ভূমিকা: পরাধীন ভারতবর্ষে স্বদেশবাসীকে সর্বপ্রথম আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তােলর কাজে সমীল হয়েছিলেন যিনি, মৃতপ্রায় একটি জাতির দেহে প্রাণ সঞ্চার করেছিলেন যিনি, তিনি হলে শ্রী শ্রী রামকৃয়দেবের প্রিয়তম শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ। স্বামীজির জাতীয়তাবাদী আদর্শ, স্বদেশচেতনা ও দেশপ্রেমে উদবুদ্ধ হয়েছিল পরবর্তী প্রজন্ম।

[1] জাতীয়তাবাদী আদর্শ: দেশবাসীর উদ্দেশ্যে স্বামীজির মহাজাগরণের বানীগুলি জাতীয়তাবাদের বােধন ঘটিয়েছিল। পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করার জন্য স্বামীজি যুব সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। পূন্যভূমি ভারতকে তিনি জীবনের একমাত্র সত্য বলে মনে করতেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন- “ভারতের মৃত্যু হলে সত্যের মৃত্যু ঘটবে।” তিনি বলেন—আমামী ৫০ বছরের জন্য ভারতমাতাই আমাদের আরাধ্য দেবতা। অন্যান্য অকেজো দেবতাদের ভুলে গেলে ক্ষতি নেই।

[2] জাতীয়তাবাদের অগ্রদূত: স্বামীজি কোনােদিনই প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক আন্দোলনগুলির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু তার অন্তরে স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের ঘাটতি ছিল না। স্বামীজির জ্ঞানযােগ, রাজযােগ, বর্তমান ভারত, পরিব্রাজক প্রভৃতি গ্রন্থ ও পত্রাবলিগুলি বিপ্লবীদের প্রেরণার উৎস ছিল। নেতাজি তাঁর অসম্পূর্ণ আত্মজীবনী ভারত-পথিক-এ স্বীকারােক্তি জানান—“স্বামীজির বানী ও রচনাবলি আমার চিন্তাধারার পরিবর্তন ঘটিয়েছিল।” গান্ধিজি বলেন—তাঁর রচনাবলি পাঠ করে মাতৃভূমির প্রতি আমার ভালােবাসা সহস্রগুণ বুদ্ধি পেয়েছে।

[3] স্বাধীনতা আন্দোলনের স্থপতি: স্বামীজির বাণীগুলিতে উদ্দীপ্ত হয়েও উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে যুবসম্প্রদায় স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। স্বাধীনতার দাবিতে উত্তাল রক্তে রাঙা দিনগুলিতে স্বামীজি ছিলেন বিপ্লবীদের আদর্শ। গােপাল হালদারের মতে বাংলাদেশকে যদি কেউ বিপ্লবী মন্ত্রে জাগিয়ে থাকনে, তিনি বিবেকানন্দ। বিবেকানন্দ বলেন—কেবল সাহসী শক্তিমানরাই স্বাধীনতা অর্জন করতে পারবে।

[4] জাতীয়তাবাদী স্বরূপ: স্বামীজির জাতীয়তাবাদে মাতৃভূমির শৃঙ্কলমােচনের পাশাপাশি মানবমুক্তির কথা বলা হয়। স্বামীজি বলেছিলেন—“জগতের ইতিহাস পর্যালােচনা কর, যেখানেই কোনাে। সুমহান আদর্শের সন্ধান মিলবে দেখিতে পাইবে উহার জন্ম ভারতবর্ষে।”

[1] স্বামীজির স্বপ্নের ভারত: স্বামীজি এমন এক ভারতের স্বপ্ন দেখতেন যেখানে থাকবে না ক্ষুধার জন্য আর্তনাদ, স্বার্থের জন্য শােষণ, লােভের জন্য নিপীড়ন, গরিমার জন্য অবহেলা। নবভারতের রূপকার স্বামীজি চেয়েছিলেন নতুন ভারত গড়ে উঠবে প্রকৃত মানুষদের নিয়ে। তিনি বলেন—“নতুন ভারত বেরুক, বেরুক লাঙল ধরে, চাষার কুটির ভেদ করে, জেলে-মাল্লা-মুচি-মেথরের ঝুপড়ির মধ্যে হতে, বেরুক মুদির দোকান থেকে, ভুনাওয়ালার উনুনের পাশ থেকে, বেরুক কারখানা থেকে, হাট থেকে, বাজার থেকে, বেরুক জঙ্গল পাহাড় পর্বত থেকে।”

[2] স্বদেশ ও দেশবাসীর মুক্তির সাধনা: ভারতবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে স্বামীজি বলেন—“সদর্পে বল আমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই।” তিনি বলতেন—“ভারতবাসী আমার ভাই, ভারতবাসী আমার প্রাণ, ভারতের দেবদেবী আমার ঈশ্বর, ভারতের সমাজ আমাদের শিশুশয্যা, আমার যৌবনের উপবন, আমার বাধ্যক্যের বারাণসী। বলাে ভাই—ভারতের মৃত্তিকা আমার স্বর্গ, ভারতের কল্যাণ আমার কল্যাণ।”

[3] আদর্শ যুবসমাজ গঠনে অনুপ্রেরণা: স্বামীজি ছিলেন যুবসমাজের আদর্শ। তিনি ভারতের স্বাধীনতা এবং নতুন ভারত গঠনের ক্ষেত্রে যুবশক্তির ওপরই ভরসা করতেন। তিনি যুবসমাজকে লৌহ কঠিন পেশি, ইস্পাত কঠিন চরিত্র ও বজ্ৰদীপ্ত মনের অধিকারী হওয়ার আহ্বান জানান। তার বিশ্বাস ছিল একশত খাঁটি আদর্শবাদী যুবক মিলিত হলে ভারতের স্বাধীনতা অবশ্যম্ভাবী। তিনি চেয়েছিলেন, যুবসমাজ আগুন ছড়িয়ে দেবে হিমালয় থেকে কন্যাকুমারীকা পর্যন্ত, উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত।

[4] রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা: স্বামী বিবেকানন্দ প্রকৃত মানুষ তৈরির লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করেন রামকৃয় মিশন (১৮৯৭ খ্রি. ১ মে)। এই মিশনের উদ্দেশ্য ধর্মীয় ঐক্য ও বৈদান্তিক আদর্শের বিশ্বব্যাপী প্রচার হলেও রামকৃয় মিশনের আসল লক্ষ্য হল মানবরূপী দেবতাদের সেবা করা। অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী অবহেলিত, শােষিত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত, অত্যাচারিত, অসহায় ও নিঃস্ব মানুষগুলির পাশে দাঁড়ানাে এবং তাদের দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত করা। রামকৃয় মিশন প্রতিষ্ঠার দ্বারা স্বামীজি জীবসােবাকেই জীবনের পরম ব্রতবূপে গ্রহণ করেছিলেন। “জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর”—এই ছিল তার মন্ত্র।

মূল্যায়ন: স্বামীজির আদর্শ ও যাবতীয় ধ্যানধারণা ঘিরে ছিল স্বদেশ ও স্বাদেশবাসীর মুক্তি ও তার সঙ্গে বিশ্ব মানবতার মােক্ষ লাভ। স্বামীজিকে স্মরণ করে আজও প্রতি বছর ১২ জানুয়ারি তার জন্মদিনটি যুবদিবসরূপে পালিত হয়।