রাজনীতিক জাতীয়তাবাদ বলতে সুনির্দিষ্ট কিছু মূলবোধ বা বিশেষ কিছু লক্ষ্যকে বোঝায় না। এ রকম জাতীয়তাবাদী ধারণার মধ্যে স্ব-বিরোধিতা, বিভ্রান্তি ও অস্পষ্টতার অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না। এই কারণে রাজনীতিক জাতীয়তাবাদ হল একটি অত্যন্ত জটিল প্রকৃতির বিষয়। রাজনীতিক জাতীয়তাবাদী বক্তব্য বিষয়াদির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের পরস্পর বিরোধী ধারণা পরিলক্ষিত হয়। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে বিবিধ বিষয়ের কথা বলা যায়।

(ক) জাতীয়তাবাদের মধ্যে একাধারে যুক্তিবাদিতার সঙ্গে সঙ্গে অ-যুক্তিবাদিতাও দেখা যায়। জাতীয়তাবাদ যুক্তিসঙ্গত বা ন্যায়নীতিসঙ্গত বিশ্বাসের উপর গুরুত্ব আরোপ করে। উদাহরণ হিসাবে জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বা নীতির কথা বলা যায়। আবার অযৌক্তিক আবেগ বা উন্মাদনা থেকে জাতীয়তাবাদী ধারণার উন্মেষের কথা বলা যায়। অতীতের ভয় ও হিংসা-দ্বেষ থেকে জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয়।

(খ) অনুরূপভাবে আবার জাতীয়তাবাদ একদিকে প্রগতিমূলক, অপরদিকে প্রগতিবিরোধী। জাতীয়তাবাদী চেতনায় জাতির স্বাধীনতা ও মহত্বপূর্ণ ভবিষ্যতের বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। তেমনি আবার জাতীয়তাবাদীরা অতীত দিনের জাতীয় গৌরবকে বিশালভাবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেন এবং প্রতিষ্ঠিত পরিচয়টিকে সযত্নে সংরক্ষণের ব্যাপারে সক্রিয় হন।

(গ) জাতীয়তাবাদ একই সঙ্গে উদারনীতিক এবং পীড়নমূলক। জাতীয়তাবাদী ধারণা উদারনীতিক প্রকৃতির। কারণ জাতীয়তাবাদীরা রাজ্য জয় এবং বিজীতদের অধীনতা-পাশে আবদ্ধ করার বিষয়টিকেও স্বীকার করেন।

প্রকৃত প্রস্তাবে মতাদর্শগত বিচারে জাতীয়তাবাদ সুস্পষ্ট আকৃতিহীন। জাতীয়তাবাদের মতাদর্শগত চেহারার এই বিভ্রান্তি ও অস্পষ্টতার পিছনে বিবিধ কারণ কাজ করেছে। এ প্রসঙ্গে হেতু হিসাবে কতকগুলি কারণের কথা বলা দরকার। বহুবিধ রাজনীতিক কারণ ও প্রত্যাশাকে পরিপুষ্ট করার জন্য জাতীয়তাবাদী ধারণাকে ব্যবহার করা হয়েছে। পরস্পর বিরোধী জীবনধারাগত উত্তরাধিকারসমূহ জাতীয়তাবাদের চেহারা নির্ধারণে সাহায্য করেছে। আবার বহু ও বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত বা পটভূমিতে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটেছে।

রাজনীতিক জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে আর একটি বিষয় বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই জাতীয়তাবাদ বিশেষ একটি সামর্থ্যযুক্ত। এই সামর্থ্যের সুবাদে জাতীয়তাবাদ অন্যান্য রাজনীতিক ধ্যান-ধারণা বা মতবাদের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে পড়তে পারে, অথবা অপরাপর রাজনীতিক মতাদর্শকে নিজের অন্তর্ভুক্ত করে নিতে পারে। এই প্রক্রিয়ার পরিণামে বিবিধ প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয়তাবাদী ঐতিহ্যের সৃষ্টি হয়। অন্যান্য রাজনীতিক দর্শনের সঙ্গে সংমিশ্রিত অবস্থায় উদ্ভূত জাতীয়তাবাদের বিভিন্ন রূপগুলি সম্পর্কে আলোচনা করা দরকার। অর্থাৎ জাতীয়তাবাদের ঐতিহ্যগত প্রকারভেদ সম্পর্কে আলোচনা করা আবশ্যক।

(ক) উদারনীতিক জাতীয়তাবাদ

জাতীয়তাবাদের ঐতিহ্যগত প্রকারভেদের মধ্যে প্রাচীনতম হল উদারনীতিক জাতীয়তাবাদ। ফরাসী বিপ্লব সুত্রে উদারনীতিক জাতীয়তাবাদের উদ্ভব। স্বভাবতই ফরাসী বিপ্লবসম্ভূত বিবিধ মূল্যবোধ উদারনীতিক জাতীয়তাবাদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ইউরোপের অধিকাংশ অঞ্চলজুড়ে, উদারনীতিক জাতীয়তাবাদী ধ্যান ধারণা অতি সত্বর বিস্তার লাভ করে। ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সুরক্ষার ধারণার উপর উদারনীতিবাদ প্রতিষ্ঠিত। বিভিন্ন অধিকারের মাধ্যমে এই ধারণার অভিব্যক্তি ঘটে। জাতীয়তাবাদীরা বিশ্বাস করতেন যে, জাতিমাত্রেই হবে সার্বভৌম সত্তা যুক্ত এবং স্বাধীনতার অধিকার সমন্বিত। জাতীয়তাবাদী ধারণা অনুযায়ী প্রতিটি জাতির বিভিন্ন অধিকার থাকবে এবং বিশেষত সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার থাকবে। প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন সমগ্র ইউরোপে কেবল জাতি-রাষ্ট্রসমূহের অস্তিত্বের এবং স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের পরিবর্তে রাজনীতিক গণতন্ত্রের অস্তিত্বের পরিকল্পনার কথা বলেছেন। উইলসনের অভিমত অনুযায়ী মার্কিন মডেলের গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রই প্রকৃত জাতি-রাষ্ট্র হিসাবে পরিগণিত হতে পারে।

প্রকৃত প্রস্তাবে উদারনীতিক জাতীয়তাবাদ হল একটি যুক্তিবাদী শক্তি। দুদিক থেকে বিষয়টি বিবেচনা করা দরকার। প্রথমত, উদারনীতিক জাতীয়তাবাদ যে কোন রকমের বৈদেশিক কর্তৃত্ব ও শোষণ-পীড়নের বিরোধী। এই বৈদেশিক প্রাধান্য বা পীড়ন ঔপনিবেশিকতাবাদী বা বহুজাতিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হতে পারে। কোন রকম বৈদেশিক নিয়ন্ত্রণ বা পীড়নকে উদারনীতিক জাতীয়তাবাদে স্বীকার বা সমর্থন করা হয় না। দ্বিতীয়ত, উদারনীতিক জাতীয়তাবাদ স্ব-শাসিত সরকারের মতবাদকে স্বীকার ও সমর্থন করে। কার্যক্ষেত্রে নিয়মতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণমূলক সরকারী ব্যবস্থার অভিব্যক্তি ঘটে। অবশ্য প্রতিনিধিত্ব মূলক শাসনব্যবস্থার মাধ্যমেও স্বশাসিত সরকারী ব্যবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়। একটি জাতির ঐক্য সাধন বা স্বাধীনতা অর্জনের মধ্যেই উদারনীতিক জাতীয়তাবাদের উদ্দেশ্য সীমাবদ্ধ নয়। এই মতাদর্শের চূড়ান্ত লক্ষ্য হল স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্রসমূহকে নিয়ে এক নতুন দুনিয়া গড়ে তোলা। ‘এক জাতি এক রাষ্ট্র’ (one nation, one state)—এই নীতির মধ্যে এই ধারণার অভিব্যক্তি ঘটেছে। জন স্টুয়ার্ট মিল (J. S. Mill) এই নীতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন: “জাতীয় জনসমাজের সীমারেখা রাষ্ট্রের সীমারেখার সমানুপাতিক হওয়া বাঞ্ছনীয়” (“….the boundaries of states should coincide in the main with those of nationalities.”)। এই মতবাদের মূল নীতি হল: “ শাসিতের দ্বারাই শাসনব্যবস্থা স্থিরীকৃত হওয়া উচিত” (“This is merely saying that the question of government ought to be decided by the governed.”)।

উদারনীতিক জাতীয়তাবাদীদের অভিমত অনুযায়ী ব্যক্তিবর্গের মত জাতিসমূহও সমান; অন্তত এই অর্থে সমান যে, প্রত্যেকেরই আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আছে। প্যারিসের শান্তি সম্মেলনে সমকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, মার্কিনীদের মত সকল জাতির মানুষজনেরই স্বাধীনভাবে বসবাসের অধিকার আছে। উইলসন বলেছেন: ‘আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার’ কেবল কথার কথা নয়, এ হল একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কার্যকর নীতি যা রাষ্ট্রনেতারা বিপদের ঝুঁকি না নিয়ে অগ্রাহ্য করতে পারেন না” (“Self determination is not a mere phrase, it is an imperative principle of action which statesmen will henceforth ignore at their peril.”

উদারনীতিক জাতীয়তাবাদ হল একটি শক্তি। এই শক্তি প্রত্যেক জাতির মধ্যে ঐক্য ও সংহতির সৃষ্টি করে এবং সকল জাতির মধ্যে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তোলে। জাতীয় বৈশিষ্ট্যসমূহের প্রতি এবং অধিকারসমূহের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে জাতিসমূহের মধ্যে এই সৌভ্রাতৃত্বের সৃষ্টি হয়। উদারনীতিক জাতীয়তাবাদ জাতিসমূহের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস, প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা বিবাদ-বিসংবাদ সৃষ্টি করে না, অথবা জাতিসমূহের মধ্যে পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতার জন্ম দেয় না। উড্রো উইলসন বিশ্বাস করতেন যে গণতান্ত্রিক জাতি-রাষ্ট্রসমূহ প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের জাতীয় সার্বভৌমিকতাকে স্বীকার ও শ্রদ্ধা করবে; প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে যুদ্ধ করবে না বা অন্য রাষ্ট্রকে পরাধীন করবে না। উদারনীতিবাদীদের অভিমত অনুযায়ী স্বাভাবিক সামঞ্জস্য বা ভারসাম্যের নীতি সমাজে ব্যক্তিবর্গের ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য, তেমনি আন্তর্জাতিক সমাজে জাতিসমূহের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ ও স্থায়ী প্রকৃতির সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের স্বীকৃতি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপীয় বিপ্লববাদীদের কাছে উদারনীতিবাদ এবং জাতীয়তাবাদ বহুলাংশে অভিন্ন প্রতিপন্ন হয়েছে। সমকালীন ইউরোপের বিপ্লবীদের জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণা প্রায়োগি ক্ষেত্রে উদারনীতিক মতাদর্শের সঙ্গে বহুলাংশে সংযুক্ত বা সংমিশ্রিত হয়ে পড়েছে। উদারনীতিক জাতীয়তাবাদী ধারণা প্রথমে ব্যক্তি, তারপর জাতি এবং অবশেষে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত হয়। ইতালীর ঐক্য সাধনের ইতিহাসে ম্যাৎসিনি একটি বিশিষ্ট নাম। এই ইতালীয় দার্শনিক উদারনীতিক জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণাকে সুস্পষ্টভাবে অভিব্যক্ত করেছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী কালে সমকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি উইলসন ইউরোপের পুনর্গঠনের জন্য ‘চৌদ্দ দফা’ (Fourteen Points) নীতি সুপারিশ করেছিলেন। মূলত উদারনীতিক জাতীয়তাবাদী নীতিসমূহের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট চৌদ্দ দফা সুপারিশ উইলসন করেছিলেন। ফরাসী দার্শনিক রুশো (Rousseau) উদারনীতিক জাতীয়তাবাদের ধারণাসমূহকে সুস্পষ্ট রূপ দিয়েছিলেন। রুশো তাঁর ‘সাধারণের ইচ্ছা’ (General Will) তত্ত্বের মাধ্যমে জনসাধারণের সার্বভৌমত্বের ধারণাটিকে তুলে ধরেছিলেন। এ ক্ষেত্রেই তিনি উদারনীতিক জাতীয়তাবাদী বক্তব্য অভিব্যক্ত করেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতেই উদারনীতিক ধারণাসমূহের সঙ্গে জনপ্রিয় স্ব-শাসিত সরকারের ধারণা সংযুক্ত হয়ে পড়ে। আবার বিংশ শতাব্দীতে ঔপনিবেশিকতাবাদ বিরোধী বিভিন্ন রাষ্ট্রনেতা উদারনীতিক ধ্যান-ধারণার দ্বারা বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হন। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে ভারতের জওহরলাল নেহরু এবং চীনের সান ইয়াৎ-সেনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

উদারনীতিক জাতীয়তাবাদের সমালোচনা

সমালোচকরা উদারনীতিক জাতীয়তাবাদের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কথা বলেছেন। বিরুদ্ধবাদীদের যুক্তিসমূহ আলোচনা করা আবশ্যক।

(ক) উদারনীতিক জাতীয়তাবাদীরা জাতীয়তাবাদের অন্ধকার দিকটি দেখতে পান না বা দেখতে চান না। নিজেদের সকল বিষয়ে অন্ধ আনুগত্য এবং অন্য সকলের প্রতি বিবাদ-বিসংবাদের মনোভাব জাতীয়তাবাদী উন্মাদনার বিকৃত ফলশ্রুতি হিসাবে পরিলক্ষিত হয়। অন্ধ আবেগ জাতীয়তাবাদকে বিকৃত করে। জাতীয়তাবাদের এই দিকটিকে উদারনীতিক জাতীয়তাবাদীরা উপেক্ষা করেন। তাঁরা জাতীয়তাবাদের প্রগতিশীল ও মুক্তিদায়িনী দিকটিকেই দেখেন। স্বভাবতই উদারনীতিবাদীদের জাতীয়তাবাদ যৌক্তিক ও সহিষ্ণু। সমালোচকদের অভিযোগ অনুযায়ী উদারনীতিক জাতীয়তাবাদ অতি সরলীকৃত ও রোমান্টিক প্রকৃতির।

(খ) উদারনীতিক জাতীয়তাবাদীদের অভিমত অনুযায়ী রাজনীতিক ও আন্তর্জাতিক সংগতি-সামঞ্জস্য সাধনের ক্ষেত্রে জাতি-রাষ্ট্রের ধারণাই হল মূল মন্ত্র। সমালোচকদের অভিযোগ অনুযায়ী উদারনীতিক জাতীয়তাবাদের এই বক্তব্য সঠিক নয়, বিভ্রান্তিমূলক। বাস্তবে তথাকথিত জাতি-রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে বিভিন্ন ভাষাভাষী, ধর্মাবলম্বী, আঞ্চলিক ও জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করে। এ রকম এক একটি জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ নিজেদের স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে বিবেচনা করতে পারে। প্রকৃত প্রস্তাবে দুনিয়া জুড়ে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীগুলিকে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তুলে এনে একই জায়গায় সন্নিবিষ্ট না করতে পারলে এবং এই সমস্ত জনগোষ্ঠীর আগমন-অভিবাসন বন্ধ করতে না পারলে রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক বিচারে সুসংহত জাতি-রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব নয়। অ্যান্ড্রু হেউড এ বিষয়ে বলেছেন: ‘‘In Fact, the ideal of a politically unified and culturally homogeneous nation-state can only be achieved by a policy of forcible deportation of minority groups and an outright ban upon immigration.”

(গ) সমালোচকদের মতানুসারে উদারনীতিবাদীদের কাছে জাতীয়তাবাদ হল একটি বিশ্বজনীন নীতি। বিরুদ্ধবাদীদের অভিযোগ অনুযায়ী উদারনীতিবাদীরা জাতীয়তাবাদের আবেগ ও উন্মাদনা সম্ভৃত শক্তি সামর্থ্য সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত নন। এই শক্তির তাড়নায় ব্যক্তিবর্গ দেশ ও জাতির জন্য জীবন নিতে বা দিতে কুণ্ঠা বোধ করে না। ন্যায়-অন্যায় বোধ এক্ষেত্রে একেবারে অকেজো হয়ে পড়ে।

(খ) রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদ

রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদের মূল উদ্দেশ্য হল জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সংরক্ষণ। দেশাত্মবোধ, আনুগত্য এবং দেশ ও জাতির জন্য গৌরববোধকে উজ্জীবিত করার মাধ্যমে এই লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করা হয়। বিশেষত সমাজতন্ত্রবাদীদের শ্রেণীসংহতি সম্পর্কিত বিভেদমূলক ধারণার প্রচারের পরিপ্রেক্ষিতে রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদীরা এ রকম উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করে থাকেন। এই শ্রেণীর জাতীয়তাবাদীরা সামাজিক বিপ্লবের প্রতিষেধক হিসাবে জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করার পক্ষপাতী। এই কারণে তাঁরা শ্রমিক শ্রেণীকে জাতির অন্তর্ভুক্ত করে আলোচনা করেন। রক্ষণশীল উদারনীতিবাদীদের অভিমত অনুযায়ী মানবসমাজ জৈব প্রকৃতি বিশিষ্ট। অভিন্ন আকৃতি-প্রকৃতি বিশিষ্ট, সম মতাবলম্বী ও অভিন্ন আচার-ব্যবহারের অংশীদার মানুষজনের সঙ্গে ব্যক্তিবর্গ বসবাস করতে চায়। মানুষের এই অভিপ্রায় থেকেই স্বাভাবিকভাবে জাতির সৃষ্টি হয়। রক্ষণশীলদের অভিমত অনুযায়ী মানুষের বিবিধ সীমাবদ্ধতা আছে। মানুষ সর্বাংশে পূর্ণাঙ্গ বা নিঁখুত নয়। স্বভাবতই জাতীয় জনসম্প্রদায়ের মধ্যে মানুষ জীবনের অর্থ অন্বেষণের এবং নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার চেষ্টা করে।

রক্ষণশীল চিন্তাবিদরা জাতীয় দেশপ্রেমমূলক মনোভাবের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করার পক্ষপাতী। এই সুবাদে তাঁরা সামাজিক সংহতি ও জনশৃঙ্খলা সংরক্ষণের অঙ্গীকারের উপর বিশেষ জোর দেন। তাঁরা বিশ্বজনীন আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের জাতীয়তাবাদী নীতি সম্পর্কে খুব বেশী আগ্রহ দেখান না। এই কারণে সাধারণত সুপ্রতিষ্ঠিত জাতি-রাষ্ট্রসমূহের মধ্যেই রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদী ধারণার বিকাশ ও বিস্তার পরিলক্ষিত হয়। আধুনিককালে অধিকাংশ রক্ষণশীলদের কাছে জাতীয়তাবাদ একটি বিশ্বাসের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এ বিষয়ে অ্যান্ড্রু হেউড বলেছেন: “In the UK, this was particularly evident in Margaret Thatcher’s triumphalist response to the Falklands War of 1982, and it has been expressed more generally in the Conservative Party’s growing antipathy towards European integration.”

জাতীয়তাবাদের ব্যাপারে রক্ষণশীলদের ধারণা সব সময় এক রকম থাকেনি, পরিবর্তন ঘটেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে রক্ষণশীলরা জাতীয়তাবাদকে একটি বৈপ্লবিক ও বিপজ্জনক শক্তি হিসাবে দেখতেন। জাতীয়তাবাদকে রাজনীতিক স্থায়িত্ব ও শৃঙ্খলার বিরোধী শক্তি হিসাবে বিবেচনা করা হত। কালক্রমে এ বিষয়ে রক্ষণশীল রাষ্ট্রকর্ণধারদের ধারণাগত পরিবর্তন ঘটে। সামাজিক শৃঙ্খলা সংরক্ষণ এবং সনাতন প্রতিষ্ঠানসমূহের সুরক্ষার ব্যাপারে জাতীয়তাবাদকে একটি সহায়ক শক্তি হিসাবে বিবেচনা করা শুরু হয়। এ প্রসঙ্গে ডিসরেইলি, বিসমার্ক প্রমুখ রাষ্ট্রনেতার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদের বিষয়টি বিশেষ বিশেষ সময়ে প্রাধান্য পায় এবং মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। জাতীয় স্বাতন্ত্র্যসূচক পরিচয় যখন বিপদাপন্ন হয়ে পড়ে বা বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়, সে রকম পরিস্থিতিতে রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদী চিন্তা-চেতনা বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। আধুনিক কালের অনেক রাষ্ট্রেই রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণার অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। এর কারণ হিসাবে অভিবাসন ও অতি জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত বিষয়াদির কথা বলা হয়। রক্ষণশীল রাজনীতিকরা বা রাষ্ট্রনেতারা অভিবাসন বা পরদেশবাসের উপর বিধি-নিষেধ আরোপ করার পক্ষপাতী। কারণ তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, বহুজাতিক ব্যবস্থা বা বহুজীবনধারাগত বিষয়াদির মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ ও অস্থায়িত্বের আশঙ্কা থাকে। সুতরাং স্থায়িত্ব ও সাফল্যের স্বার্থে সমাজ অভিন্ন জীবনধারাগত বিবিধ বৈশিষ্ট্য এবং মূলবোধসমূহের সমতার উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া আবশ্যক। স্বভাবতই বহু ধর্মাবলম্বী, বহু ভাষাভাষী ও বিবিধ জীবনধারাগত বৈশিষ্ট্য সমন্বিত সমাজ থেকে অভিবাসন আটকানো আবশ্যক এবং সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীগুলিকে মূল জাতীয় জীবনধারার সঙ্গে সংযুক্ত করা দরকার।

রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদের আর একটি দিক আছে। এ ধরনের জাতীয়তাবাদ পশ্চাদ্বর্তী দৃষ্টিভঙ্গিযুক্ত এবং স্মৃতিবেদনাতুর। রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদে প্রতিফলিত হয় জাতির যাবতীয় অতীত গৌরব ও সাফল্যমণ্ডিত কীর্তি-কাহিনী। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি আবেদনের ভিত্তিতে রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদ পরিপুষ্ট হয়। সনাতন জীবনধারা ও ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানসমূহের পরিপোষক হিসাবে রক্ষণশীল জীবনধারা প্রতিপন্ন হয়। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে ইংরেজদের রক্ষণশীল জীবনধারায় রাজতন্ত্র এই ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব ও তাৎপর্যের কথা বলা যায়।

রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদের সমালোচনা

রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদ বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধে নয়। বিরুদ্ধবাদীরা এ ধরনের জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে বিবিধ বিরূপ সমালোচনার অবতারণা করেন।

(ক) জাতীয়তাবাদী আবেদন-নিবেদনের ভিত্তিতে রক্ষণশীল রাজনীতিবিদ্রা এবং রক্ষণশীল রাজনীতিক দলগুলি বিভিন্ন সময়ে বিবিধ প্রকারের রাজনীতিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছে।

(খ) সমালোচকদের অভিযোগ অনুযায়ী রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদী ধারণাসমূহ ক্ষেত্রবিশেষে ভ্রান্ত আত্মম্ভরিতার উপর ভিত্তিশীল।

(গ) রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদের কারণে সংকীর্ণতা ও অসহিষ্ণুতা প্রশ্রয় ও পরিপুষ্ট হয়। রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদীরা সংস্কৃতি বা জীবনধারাগত বিশুদ্ধতা ও প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যসমূহের সংরক্ষণের উপর বিশেষ জোর দেন। এই কারণে তাঁরা পরদেশে বসবাসকারীদের বা সাধারণভাবে বিদেশীদের বিপদ হিসাবে বিবেচনা করেন। এইভাবে রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে জাত্যাভিমান বৈধতা লাভ করে এবং বিদেশাতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

(ঘ) রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদ এলিটবাদী বক্তব্যের অনুপন্থী। রাজনীতিক নেতারা নিজেদের রাজনীতিক স্বার্থে রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করেন। যুদ্ধ বা অনুরূপ কোন আন্তর্জাতিক সংকটকালীন পরিস্থিতিতে দেশাত্মবোধক সংবেদনশীল মনোভাবের কাছে আবেদনের মাধ্যমে দেশমাতৃকার স্বার্থ সংরক্ষণে দেশবাসীকে আবেগ তাড়িত করা হয়। এ রকম অবস্থায় দেশের মানুষজনকে যে কোন কাজ করিয়ে নেওয়া যায়।

(গ) সম্প্রসারণবাদী জাতীয়তাবাদ

আগেকার আমলের ঔপনিবেশিকতাবাদী সম্প্রসারণবাদের থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকের সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণবাদ ছিল পৃথক প্রকৃতির। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকের সাম্রাজ্যবাদ সমর্থিত হয়েছে এক জনপ্রিয় জাতীয়তাবাদী চেতনার দ্বারা। এই সময় সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের সঙ্গে জাতীয় মর্যাদা সংযুক্ত হয়ে পড়ে। প্রতিটি ঔপনিবেশিক বিজয় জনসাধারণের ব্যাপক স্বীকৃতি ও সমর্থনের মাধ্যমে অভিনন্দিত হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে জাতীয় গৌরবের নামে জাতীয়তাবাদের আক্রমণাত্মক চেহারা চরিত্রের অভিব্যক্তি ঘটে। ইউরোপীয় শক্তিসমূহ এ ধরনের আক্রমণাত্মক জাতীয়তাবাদী কার্যকলাপের সামিল হয়। অর্থাৎ এই সময় জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নীতির বিপরীত ক্রিয়া হিসাবে জাতীয়তাবাদ আক্রমণাত্মক ও সামরিক আদর্শবাদী হয়ে পড়ে। এ হল জাতীয়তাবাদের এক প্রাধান্যকারী অভিব্যক্তি।

দুই বিশ্বযুদ্ধের অন্তর্বর্তী সময়ে আক্রমণাত্মক ও সম্প্রসারণবাদী জাতীয়তাবাদ উচ্চতর এক পর্যায়ে উপনীত হয়। এই সময় জার্মানী, জাপান ও ইতালীর কর্তৃত্ববাদী বা ফ্যাসিবাদী শাসক গোষ্ঠী সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণ এবং বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ব কায়েম করার নীতি গ্রহণ করে। এই ঘটনাপ্রবাহ বিশ্বকে ১৯৩৯ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগিয়ে দেয়। আক্রমণাত্মক জাতীয়তাবাদ বা সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণবাদের প্রতি জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। এই মনোভাবের অভিব্যক্তির জন্য ‘জিঙ্গোবাদ’ (Jingoism) নামে একটি নতুন ‘শব্দ’ চালু হয়।

উগ্র জাতীয়তাবাদ সম্প্রসারণবাদী জাতীয়তাবাদের একটি বড় পরিচয়। এই পরিচয়ের পরিপ্রেক্ষিতে উদারনীতিক জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সম্প্রসারণবাদী জাতীয়তাবাদের পার্থক্য প্রতীয়মান হয়। সম্প্রসারণবাদী জাতীয়তাবাদের মধ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদের উন্মত্ততা থাকে; নিজেদের সম্পর্কে উচ্চ মান্যতা বা প্রাধান্য সম্পর্কে এক ধরনের দৃঢ় বিশ্বাস বর্তমানে থাকে। অত্যন্ত গভীর এবং এমনকি উন্মত্ত-উদ্দাম জাতীয়তাবাদী উদ্যোগ-আয়োজন থেকে সৃষ্টি হয় উগ্র জাতীয়তাবাদ বা সম্প্রসারণবাদী জাতীয়তাবাদ। এ ধরনের জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে দেশপ্রেমের উন্মাদনার ঢেউ চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ব্যক্তি মানুষের স্বতন্ত্র ন্যায় অন্যায় বোধ বা যুক্তিবাদিতা ধুয়ে-মুছে যায়। দেশপ্রেমের আবেগ ও উন্মত্ততা অভিব্যক্তি লাভ করে অন্য দেশকে আক্রমণ, সম্প্রসারণ ও যুদ্ধের অভিলাষের মধ্যে। সর্বশক্তিমান জাতির মধ্যে ব্যক্তিবর্গের এবং স্বাধীন গোষ্ঠীসমূহের স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে যায়।

উগ্র জাতীয়তাবাদ বিচ্ছিন্ন ও দুর্বল জনগোষ্ঠীসমূহের কাছে আশীর্বাদ স্বরূপ। এই সমস্ত জনগোষ্ঠী এ রকম জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে নিরাপত্তা, আত্মমর্যাদা ও আত্মগৌরব অর্জন করে। এই কারণে বিশিষ্ট ফরাসী জাতীয়তাবাদী চার্লস মাউরাস (Charles Maurras) উগ্র জাতীয়তাবাদ (Chauvinism)- কে সম্পূরক জাতীয়তাবাদ’ (integral nationalism) হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। যথার্থ দেশপ্রেম জাতীয়তাবাদের আদর্শের মাধ্যমে মূর্ত হলে বিশ্বসভ্যতা ও মানবতার পক্ষে তা আশীর্বাদস্বরূপ (‘Nationalism when it becomes synonymous with purest patriotism will prove a unique blessing to humanity and to the world.”)।

ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপে এই ধারণা বা বিশ্বাস বিকশিত ও বিস্তার লাভ করে যে, ইউরোপ আমেরিকার শ্বেতকায় মানুষজন এশিয়া-আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ ও অন্যান্য বর্ণের বক্তিবর্গের থেকে বৌদ্ধিক ও নৈতিক বিচারে অনেক বেশী উন্নত। উপনিবেশগুলির অধিবাসীরা শ্বেতকায় ব্যক্তিবর্গের বোঝা বিশেষ। ইউরোপীয় মানুষজন এদিক থেকেই সাম্রাজ্যবাদকে তাদের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য হিসাবে প্রতিপন্ন করার পক্ষপাতী। দুনিয়ার অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর ও দুর্ভাগ্যপীড়িত বিশাল সংখ্যক মানুষের কাছে সাম্রাজ্যবাদই সভ্যতার সুফলসমূহ পৌঁছে দিয়েছে।

উগ্র জাতীয়তাবাদ বিশেষ রূপে বিকশিত হয়েছে জার্মানী ও রাশিয়ায়। নেপোলিয়নীয় যুদ্ধে পরাজয়ের পরিপ্রেক্ষিতে জার্মানীতে ঐতিহ্যবাদী জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে। জার্মানীর এই সাবেকি জাতীয়তাবাদও ছিল উন্মাদনাপূর্ণ উগ্র প্রকৃতির। রাশিয়ায় ‘সার্বিক স্লাভবাদ’ (Pan-Slavism) হিসাবে এই উগ্র জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে। রাশিয়ার এই জাতীয়তাবাদকে অনেক সময় স্লাভীয় জাতীয়তাবাদ (Slavophile nationalism) বলা হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এই জাতীয়তাবাদ বিশেষভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠে।

সম্প্রসারণবাদী জাতীয়তাবাদের সমালোচনা

সম্প্রসারণবাদী জাতীয়তাবাদ হল উগ্র জাতীয়তাবাদ বা জঙ্গী জাতীয়তাবাদ। এ ধরনের জাতীয়তাবাদ বিবিধ বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে।

(১) সুনির্দিষ্ট একটি জাতি-গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তির চেতনাই জঙ্গী জাতীয়তাবাদ বা ‘সম্পূরক জাতীয়তাবাদে’র সৃষ্টি করে। এ রকম জাতীয়তাবাদী চেতনার উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে এক ধরনের ‘নেতিবাচক সংহতি’ (negative integration)। অপর কোন জাতি বা জাতি গোষ্ঠীর শত্রুতা ও ভীতি সম্পর্কিত ধারণাই এ রকম জাতীয়তাবাদের সৃষ্টিতে সাহায্য করে থাকে। হেউড এ বিষয়ে বলেছেন: “In the face of the enemy, the nation draws together and experiences an intensified sense of its own identity and importance.”

(২) সম্প্রসারণবাদী জাতীয়তাবাদ অন্যায়ের উৎস। উগ্র জাতীয়তাবাদের দ্বারা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ উন্মত্ত হয়। উপনিবেশগুলির অসভ্য অনুন্নত মানুষকে সভ্য ও উন্নত করার মহান আদর্শ ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের কথা তারা জোর গলায় প্রচার করে। হিটলার একমাত্র আর্য জাতি হিসাবে জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্ব এবং অন্য সকল জাতির উপর জার্মানের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার অধিকারের কথা প্রচার করেছেন। ইংরেজরা ভারতীয়দের শিক্ষিত ও সভ্য করার মহান দায়িত্বের কথা প্রচার করেছে। উগ্র জাতীয়তাবাদই হল এই সমস্ত অন্যায় ও অমঙ্গলের উৎস। ইউরোপের এই সাম্রাজ্যবাদী জাতীয়তাবাদকে ‘ঘোরতর পৈশাচিক পাপ’ বলে বঙ্কিমচন্দ্র তীব্র সমালোচনা করেছেন। হেউড এ বিষয়ে বলেছেন: “National Chauvinism therefore breeds off a clear distinction between ‘them’ and ‘us’. There has to be a “them’ to deride or hate in order to forge a sense of ‘us’.

(৩) উগ্র জাতীয়তাবাদ সংকীর্ণতার সৃষ্টি করে; অন্ধ আবেগ ও উম্মাদনার সৃষ্টি করে। তার ফলে দেশ ও জাতির সব কিছুকে একটি বাঁধাধরা নির্দিষ্ট পথে পরিচালিত করা হয়। এইভাবে বাইরের জ্ঞানবিজ্ঞানের ও সভ্যতা-সংস্কৃতির আলোক প্রবেশের পথ অবরুদ্ধ হয়। তার ফলে জাতির সর্বাঙ্গীণ বৈচিত্র্যময় উন্নতি ব্যাহত হয়। বস্তুত বিকৃত জাতীয়তাবাদ হল জাতির এক বাতিকগ্রস্ত রোগ বিশেষ।

(৪) উগ্র জাতীয়তাবাদ সর্বক্ষেত্রে স্বদেশ ও স্বজনের দাবিকে অগ্রাধিকার দেয়। ন্যায়-অন্যায়, যুক্তি ও আলাপ আলোচনাকে অস্বীকার করা হয় এবং সর্বপ্রকার বিরোধ মীমাংসার জন্য যুদ্ধের পথ গ্রহণ করা হয়। এই যুদ্ধবাদী প্রবণতা বিশ্বশান্তির ঘোরতর শত্রু। হায়েস (Hayes)-এর মতানুসারে বিকৃত জাতীয়তাবাদ হল কৃত্রিম, ভণ্ড জাতিপ্রেম (“Nationalism is artificial and it is far form ennobling, in a word it is patriotic snobbery.”)। হেউড এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “In politics, national chauvinism has commonly been reflected in racialist ideologies, which divide the world into an ‘in group’ and an ‘out group’, in which the ‘out group becomes a scapegoat for all the misfortunes and frustrations suffered by the ‘in group’.”

(ঘ) ঔপনিবেশিকতাবিরোধী জাতীয়তাবাদ

ঔপনিবেশিকতাবিরোধী আন্দোলনসমূহ অনেক সময়েই উদারনীতিক জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের উপনিবেশগুলির স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক বিশিষ্ট নেতারই উচ্চশিক্ষা সম্পাদিত হয়েছে পশ্চিমে। তাঁরা ছিলেন বহুলাংশে পশ্চিমী মনস্ক ও পশ্চিমী ধ্যান-ধারণায় পরিপুষ্ট। এই কারণে বলা হয় যে, ইউরোপের ঔপনিবেশিক শক্তিসমূহ নিজেদের ধ্বংস সাধনের মূল মন্ত্র সঙ্গে নিয়েই তৃতীয় বিশ্বের উপনিবেশগুলিতে এসেছিল। এই মূল মন্ত্রটিই হল ‘জাতীয়তাবাদ’। ঔপনিবেশিকতাবাদ বিরোধিতার মাধ্যমে রাজনীতিক ও আর্থনীতিক উভয় ক্ষেত্রেই জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি ঘটেছে। এই বিষয়টির দ্বারা উন্নয়নশীল দেশগুলির জাতীয়তাবাদের চেহারা-চরিত্র প্রভাবিত হয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসন শোষণের তিক্ত-করুণ অভিজ্ঞতার কারণে এশিয়া-আফ্রিকার বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্বতন্ত্র জাতি সত্তার চেতনা এবং জাতীয় স্বাধীনতার বাসনা উদ্দীপ্ত হয়েছে। জাতীয়তাবাদী ধ্যান ধারণার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে ইউরোপে। এ কথা ঠিক। কিন্তু জাতীয়তাবাদ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। এবং সাম্রাজ্যবাদ পৃথিবী জুড়ে জাতীয়তাবাদের বিস্তারে বিশেষভাবে সাহায্য করেছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী কালে ভার্সাই চুক্তিতে জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নীতি স্বীকৃত ও সমর্থিত হয়। নীতিটিকে ইউরোপে প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য অংশে বা অঞ্চলে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নীতিটির প্রয়োগকে উপেক্ষা করা হয়। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলিতে জার্মান উপনিবেশগুলি ব্রিটিশ বা ফরাসী উপনিবেশে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু দুটি বিশ্বযুদ্ধের অন্তবর্তী পর্বে সংঘটিত স্বাধীনতা সংগ্রাম ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ও ফরাসী শক্তিকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলে। এশিয়া ও আফ্রিকার উপনিবেশগুলিতে ঔপনিবেশিকতাবাদ বিরোধী জাতীয়তাবাদ বিকশিত হয় ও বিস্তার লাভ করে।

উন্নয়নশীল দুনিয়ার জাতীয়তাবাদীরা সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের ব্যাপারে আগ্রহ-অনুরাগ দেখিয়েছিলেন। এশিয়া-আফ্রিকার ঔপনিবেশিকতাবাদ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের অধিকাংশ নেতাই কোন-না-কোন রকমের সমাজতন্ত্রবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ভারতের মহাত্মা গান্ধী ও নেহরু প্রমুখ নেতা মধ্যপন্থী ও শান্তিপূর্ণ সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। অপরদিকে চীনের মাও জেদং, ভিয়েতনামের হো চি মিন এবং কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো বৈপ্লবিক মার্কসবাদের অনুগামী হয়েছিলেন। ঔপনিবেশিক শাসন শোষণের প্রকৃতি পর্যালোচনার ক্ষেত্রে এবং ঔপনিবেশিক অসাম্য-বৈষম্য ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা এবং বিশেষভাবে মার্কসীয় মতাদর্শ ঔপনিবেশিকতাবাদ বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতাদের বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল।

ঔপনিবেশিকতা বিরোধী জাতীয়তাবাদ হল প্রকৃতপক্ষে তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদ। তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদের চেহারা-চরিত্র সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক।

ঔপনিবেশিকতা বিরোধী জাতীয়তাবাদ: তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদ হল প্রকৃতপক্ষে ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী জাতীয়তাবাদ। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির অধিবাসীদের ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের প্রতিকূল অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতেই এ ধরনের জাতীয়তাবাদী চেতনার সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণভাবে বলা যেতে পারে যে, সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শক্তিসমূহের পীড়নমূলক প্রকৃতি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, ঔপনিবেশিক শাসন কর্তৃপক্ষের নীতি এবং উপনিবেশগুলি ও তাদের অধিবাসীদের উপর ঔপনিবেশিক শোষণ-পীড়ন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও বিকাশের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। অ্যাফ্রো-এশীয় দেশগুলিতে ঔপনিবেশিক শাসনের বিস্তার এবং এ ধরনের শাসনের পীড়নমূলক প্রকৃতি প্রকট হয়ে পড়ে। তার ফলে ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। ঔপনিবেশিকতার বিরোধিতা, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের স্বীকৃতি, ব্যক্তিস্বাধীনতার সংরক্ষণ, আর্থ-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সুসংহত উন্নয়ন প্রভৃতি নানা ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রস্তাব গৃহীত হতে থাকে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ অধিকৃত উপনিবেশগুলির নিজেদের স্বার্থের সহায়ক রাজনীতিক ও প্রশাসনিক পরিকাঠামো গড়ে তোলার ব্যাপারে বিশেষভাবে উদ্যোগী হয়। তারা উপনিবেশগুলিতে পশ্চিমী শিক্ষার বিস্তার, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও গণ-সংযোগের ক্ষেত্রে আধুনিক উপায় পদ্ধতির বিকাশ ও বিস্তার, নিরাপত্তা ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ, আর্থ-রাজনীতিক সংগঠনের স্বীকৃতি প্রভৃতি বহু ও বিবিধ উদ্যোগ আয়োজন গ্রহণ করতে থাকে। এই সমস্ত ব্যবস্থার অন্যতম ফলশ্রুতি হিসাবে উপনিবেশগুলিতে পশ্চিমী শিক্ষায় শিক্ষিত এক বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটে। স্বরাজ্য ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের আন্দোলনে তাঁরা আত্মনিয়োগ করেন। এই বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী জাতীয়তাবাদী চিন্তা-চেতনার মধ্যেই তাঁদের অভীষ্ট অর্জনের শক্তি খুঁজে পান। ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের জাল ছিন্ন করে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের তাগিদে তাঁরা জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণার বিকাশ ও বিস্তারের উপর জোর দেন। দেশবাসীর মধ্যে সচেতনতা ও সংহতিবোধ সৃষ্টি এবং জনসাধারণের মধ্যে জাতীয় সত্তার চেতনা সৃষ্টির ব্যাপারে তারা আত্মনিয়োগ করেন। এবং এইভাবে তৃতীয় বিশ্বের উপনিবেশগুলিতে দেশ ও দেশবাসীর স্বাধীনতার দাবীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে থাকে দুর্বার গণ-আন্দোলন।

জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের মোকাবিলা: ঔপনিবেশিক শাসকশক্তিসমূহ এই সমস্ত মুক্তি আন্দোলন মোকাবিলার ক্ষেত্রে সর্বত্র অভিন্ন উপায়-পদ্ধতি অবলম্বন করেনি। ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষের স্বরূপ, সামরিক শক্তি ও রাজনীতিক অবস্থা অনুসারে পরিস্থিতি মোকাবিলার ক্ষেত্রে গৃহীত ব্যবস্থাদির পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সামরিক তৎপরতা ও দমন-পীড়নের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শাসকশক্তি জাতীয় স্বাধীনতার জন্য গণ-আন্দোলনকে শুরুতেই নির্মূল করতে সক্রিয়ভাবে উদ্যোগী হয়। জাতীয়তাবাদী এরকম আন্দোলনকে অনেক ক্ষেত্রেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এ্যাডেন, অ্যালজিরিয়া, সাইপ্রাস প্রভৃতি অঞ্চলে সংশ্লিষ্ট ঔপনিবেশিক শাসক কর্তৃপক্ষ এ রকম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সশস্ত্র ও অহিংস রূপ: এতদ্‌সত্ত্বেও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের উন্মাদনা একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়নি। প্রকাশ্যে বে-আইনী ঘোষিত হওয়ায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ধারা গোপনে অব্যাহত থাকে। ক্ষেত্র বিশেষ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এই ধারা চরমপন্থী আন্দোলনে পরিণত হয়। এবং এই আন্দোলন গেরিলা কায়দায় গুপ্ত পথে পরিচালিত হতে থাকে। আবার কোন কোন ঔপনিবেশিক শাসক-কর্তৃপক্ষ জাতীয়তাবাদী মুক্তি আন্দোলন মোকাবিলার জন্য এক বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে। এই কৌশলটিকে ‘গণতান্ত্রিক অধীনতাবন্ধন’ হিসাবে অভিহিত করা হয়। সমকালীন ভারতের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকশক্তি এই কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করে। ভারতবর্ষের বুকে ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণকে যথাসম্ভব দীর্ঘমেয়াদী করার উদ্দেশ্যে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী জাতীয়তাবাদী রাজনীতিক সংগঠন গড়ে তোলার অধিকারকে স্বীকার করে নেয়। পার্লামেন্টীয় পন্থাপদ্ধতিতে আস্থাশীল জাতীয়তাবাদী রাজনীতিক দল গঠনের অধিকারকেও স্বীকার করা হয়। বস্তুত সমকালীন ভারতের ব্রিটিশ সরকারের আসল উদ্দেশ্য ছিল এ রকম রাজনীতিক দলকে ব্রিটিশ স্বার্থের রক্ষাকবচ হিসাবে ব্যবহার করা। সুতরাং তৃতীয় বিশ্বের উপনিবেশগুলিতে জাতীয়তাবাদী মুক্তি আন্দোলন কোথাও সশস্ত্র ও সহিংস পথে পরিচালিত হতে থাকে; আবার কোথাও সংসদীয় উপায়-পদ্ধতিতে অহিংস পথে পরিচালিত হতে থাকে। প্রথম শ্রেণীর জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এগিয়ে চলে বৈপ্লবিক সংগ্রামের পথে। এবং এই আন্দোলন তাঁর রাজনীতিক বৈধতা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে জনসাধারণের ব্যাপক সমর্থন লাভের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। দ্বিতীয় শ্রেণীর জাতীয়তাবাদী আন্দোলন স্বদেশ-স্বজন ও ঔপনিবেশিক শাসক কর্তৃপক্ষের কাছে নিজস্ব শক্তিমত্তার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করতে সাধ্যমত উদ্যোগী হয়। অবশ্য উভয় ধরনের জাতীয়তাবাদী মুক্তি আন্দোলনের সাফল্য নির্ভর করে আমজনতার সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং দুর্বার গণ-সমর্থনের তীব্রতা ও ব্যাপ্তির উপর। সুতরাং জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বিভিন্ন রূপ ধারণ করে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের পথে পরিচালিত হয়েছে। এই আন্দোলন কখনো এবং কোথাও গণতান্ত্রিক পথে রাজনীতিক উদ্দেশ্য সাধনের হাতিয়ার হিসাবে কাজ করেছে এবং জাতীয় জীবনধারায় সংহতি সাধনের ক্ষেত্রে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করেছে। আবার কখনো এবং কোথাও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সামগ্রিকতাবাদী মতাদর্শ ও কার্যপ্রক্রিয়ায় জঙ্গী রূপ ধারণ করেছে এবং গুপ্ত পথে পরিচালিত হয়েছে।

উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তৃতীয় বিশ্বের ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী জাতীয়তাবাদী ধারার কতকগুলি মূল বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায়। এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ ও আলোচনা আবশ্যক। তা হলে এ ধরনের জাতীয়তাবাদের স্বরূপ সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত হওয়া সম্ভব হবে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির জাতীয়তাবাদী ধারার বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে নিম্নলিখিতগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

প্রথমত, ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী শক্তি: তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাতীয়তাবাদ ঔপনিবেশিকতা বিরোধী শক্তি হিসাবে অভিব্যক্তি লাভ করেছে। ঔপনিবেশিক শাসক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে জাতীয়তাবাদ দেশবাসীকে সংগ্রামের সামিল করেছে। এই সমস্ত দেশে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদ জনসাধারণের মনে সংগ্রামী চেতনার সৃষ্টি করেছে। আবার এই জাতীয়তাবাদী চেতনাই উপনিবেশের অধিবাসীদের মধ্যে জাতিগঠনের উদ্যোগী মানসিকতার সৃষ্টি করেছে। ভারত, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিরিয়া, কেনিয়া, নাইজেরিয়া প্রভৃতি এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী শক্তি হিসাবে জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি প্রবলভাবে প্রকাশিত হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, মূলত নেতিবাচক: অ্যাফ্রো-এশীয় দেশগুলিতে জাতীয়তাবাদ জন্মলগ্ন থেকেই একটি ঔপনি বেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। এই জাতীয়তাবাদী চেতনার মধ্যে বিরোধিতার মনোভাব বা বৈরী অনুভূতির আধিক্য পরিলক্ষিত হয়। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জন বা স্বাধীন সংগ্রামের প্রাক্কালে ঔপনিবেশিক শাসন কর্তৃপক্ষের প্রতি বিরোধিতার মনোভাব ও কার্যপ্রক্রিয়া প্রবলভাবে প্রকট হয়ে পড়ে। এই কারণে এ ধরনের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন অনেকাংশে একটি নেতিবাচক শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। তবে এই সময় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যে জাতিগঠনের পক্ষে ইতিবাচক উপাদান একেবারে ছিল না, এমন নয়। তবে ইতিবাচক উপাদানগুলি ছিল অসংবদ্ধ ও দুর্বল। শ্রমিক-কৃষকের স্বার্থ রক্ষা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সংরক্ষণ, সামাজিক সংস্কার ও সংহতি সাধন, দেশ ও দেশবাসীর আর্থনীতিক অবস্থার উন্নয়ন প্রভৃতি জাতীয় সমস্যাদির সমাধান কল্পে জাতীয়তাবাদী নেতারা অল্পবিস্তর উদ্যোগী হয়েছেন। কিন্তু এ জাতীয় উদ্যোগ বড় একটা সফল হয়নি। এমনকি স্বাধীনতা লাভের পরেও জাতীয়তাবাদী নেতারা ইতিবাচক ও উন্নয়নমূলক ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছেন এবং জনসাধারণের মধ্যে নিজেদের মর্যাদামণ্ডিত অস্তিত্বকে অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী জ্বালাময়ী বক্তৃতার আশ্রয় নিয়েছেন।

তৃতীয়ত, ঐক্যবোধের সৃষ্টি: ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী জাতীয়তাবাদ পরাধীন দেশের বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে সুদৃঢ় ঐক্য সৃষ্টির এক অনন্য শক্তি হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। উপনিবেশগুলিতে বিভিন্ন জাতীয় জনসমাজ রাজনীতিক বিচারে পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। জাতীয়তাবাদী শক্তি বিচ্ছিন্ন জাতীয় জনসমাজগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং তাদের মধ্যে সংঘবদ্ধতা ও সংহতির সৃষ্টি করে। এমনি এই জাতীয়তাবাদী চেতনা আঞ্চলিক বিচারে বিচ্ছিন্ন জাতীয় জনসমাজসমূহের মধ্যে ঐক্যসাধনের পথকে প্রশস্ত ও সুগম করে। জাতীয়তাবাদ উপনিবেশের অন্তর্ভুক্ত জাতীয় জনসমাজগুলির মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষের আশঙ্কা দূর করে এবং সহযোগিতা ও সম্প্রীতির সম্পর্ক সৃষ্টি করে। জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ জাতীয় জনসমাজগুলির মধ্যে বিবাদ বিসংবাদের পরিবর্তে সৌভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যবোধ জাগ্রত হয়।

চতুর্থত, ভাতৃত্ববোধের সৃষ্টি: আবার জাতীয়তাবাদী চেতনা একই জাতিগোষ্ঠীর বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্বের সৃষ্টিতে সাহায্য করে। জাতীয়তাবাদী শক্তি সংকীর্ণ ভেদাভেদ ভুলে ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে তোলে। প্রকৃত প্রস্তাবে উপনিবেশগুলির জাতীয় জীবনে জাতীয়তাবাদ হল একটি মহান আদর্শ। এ হল একটি গভীর অনুপ্রেরণা। জাতীয়তাবাদ এই সমস্ত দেশের মানুষকে ঐক্যবোধে একাত্ম করে এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। এই চেতনা দেশের ও দশের স্বার্থে উপনিবেশের অধিবাসীদের আত্মত্যাগে অনুপ্রাণিত করে।

পঞ্চমত, স্বাধীনতা সংগ্রামের শক্তি: ঔপনিবেশিক শাসনের সাম্রাজ্যবাদী নাগপাশ ছিন্ন করে মুক্ত হয়ে স্বদেশী শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী জাতীয়তাবাদ গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতা অর্জনের শক্তি হিসাবে এই জাতীয়তাবাদের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ। মুক্তিকামী দেশের পক্ষে এই জাতীয়তাবাদ আশীর্বাদস্বরূপ। জাতীয়তাবাদের দ্বারা গভীরভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে উপনিবেশের পরাধীন ও দুর্বল জাতিগুলি মরণপণ স্বাধীনতা সংগ্রামের সামিল হয়। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, ভিয়েতনাম ও কামপুচিয়ার মুক্তি সংগ্রাম, আফ্রিকার জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রভৃতি হল ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী জাতীয়তাবাদের বলিষ্ঠ বহিঃপ্রকাশের নজির।

ষষ্ঠত, গণতন্ত্র সংরক্ষণে ব্যর্থতা: তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সফল পরিণতিতে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। কিন্তু এই স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত করে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। অনেক ক্ষেত্রেই সামরিক বাহিনী বা কোন সংখ্যালঘু গোষ্ঠী দেশের শাসনক্ষমতার উপর দখলদারী কায়েম করেছে। প্রায় ক্ষেত্রেই জাতীয় সংহতি সংরক্ষণ বা দেশের নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা সংরক্ষণের নামে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বাতিল করে একনায়কতান্ত্রিক বা সামরিক শাসন কায়েম হয়েছে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন প্রভৃতি দেশের সামরিক একনায়কতন্ত্রের কথা বলা যায়। অর্থাৎ এই সমস্ত দেশে জাতীয়তাবাদ গণতন্ত্রের সহায়ক পটভূমি সংরক্ষণ করতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের অভিমত অনুসারে এ রকম অনেক দেশেই সংখ্যালঘুদের রাজনীতি সচেতন গোষ্ঠী গণতন্ত্রের পরিবর্তে পুরুষানুক্রমিক পারিবারিক বা একনায়কতান্ত্রিক শাসনের পক্ষপাতী ছিল।

সপ্তমত, জাতীয় ঐক্যে ভাঙ্গন: তৃতীয় বিশ্বের উপনিবেশগুলিতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও মুক্তিসংগ্রামের প্রাক্কালে দেশবাসীর বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সুদৃঢ় জাতীয় ঐক্যের সৃষ্টি হয়েছিল। জাতীয় ঐক্যের এই বনিয়াদের উপর গড়ে উঠেছিল দুর্বার গণ-আন্দোলন। এই গণ-আন্দোলনের পরিণতিতে অর্জিত হয়েছিল অভীষ্ট স্বাধীনতা। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের পর তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশে ঐক্য ও সংহতির বাতাবরণ ক্রমশ দুর্বল হয়েছে এবং জাতীয় ঐক্য শিথিল হয়েছে। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সময়কার জাতীয় সত্তার উজ্জ্বল অভিব্যক্তি মলিন হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় বিরোধ, ভাষাগত দ্বন্দ্ব প্রভৃতি জাতীয় ঐক্যে ভাঙন ধরিয়েছে।

  • (ক) সাম্প্রদায়িকতা: তৃতীয় বিশ্বের উপনিবেশসমূহের অধিবাসীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বিবাদ সৃষ্টির স্বার্থে ঔপনিবেশিক শাসন-কর্তৃপক্ষগুলি সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানোর অপকৌশল অবলম্বন করেছিল। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাম্প্রদায়িক উস্কানির ফলে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলি সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। তা ছাড়া এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলিতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহু রকম বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা বর্তমান ছিল। স্বভাবতই সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি অনুকূল অবস্থার সুযোগ নিয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। এই কারণে অ্যাফ্রো-এশীয় দেশগুলিতে স্বাধীনতার উত্তর পর্বে জাতীয়তাবাদী চেতনা সাম্প্রদায়িক অভিশাপকে আটকাতে পারেনি। ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ রকম অনভিপ্রেত বহু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা ঘটেছে।

  • (খ) ধর্মান্ধতা: বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সংকীর্ণ ও প্রতিক্রিয়াশীল ব্যাখ্যা এশিয়া ও আফ্রিকার বহু দেশে জাতীয়তাবোধকে আচ্ছন্ন করেছে। তৃতীয় বিশ্বের এই সমস্ত দেশে আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের ভেদাভেদ ও বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা ছিলই, তার সঙ্গে ধর্মান্ধতার উসকানি জাতীয়তাবাদের সংহতি সাধনের শক্তিকে হীনবল করেছে। ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় সংঘাত-সংঘর্ষ জাতীয়তাবাদকে কলুষিত করেছে। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের মত এশিয়ার বহু দেশে এ রকম অসংখ্য ঘটনার নজির আছে।

  • (গ) ভাষাগত বিরোধ: আবার ভাষাগত বিরোধও জাতীয়তাবাদের ঐক্যশক্তিকে ক্ষুণ্ণ করেছে। ভিন্ন ভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদ দেশবাসীর জাতীয়তাবাদী চেতনাকে দুর্বল করে দিয়েছে। ভাষা গোষ্ঠীগুলির মধ্যে অসদ্ভাব ও অসহিষ্ণুতা জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশের পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে।

অষ্টমত, তৃতীয় বিশ্বের উপনিবেশগুলিতে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও বিস্তার পর্যালোচনা করলে স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয় যে, এ ধরনের জাতীয়তাবাদের মধ্যে আবেগের আধিক্য বর্তমান। এই সমস্ত দেশে ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সংগ্রামী আবেগপ্রবণতা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। জাতীয়তাবাদী নেতারা অনেক ক্ষেত্রেই এই আবেগপ্রবণতাকে হাতিয়ার করে দেশবাসীকে মুক্ত সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তবে এই আবেগপ্রবণতা সব সময় এবং সব ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই এই আবেগ অকস্মাৎ নিম্নগ্রামে নেমে এসেছে। এমনকি স্বাধীনতা অর্জনের পরেও আবেগপ্রবণতার এই ধারা পরিলক্ষিত হয়।

উপসংহার: পরিশেষে বলা প্রয়োজন যে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বা অঞ্চলে জাতীয়তাবাদের কতকগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। পৃথিবীর সকল মহাদেশের অধিবাসীদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার বেশ কিছু সাধারণ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। এশিয়া, আফ্রিকা, আমেরিকা, ইউরোপে নির্বিশেষে একথা সাধারণভাবে সত্য। তবে ঔপনিবেশিকতার পরিপ্রেক্ষিতে এক্ষেত্রে কিছু মৌলিক পার্থক্যের সৃষ্টি হয়। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী জাতীয়তাবাদ বর্তমান। অপরদিকে ইউরোপের ঔপনিবেশিক বা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির জাতীয়তাবাদ এ ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র প্রকৃতির। এই সমস্ত দেশের জাতীয়তাবাদের মধ্যে কতকগুলি বিশেষ উপাদান বা বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল : বিশ্ব বাজারে আর্থনীতিক আধিপত্য কায়েম করার উদ্যোগ, নতুন নতুন উপনিবেশ সৃষ্টির উদ্যোগ, সাম্রাজ্য বিস্তারের উদ্যোগ প্রভৃতি।

(ঙ) উত্তর-ঔপনিবেশিকতাবাদী জাতীয়তাবাদ

উত্তর-ঔপনিবেশিকতাবাদী জাতীয়তাবাদের মধ্যে ব্যাপক রকমফের পরিলক্ষিত হয়। ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের নীগড় থেকে নিষ্কৃতি প্রাপ্তির পরে সকল দেশে জাতীয়তাবাদের চেহারা-চরিত্র সর্বাংশে এক রকমের হয় নি। সমকালীন জাতীয়তাবাদের মধ্যে পশ্চিমী সভ্যতা-সংস্কৃতি ও ধ্যান-ধারণার বাতিলকরণের উদ্যোগ-আয়োজন আছে অধিক মাত্রায়; সঙ্গে সঙ্গে সে সবকে পুনরায় প্রয়োগ করার প্রচেষ্টা আছে, আবার সে সবের সঙ্গে স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণের প্রয়াসও আছে। সাধারণভাবে পশ্চিমকে এবং বিশেষভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বাতিল করে দিয়ে যে জাতীয়তাবাদের উদয়, তা অ-পশ্চিমী দর্শন, মতাদর্শ ও ধ্যান-ধারণার প্রতি অধিকমাত্রায় আকৃষ্ট হওয়াই স্বাভাবিক। উন্নয়নশীল দুনিয়ার জাতীয়তাবাদে ধর্মের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। ধর্মের এই মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব উন্নয়নশীল বিশ্বের জাতীয়তাবাদকে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ প্রকৃতি প্রদান করেছে; নতুন শক্তি-সামর্থ্যে সঞ্জীবিত করেছে। অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশে পশ্চিমী প্রাধান্যের বিরুদ্ধে এবং মার্কিন সংস্কৃতি ও আর্থনীতিক ক্ষমতার বিরুদ্ধে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। পশ্চিমী ঔপনিবেশিকতা শোষণ-পীড়নের উৎস হিসাবে চিহ্নিত হলে উত্তর-ঔপনিবেশিকতাবাদী জাতীয়তাবাদের মধ্যে সরাসরি পশ্চিম-বিরোধিতা নিতান্তই স্বাভাবিক।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খোলাখুলিভাবে রাজনীতিক ঔপনিবেশিকতাবাদী উদ্যোগ-আয়োজনের সামিল হয় নি। কিন্তু আর্থনীতিক বিচারে মার্কিন ঔপনিবেশিকতা বিশ্বব্যাপী পরিব্যাপ্ত। মার্কিন অর্থনীতির প্রভাব প্রতিক্রিয়া পৃথিবীর সর্বত্র অনুভূত হয়। মূলধনের বিনিয়োগ, পশ্চিমী ভোগ্য পণ্য সামগ্রীর দুনিয়ার সর্বত্র সরবরাহ, চাকরির বাজারের ওঠানামা প্রভৃতি অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে মার্কিনী প্রভাব প্রকট। একে বলা হয় নয়া ঔপনিবেশিকতা। নয়া ঔপনিবেশিকতা প্রকাশ্যে রাজনীতিক চেহারা পরিগ্রহ করে না। কিন্তু এ ধরনের ঔপনিবেশিকতাও উল্লেখযোগ্য অসন্তোষ ও বিক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। নয়া ঔপনিবেশিকতার মোকাবিলা করা অপেক্ষাকৃত কঠিন কাজ।

ঔপনিবেশিকতার অভিশাপ থেকে মুক্ত ‘তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি সাম্রাজ্যবাদী যাবতীয় প্রক্রিয়াকে বাতিল করে দিয়েছে। ঔপনিবেশিক শোষণ-পীড়নের অভিন্ন অভিজ্ঞতা এই সমস্ত দেশের আছে। আর্থনীতিক উন্নয়নের ব্যাপারে সাধারণ আগ্রহ এই সমস্ত দেশের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। স্বভাবতই সদ্য স্বাধীন তৃতীয় বিশ্বের এই সমস্ত দেশের মধ্যে এক ধরনের নিবিড় নৈকট্য পরিলক্ষিত হয়। ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের অভিন্ন অতীতই এ ক্ষেত্রে সংযোগ সম্পর্কের সৃষ্টি করে। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনের স্মৃতি কালক্রমে ফিকে হয়ে যায়। তৃতীয় বিশ্বে’র উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে সাংস্কৃতিক ও রাজনীতিক পার্থক্যসমূহ ক্রমশ প্রকট হয়ে পড়ে। তখন স্বাধীনতা প্রাপ্তির গোড়ার দিককার সংযোগ সম্পর্ক ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে।

উন্নয়নশীল দুনিয়ার কিছু কিছু দেশ অন্যান্য পূর্বতন উপনিবেশের সঙ্গে সংযোগ সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে নিজেদের জাতীয়তাবাদী ধারণা অভিব্যক্ত করে। উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলির জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণার এ রকম অভিব্যক্তি এবং অনুরূপ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পূর্বতন উপনিবেশগুলির সঙ্গে সংযোগ সম্পর্ক সৃষ্টির অন্যতম উদ্দেশ্য হল ‘তৃতীয় বিশ্বে’র একটি স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি এবং বক্তব্য ও মতামতগত অবস্থান গড়ে তোলা। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির এই অবস্থান পুঁজিবাদী ‘প্রথম বিশ্ব’ এবং কমিউনিস্ট ‘দ্বিতীয় বিশ্বে’র থেকে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন। ১৯৫৫ সালের বান্দুং সম্মেলনে এশিয়া-আফ্রিকার সদ্য স্বাধীন দেশগুলি তৃতীয় বিশ্বের এই স্বতন্ত্র ও স্বাধীন অবস্থানকে তুলে ধরার ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেছে। তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলি ‘‘ঠাণ্ডা যুদ্ধ (cold war) চলাকালীন সময়ে এ রকম গোষ্ঠী নিরপেক্ষ অবস্থানের আন্দোলনকে অব্যাহত রেখেছে।

পশ্চিমী শক্তিসমূহের এবং তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তির বিরুদ্ধে ঔপনিবেশিকতাবাদ বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত ও পরিচালিত হয়েছে। স্বভাবতই সদ্য স্বাধীন উপনিবেশগুলি সব সময় পশ্চিমী উদারনীতিবাদকে বা সমাজতন্ত্রবাদকে নির্বিবাদে পুরোপুরি গ্রহণ করে নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পশ্চিমী ধ্যান-ধারণাকে গ্রহণ করা হয়েছে এবং তারপর প্রয়োজনমত পরিবর্তন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে তথাকথিত ‘আফ্রিকার সমাজতন্ত্র’ (African Socialism) -এর কথা বলা যায়। আফ্রিকান সমাজতন্ত্রবাদ সাবেকি সমভোগবাদী মূল্যবোধসমূহের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই সমাজতন্ত্রবাদ বিভেদমূলক উপজাতীয় পারস্পরিক বিবাদ-বিসংবাদকে অবদমিত করে আর্থনীতিক প্রগতির প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার প্রদানের পক্ষপাতী। আফ্রিকান সমাজতন্ত্র সোভিয়েত মডেলের রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রবাদের অনুগামী নয়; আবার পশ্চিমী সামাজিক গণতন্ত্রেরও অনুসারী নয়। আফ্রিকান সমাজতন্ত্র অ্যাঙ্গোলা, জিম্বাবোয়ে এবং টানজানিয়াতে প্রচলিত দেখা যায়।

আবার স্বাধীনতাপ্রাপ্ত কতকগুলি উন্নয়নশীল দেশ মার্কসবাদী-লেনিনবাদী মতাদর্শের অনুগামী শাসনব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এই সমস্ত দেশে সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা ও প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রচলিত হয়েছে। বিশেষ প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পথ গ্রহণ করা হয়েছে। এই সমস্ত দেশে জাতীয় স্বার্থের কারণে ঐক্য ও সংহতির ব্যাপারে আবেদন জানানো হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সামাজিক বা আর্থনীতিক উন্নয়নকেই জাতীয় স্বার্থ হিসাবে প্রতিপন্ন করা হয়।

স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরে কতকগুলি দেশে সোভিয়েত মডেলকে অনুসরণ করে একদলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা ও কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পিত আর্থনীতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। আর্থনীতিক উৎসসমূহের জাতীয়করণ করা হয়। এবং বিদেশী সম্পদসমূহ বাজেয়াপ্ত করা হয়। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে গণ-প্রজাতন্ত্রী চীন, ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়া ও কাম্বোডিয়ার কথা বলা যায়। আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের কতকগুলি দেশে জাতীয়তাবাদী সমাজতন্ত্রবাদ বিকশিত হয়। এই সমস্ত সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মধ্যে মতদর্শগত বিশুদ্ধতা ততটা ছিল না। এই সমস্ত দেশেও একদলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। সাধারণত গণমোহিনী চরিত্রের এবং বিশেষভাবে শক্তিশালী কোন নেতা এই দলের উপর কর্তৃত্ব কায়েম করেন। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে লিবিয়ার গদ্দাফি (Gadhafi) এবং ইরাকের সাদ্দাম হুসেন (Saddam Hussein) এর কথা বলা যায়। লিবিয়া ও ইরাক ছাড়া অ্যালজিরিয়া, জামবিয়া ও দক্ষিণ ইয়েমেনে এ ধরনের জাতীয়তাবাদী সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পরিলক্ষিত হয়।


বর্তমান যুগে জাতীয়তাবাদ

‘জাতীয়তাবাদের অবসান মানবসভ্যতার পক্ষে আশীর্বাদ হিসাবে দেখা দেবে’—এ রকম আপ্তবাক্য আবহমান কাল ধরে ব্যক্ত হয়ে আসছে। অন্য কোন রাজনীতিক মতাদর্শকে অপমৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার ব্যাপারে অধিক উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করা হয় নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন : “জাতীয়তাবাদ সভ্যতার সংকটস্বরূপ” (“Nationalism is a menance to civilisation.”)। মনীষী কার্ল মার্কস ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের শেষের দিকে ঘোষণা করেছিলেন যে, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে জাতিগত বিভেদসমূহ এবং যাবতীয় বিবাদ-বিসংবাদ দিনে দিনে ক্রমান্বয়ে অধিক হারে অন্তর্হিত হবে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি-পরিমণ্ডল ক্রমশ রাজনীতিক জাতীয়তাবাদের অস্তিত্বের পক্ষে প্রতিকূল হয়ে দাঁড়ায়। একবিংশ শতাব্দীতে জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত অবসানের সম্ভাবনা অমূলক নয়। অ্যান্ড্রু হেউড তাঁর Political Idiologies শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “…surely the twenty-first century is going to witness the final eclipse of political nationalism.”

জাতীয়তাবাদের অবসান অনিবার্য এই ধারণায় বিশ্বাসী ব্যক্তিবর্গ এ বিষয়ে বিবিধ বক্তব্য বিন্যস্ত করে থাকেন।

(ক) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী কালে জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নীতির প্রয়োগের পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপের পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই সময় জাতিগঠনের কর্মসূচী হিসাবে জাতীয়তাবাদের অন্তর্হিত হওয়ার বিষয়টি সর্বসমক্ষে আসতে থাকে।

(খ) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী কালে এশিয়া, আফ্রিকা এবং পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে ঔপনিবেশিকতাবাদের অবসান ঘটতে থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের উপনিবেশগুলি একে একে ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের নিগড় থেকে মুক্তি পেতে থাকে। এইভাবে বিশ্বব্যাপী জাতি-রাষ্ট্রসমূহ গঠনের প্রক্রিয়া সফল ও সম্পন্ন হলে জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে।

(গ) বিংশ শতাব্দীর অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আর্থনীতিক ও রাজনীতিক জীবনধারার আন্তর্জাতিকীকরণ ঘটতে থাকে অতি দ্রুত গতিতে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ, ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন এবং বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্বব্যাঙ্ক, আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার প্রভৃতি বহু ও বিভিন্ন বিশেষীকৃত আন্তর্জাতিক সংগঠন সিদ্ধান্তমূলক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে। এ রকম অবস্থায় স্বতন্ত্রভাবে তেমন কোন বিষয় এককভাবে কোন জাতি-রাষ্ট্রের হাতে বড় একটা থাকে না। স্বভাবতই পরিবর্তিত পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলে পৃথকভাবে জাতির অস্তিত্ব ও উপযোগিতা অপ্রাসঙ্গিক প্রতিপন্ন হয়।

(ঘ) জাতীয়তাবাদী, মতাদর্শের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলার ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন বিশেষভাবে কার্যকর প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন জাতির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব সম্পর্কিত ধারণার ভিত্তিতেই সৃষ্টি হয়েছে জাতি-রাষ্ট্রের ধারণা এবং আনুষঙ্গিক রাজনীতিক বিশ্বাস। বিশ্বায়নের ধারণা জাতিসমূহের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব সম্পর্কিত ধারণার মূলটিকে একেবারে গোড়া থেকে উপড়ে ফেলার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার সুবাদে সুসংহত বিশ্ব অর্থনীতিক ব্যবস্থা বিকশিত হচ্ছে। মানুষজনের আর্থনীতিক বা সামগ্রিক উন্নয়নের বিষয়টি বর্তমানে যতটা না জাতীয় সরকারের ক্রিয়াকর্মের উপর নির্ভরশীল, তার থেকে অধিক বহুজাতিক সংগঠনসমূহের বিনিয়োগ পরিকল্পনা বা আর্থনীতিক কর্মসূচীর উপর নির্ভরশীল।

(ঙ) সাংস্কৃতিক বা জীবনধারাগত বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জাতিগত সত্তার স্বতন্ত্র অস্তিত্বের বিষয়টি বর্তমানে বহুলাংশে অর্থহীন প্রতিপন্ন হয়। আকাশপথে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছে; পর্যটন ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে; শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনোদন প্রভৃতি জনজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী সংযোগ-সম্পর্ক গড়ে উঠেছে; বৈদ্যুতিন যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছে; উপগ্রহ মারফৎ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংযোগ-সম্পর্ক অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে প্রভৃতি। অত্যাধুনিক সমাজব্যবস্থা হল বাজার পরিচালিত সমাজব্যবস্থা। কেবল আর্থনীতিক ক্ষেত্রে নয়, জনজীবনের কোন ক্ষেত্রেই কোন মানব গোষ্ঠীরই স্বতন্ত্র সত্তা বা অস্তিত্ব অব্যাহত রাখা বাস্তবে এক রকম অসম্ভব। 

আধুনিক দুনিয়ায় রাজনীতিক জাতীয়তাবাদের মতাদর্শ হীনবল হয়ে পড়েছে। এ কথা অনেকাংশে অনস্বীকার্য। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও জাতিগোষ্ঠীর রাজনীতিক গুরুত্ব ও তাৎপর্যের বিষয়টি এখনও অনেকাংশ অর্থবহ। এ প্রসঙ্গে কতকগুলি বিষয় বিচার-বিবেচনা করা দরকার।

(১) একবিংশ শতাব্দীর পরিবর্তিত পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলে সাবেকি জাতীয় রাষ্ট্র সাধারণত সমষ্টি-সংহতির সত্তা সৃষ্টি করতে সমর্থ হয় না। এ রকম ক্ষেত্রে ধর্ম, আঞ্চলিকতা, বংশ প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে একনিষ্ঠ আনুগত্যের সৃষ্টি হতে পারে। পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে এ রকম অন্ধ-আনুগত্যভিত্তিক সংঘাত-সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়েছে। পূর্বতন যুগোশ্লাভিয়াতেও জাতিদাঙ্গার সৃষ্টি হয়েছে। আবার কোন কোন দেশে অপকেন্দ্রিক বা কেন্দ্রাতিগ জাতীয়তাবাদী শক্তির সৃষ্টি হয়ছে। ইতালী, স্পেন, বেলজিয়াম প্রভৃতি দেশে এ রকম বিচ্ছিন্নতাবাদী জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয়েছে।

(২) এমন কথাও বলা হয় যে, বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সাবেকি জাতীয় ও পৌর বন্ধনসমূহ অনেকাংশে আলগা হয়ে গেছে। কিন্তু বিশ্বায়ন ব্যবস্থার সূত্রে বংশগত আনুগত্যভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বা আক্রমণাত্মক প্রকৃতির জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এরকম আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

(৩) বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জাতিভিত্তিক কর্মসূচীসমূহ নতুন করে বিশেষভাবে অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। ক্রমবর্ধমান বিশ্বায়ন এবং পরস্পর নির্ভরশীল দুনিয়ায় জাতিসমূহের স্বতন্ত্র ভবিষ্যতের বিষয়টি নতুন মাত্রাযুক্ত হয়ে পড়তে পারে। জাতিসমূহ নিজেদের স্বতন্ত্র সত্তাকে পৃথকভাবে অনুধাবনের জন্য আবার আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে। বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার প্রতিযোগিতামূলক এবং অনেকাংশে অসংবদ্ধ প্রকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয়তাবাদী চেতনার গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে পারে। সামাজিক সংহতি সৃষ্টি এবং পরিচয়ের স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণের স্বার্থে জাতীয়তাবাদী ধারণার অব্যাহত অস্তিত্ব প্রয়োজনীয় প্রতিপন্ন হতে পারে।

রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানী হায়েস যথার্থই বলেছেন: ‘যথার্থ দেশপ্রেম জাতীয়তাবাদের আদর্শের মাধ্যমে মূর্ত হলে বিশ্বসভ্যতা ও মানবতার পক্ষে তা আশীর্বাদস্বরূপ’ (“Nationalism when it becomes synonymous with purest patriotism will prove a unique blessing to humanity and to the world.”)।