জাতীয়তাবাদ একটি রাজনীতিক আদর্শ: জাতীয়তাবাদ হল একটি রাজনীতিক আদর্শ। শুধু তাই নয় জাতীয়তাবাদ হল একটি অতি বিতর্কিত রাজনীতিক আদর্শ। এই রাজনীতক আদর্শ একদিকে যেমন ধ্বংসের সমস্যা সৃষ্টি করে, অপরদিকে তেমনি সৃষ্টির সমস্যা সৃষ্টি করে। উগ্র জাতীয়তাবাদের বিকৃত উন্মাদনা সভ্যতার সংকট সৃষ্টি করেছে। আবার সুস্থ জাতীয়তাবাদের আত্মিক আবেদন পরাধীন জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করেছে। বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে জাতীয়তাবাদের এই উভয়বিধ প্রকাশই পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং মানবসভ্যতার পরিপ্রেক্ষিতে একটি রাজনীতিক আদর্শ হিসাবে জাতীয়তাবাদের আলোচনা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় জাতীয় রাষ্ট্র ও জাতীয়তাবাদের আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লয়েড মন্তব্য করেছেন: “Nationalism is the religion of the modern world.”

জাতীয়তাবাদ হল একটি মানসিক অনুভূতি বা চেতনা: জাতীয়তাবাদ একটি ভাবগত বা মানসিক ধারণাবিশেষ। জাতীয়তাবাদ হল একটি প্রবল মানসিক অবস্থা বা অনুভূতি—একটি আত্মিক ধারণা। জাতীয়তাবাদ হল জনসমাজের মধ্যে এক গভীর ঐক্যবোধ বা স্বাতন্ত্র্যবোধ। কোন জনসমাজ যখন ভাবগত ঐক্যবোধের ভিত্তিতে একাত্ম হয় এবং নিজেদের স্বতন্ত্র সত্তা সম্বন্ধে সচেতন হয় তখনই জাতীয়তাবোধের সৃষ্টি হয়। সুতরাং জাতীয়তাবাদ হল একটি ঐক্য বা সংহতি সাধনকারী ধারণা বা চেতনা। এই চেতনাই একটি মানবগোষ্ঠীর মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন গড়ে তোলে। এইভাবে সংশ্লিষ্ট মানবগোষ্ঠীর মধ্যে স্বাজাত্যবোধের সৃষ্টি হয়। এই স্বাজাত্যবোধ আবার জাতীয় স্বাতন্ত্রের ধারণার সৃষ্টি করে। অর্থাৎ স্বকীয়তা ও স্বাজাত্যবোধে অনুপ্রাণিত কোন জাতি অন্য জাতির থেকে নিজেদের স্বতন্ত্র্য্য বলে মনে করে। এই স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য সংশ্লিষ্ট জাতির মধ্যে এক বিশেষ ধরনের আবেগ-অনুভূতি বা আত্মিক চেতনার সৃষ্টি করে। এই মানসিক অনুভূতি বা চেতনাই হল জাতীয়তাবাদ।

জাতীয়তাবাদের অর্থ ও প্রকৃতি:

সুতরাং জাতীয়তাবোধের দুটি মূল বৈশিষ্ট্য বর্তমান: (১) নিজেদের মধ্যে গভীর ঐক্যবোধ এবং (২) দুনিয়ার অন্যান্য জনসমাজ থেকে স্বাতন্ত্র্যবোধ। কোন জনসমষ্টি যখন ভাষা, সাহিত্য, বংশ, ধর্ম প্রভৃতি নানা কারণে নিজেদের সমস্বার্থ, সম-ঐতিহ্য, সম-গৌরব ও গ্লানির অংশীদার বলে মনে করে; যাদের বর্তমানের কার্যপ্রেরণা এবং ভবিষ্যতের পরিকল্পনা এক; জীবনদর্শন যাদের অভিন্ন তারা পরস্পর গভীর ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এই একাত্মবোধের ভিত্তিতেই জাতীয়তাবোধের সৃষ্টি হয়। রাসেল (Bertrand Russel)-এর মতানুসারে জাতীয়তাবাদ হল একটি সাদৃশ্য ও ঐক্যের অনুভূতি (a sentiment of similarity and solidarity) যা পরস্পরকে ভালবাসতে শিক্ষা দেয়। তাই লয়েড-এর অভিমত হল, ‘জাতীয়তাবাদকে একটি ধর্ম হিসাবে অভিহিত করা যায়, কারণ এর উৎস মানুষের গূঢ়তম প্রবৃত্তির মধ্যে নিহিত আছে’। তিনি মন্তব্য করেছেন: “Nationalism may be called a religion because it is rooted in the deepest instincts of man.”

দেশপ্রেম ও রাজনীতিক স্বাধীনতা: জাতীয়তাবাদের মধ্যে শুধু যে স্বজনপ্রীতিই থাকে, তা নয়— স্বদেশের প্রতি গভীর অনুরাগও থাকে। হায়েসের মতানুসারে জাতীয়তাবাদের কেন্দ্রস্থলে জন্মভূমির প্রতি গভীর অনুরাগ বর্তমান থাকে। হায়েস তাঁর Nationality and Patriotism শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Nationalism consists of a modern fusion of emotional and exaggeration of two very old phenomena.” জনসমাজের মধ্যে এই স্বজনপ্রীতি বা একাত্মবোধের সঙ্গে দেশপ্রেম যুক্ত হলে জাতীয়তাবাদ পরিপূর্ণ রূপ লাভ করে। এই জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্রনীতিক আশা-আকাঙ্ক্ষার মধ্যেই মূর্ত হয়ে উঠে। অর্থাৎ জাতীয় জনসমাজ নিজেদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠন করতে পারলেই জাতীয়তাবাদ মূর্ত হয়ে উঠে। রাজনীতিক আদর্শ হিসাবে জাতীয়তাবাদ জাতীয় রাষ্ট্রগঠনের চরম পরিণতি। ল্যাস্কির মতানুসারে জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হল মানুষের সঙ্গ পাওয়ার প্রবৃত্তি (gregarious instinct) এবং স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা। জাতিকে যে সকল উপাদান দৃঢ়ভাবে ঐক্যসূত্রে গ্রথিত করে তার মধ্যে রাজনীতিক বন্ধন হল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। রাজনীতিক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করার বাসনা একটি জাতির সকলকে সুদৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ করে। স্বাজাত্যবোধ বৃদ্ধি পেলে প্রত্যেক জাতি নিজেদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠন করতে চায়। এই প্রচেষ্টা সফল হলে জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র গঠিত হয়।

জাতীয়তাবাদে লিপসন (Leslie Lipson)-এর অভিমত:

জাতীয়তাবাদের ধারণা পর্যালোচনার প্রাক্কালে কয়েকজন বিশিষ্ট চিন্তাবিদের অভিমত উল্লেখ করা দরকার। লিপ্‌সন তাঁর The Great Issues of Politics শীর্ষক গ্রন্থে জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতানুসারে জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে বিশেষ এক ধরনের আবেগ-অনুভূতি প্রকাশিত হয়। তার মধ্যে আশা-আকাঙ্ক্ষা, সহানুভূতির মত ইতিবাচক মানসিকতা থাকে; আবার ঘৃণার মত নেতিবাচক মনোভাবও থাকে। এ প্রসঙ্গে তিনি দেশপ্রেমের কথা বলেছেন। অস্তিত্বকে অটুট রাখার জন্য রাষ্ট্রকে মানসিকতা বা মনোগত দিকগুলির উপর গুরুত্ব আরোপ করতে হয়। নাগরিকদের কাছ থেকে রাষ্ট্র আনুগত্যবোধ দাবি করতে সক্ষম হয়, যদি রাষ্ট্র সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারে। লিপসনের মতানুসারে সকল নাগরিকের মধ্যে এই আনুগত্যবোধ বিকশিত হলে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে তা ব্যক্ত হলে জাতীয়তাবোধের অভিব্যক্তি ঘটে। তাঁর মতে নাগরিকদের মধ্যে নির্দিষ্ট এক ধরনের অনুভূতি বা মনোভাবকে সঞ্চারিত করার জন্য সরকার মাত্রেই এক সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

জাতীয়তাবাদে বার্নস (C. D. Burns)-এর অভিমত:

বার্নস তাঁর Political Ideals শীর্ষক গ্রন্থে জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। বার্নস-এর অভিমত অনুসারে জাতীয়তাবাদ প্রতিটি মানবগোষ্ঠীর বিভিন্নতা ও স্বকীয়তা সংরক্ষণে এবং সমন্বয় সাধনের ক্ষেত্রে সাহায্য করে। প্রতিটি মানবগোষ্ঠীর সামগ্রিক বিচ্ছিন্নতাকে জাতীয়তাবাদ বলে না। আত্মবিকাশ বা আত্মপ্রতিষ্ঠা বিচ্ছিন্নভাবে কোন জাতির পক্ষেই সম্ভব নয়। বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর মধ্যে জাতীয়তাবাদ নিকট সম্পর্ক সংরক্ষণ করতে চেষ্টা করে। অর্থাৎ জাতীয়তাবাদের মূল কথা হল প্রত্যেক মানবগোষ্ঠীর সৃজনশীল বিকাশকে সম্ভব করে তোলা; তাদের স্বকীয়তা বা বিভিন্নতার বিলোপ সাধন নয়।

জাতীয়তাবাদে রেনী (Ernest Rena)-র অভিমত:

রেনার অভিমত অনুসারে জাতীয়তাবাদ হল মূলত একটি ভাবগত বিষয়। এই বিষয়টির দু’টি দিক আছে। একটি দিক হল ঐতিহ্য এবং আর একটি দিক হল ঐক্যবদ্ধভাবে বসবাস করার দৃঢ় মানসিকতা। প্রত্যেক জাতি তার অতীত ঐতিহ্যকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে থাকে। এবং সঙ্গে সঙ্গে তারা সম্প্রীতি ও সৌভ্রাতৃত্বের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে বসবাস করতে চায়। সুখে দুঃখে, সম্পদে-বিপদে তারা নিজেদের অভিন্ন অংশীদার বলে মনে করে। এভাবেই গড়ে উঠে জাতীয়তাবাদের ভাবগত ভিত্তি। সুতরাং জাতীয়তাবাদ হল সম্পূর্ণভাবে একটি ভাবগত বা আত্মিক বিষয়। এই জাতীয়তাবোধের ভিত্তিতে গড়ে উঠে একটি ঐক্যবদ্ধ বা সুসংহত জাতি।

মানবসভ্যতার অঙ্গ: ব্যাপক অর্থে জাতীয়তাবাদের মধ্যে বিশ্বজননীতার আদর্শ বিধৃত আছে। এর মধ্যে সংকীর্ণতার কোন স্থান নেই। জাতীয়তাবাদের উদ্দেশ্য বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্ক ছিন্ন করা নয়। জাতীয়তাবাদ স্বাতন্ত্র্য ও বৈচিত্র্য উভয়কেই স্বীকার করে। জাতীয়তাবাদ প্রত্যেক মানবগোষ্ঠীর সমৃদ্ধশালী ও বৈচিত্র্যময় ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করতে চায়। জাতীয়তাবাদের উদ্দেশ্য হল প্রতিটি মানবগোষ্ঠীর সামগ্রিক বিকাশের স্বার্থে প্রয়োজনীয় সব কিছু সম্পাদন। এইভাবে জাতীয়তাবাদ সমগ্র মানবসভ্যতা বা বিশ্বসভ্যতারই অংশ হিসাবে প্রতিপন্ন হয়।


জাতীয়তাবাদের মূল্যবিচার

জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক আলোচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রনীতিক আদর্শ। এই আদর্শের সমর্থনে বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করা হয়।

(১) একটি মহান আদর্শ: জাতির জীবনে জাতীয়তাবাদ একটি মহান আদর্শ। এ হল এক গভীর অনুপ্রেরণা। জাতীয়তাবাদ জাতিকে ঐক্যবোধে একাত্ম করে এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। এই আদর্শ দেশের ও দশের স্বার্থে আত্মত্যাগে ব্যক্তিকে অনুপ্রাণিত করে। এইভাবে জাতির সর্বাঙ্গীণ বিকাশের আবহাওয়া সৃষ্টি হয়।

(২) স্বাধীনতা সংগ্রামের উদ্দীপক: মুক্তিকামী দেশের পক্ষে জাতীয়তাবাদ আশীর্বাদস্বরূপ। জাতীয়তাবাদের দ্বারা গভীরভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে পরাধীন ও দুর্বল জাতি মরণপণ স্বাধীনতা-সংগ্রামে সামিল হয় এবং স্বাধীন ও শক্তিশালী রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করে। অনেক বিচ্ছিন্ন জাতীয় জনসমাজ জাতীয়তাবাদের মহান আদর্শের প্রভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে এবং স্বৈরাচারী বিদেশী শাসনের শৃঙ্খল মুক্তির সংগ্রামের সামিল হয়েছে। এক্ষেত্রে ভারত ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস উদাহরণ হিসাবে উল্লেখযোগ্য। ইতালী ও জার্মানীর ঐক্য সাধনের ইতিহাস জাতীয়তাবাদের জয়গানে সমৃদ্ধ। আবার ভিয়েতনাম ও কাম্পুচিয়ার মুক্তিসংগ্রাম এবং আফ্রিকার জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রাম জাতীয়তাবাদের বলিষ্ঠ বহিঃপ্রকাশের নজির। বস্তুত বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে এমন অনেক দৃষ্টান্ত বর্তমান। পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশের ইতিহাসে জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ পরাধীন মানবগোষ্ঠীর বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের এবং জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমিকতা অর্জনের উজ্জ্বল কাহিনী আছে।

(৩) মানব সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করে: জাতীয়তাবাদের জনক হিসাবে ইতালীর দার্শনিক ম্যাৎসিনি (Mazzini)-র কথা বলা হয়। তাঁর মতানুসারে বিভিন্ন গুণ ও প্রতিভার বিকাশ সাধনের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদ মানবসভ্যতাকে সমৃদ্ধ ও উন্নত করে। বিশ্বের প্রত্যেক জাতির একেবারে নিজস্ব কিছু গুণ বা বৈশিষ্ট্য থাকে। জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে এইসব গুণাবলীর বিকাশ ঘটে। প্রত্যেক মানবগোষ্ঠী জাতীয় গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যের যথাযথ বিকাশের জন্য জাতীয় স্বাধীনতা ও আত্মবিকাশের অধিকারের স্বীকৃতি অপরিহার্য। পৃথিবীর প্রতিটি জাতির স্বকীয়তার স্বাধীন বিকাশ সুনিশ্চিত হলে মানবসভ্যতা সমৃদ্ধশালী ও বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে উঠবে। এবং জাতীয়তাবাদের মাধ্যমেই তা সম্ভব। এইভাবে প্রত্যেকটি জাতির গুণরাজির বিকাশের মাধ্যমে মানবসমাজ ও সভ্যতা সমৃদ্ধ ও উন্নত হয়। ম্যাৎসিনি সম্পর্কে লয়েড বলেছেন: “He thought each nation possessed certain talents, which taken together formed the wealth of the human race.”

(৪) সহযোগিতার আবহাওয়া গড়ে তোলে: জাতীয়তাবাদ জাতিসমূহের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষের আশংকা দূর করে এবং সহযোগিতা ও সম্প্রীতির সম্পর্ক সৃষ্টি করে। জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ জাতিসমূহের মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদের প্রবণতা থাকে না; তার পরিবর্তে সৌভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যবোধ জাগ্রত হয়। এইসব জাতি নিজের উন্নতি ত্বরান্বিত করে এবং অপরের উন্নতিতে সাহায্য করে। জাতীয়তাবাদের মূল কথাই হল, ‘নিজে বাঁচ এবং অপরকে বাঁচতে দাও’ (Live and let live)।

(৫) শাসক ও শাসিতের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক: জাতীয়তাবাদ দেশের শাসনব্যবস্থাকে স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল করে। জাতীয়তাবাদের কারণে দেশের মধ্যে শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক সহজ ও স্বাভাবিক হয়। আইনের নির্দেশ ও আইন মান্য করার মধ্যে কোন রকম অস্বস্তিকর ফাঁক থাকে না। তার ফলে সার্বভৌম কর্তৃত্ব ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার মধ্যে সহজ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। দেশবাসীকে রাষ্ট্রীয় কাজকর্মের সামিল করার ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদের অবদান অনস্বীকার্য। জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ছাড়া কোন সরকারই জনসাধারণের কাছ থেকে আনুগত্য আদায় করতে পারে না। স্বৈরতান্ত্রিক সরকারও এ ক্ষেত্রে অসহায় বোধ করে। বার্জেসের মতানুসারে জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও স্থায়িত্বকে দৃঢ় করে এবং সার্বভৌমিকতা ও স্বাধীনতার মধ্যে সংহতি স্থাপন করে। তা ছাড়া রাষ্ট্রের ভিতরে শান্তি-শৃঙ্খলা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদী চেতনা সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

(৬) গণতন্ত্রের অনুকূল: জাতীয়তাবাদ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সুস্থ গণতান্ত্রিক অধিকার ও চেতনার বিকাশের ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদ সহায়ক ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। জাতীয়তাবোধ একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে দেশবাসীর মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। এই কারণে ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে একটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। ইতিহাসে এরকম নজিরের অভাব নেই।

(৭) আন্তর্জাতিকতার পরিপূরক: জাতীয়তাবোধ জাতিকে নিজের জাতীয় চরিত্র ও স্বকীয়তা সংরক্ষণে যেমন উদ্দীপ্ত করে তেমনি অপর জাতির সঙ্গে সদ্ভাব ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে অনুপ্রাণিত করে। জাতীয়তাবাদ বিভিন্ন জাতির মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্প্রীতির পথকে প্রশস্ত করে। বিভিন্ন জাতির মধ্যে বিচ্ছিন্নতার পরিবর্তে জাতীয়তাবাদ সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা প্রয়াসী হয়। তার ফলে জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ জাতিসমূহের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জাতীয়তাবাদের এই গঠনমূলক দিকটি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। জাতীয়তাবাদ হল আন্তর্জাতিকতার পরিপূরক। জিমার্ন বলেছেন: “Nationalism is a highway to internationalism.”

(৮) সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের অশুভ আক্রমণ থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে পারে জাতীয়তাবাদী আদর্শ। জাতীয়তাবাদী আদর্শই এশিয়া ও আফ্রিকায় ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিস্তারকে রোধ করেছে এবং বহুলাংশে অপসারিত করেছে।


জাতীয়তাবাদের সীমাবদ্ধতা

জাতীয়তাবাদের সমর্থনসূচক নানারকম যুক্তি আছে। তবুও বিভিন্ন মনীষী ও চিন্তাবিদ জাতীয়তাবাদের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। অনেকের মতে জাতীয়তাবাদ মানবসভ্যতা ও বিশ্বশান্তির শত্রুস্বরূপ। জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে সাধারণত নিম্নলিখিত যুক্তিসমূহের অবতারণা করা হয়।

(ক) সভ্যতার সংকট: স্বদেশ ও স্বজনের প্রতি গভীর অনুরাগের ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদ জাত্যভিমানে রূপান্তরিত হয়। নিজেদের সকল বিষয়ে উন্নত ধারণা এবং অন্য জাতির সকল কিছুকে হেয় জ্ঞান জাতির মধ্যে দেখা যায়। জাতির মধ্যে এক অন্ধ আবেগের সৃষ্টি হয়। একেই বলে উগ্র জাতীয়তাবাদ। এর ফলেই জাতির মনে নিজের সম্পর্কে গর্ববোধ এবং অপর জাতির প্রতি ঘৃণা জন্মায়। দেশবাসীর সুস্থ চেতনা দূষিত হয়। এক ধরনের উন্মত্ততা দেখা দেয়। এইভাবে বিকৃত রূপ ধারণ করে জাতীয়তাবাদ বিভিন্ন জাতির মধ্যে হিংসা, ঘৃণা ও বিদ্বেষের সম্পর্ক সৃষ্টি করে। তার ফলে মানবসভ্যতা সংকটের সম্মুখীন হয়।

(খ) সাম্রাজ্যবাদের আশংকা: উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রবণতার তাড়নায় অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী জাতিগুলি দুর্বল জাতিগুলিকে হেয় জ্ঞান করে পদানত করতে প্রয়াসী হয়। এইরকম জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রগুলি ভাবতে শুরু করে যে পৃথিবীর অন্যান্য জাতির উপর প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব কায়েম করার স্বাভাবিক অধিকার তাদের আছে। জাতীয়তাবাদ তখন আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে। এবং এই শক্তি তখন নুতন নুতন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কালক্রমে দুর্বল রাষ্ট্রসমূহ সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের উপনিবেশে পরিণত হয়। এইভাবে উগ্রজাতীয়তাবাদ সাম্রাজ্যবাদের জন্ম দেয়। প্রকৃতপক্ষে জাতির আত্মস্বার্থ ও অহংবোধ থেকে এই সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্টি হয়। অন্য জাতিকে পদানত করে নিজেদের জাতীয় গরিমা ও মহত্ত্ব প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা থেকে সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্টি হয়। যুদ্ধ জয় ও সাম্রাজ্য বিস্তারের মাধ্যমে জাতীয় শৌর্যবীর্য পরিপূর্ণতা লাভ করে বলে মনে করা হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে উগ্র জাতীয়তাবাদের চরম পরিণতি হিসাবে সামরিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্টি হয়। ল্যাস্কির মতে ‘ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে জাতীয়তাবাদ সাম্রাজ্যবাদে রূপান্তরিত হয়’ (“As power extends, nationalism becomes transformed into imperialism.”)। দ্বিতীয় মহাসমরের সময় হিটলার জার্মান জাতিকে বিকৃত ও উগ্র জাতীয়তাবাদের দ্বারা উদ্দীপ্ত করে তাঁর সাম্রাজ্যবাদী নীতিকে বাস্তবে রূপায়িত করতে চেষ্টা করেছিলেন। এই উগ্র জাতীয়তাবাদের দ্বারা উম্মত্ত জাতিগুলিই বিশ্বে বারে বারে যুদ্ধের আবহাওয়া সৃষ্টি করেছে। জাতিকে বিকৃত ও উগ্র জাতীয়তাবাদের দ্বারা উদ্দীপ্ত করে তাঁর সাম্রাজ্যবাদী নীতিকে বাস্তবে রূপায়িত করতে চেষ্টা করেছিলেন। এই উগ্র জাতীয়তাবাদের দ্বারা উন্মত্ত জাতিগুলিই বিশ্বে বারে বারে যুদ্ধের আবহাওয়া সৃষ্টি করেছে।

(গ) অন্যায়ের উৎস: উগ্র জাতীয়তাবাদের দ্বারা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ উন্মত্ত হয়। তারা প্রথমে দুর্বল রাষ্ট্রগুলির আর্থনীতিক ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তার করে। তারপর প্রশাসনিক ও রাজনীতিক ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব কায়েম করে। এইভাবে ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতিকে এইসব ঔপনিবেশিক শক্তি গ্রাহাই করে না। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি অসভ্য ও অনুন্নত মানুষকে সভ্য ও উন্নত করার মহান আদর্শ ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের কথা জোর গলায় প্রচার করে। হিটলার একমাত্র আর্য জাতি হিসাবে জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্ব এবং অন্য সকল জাতির উপর জার্মানদের আধিপত্য করার অধিকারের কথা বলেছেন। ভারতীয়দের শিক্ষিত ও সভ্য করার মহান দায়িত্বের কথা ইংরাজরা প্রচার করেছে। এই সব অন্যায় ও অমঙ্গলের উৎস হল উগ্র জাতীয়তাবাদ। ইউরোপের এই সাম্রাজ্যবাদী জাতীয়তাবাদকে বঙ্কিমচন্দ্র ‘ঘোরতর পৈশাচিক পাপ’ বলে তীব্র সমালোচনা করেছেন। রুশ চিন্তাবিদ সোলোভেব (Vladimir Solovyev ) -এর মতানুসারে ‘জাতীয়তাবাদ উগ্র হলে জাতিকে বিনষ্ট করে, কারণ তখন সে নিজেকে পরিণত করে মানবতার শত্রুতে। তিনি বলেছেন: “In its extreme form it destroys a nation for it makes the enemy of mankind.”

(ঘ) অগণতান্ত্রিক: জাতীয়তাবাদের এই উগ্র, হিংস্র ও বীভৎস প্রকাশ গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা ও সমস্ত মানবিক চেতনার পরিপন্থী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় ‘জাতীয়তাবাদ সভ্যতার সংকট স্বরূপ’ (“Nationalism is a menace to civilisation.’)। আর এক দিক থেকেও জাতীয়তাবাদের অ-গণতান্ত্রিক প্রকৃতি প্রকাশ পায়। জাতীয়তাবাদের সারকথা হিসাবে জাতীয় স্বার্থের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বলা হয় যে ব্যক্তিস্বার্থের উপরে জাতীয় স্বার্থ প্রতিষ্ঠিত এবং এই জাতীয় স্বার্থের পরিপোষক হিসাবে রাষ্ট্র তার ভূমিকা পালন করে থাকে। অর্থাৎ জাতীয়তাবাদী বক্তব্য অনুসারে ব্যক্তিস্বার্থকে অবহেলা করা হয়। অথচ গণতন্ত্র বা উদারনীতিবাদে ব্যক্তিস্বার্থের উপর জোর দেওয়া হয়।

(ঙ) বিশ্বশান্তির বিরোধী: উগ্র জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিক শক্তির পক্ষে ক্ষতিকর। এইরকম জাতীয়তাবাদ সর্বক্ষেত্রে স্বদেশ ও স্বজনের দাবিকে অগ্রাধিকার দেয়। ন্যায়-অন্যায়, যুক্তি ও আলাপ-আলোচনাকে অস্বীকার করা হয় এবং সর্বপ্রকার বিরোধ মীমাংসার জন্য যুদ্ধের পথ গ্রহণ করা হয়। আত্মগরিমা প্রতিষ্ঠাই জাতির মহৎ লক্ষ্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এবং তারজন্য যুদ্ধ ও বলপ্রয়োগের নীতিকে লক্ষ্য সাধনের একমাত্র উপায় হিসাবে গ্রহণ করা হয়। বস্তুত উগ্র জাতীয়তাবাদ ও যুদ্ধ পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। উগ্র জাতীয়তাবাদের যুদ্ধোন্মাদ ও ধ্বংসাত্মক লীলার ভয়ঙ্কর দৃষ্টান্ত হিসাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানী, জাপান ও ইতালীর বিধ্বংসী ভূমিকার কথা স্মরণ করা যায়। এই যুদ্ধবাদী প্রবণতা বিশ্বশান্তির ঘোরতর শত্রু। জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার বিরোধী।

(চ) সংকীর্ণতার সৃষ্টি করে: বিকৃত জাতীয়তাবাদ অন্ধ আবেগ ও উন্মাদনার সৃষ্টি করে। তার ফলে দেশ ও জাতির সবকিছুকে একটি বাঁধাধরা নির্দিষ্ট পথে পরিচালিত করা হয়। এইভাবে বাইরের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতা-সংস্কৃতির আলোেক প্রবেশের পথ অবরুদ্ধ হয়। জাতির স্বকীয়তা সংরক্ষণের অত্যুগ্র বাসনা বিচ্ছিন্ন বর্বরতায় পরিণত হয়। রাজনীতিক চিন্তা-চেতনার দিগন্তকেও জাতীয়তাবাদ সংকীর্ণ করতে উদ্যোগী হয়। এই সমস্ত কিছুর ফলে জাতির সর্বাঙ্গীণ ও বৈচিত্র্যময় উন্নতি ব্যাহত হয়। মানবজাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতির ও মানবিক গুণাবলীর স্বাধীন ও স্বচ্ছন্দ বিকাশের পথে উগ্র জাতীয়তাবাদ বাধার সৃষ্টি করে। বস্তুত বিকৃত জাতীয়তাবাদ মানবসভ্যতার সৃজনশীল বিকাশের পথকে প্রতিহত করে। এর উদ্দেশ্য হল পরজাতি বিদ্বেষ ও সামরিকতাবাদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সভ্যতা-সংস্কৃতি ও মননশীলতা গড়ে তোলা। এই উদ্দেশ্যেই নাৎসি নেতা হিটলার নাৎসিবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে জার্মান জাতির সভ্যতা-সংস্কৃতি, শিক্ষা-দীক্ষা প্রভৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছিলেন। এ জাতীয় উদ্যোগ মানবজাতির সর্বাত্মক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ বিকাশকে বিপন্ন করে তোলে। বস্তুত উগ্র জাতীয়তাবাদের আর্থ-রাজনীতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক প্রকাশ বিশ্বশান্তি ও সৌভ্রাতৃত্বের পরিপন্থী। প্রকৃতপক্ষে বিকৃত জাতীয়তাবাদ হল জাতির এক বাতিকগ্রস্ত রোগবিশেষ।

(ছ) আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সৃষ্টি: জাতীয়তাবাদ রাজনীতিক স্বাধীনতার তত্ত্বের উপর অতিমাত্রায় গুরুত্ব আরোপ করে। এই কারণে জাতীয়তাবাদী চেতনার ভিত্তিতে জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারনীতি জোরদার হয়। কিন্তু এই নীতির ব্যাপক প্রয়োগ ঘটলে বিশ্বজুড়ে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের সৃষ্টি হবে। তখন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের রাষ্ট্রসমূহের রাজনীতিক বিন্যাস বিপর্যস্ত হবে। এবং পরিবর্তিত রাজনীতিক পরিস্থিতিতে বহু ও বিভিন্ন নতুন প্রকৃতির সমস্যার সৃষ্টি হবে।

(জ) অপদার্থ শাসকদের হাতিয়ার: অনেক ক্ষেত্রে দেশের শাসকশ্রেণী নিজেদের ব্যর্থতা ও অসামর্থ্যকে আড়াল করার জন্য সংকীর্ণ স্বাদেশিকতার উন্মাদনা সৃষ্টির চেষ্টা করে। দেশ ও দেশবাসীর সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে ব্যর্থতাকে ঢাকার উদ্দেশ্যে সরকার যুদ্ধের আশঙ্কা ও আতঙ্ক সৃষ্টির ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। সাধারণত উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রসারের মাধ্যমে ব্যর্থ শাসকরা এই অপচেষ্টার সামিল হন। অর্থাৎ অপদার্থ শাসকরা তাঁদের নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থ রক্ষার তাগিদে উগ্র জাতীয়তাবাদকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেন।

(ঝ) প্রকৃত প্রস্তাবে ধনতন্ত্রের বিকাশের পর্যায়েই জাতীয়তাবাদ বিকৃত রূপ ধারণ করে। সামন্ততত্ত্বের বিরুদ্ধে ধনতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার পর্বে বুর্জোয়াশ্রেণী জাতীয়তাবাদকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে। হায়েস এর মতানুসারে বিকৃত জাতীয়তাবাদ হল কৃত্রিম, ভণ্ড জাতিপ্রেম। তিনি তাঁর Nationality and Patriotism শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “Nationalism is artificial and it is far from ennobling, in a word it is patriotic snobbery.” জাতীয়তাবাদ বিকৃত হয়ে সংকীর্ণ স্বাদেশিকতায় পরিণত হলে তা সমাজ ও সভ্যতার শত্রুতে পরিণত হয়।


জাতীয়তাবাদের মূল্যায়ন

সামগ্রিক আলোচনা থেকেই এটুকু পরিষ্কারভাবে প্রতিপন্ন হয় যে, আদর্শ জাতীয়তাবাদ মানবসভ্যতার সমৃদ্ধি ও উন্নতিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কিন্তু সংকীর্ণ বা উগ্র জাতীয়তাবাদ সাম্রাজ্যবাদে রূপান্তরিত হয় এবং মানবসভ্যতার সংকট সৃষ্টি করে। সুতরাং আদর্শ জাতীয়তাবাদ তার কল্যাণকর প্রভাবের ক্ষিতে একটি মহান রাষ্ট্রনীতিক আদর্শ হিসাবে গণ্য হয়। আর উগ্র বা বিকৃত জাতীয়তাবাদ তার সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মানবসভ্যতার শত্রু হিসাবে তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়। প্রকৃত জাতীয়তাবাদের মধ্যে এর গুণাবলী এবং বিকৃত জাতীয়তাবাদের মধ্যে এর ত্রুটিসমূহ নিহিত আছে। যথার্থ দেশপ্রেম জাতীয়তাবাদের আদর্শের মাধ্যমে মূর্ত হলে বিশ্বসভ্যতা এবং মানবতার পক্ষে তা আশীর্বাদস্বরূপ। হায়েস তাঁর Nationality and Patriotism শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Nationalism when it becomes synonymous with purest patriotism will prove a unique blessing to humanity and to the world.”


জাতীয়তাবাদের মার্কসীয় ব্যাখ্যা

বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ:

আবার মার্কসবাদীরা জাতীয়তাবাদকে বুর্জোয়া ও প্রলেতারীয়—এই দু’ভাগে বিভক্ত করে থাকেন। বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থায় উৎপাদনের উপাদানসমূহ বুর্জোয়া শ্রেণীর হাতে থাকে। এই শ্রেণীই গণসংযোগের মাধ্যমগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে। এইভাবে এই শ্রেণী সামাজিক, রাজনীতিক, আর্থনীতিক প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রে নিজেদের শ্রেণীকর্তৃত্ব অব্যাহত রাখে। মার্কসবাদীরা এই বুর্জোয়া সমাজের জাতীয়তাবাদকে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ হিসাবে অভিহিত করেন; বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ হল বুর্জোয়া শ্রেণীর হাতে একটি আর্থ-রাজনীতিক এবং কূটনীতিক ও সামরিক হাতিয়ার। নিজেদের শ্রেণী স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে বুর্জোয়া শ্রেণী জাতীয় রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে। তারা নিজেদের শ্রেণী-স্বার্থেই সমগ্র জাতির চরম আনুগত্যের কথা বলে। বুর্জোয়া শ্রেণীর হাতে স্বাদেশিকতা সংকীর্ণ শ্রেণীস্বার্থ সংরক্ষণের হাতিয়ারে পরিণত হয়। বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ কখনই এই শ্রেণীর আর্থনীতিক ও সম্পত্তি-স্বার্থকে অতিক্রম করে না। তাছাড়া পরজাতির প্রতি বিরূপ মনোভাব সৃষ্টির ব্যাপারে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের সাহায্যে শাসক শ্রেণী নিজেদের সভ্যতা-সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসাবে নিজেদের প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে। এবং এই পথে পররাজ্য গ্রাস করার অভিসন্ধিকে কার্যকর করার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়।

প্রলেতারীয় জাতীয়তাবাদ:

অপরপক্ষে সর্বহারা শ্রেণীর প্রাধান্য ও কর্তৃত্ব সমাজে প্রতিষ্ঠিত হলে সর্বহারা শ্রেণী সামাজিক সংযোগ সাধনের মাধ্যমগুলিকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে। এইভাবে এই ধরনের সমাজে যে জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয় তা হল প্রলেতারীয় জাতীয়তাবাদ। মার্কসবাদীদের মতানুসারে এই ধরনের জাতীয়তাবাদ মানব সভ্যতার পরিপন্থী নয়, এ হল আন্তর্জাতিকতা, বিশ্বশান্তি ও মানবসভ্যতার অনুপন্থী। এই জাতীয়তাবাদ সকল দেশ ও জাতির স্বাধীন বিকাশের সমানাধিকারে বিশ্বাসী। এইভাবে সকল জাতির অভাব অভিযোগ মিটে গেলে দুনিয়ার সকল জাতির মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপিত হবে। ‘কমিউনিস্ট ইস্তেহার’ (Communist Manifesto)-এ মার্কস ও এঙ্গেল্স বলেছেন: “In proportion as the antagonism between classes within the nation vanishes, the hostility of one nation to another will come to an end.”

প্রকৃত প্রস্তাবে জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে মার্কসবাদীদের বক্তব্য বেশ জটিল; মোটেই স্পষ্ট নয়। তাই মিলিব্যাও (Miliband) মন্তব্য করেছেন: “Nationalism has proved a much more enduring and therefore much more difficult problem to confront than the early Marxist thought likely.”

উপসংহার: প্রকৃত প্রস্তাবে জাতীয়তাবাদের দ্বিবিধ প্রকাশ পরিলক্ষিত হয়। একটি হল জাতীয়তাবাদের সৃজনশীল ও গঠনমূলক দিক এবং আর একটি হল জাতীয়তাবাদের উগ্র, বিকৃত ও ধ্বংসাত্মক দিক। ঊনবিংশ শতাব্দীতে জাতীয়তাবাদ বিশেষত য়ুরোপের বিভিন্ন দেশে রাজনীতিক স্বাধীনতা অর্জন এবং জাতীয় ঐক্য সাধনের ক্ষেত্রে এক গভীর অনুপ্রেরণার সৃষ্টি করেছিল। জাতীয়তাবাদী চেতনা পরাধীন জাতিসমূহের মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামে আগুন জ্বালিয়েছে। গ্রীসের স্বাধীনতা অর্জন; এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বহু পরাধীন দেশের স্বাধীনতা লাভ; জার্মানী ও ইতালীর ঐক্য সাধন প্রভৃতি জাতীয়তাবাদের সৃজনশীল প্রকৃতিরই প্রকাশ। তবে জাতীয়তাবাদের এই গঠনমূলক দিকটি কেবলমাত্র জাতির রাজনীতিক স্বাধীনতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। জাতীয়তাবাদ আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রগতির ক্ষেত্রে একটি উদ্দীপক হিসাবে কাজ করে। জাতীয়তাবাদ প্রত্যেক মানবগোষ্ঠীর স্বকীয় সত্তা, জাতীয় বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য বিকাশের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এইভাবে মানবসভ্যতা সমৃদ্ধশালী ও বৈচিত্র্যপূর্ণ হয় এবং অগ্রগতি লাভ করে। প্রতিটি জাতির আত্মবিকাশের ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদের অনুকূল ভূমিকা অনস্বীকার্য। জাতীয়তাবাদ উদারনীতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে সুদৃঢ় ও শক্তিশালী করে এবং জনসাধারণের মধ্যে হতাশাকে দূর করে এবং নতুন আশা ও চেতনার সঞ্চার করে। অপরদিকে জাতীয়তাবাদ উগ্র ও বিকৃত হয়ে পড়লে তার ধ্বংসাত্মক রূপ যে কত ভয়াবহ হতে পারে তাও আজ আর অজানা নয়।


জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

জাতীয়তাবাদের ইতিহাস নাতিদীর্ঘ: জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কিত আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই আলোচনা অপরিহার্য। কারণ এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি যথাযথভাবে পর্যালোচনা করা যাবে এবং এই রাজনীতিক মতাদর্শের সঠিক মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে। উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের ধারায় বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিক উপাদান জাতীয়তাবাদী চেতনাকে প্রভাবিত করেছে। এই সমস্ত উপাদান সম্পর্কে অবহিত হওয়া আবশ্যক। তা না হলে এ বিষয়ে ধারণা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। যাইহোক জাতীয়তাবাদের উৎপত্তির ইতিহাস নাতিদীর্ঘ। রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তাজগতে এই রাজনীতিক আদর্শের আবির্ভাবের ঘটনা বেশী দিনের নয়। জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণার জোরদার আলোচনা বলতে গেলে অষ্টাদশ শতাব্দীতে শুরু হয়েছে। অর্থাৎ পরিপূর্ণ অর্থে এই আলোচনার বয়স তিন শতাব্দীর। তবে এই ধারণার অস্পষ্ট পরিচয় আগেও পাওয়া গেছে। এমনকি চতুর্দশ শতাব্দীতে এরকম কথাবার্তা লক্ষ্য করা যায়। আবার ম্যুর (Muir) প্রমুখ অনেকের অভিমত হল যে, জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রথম প্রকাশিত হয়েছে ইংল্যাণ্ডে। ফ্রান্সকে অধিকার করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ শক্তির উদ্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে ফ্রান্সেও পঞ্চদশ শতকে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে।

আগেকার দিনে এক একটি দেশকে এক একটি ‘রাজ্য’, নৃপতির প্রশাসনিক এলাকা বা রাজার রাজ্যক্ষেত্র হিসাবে বিবেচনা করা হত। রাজার রাজ্যের অধিবাসীদের বলা হত ‘প্রজা’ (subjects)। প্রজাদের কোন রকম জাতীয়তার পরিচয় বা স্বীকৃতি ছিল না; ছিল না দেশপ্রেমের ব্যঞ্জনা। শাসকের প্রতি বা শাসক‌ পরিবারের প্রতি আনুগত্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকাশিত হত প্রজাদের রাজনীতিক পরিচিতি। কিন্তু ১৭৮৯ সালে ষোড়শ লুইয়ের বিরুদ্ধে ফ্রান্সের বিপ্লবীরা মাথা তুলে দাঁড়ায়। ফরাসী বিপ্লবীরা জনগণের নামে বিপ্লবের সামিল হয়। ফরাসী জনগণকে ফরাসী জাতি (French Nation) হিসাবে বিচার-বিবেচনা করা হয়। জনপ্রিয় সরকারের বা স্বশাসনের নতুন নীতি এবং ফরাসী দার্শনিক জ্যাঁ জ্যাক রুশো (Jean-Jacques‌Rousseau)-র ধ্যান-ধারণা ফরাসী বিপ্লবীদের অনুপ্রাণিত করে। এই কারণে বলা হয় যে, ফরাসী বিপ্লবের প্রাক্কালে জাতীয়তাবাদী ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। ১৭৮৯ সালেই প্রথম ‘জাতীয়তাবাদ’ কথাটি ছাপার অক্ষরে ব্যবহার করা হয়। জাকোবিয়ান বিরোধী ফরাসী যাজক অগাসটিন বারুয়েল (Augustin Barruel) সর্বপ্রথম ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটি ছাপার অক্ষরে ব্যবহার করেন।

ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে জাতীয়তাবাদ একটি রাজনীতিক মতাদর্শ বা আন্দোলন হিসাবে ব্যাপকভাবে স্বীকৃতি লাভ করে। ১৮৪৮ সালে ইউরোপ জুড়ে যে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে, তার অন্যতম উল্লেখযোগ্য উপাদান ছিল জাতীয়তাবাদ। অতঃপর দু’শতাব্দীর অধিককাল ধরে জাতীয়তাবাদ সফল ও প্রাধান্যকারী একটি রাজনীতিক দর্শন হিসাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিকশিত হয়। এই সময় কালের পরিধিতে এই রাজনীতিক মতাদর্শ মানবসভ্যতার ইতিহাসকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত করেছে। প্রকৃত প্রস্তাবে জাতীয়তাবাদ হল একটি গণতান্ত্রিক ও বৈপ্লবিক ধারণা। এই রাজনীতিক মতাদর্শের সুবাদে এই ধারণা প্রতিফলিত হয়েছে যে ফ্রান্সের মানুষ রাজার প্রজা নয়, ফ্রান্সের নাগরিক। জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণা ফ্রান্সের সীমানা অতিক্রম করে ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। ইতালী ও জার্মানীতে জাতীয়তাবাদের বিশেষ অভিব্যক্তি পরিলক্ষিত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে লাতিন আমেরিকায় জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণার বিকাশ ও বিস্তার ঘটে।

জাতীয়তাবাদের জন্য যাবতীয় উৎসাহ-উদ্দীপনা উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণীসমূহের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কারণ সাংবিধানিক সরকার ও জাতীয় ঐক্যের ধ্যান-ধারণার ব্যাপারে মধ্যবিত্ত শ্রেণীসমূহের বিশেষ আগ্রহ আকর্ষণ ছিল। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জাতীয়তাবাদী আন্দোলসমূহ জাতীয় সংহতি ও স্বাধীনতার আশা-আকাঙ্ক্ষাকে সদা সজীব রেখেছিল। কিন্তু জাতি-রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়াকে সার্থক ও সফল করার সামর্থ্য এককভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণীসমূহের ছিল না।

নবজাগরণের অধ্যায়ে জাতীয়তাবাদের সূত্রপাত: মধ্যযুগীয় সমাজ জীবনে চরম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে শক্তিশালী রাজাকে কেন্দ্র করে জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। বিভিন্ন রাষ্ট্রে রাজার প্রতি আনুগত্য জাতীয় চেতনার সৃষ্টি করে। ইতিহাসের এই পর্যায়ে ‘নবজাগরণ’ (Renaissance) -এর ঢেউ ইউরোপকে প্লাবিত করে। এই নবজাগরণের আলোকে সুস্পষ্ট জাতীয় চেতনার অভ্যুত্থান ঘটে। জাতীয়তাবাদের উদ্ভবের ইতিহাস নবজাগরণের যুগে নিহিত। বার্নস (C. D. Burns) তাঁর Political Ideals শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “It had its origin at the Renaissance.” জাতীয়তাবাদী ধারণার সঞ্চারের ক্ষেত্রে রেঁনেসা বা নবজাগরণের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বার্নস-এর অভিমত অনুসারে জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি হয়েছে নবজাগরণ এবং নবজাগরণ-সার্বভৌমিকতা (Renaissance Sovereignty) থেকে। এ বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই যে জাতীয়তাবাদী চেতনার আবির্ভাব ঘটেছে জাতীয় রাষ্ট্র ও তার সার্বভৌমিকতার ধারণা থেকে। সর্বপ্রথম সার্বভৌমিকতা সম্পর্কিত এক ব্যাপক ধারণার সৃষ্টি হয় নবজাগরণের যুগে। এই সময় রাজতন্ত্রের ভিত্তিতে একটি স্বাধীন সরকারের কথা বলা হয়। নবজাগরণের যুগে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী মানসিকতার সৃষ্টি হয়। এবং স্বীয় স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে প্রতিটি মানবগোষ্ঠীকে ওয়াকিবহাল করা হয়। যে যার ইচ্ছা অনুসারে প্রত্যেক মানবগোষ্ঠীকে তার আত্মবিকাশের সঙ্গে অধিকার প্রদানের কথা বলা হয়। বার্নস এর অভিমত অনুসারে সার্বভৌমত্বের যে ধারণা নবজাগরণের যুগে সৃষ্টি হয় তাকে কোন জাতীয় আদর্শ বলা যায় না। এ হল প্রকৃতপক্ষে একটি রাষ্ট্রীয় আদর্শ। তবে এই সার্বভৌমত্বের ধারণার মধ্যেই আধুনিক জাতীয়তাবাদের ধারণা অন্তর্নিহিত ছিল। বার্নস বলেছেন: “Renaissance sovereignty therefore was a state ideal rather than a national ideal, but it has within it implicitly the later ideal of modern nationalism.”

বার্নসের মত: এই সময় চার্চ বা পোপের কর্তৃত্বের পরিবর্তে রাজার নেতৃত্বে ‘জাতীয় রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের’ সৃষ্টি হয়। রাজন্যবর্গের কর্তৃত্ব ও প্রাধান্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রজাসাধারণের অকুণ্ঠ আনুগত্য লাভের উদ্দেশ্যে দেশপ্রেম, রাজানুগত্য প্রভৃতি পবিত্র কর্তব্যের কথা বলা হয়। এর ফলে জন মনে যেমন জাতীয়তাবোধের সৃষ্টি হয় তেমনি রাজার চূড়ান্ত কর্তৃত্ব বা রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতা সুদৃঢ় হয়। বার্নস-এর মতানুসারে নবজাগরণপ্রসূত সার্বভৌমিকতা এবং বৈপ্লবিক অধিকারের সমন্বয়ে জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয়। তিনি বলেছেন: “Out of Renaissance Sovereignty combined with revolutionary Rights comes Nationalism.” এর ফলে স্থায়ী সংগঠিত জনসমাজ ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন হয় এবং একটি জাতীয় চরিত্র লাভ করে।

স্বতন্ত্র জাতি সত্তার ধারণা: রোমের সঙ্গে ইংল্যাণ্ডের ধর্মীয় সংঘর্ষ ও ফ্রান্সের সঙ্গে শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধ—এই দু’টি ঘটনা ব্রিটিশদের মনে তাদের স্বতন্ত্র জাতিত্ব সম্পর্কে ধারণার সৃষ্টি করে। আবার ফ্রান্সের উপর ইংল্যাণ্ডের কর্তৃত্ব কায়েমের উদ্যোগেও ফরাসীদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়। ইটালীর দার্শনিক মেকিয়াভেলী (N. Machiavelli) ষোড়শ শতাব্দীতে ইটালীর অধিবাসীদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী আদর্শ প্রচার করেন। লুথার (Martin Luther)- এর নেতৃত্বে ধর্মসংস্কারের আন্দোলন (Reformation Movement) জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণা ও রাজার প্রাধান্যকে প্রতিষ্ঠিত করে। ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স, স্পেন, সুইজারল্যাও, হল্যান্ড প্রভৃতি দেশ জাতীয় রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

পোল্যাণ্ডের বিভক্তিকরণ এবং আধুনিক অর্থে জাতীয়তাবাদের বিকাশ: রাজনীতিক আদর্শ হিসাবে জাতীয়তাবাদ হল জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের চরম পরিণতি। অর্থাৎ প্রত্যেক জাতীয় জনসমাজের নিজস্ব শাসনব্যবস্থার ধারণাই হল জাতীয়তাবাদের রাজনীতিক আদর্শ। এই অর্থে জাতীয়তাবাদ পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয় অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে। পোল্যান্ডের বিভক্তিকরণ (১৭৭২) এর ঘটনা থেকে আধুনিক অর্থে জাতীয়তাবাদের বিকাশের অধ্যায়ের সূচনা ঘটে। এই ঘটনার আগে জাতীয়তার অনুভূতি এমন প্রবলভাবে প্রতিপন্ন হয়নি। এই কারণে ল্যাস্কি তাঁর A Grammar of Politics শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Modern nationalism is boardly speaking, hardly older than the first partition of Poland.” ইতিহাসে নির্লজ্জ ও নিষ্ঠুর এক স্বৈরাচারের বীভৎস প্রকাশ ঘটে। নিরপরাধ এক জনসমাজের অধিকার অপহৃত হয় এবং আন্তর্জাতিক ন্যায়-নীতির নিয়ম অস্বীকৃত হয়। চরম রাজতন্ত্রের স্বৈরাচার এবং দুর্বল জনসমাজের উপর নির্যাতন ও শোষণপীড়ন স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন জনসমাজকে সতর্ক ও সচেতন করে। এইভাবে ইউরোপে জাতীয় জনসমাজের অধিকার বিষয়ক মতবাদের উদ্ভব হয়। অ্যাকটন (Lord Acton) মন্তব্য করেছেন: “This most revolutionary act of the old absolutism awakened the theory of nationality in Europe.”

ফরাসী বিপ্লব ও জাতীয়তাবাদ: বার্নস (C.D. Burns)-এর মতানুসারে, আধুনিক অর্থে জাতীয়তাবাদ বলতে যা বোঝান হয়, তা ফরাসী বিপ্লব (১৭৮৯)-এর মাধ্যমে পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ফরাসী বিপ্লবের পর জাতীয়তাবাদের ধারণা সুস্পষ্ট রূপ লাভ করে। জাতীয়তাবাদের ক্রমবিবর্তনের ধারায় ফরাসী বিপ্লবের অবদান অনস্বীকার্য। ফরাসী বিপ্লবের সমসাময়িক দার্শনিকগণ জনগণের অধিকার, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমিকতার বৈপ্লবিক তত্ত্ব প্রচার করেন। এর ফলে ফরাসীদের মধ্যে স্বদেশপ্রীতি বা জাতীয়তাবোধ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ফরাসী বিপ্লবের গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা ও জাতীয়তাবাদী আদর্শ ক্রমশ ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় জাতীয়তাবাদী গণ-আন্দোলনের সৃষ্টি করে।

বিভিন্ন দেশে জাতীয়তাবাদী ধারণার সৃষ্টি: বিভিন্ন দেশের অধিবাসীদের মধ্যে স্বতন্ত্র জাতীয় সত্তার সৃষ্টি হতে থাকে। জার্মান দার্শনিক ফিক্‌টে (Fichte) জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলে তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী ধারণার সৃষ্টি করেন। তিনি ১৮০৭ সালে জার্মান জাতির উদ্দেশ্যে একটি ঘোষণা করেন। এই ঘোষণায় তিনি স্বাদেশিকতা এবং জাতির জন্য আত্মত্যাগের কথা বলেন। ম্যাৎসিনি (Mazzini) জাতীয়তাবাদী আদর্শ প্রচার করে ইটালীকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। লর্ড মর্লে (Lord Morley) বলেছেন: “Nationalism from instinct become idea from idea abstract principle, then fervid prepossession; ending where it is today, in dogma, whether accepted or evaded.” এইভাবে নবজাগরণের যুগে যে জাতীয়তাবোধের সৃষ্টি হয়, ফরাসী বিপ্লব-প্রসূত গণতান্ত্রিক চেতনা এবং বৈপ্লবিক অধিকার ও স্বাধীনতাবোধের ভিত্তিতে তা পরিণতি লাভ করে। ম্যাৎসিনি বললেন: “Country is not a territory, it is the ‘idea’ to which it gives birth.” তিনি আরও বললেন: “United Italy can only be founded by the Italian people.” একই সঙ্গে গ্যারিবন্ডি (Gariboldi) ও কাভুর (Cavour) -এর উদ্যোগে ইটালীর ঐক্যসাধন ও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা ঘটে। জাতীয়তাবাদের অনুপ্রেরণায় জার্মানীতেও জাতীয় ঐক্য সাধিত হয়। একইভাবে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যে গ্রীস, বেলজিয়াম, রুমানিয়া ও সার্বিয়া স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। অর্থাৎ এই সময় (ঊনবিংশ শতাব্দী) জাতীর ঐক্যসাধন এবং রাজনীতিক স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণা বিকশিত হয়।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে জাতীয়তাবাদ প্রকৃত প্রস্তাবে এক ধরনের জনপ্রিয় আন্দোলনে পরিণত হয়। জনপ্রিয় আন্দোলন হিসাবে জাতীয়তাবাদের চেহারা-চরিত্রে পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। আগে উদারনীতিক ও প্রগতিমূলক আন্দোলনের সঙ্গে জাতীয়তাবাদ সংযুক্ত ছিল। কালক্রমে রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিবিদরা জাতীয়তাবাদের রাশ নিজেদের হাতে নিয়ে নিতে শুরু করে ক্রমবর্ধমানভাবে। গণ-স্বাক্ষরতা, প্রাথমিক শিক্ষার ব্যাপক বিকাশ ও বিস্তার, জনপ্রিয় সংবাদপত্রসমূহের প্রসার প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতি পরিমণ্ডলের পরিবর্তন ঘটে। জাতীয় পতাকা; জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় শিক্ষা-সাহিত্য; দেশাত্মবোধক কবিতা, গান; জাতীয় বীর চরিত্রের পূজা প্রভৃতির ব্যাপক প্রসার ঘটে। এ রকম এক পরিবর্তিত পরিমণ্ডলে জাতীয়তাবাদ গণ-রাজনীতি ভাষায় রূপান্তরিত হয়। অতীতের জাতীয় গৌরব ও সামরিক বিজয়ের ইতিহাসের স্মৃতি দেশাত্মবোধক উন্মাদনার সৃষ্টি করে। রাজনীতিক স্বাধীনতা বা গণতন্ত্রের সদর্থক সম্ভাবনা এই উন্মাদনার সৃষ্টি করতে পারে না। এই সময় শ্রমিক শ্রেণী ক্রমশ শক্তিশালী হতে থাকে। এই শ্রমিক শ্রেণীকে জাতীয়তাবাদ একটি জাতির মধ্যে সুসংহত করে। জাতীয়তাবাদ এই ভাবে বিদ্যমান সামাজিক কাঠামোকে বজায় রাখে। আবার এই সময় সমাজতন্ত্রবাদও নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে হাজির হয়। সমাজতন্ত্রবাদ আন্তর্জাতিক শ্রমিকশ্রেণীর সংহতি ও সামাজিক বিপ্লবের ধারণার বিকাশ ও বিস্তার ঘটায়। এ রকম এক প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জাতীয়তাবাদ, সামাজিক সংহতি, শৃঙ্খলা ও স্থায়িত্বের সহায়ক ও সক্রিয় শক্তি হিসাবে প্রতীয়মান হয়। জনপ্রিয় জাতীয়তাবাদের এই পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলের মধ্যে ঔপনিবেশিক বিস্তারের নীতি অধিকতর পরিপুষ্ট হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর সত্তরের ও আশির দশকে ঔপনিবেশিকতাবাদী সম্প্রসারণ বিশেষভাবে বেগবান হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ইউরোপীয় নিয়ন্ত্রণাধীনে চলে আসে। আবার এই জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অবিশ্বাস ও বিরোধিতার মানসিকতাকে পরিপুষ্ট করে। তার ফলে ১৯১৪ সালে বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। অ্যান্ড্রু হেউড তাঁর Political Ideology শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “Such nationalism became increasingly chauvinistic and xenophobic. Each nation claimed its own unique or superior qualities, while other nations were regarded as alien, untrustworthy, even menacing.”

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪) সংঘটিত হওয়ার পিছনে জাতীয়তাবাদের প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার অল্পবিস্তর অবদান ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯) বেধে যাওয়ার পিছনে বিবিধ কারণের মধ্যে জাতীয়তাবাদী প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার অস্তিত্বও অস্বীকার করা যায় না। অ্যান্ড্রু হেউড এ বিষয়ে বলেছেন: “Nationalism was a powerful factor leading to war in both 1914 and 1939. ” বিভিন্ন জাতির মধ্যে বিভিন্ন পারস্পরিক বিবাদ বিসংবাদ ও উত্তেজনার কারণে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সৃষ্টি হয়েছিল। এই বিশ্বযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট কারণগুলিকে অপসারিত করতে পারে নি। শান্তি চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে পরাজয় ও হতাশার বেদনাবিদীর্ণ অভিজ্ঞতার কারণে জন্ম নিয়েছিল তিক্ততা এবং হতাশা সম্ভৃত এক ধরনের উচ্চাশা। জার্মানী, ইতালি ও জাপানে এর বিশেষ অভিব্যক্তি পরিলক্ষিত হয়েছে। দুই বিশ্বযুদ্ধের অন্তর্বর্তী সময়ে এই সমস্ত দেশে ফ্যাসিবাদী বা কর্তৃত্ববাদী আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের নীতিকে অনুসরণ করার মাধ্যমে জাতীয় গৌরবকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী বা কর্তৃত্ববাদী শক্তিসমূহ এই সমস্ত রাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন হয়।

বিংশ শতাব্দীতে জাতীয়তাবাদ: তারপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ও ভার্সাই চুক্তি (১৯১৯) পর্যন্ত এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সংগঠিত হয়। তার ফলে ঔপনিবেশিক অঞ্চলগুলিতে মুক্তিসংগ্রাম বলিষ্ঠ রূপ ধারণ করে। ভার্সাই চুক্তির ভিত্তিতে জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠে। এই সময় জাতীয়তার ভিত্তিতে অনেক নূতন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। এরপর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে এবং পরে ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের অধিবাসীরা জাতীয়তাবাদী চরম সংগ্রামের সামিল হয়েছে। এইভাবে বিংশ শতাব্দীতে জাতীয়তাবাদের আদর্শ এক বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করেছে। এই সময় সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের আগুন চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। তারফলে বহু স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। লয়েড (Lloyd) মন্তব্য করেছেন: ‘‘In modern times it has become a faith as complex and compelling as any religious creed for which men have died or conquered.”

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তির পর কেন্দ্রীয় ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে রাষ্ট্রগঠনের প্রক্রিয়ার পরিসমাপ্তি ঘটে। প্যারিসের শান্তি সম্মেলনে সমকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন ‘জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারে’র নীতিটি তুলে ধরেন। জার্মান, রাশিয়ান ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য ভেঙ্গে যায়। ফিনল্যান্ড, পোল্যান্ড, যুগোশ্লাভিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরী প্রভৃতি আটটি নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। এই সমস্ত নতুন রাষ্ট্রকে জাতি-রাষ্ট্র (nation-state) হিসাবে অভিহিত করা হয়। বিদ্যমান জাতি বা জাতিগোষ্ঠীসমূহের ভৌগোলিক এলাকার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে এই সমস্ত জাতি-রাষ্ট্র গড়ে উঠে।

ঔপনিবেশিকতাবাদী প্রক্রিয়ার প্রভাবে রাজনীতিক কর্তৃত্ব ও আর্থনীতিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমী ধ্যান-ধারণাও প্রাচ্যের দেশগুলিতে হাজির হচ্ছিল। স্বভাবতই জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণার প্রভাব প্রতিক্রিয়াও পরিলক্ষিত হচ্ছিল। এই জাতীয়তাবাদী চেতনাই ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। বিংশ শতাব্দীতে ইউরোপের জাতীয়তাবাদ বিশ্বব্যাপী বিস্তার লাভ করে। এশিয়া ও আফ্রিকার মানুষ জাতীয়তাবাদী চেতনার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়। ঔপনিবেশিকতাবাদ বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী কালে এশিয়া ও আফ্রিকার ব্রিটিশ, ফরাসী, ডাচ্ ও পর্তুগীজ উপনিবেশগুলি ধীরে ধীরে স্বাধীনতা লাভ করে। এশিয়া ও আফ্রিকার রাজনীতিক চিত্র নতুন করে নির্ধারিত হয়।

ঔপনিবেশিকতাবাদ বিরোধী আন্দোলনের সুবাদে পশ্চিমী ধাঁচের জাতীয়তাবাদ উন্নয়নশীল দুনিয়ায় ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন রকমের নতুন ধাঁচের জাতীয়তাবাদও বিকশিত হয়। উন্নয়নশীল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাতীয়তাবাদী প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার সুবাদে বিবিধ প্রকারের আন্দোলন সংগঠিত হয়। প্রকৃতিগত বিচারে উন্নয়নশীল দুনিয়ার জাতীয়তাবাদ হল বহু পশ্চিম-বিরোধী; উদারনীতিক গণতান্ত্রিক এবং বৈপ্লবিক সমাজতান্ত্রিক মহাজাতিত্বের ধারণার বিরোধী। অপরদিকে চীন, ভিয়েতনাম ও আফ্রিকার কতকাংশে জাতীয়তাবাদ মার্কসবাদের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে পড়ে। এই সমস্ত জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণা রাজনীতিক উদ্দেশ্যের সীমানাকে অতিক্রম করে সামাজিক বিপ্লবের অন্যতম অংশ হিসাবে পরিগণিত হয়।