জলসেচ ও কৃষি প্রযুক্তি:

ড. হবস মুখিয়া মনে করেন, ঐক্যবদ্ধ সামাজিক উদ্যমের অভাব আদি-মধ্যযুগে কৃষি উৎপাদনের উপায়, পদ্ধতি ও সম্পর্কের পরিবর্তন রুদ্ধ করেছিল। কিন্তু অধ্যাপক শর্মার মতে, নানা কারণে এই যুগটি নিঃসন্দেহে ব্যাপক উৎপাদন ও কৃষি সম্প্রসারণের কাল ছিল। তাঁর মতে, এই সময় ছোটো ছোটো রাজ্যগুলির বৃহৎ রাষ্ট্রে উন্নীত হওয়ার চেতনা সক্রিয় ছিল। এজন্য প্রয়োজন ছিল একটি শক্ত কৃষিভিত্তি। নিশ্চিত কৃষি-আয় থেকে রাষ্ট্র তার কর্মীগোষ্ঠীকে ও সেনাদের প্রতিপালন করতে পারবে—এই চেতনা কৃষি সম্প্রসারণের প্রেরণা দিয়েছিল। একই সময়ে ক্ষয়িষ্ণু শহরগুলি থেকে ব্রাহ্মাণ-সহ প্রতিপত্তিশালী লোকেরা গ্রামাঞ্চলে পরিযান করত। এঁরা শাসকের কাছ থেকে জমি নিয়ে সেখানে উন্নততর প্রণালীতে কৃষি-উৎপাদনে মনোযোগী হন। স্বভাবতই কৃষি-উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।

‘অগ্রহার’ দানব্যবস্থা আপাতভাবে কৃষি সম্প্রসারণের সহায়ক ছিল—একথা অধিকাংশ পণ্ডিত সমর্থন করেন। চিনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণ সেকালে ভারতে ক্রমবর্ধমান কৃষিকর্মের সাক্ষ্য দেয়। সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে এই বৌদ্ধ পণ্ডিত ভারতে আসেন এবং উত্তর ভারতের প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ শহর ও গৌতম বুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান পরিভ্রমণ করেন। তিনি ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে কৃষিকার্যের সাথে যুক্ত থাকতে দেখেন এবং ব্যাপকহারে কৃষিনির্ভর অর্থনীতির অস্তিত্ব লক্ষ্য তাঁর বিবরণ থেকে অনুমান করা যায় যে, তখন ভারতে স্বচ্ছন্দ কৃষি-উৎপাদনের ধারা বহমান করেন। ছিল। ধান, আখ, তুলা, তিল, সরিষা, নীল, শণ ইত্যাদি খাদ্যশস্য ও অর্থকরী ফসল উৎপাদন করা হত। বস্তুত নতুন ভূমিদানব্যবস্থা (অগ্রহার) সপ্তম-অষ্টম শতকে ভারতে কৃষি সম্প্রসারণের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল।

আগেই দেখেছি যে, গুপ্ত ও গুপ্ত-পরবর্তী সময়ে তাম্রশাসন জারি করে জমি হস্তান্তরের ঘটনা যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। রাজা স্বয়ং যেমন দান করতেন, তেমনি ধনী ব্যক্তিরাও রাজার কাছে জমি ক্রয় করে ধর্মীয় ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ভূখণ্ড দান করতেন। এই সকল জমির বেশির ভাগই ছিল পতিত ও অনাবাদী। সাতবাহন, গুপ্ত ও বকাটকদের রাজ্যে পতিত জমি অগ্রহার বা নিষ্কর হিসেবে দান করার রেওয়াজ ছিল। পরবর্তী কালেও এই ধারা অব্যাহত ছিল। অন্তত উত্তর ও পূর্ব ভারতে অনাবাদী জমিই অগ্রহার হিসেবে দান করা হত। সপ্তম শতকে প্রাচীন শ্রীহট্টের এক সামন্ত প্রায় দুইশত ব্রাহ্মণকে ভূমিদান করেন। তাঁর ‘টিপেরা তাম্রশাসনে’ (আনুঃ ৬৬৫ খ্রিঃ) বার বার বলা হয়েছে যে, দান করা জমি হিংস্র পশুতে ভরা গভীর অরণ্যে অবস্থিত ছিল। সপ্তম শতকের ‘মেদিনীপুর লেখ’ থেকে জানা যায় যে, দণ্ডভুক্তি অঞ্চলের বহু অনাবাদী জমিকে ‘ব্রাহ্মণ শাসন’ গ্রামে রূপান্তরিত করা হয়। এইভাবে অষ্টম শতকে সামন্ত মরুগুনাথ ভগবান শ্রীবিষ্ণুর (অনন্তস্বামী) মন্দির নির্মাণের জন্য একটি ‘জলাট বিভূখণ্ড’ বা জলা ও জঙ্গলে পরিপূর্ণ ভূমিদান করেছিলেন। এই সকল অনাবাদী জমিকে দানগ্রহীতারা আবাদী জমিতে রূপান্তরিত করেন। ফলে অঙ্কশাস্ত্রের সাধারণ নিয়মেই দেশের কৃষিজ উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। তৎকালীন নিয়ম অনুসারে ব্রাহ্মণ, পুরোহিত বা ধর্মীয় ব্যক্তিরা দৈহিক শ্রম এবং বিশেষ করে হলকর্ষণ জাতীয় কর্মে লিপ্ত হতেন না। ফলে এই কৃষিকার্যে তাঁরা কৃষক নিয়োগ করতেন। ফলে কৃষি-উৎপাদনে কাঙ্ক্ষিত দক্ষতার অভাব ঘটত না। উন্নত কৃষি-উৎপাদনের প্রমাণ হিসেবে সেকালে বড়ো লাঙল-এর ব্যবহার ছিল বলে জানা যায়। বিগ্রহরাজের ‘হর্ষ লেখ’তে (৯৭৫ খ্রিঃ) বৃহৎ হল’ বা বড়ো লাঙলের কথা বলা হয়েছে। রণবীর চক্রবর্তী ‘মঙ্খকোষ’ গ্রন্থের ভিত্তিতে লিখেছেন যে সেকালে কাঠের তৈরি লাঙল ব্যবহার করা হত, যা গভীর গর্ত করতে সক্ষম।

উন্নত কৃষি-উৎপাদনের একটি আবশ্যিক শর্ত হল জলসেচের সুবন্দোবস্ত। বিশেষত অরণ্য অঞ্চলে বা উঁচু পতিত জমিতে চাষের ক্ষেত্রে সেচের ব্যবস্থা ছিল খুবই আবশ্যিক। আদি মধ্যযুগের প্রথমার্ধে সেচব্যবস্থার দিকেও যে নজর দেওয়া হয়েছিল, সমকালীন লেখতে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। কল্হনের ‘রাজতরঙ্গিনী’ থেকে জানা যায় যে, কাশ্মীরের কৃষি-উৎপাদন বিতস্তা নদীর খামখেয়ালিপনার জন্য ব্যাহত হত। বিতস্তার জলস্ফীতি বহুবার কৃষিজমিকে প্লাবিত করে বিপর্যয় ডেকে এনেছে। শেষ পর্যন্ত কাশ্মীরের রাজা অবস্তীবর্মনের (৮৩৬- ‘৫৫ খ্রিঃ) উদ্যোগে সূর্যনামক জনৈক প্রযুক্তিবিদ বিতস্তা নদের গতিপথ পরিবর্তন করে কাশ্মীরের কৃষি-উৎপাদনে অনিশ্চয়তার অবসান ঘটান। একই সঙ্গে জলসেচের ব্যবস্থা করেও কৃষি-অর্থনীতিকে সবল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই কাজে রাজকীয় উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতা যেমন ছিল, তেমনি ব্যক্তিগত উদ্যোগেরও অভাব ছিল না। সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিত গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, রাজা রামপাল বরেন্দ্র অঞ্চলে এক বিশাল দিঘি খনন করে জলসেচের বন্দোবস্ত করেছিলেন। চোলদের লেখাতেও অনুরূপ জলাশয় নির্মাণে জনগণের উদ্যোগের কথা উল্লেখ আছে। চোল আমলের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার সাথে জলসেচ ব্যবস্থার পরিচালনাতেও মিল দেখা যায়। এখানে সেচব্যবস্থার পরিকল্পনা, রূপায়ণ ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নির্বাচিত প্রতিনিধি সভাগুলিই প্রধান ভূমিকা পালন করত। রামশরণ শর্মা গুজরাট ও রাজস্থান অঞ্চলে ‘বাপী’ নামক একধরনের গভীর কূপ খননের কথা বলেছেন। ভূপ্রকৃতিগত কারণে এই সকল অঞ্চলে সেচখাল খনন করা সহজসাধ্য ছিল না। পরিবর্তে ‘বাপী’ নামক গভীর কূপ জমিতে সেচের কাজে বেশি উপযোগী ছিল।

জল উত্তোলনের জন্য সেকালে ‘অরঘট্ট’ নামক যন্ত্রের উল্লেখ ড. শর্মা, রোমিলা থাপার, হেমচন্দ্র চৌধুরী প্রমুখের গ্রন্থে পাওয়া যায়। হলায়ুধ-এর ‘অভিধানরত্নমালা’ গ্রন্থে অনুরূপ এক সেচযন্ত্রকেই ‘উদ্ঘাটক’ বলা হয়েছে। একটি চক্রাকার কাঠামোর গায়ে অনেকগুলি ঘটিজাতীয় পাত্র লাগিয়ে নিচু থেকে জল উত্তোলন করা যেত। রাজস্থানের মান্দোরের দুটি ভাস্কর্যে এই জাতীয় যন্ত্রের প্রতিকৃতি দেখা যায়। রণবীর চক্রবর্তীর মতে, অনেকে এই সেচ যন্ত্রটিকে ‘পার্সিয়ান হুইল’ (Persian wheel) বলে মনে করেন। কিন্তু ড. ইরফান হাবিবের গবেষণার ভিত্তিতে ড. চক্রবর্তী বলেছেন, ‘পার্সিয়ান হুইল’ যন্ত্রটি ভারতীয় অরঘট্টর তুলনায় অনেক উন্নত, জটিল ও বেশি কার্যকরী। চতুর্দশ শতকে ইবন বতুতা বাংলাদেশ পর্যটনকালে পূর্ববাংলা থেকে আসামের দিকে যাওয়ার সময় নদী থেকে জল তোলার জন্য একধরনের চক্রাকার যন্ত্র দেখেছিলেন। সম্ভবত এটি ‘অরঘট্ট’ জাতীয় কোনো যন্ত্র ছিল।

সপ্তম শতক ও পরবর্তীকালে রচিত বিভিন্ন গ্রন্থ ও লেখ থেকে সেকালের উন্নত কৃষি-উৎপাদনের কথা প্রমাণিত হয়। সমকালে রচিত কয়েকটি কৃষি-বিষয়ক গ্রন্থ হল ‘কৃষিপরাশর’, ‘শূন্যপুরাণ, ‘মঙ্খকোষ’ ইত্যাদি। এই সকল গ্রন্থে তৎকালীন কৃষি-প্রণালী, উৎপাদিত পণ্যাদি, সেচব্যবস্থা ইত্যাদির বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। এমন গ্রন্থের প্রণয়ন-প্রবণতা কৃষিকার্যের প্রতি সমকালীন সমাজের অনুরাগের পরিচয় বহন করে। বিভিন্ন লেখমালাগুলিও যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে কৃষি-বিষয়ক তথ্যাদি লিপিবদ্ধ করেছে। ১৭৫ খ্রিস্টাব্দের ‘বিলহরি লেখ’তে শাক ও বেগুন চাষের উল্লেখ পাওয়া যায়। দক্ষিণ ভারত, কোঙ্কন উপকূল, আসাম ও বাংলাদেশে নারকেল ও সুপারি উৎপাদন হত। দক্ষিণ ভারতে ব্যাপক পানের চাষ হত। আদি-মধ্যযুগের বাংলার একটি লেখতে ‘বারজিক’ শব্দটির উল্লেখ আছে। অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সরকার ‘বারজিক’ শব্দটিকে পানচাষের ক্ষেত্র ‘বরজ’-এর সাথে অভিন্ন বলে মতপ্রকাশ করেছেন। সুস্বাদু মশলার উৎপাদক হিসেবে ভারতের নাম বিশ্বখ্যাত। আদি-মধ্যযুগের সাহিত্য ও লেখমালা থেকে সেকালে মশলা চাষের বিবরণ পাওয়া যায়। দ্বাদশ শতকে উৎকীর্ণ গুজরাটের একটি লেখতে কর্পূর, হিং, জায়ফল, জয়িত্রী, খেজুর ইত্যাদি চাষের কথা উল্লেখ আছে। সম্ভবত মরিচ গুজরাটে চাষ হত না। মরিচ উৎপাদনে মালাবার উপকূল অঞ্চলের একাধিপত্যর কথা স্থানীয় লেখমালা এবং চৈনিক ও আরবি পর্যটকদের বর্ণনা থেকে জানা যায়। ‘রাজতরঙ্গিনী’তে কাশ্মীরে জাফরান চাষের উল্লেখ পাওয়া যায়। কাপাস ও তৈল উৎপাদনের ক্ষেত্রেও আদি-মধ্যযুগের দক্ষতা প্রমাণিত। অধ্যাপক রণবীর চক্রবর্তীর মতে, গুজরাট ও দাক্ষিণাত্যে কার্পাস উৎপাদনের অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ ছিল। কারণ ওই অঞ্চলে কৃষ্ণ মৃত্তিকার অস্তিত্ব ছিল, যা তুলোচাষের উপযোগী। জনৈক চিনা রাজকর্মচারী চৌ-জু-কুয়া তাঁর ‘চু-ফান-চি’ গ্রন্থে (১২২৫ খ্রিঃ) লিখেছেন যে, দক্ষিণ- বাংলায় (পং-কি-লো’) প্রচুর তুলো উৎপাদিত হত। অধ্যাপক চক্রবর্তী লিখেছেন, “আদি-মধ্যযুগের ফসলের এই তালিকা থেকে কৃষি-উৎপাদনের দৃঢ় ভিত্তি, বহুল ফলন ও ফসলের বৈচিত্র্য অনুধাবন করতে কোনও দ্বিধা ও অসুবিধা হয় না।”