প্রাপ্ত তথ্যাদির সদ্ব্যবহার করে এবং ঐতিহ্যানুসারে আজ প্রায় নিশ্চিত ভাবেই সিদ্ধান্ত করা চলে যে, কবি কুলপতি জয়দেব গোস্বামী অপর কয়জন প্রতিষ্ঠিত কবিসহ দ্বাদশ শতকের শেষপাদে গৌরাধিপতি রাজা লক্ষ্মণসেনের রাজসভাকে অলংকৃত করেছিলেন। অতএব কালের বিচারে তিনি সংস্কৃত সাহিত্যের অবক্ষয় যুগের কবি। কিন্তু প্রতিভা এবং জনপ্রিয়তার বিচারে সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে মহাকবি কালিদাসের পরই যে তাঁর আসনটি প্রতিষ্ঠিত, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। জয়দেবের আবির্ভাব কালটি ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাসে এক যুগসন্ধিকাল—মধ্যযুগের অন্ত্যে তখন নবযুগের আবির্ভাব সূচিত হচ্ছে, নব্যভারতীয় আর্যভাষা সমূহ তথা ভারতের আঞ্চলিক ভাষাসমূহ তখন আত্মপ্রকাশের পথে, সংস্কৃত ভাষা উচ্চ সমাজে কোনো প্রকারে বেঁচে বর্তে আছে মাত্র। প্রাকৃত অবহট্টের প্রভাবে ভাষায় এক ধরনের সংগীত ধর্মিতা দেখা দিচ্ছে। এমন সময় আবির্ভূত হলেন কবি জয়দেব— ক্ষয়িষ্ণু সংস্কৃত সাহিত্যে তিনি নতুন যুগের ধ্বনি নিয়ে এলেন। সংস্কৃত সাহিত্যের পতন দশায় কবি কর্তৃক বিরচিত ‘গীতগোবিন্দমের’ মাধ্যমে শেষবারের মতো উজ্জ্বল আলো সামনে তুলে ধরলেন কবি জয়দেব।

দ্বাদশ সর্গে বিরচিত ‘গীতগোবিন্দ’ মূলত চব্বিশটি গানের একটি পালা, এছাড়া কাহিনি সূত্র ধরিয়ে দেবার জন্য রয়েছে বিভিন্ন ছন্দে রচিত কতকগুলি শ্লোক। এই গান বা পদ এবং শ্লোকগুলি কৃষ্ণ, রাধা অথবা কোনও এক সখীর উক্তিরূপে ব্যবহৃত হওয়াতে সমগ্র কাহিনিটি একটি নাটকের পালার আকার ধারণ করে। বারোটি সর্গের প্রত্যেকটিরই একটি নাম আছে এবং নামটি অর্থবহ। এ কাব্যের কাহিনিধারা এমনভাবে বিশ্লেষিত—

প্রথম সর্গ—’সামোদ দামোদর’ : কৃষ্ণ সন্ধানে তৎপরা শ্রীমতি রাধিকা এক সখীর সহায়তায় দেখতে পেলেন অপর এক নায়িকার সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ আমোদে মত্ত।

দ্বিতীয় সর্গ—‘অক্লেশ কেশব’ : নিজের উৎকর্ষ আর রইল না ভেবে শ্রীমতি নির্জনে এক লতাকুঞ্জে ক্ষুব্ধ হয়ে সখীকে বললেন, শ্রীকৃষ্ণ অপর যুবতীর প্রতি আসক্ত হওয়া সত্ত্বেও আমার মন তাঁরই প্রতি অনুরক্ত কেন ? শ্রীকৃষ্ণ গোপীদের বিলাসকলা দেখে হয়তো বা রাধার কথাই স্মরণ করেছেন, তাঁর সঙ্গে রাধা মিলন কল্পনা করেছেন—কেশব সকলের ক্লেশ দূর করুন।

তৃতীয় সর্গ—মুগ্ধ মধুসূদন’ : শ্রীকৃষ্ণকে অপর ব্রজাঙ্গনাদের ত্যাগ করায় রাধার সন্ধানই তৎপর হলেন। নিজের অপরাধবোধে তিনিও অনুতপ্ত, রাধাভাবে তন্ময় মুগ্ধ মধুসূদন রাধার সঙ্গে মিলনের কথাই ভাবছেন।

চতুর্থ সর্গ–স্নিগ্ধ মধুসূদন : মাধবের বিরহে রাধা অতিশয় কাতর হয়ে পড়েছেন। একমাত্র স্নিগ্ধ মধুসূদনের কথা ভেবেই তিনি এখনো জীবিত।

পঞ্চম সর্গ—’সাকঙ্ক্ষ পুণ্ডরীকাক্ষ : এদিকে রাধার জন্য বিরহে কৃষ্ণ ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে রাধার নাম ধরে কাঁদছেন অবিলম্বে রাধা এসে যেন শ্রীকৃষ্ণের আশা পূর্ণ করেন। 

ষষ্ঠ সৰ্গ—‘ধৃষ্ঠ বৈকুণ্ঠ’ : কিন্তু খবর এল সখী মারফৎ শ্রীমতীর দেহ কৃষ্ণ বিরহে বিকল, অবিলম্বে কৃষ্ণ যেন রাধাকুঞ্জে গমন করেন।

সপ্তম সর্গ—’নাগর নারায়ণ’ : কৃষ্ণের প্রতীক্ষায় সময় কাটে শ্রীমতির। বিপ্রলব্ধা শ্রীমতী বহুবল্লভ কৃষ্ণের নাগর রূপের কল্পনায় অতিশয় মনঃপীড়া বোধ করতে লাগলেন।

অষ্টম সর্গ—‘বিদক্ষ লক্ষ্মীপতি’ : যামিনী অবসানে কৃষ্ণ শ্রীমতির কুঞ্জদ্বারে উপনীত হলে তাঁর দেহে অপর নারীর সম্ভোগ চিহ্ন দর্শন করে শ্রীমতি তীব্র ভাষায় তাঁকে বিদ্ধ করতে লাগলেন।

নবম সর্গ—’মুগ্ধ মুকুন্দ : সখীরা বুঝালেন কৃষ্ণ যখন স্বয়ং এসেছেন তখন রাধার আর মান করা চলে না।

দশম সর্গ–‘মুগ্ধ মাধব’ : সন্ধ্যার দিকে রাধার মান কিছুটা প্রশমিত হলে অনুতপ্তচিত্তে অতঃপর শ্রীমতীর চরণ যুগল মস্তকে স্থাপন করে শ্রীকৃষ্ণ রাধার মান ভাঙালেন।

একাদশ সর্গ—’সানন্দ গোবিন্দ’ : কুঞ্জ থেকে সখীরা বেরিয়ে গেলে অতঃপর কৃষ্ণের সাহচর্যে অভিসারিকা রাধারও লজ্জা অপসৃত হল।

দ্বাদশ সর্গ—‘সুপ্রীত পীতাম্বর : সখীরা চলে গেলে শ্রীকৃষ্ণ সাদরে রাধিকাকে গ্রহণ করলেন, স্বাধীন ভর্তৃকা শ্রীমতী রাধা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হলেন। এমনভাবে গীতগোবিন্দমের কাহিনি বিশ্লেষিত হয়েছে।

সমগ্র উত্তর ভারতে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দ ভক্তিকাব্য রূপে সমাদৃত হয়। সমগ্র বৈশ্বব সমাজে এই কাব্যখানি দ্বিতীয় ভাগবত তুল্য মর্যাদা লাভ করে—স্বয়ং শ্রীচৈতন্যদেব এই গ্রন্থ শ্রবণে রসাবিষ্ট হতেন—এই কাব্যের জনপ্রিয়তাই তার অকাট্য প্রমাণ। ভক্তিভাবের প্রভাবেই যে জয়দেব ভারত জুড়ে খ্যাতি লাভ করেছিলেন তা নয়—গীতগোবিন্দর কাব্য মূল্যও আছে নিশ্চয়ই। জয়দেব ভক্ত ভাবুক ছিলেন সন্দেহ নেই, কিন্তু তিনি যে একজন সংগীতপ্রাণ কবিও ছিলেন তাঁর পরিচয় এই গীতগোবিন্দ শুধু নয়–‘সুদুক্তি কৰ্ণামৃত’ গ্রন্থে সংকলিত তাঁর ৩১টি পদেও পাওয়া যায়। এই পদগুলির মধ্যে যেমন রাধাকৃষ্ণ প্রসঙ্গ আছে, তেমনি পার্থিব চেতনা—যুদ্ধ, দ্বিগ্বিজয়, রাজস্তুতি, রাজার পৌরুষ বীর্য, তেজের বর্ণনাও আছে। জয়দেব শুধু শৃঙ্গার রসাত্মক কাব্যই রচনা করেননি, বীর রসাত্মক ও বস্তু প্রধান বিভিন্ন বিষয়ক কবিতাও রচনা করেছেন। উৎকর্ষের বিচারে সমগ্র রচনার মধ্যে যদিও গীতগোবিন্দের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকৃত তবুও জয়দেবের কবি পরিচয়টি বুঝে নিতে হলে ওই শ্লোকগুলির কথা স্মরণ রাখতে হয়।

সর্বোপরি, গীতগোবিন্দের শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম কারণ, এ কাব্যের গানের ভাষা, প্রাচীন সংস্কৃত কাব্যের সমকালীন অপভ্রংশ ও প্রাকৃত কাব্যের ভাষাকে সংমিশ্রিত করে জয়দেব “মধুর কোমলকান্ত পদাবলী”র সৃষ্টি করেছেন। অলৌকিক দেবকাহিনির সঙ্গে লৌকিক প্রেমকথার যে সমন্বয় তাঁর কাব্যে লক্ষিত হয় ভারতীয় সাহিত্যে তা অভিনব। আবার গীতিকাব্য রচনা করতে বসে তাকে নৃত্যগীতাভিনয়ের আঙ্গিকে বিন্যস্ত করে যে নাটকীয় গুণসম্পন্ন হয়েছে তা অভিনব। কাব্য ও ধর্মের মধ্যে অসামান্য সম্মিলন ঘটিয়ে তিনি ভক্ত হয়েও কবির শিরোপমা পেয়েছেন। এই কারণেই তাঁর গীতগোবিন্দ একাধারে ভক্ত ও রসিক সমাজের ভক্তি ও রসতৃষ্ণা নিবারণে সমর্থ হয়েছে। যিনি ভক্ত তিনি জয়দেবের কাব্য থেকে তাঁর আরাধ্য দেবতার সন্ধান পেতে বেগ পারেন না, যিনি কাব্যরসিক, কাব্যানুশীলন জাতি স্বচ্ছমনের অধিকারী, তিনি এই কাব্য পাঠে বিমল আনন্দ লাভে সমর্থ হবেন। দেবকাহিনি বর্ণনায় কবি হিসাবে জয়দেবের এইখানেই জয়।