তি দাও।
ভূমিকাঃ জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি অন্যতম আলােচ্য বিষয়। বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে জাতি ও জাতীয়তাবাদ একটি যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা করেছে। জাতীয়তাবাদ বর্তমানে বিশ্ব রাজনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। যার ফলে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্যায়ে ঔপনিবেশিক অঞ্চলগুলাে জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে নতুন নতুন রাষ্ট্র গঠন করেছে।
জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞাঃ একই ভৌগােলিক সীমানায় বসবাসরত সমগ্র জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবােধের ওপর অন্যকোনাে ভৌগলিক সীমারেখায় অবস্থিত মানুষের আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জনমতকে ঐক্যবদ্ধ করে সংগ্রাম পরিচালনা করার মানসিকতা হলাে জাতীয়তাবাদ। অর্থাৎ যখন কোনাে জনসমষ্টির মধ্যে ভাষাগত ঐক্য, সাংস্কৃতিক ঐক্য, জীবনধারণগত ঐক্য দেখা দেয় তখন তাদের মধ্যে জাতীয়তাবােধের সৃষ্টি হয়।
জাতীয়তাবাদ কী সভ্যতার প্রতি হুমকিঃ বর্তমানে জাতীয়তাবাদের বিকাশে দুটি ধারা বা রূপ প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। একটি আদর্শ বা প্রকৃত জাতীয়তাবাদ এবং অন্যটি বিকৃত বা উগ্র জাতীয়তাবাদ। আদর্শ জাতীয়তাবাদকে মানব সভ্যতার প্রতি আশীর্বাদরূপে গণ্য করা হয় এবং উগ্র জাতীয়তাবাদকে সভ্যতার প্রতি অভিশাপ হিসাবে গণ্য করা হয়। জাতীয়তাবাদ মানবসভ্যতার প্রতি হুমকি কিনা সে সম্পর্কে মন্তব্য করার পূর্বে আমাদের আদর্শ ও বিকৃত জাতীয়তাবাদের রূপ ও প্রতিফলন কী সে সম্পর্কে জানতে হবে।
আদর্শ বা প্রকৃত জাতীয়তাবাদঃ আদর্শ বা প্রকৃত জাতীয়তাবাদ নিম্নে আলােচনা করা হলাে-
(১) দেশপ্রেম সৃষ্টি করেঃ আদর্শ জাতীয়তাবাদ দেশে বসবাসকারী জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করে। এরূপ জাতীয়তাবাদী চেতনা মানবসমাজে শান্তি বয়ে আনে।
(২) বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠাঃ আদর্শ জাতীয়তাবাদ বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার সহায়ক। আদর্শ জাতীয়তাবাদ মানুষের মধ্যে স্বদেশের প্রতি মায়া সৃষ্টি করে দেয় যা বিশ্বশান্তির জন্য খুবই সহায়ক।
(৩) গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়ঃ পৃথিবীর নব্য স্বাধীন দেশগুলােতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় জাতীয়তাবাদ উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেছে। জাতীয়তাবাদী চেতনার ফলে দেশের মানুষ তাদের নিজেদের পছন্দমতাে সরকার নির্বাচনের সুযােগ পায়।
(৪) প্রতিযােগিতা সৃষ্টিঃ আদর্শ জাতীয়তাবাদ বিভিন্ন জাতির মধ্যে সুষ্ঠু প্রতিযােগিতা সৃষ্টির মাধ্যমে মানব সমাজকে উন্নতি ও প্রগতির দিকে এগিয়ে নেয়।
(৫) ঐক্যের সৃষ্টি করেঃ আদর্শ জাতীয়তাবাদ মানুষে মানুষে ঐক্যের বােধ সৃষ্টি করে এবং ঐ জনসমাজকে আদর্শ ও আত্মপ্রত্যয় শিক্ষা দেয় এবং সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে ওঠে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার নীতি শিক্ষা দেয়।
(৬) কৃষ্টির সংরক্ষণঃ আদর্শ জাতীয়তাবাদ কোন জাতির স্বীয় কৃষ্টি সংরক্ষণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এর ফলে সমগ্র মানবজাতির কৃষ্টি সংরক্ষিত, বিকশিত ও সমৃদ্ধ হয়।
বিকৃত বা উগ্র জাতীয়তাবাদঃ বিকৃত বা উগ্রজাতীয়তাবাদ বিশ্বশান্তি ও সুষ্ঠু মানসিক বিকাশের পরিপন্থী। বিকৃত বা উগ্র জাতীয়তাবাদ নিম্নে আলােচনা করা হলাে-
(১) বিশ্বশান্তির প্রতি হুমকিঃ উগ্র জাতীয়তাবাদ বিশ্বশান্তির প্রতি এক বিরাট হুমকি। উগ্র জাতীয়তাবাদীরা শুধু শক্তি প্রয়ােগ ও নিজ শক্তি অর্জনের নীতিতে বিশ্বাসী। অন্যের স্বার্থ ও শান্তি উগ্র জাতীয়তাবাদীরা বিবেচনায় আনে না ফলে বিশ্বশান্তি হুমকির সম্মুখীন হয়।
(২) জাতিবিদ্বেষ সৃষ্টিঃ উগ্র জাতীয়তাবাদ জাতিতে-জাতিতে সম্প্রীতির বদলে বিদ্বেষ সৃষ্টি করে। জাতীয়তাবাদ নিজ জাতির প্রতি গর্ব, দাম্ভিকতা সৃষ্টি করে এবং অন্য জাতির প্রতি হিংসা-বিদ্বেষের মানসিকতা সৃষ্টি করে। ফলে জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়।
(৩) দুর্বলের ওপর আক্রমণঃ উগ্র জাতীয়তাবাদীরা দুর্বল বা দুর্বল জাতির ওপর আক্রমণ চালাতে মােটেও কুণ্ঠাবােধ করে না। তারা বিভিন্ন দুর্বল জাতিকে শােষণ করে। বর্তমান বিশ্বের দিকেই তাকলে আমরা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ দেখতে পাব। যেমন-সাম্প্রতিককালের ইরাক সংকট। তা ছাড়া ফিলিস্তিনের কথা বলা যায়।
(৪) বিশ্ব নিরাপত্তা বিনষ্টঃ জাতীয়তাবাদ বিশ্ব নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটায়। উগ্র জাতীয়তাবাদী ধারণার ফলে জাতিতে-জাতিতে সমর সজ্জার প্রতিযােগিতা ও যুদ্ধপ্রস্তুতি বৃদ্ধি পায়, ফলে বিশ্ব নিরাপত্তা বিনষ্ট হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে উগ্রজাতীয়তাবাদী জার্মানি, ইটালি, জাপান এভাবে বিশ্বশান্তি ও সৌভ্রাতৃত্ব ধ্বংস করে ফেলেছিল।
(৫) সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি হুমকিঃ উগ্র জাতীয়তাবাদ সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি মারাত্মক হুমকি। সমরাস্ত্র প্রতিযােগিতা ও বিভিন্ন জাতির মধ্যে যুদ্ধপ্রস্তুতির ফলে যেকোনাে সময় মানবসভ্যতা ও সংস্কৃতি ধ্বংস হতে পারে। কেননা উগ্র জাতীয়তাবাদ ভৌগােলিক সীমারেখাকে সীমিত করে বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতির সংমিশ্রণের পথ রুদ্ধ করে দেয়।
(৬) সাম্রাজ্যবাদে পরিণতঃ উগ্র জাতীয়তাবাদ ক্রমে ক্রমে সাম্রাজ্যবাদে পরিণত হয়। নিজ জাতির শ্রেষ্ঠত্ব ও গর্ব বৃদ্ধির জন্য রাষ্ট্রের শক্তি ও কর্তৃত্ব বাড়ানাে হয়। অধ্যাপক লাস্কি বলেন, ক্ষমতা যখন বেড়ে যায় জাতীয়তাবাদ তখন সাম্রাজ্যবাদে পরিণত হয়।
(৭) ঔপনিবেশিকতাবাদে পরিণতঃ উগ্র জাতীয়তাবাদের ফলে শিল্পায়িত ধনী রাষ্ট্রসমূহ নিজেদের শিল্পের কাঁচামাল সংগ্রহ ও শিল্পায়িত দ্রব্যসামগ্রী বাজারজাত করার জন্য অনুন্নত দেশগুলােতে উপনিবেশ স্থাপন করে। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
(৮) শক্তি হ্রাসের হাতিয়ারঃ জাতিয়তাবাদ শক্তি হ্রাসের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। কোনাে বৃহত্তর জাতির শক্তি হ্রাস করার জন্য তাদের মধ্যে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জনগােষ্ঠীর মধ্যে জাতীয়তাবােধের ধারণা দেয়া হলে, তাদের মধ্যে একতা বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যাতে তাদের শক্তি হ্রাস পাই।
(৯) শােষণের মূলমন্ত্রঃ জাতীয়তাবাদের ধারণা শােষণের মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করে। যেমন- ব্রিটিশ সরকার তার ভাগ কর, শাসন কর, নীতি মূলত জাতীয়তাবাদের ধারণা দিয়ে শােষণের পথ উন্মুক্ত করা। তাই জাতীয়তাবাদকে শােষণের মূলমন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।
(১০) ধ্বংসাত্মক অস্ত্রের প্রসারঃ জাতীয়তাবাদের ধারণা যত প্রসারিত হবে, ততবেশি জাতি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হবে। আর রাষ্ট্রের বৃদ্ধি হলে বা নতুন রাষ্ট্র গঠনের ফলে তাদের নিরাপত্তার জন্য অস্ত্রের দরকার হবে, যাতে ধনী রাষ্ট্রগুলাের অস্ত্রের ব্যবসা প্রসার লাভ করবে। আর এর জন্য তারা জাতীয়তাবাদের ধারণার প্রসার বৃদ্ধি করার জন্য বিভিন্ন পন্থা অনুযায়ী কাজ করে।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, জাতীয়তাবাদের দু’ধরনের রূপ রয়েছে, এর মধ্যে একটি আদর্শ বা প্রকৃত জাতীয়তাবাদ ও অন্যটি বিকৃত জাতীয়তাবাদ। আদর্শ জাতীয়তাবাদ মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ব, ভালােবাসা তৈরি, পারস্পরিক সম্প্রীতি ও বিশ্বশান্তিতে সহায়তা করে। কিন্তু উগ্র বা বিকৃত জাতীয়তাবাদ জাতিতে জাতিতে কলহ-বিবাদ সৃষ্টি করে। তাদের নিজেদের মধ্যে অহংবােধ এবং অপরের প্রতি হিংসাত্মক মনােভাব জাগিয়ে তােলে। এর পরিণতি স্বরূপ মানবজাতি যুদ্ধে ও কলহে লিপ্ত হয়, ফলে সভ্যতা সংস্কৃতি ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়ায়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, উগ্র বা বিকৃত জাতীয়তাবাদই একমাত্র সভ্যতার প্রতি হুমকি; জাতীয়তাবাদ নয়।
Leave a comment