প্রশ্নঃ জন লকের সামাজিক চুক্তি মতবাদটি আলোচনা কর।

অথবা, জন লকের সামাজিক চুক্তি তত্ত্ব আলোচনা কর।

ভূমিকাঃ জন লক ছিলেন বৃটেনের গণতন্ত্রের পুরোধা। জন লক ১৬৩২ সালে ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন সর্বকালের সর্বযুগের বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের একজন। তার বাস্তবধর্মী চিন্তা, গণতান্ত্রিক সচেতনতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ তাকে শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদদের প্রথম সারিতে দাঁড় করিয়েছে। মূলত তিনি ছিলেন একজন চিকিৎসাবিদ। কিন্তু তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতি ছিলেন নিরুৎসাহী। রাষ্ট্রদর্শনে ছিল তার অবাধ বিচরণ। তার রাজনৈতিক মতবাদ মূলত Two treatise of civil Government রচনায় বিধৃত হয়।

সামাজিক চুক্তি মতবাদঃ সামাজিক চুক্তি মতবাদটি জন লকের রাষ্ট্র দর্শনের একটি দিক। এই ইংরেজ দার্শনিক ১৬৯০ সালে ‘Two treatise of civil Government’ নামক গ্রন্থে সামাজিক চুক্তি মতবাদটি ব্যাখ্যা করেন। লকের মতে প্রকৃতির রাজ্যে সাম্য, স্বাধীনতা ও শান্তি বিরাজ করত। প্রকৃতির আইনের অধীনে মানুষ সুখে শান্তিতে বাস করত। কিন্তু সেখানে বিদ্যমান ছিল কতিপয় সমস্যা। এই সমস্যা সমূহ দূর করার জন্য মানুষ স্বেচ্ছায় ও সর্বসম্মতিক্রমে যে চুক্তিতে আবদ্ধ হয় তাই লকের সামাজিক চুক্তি (Social Contract) নামে পরিচিত।

সামাজিক চক্তির শর্তসমূহঃ লকের সামাজিক চুক্তির শর্তসমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হলো-

(১) প্রকৃতির রাজ্যের অবাধ ও ক্ষতিকর স্বাধীনতাটুকু ছাড়া বাদবাকি সবকিছুই তাদের এখতিয়ারে থাকবে।

(২) চুক্তির পেছনে তাদের প্রত্যেকের স্বাধীনতা থাকবে।

(৩) প্রত্যেক ব্যক্তি অন্যকে শাস্তি দেয়ার অবাধ ক্ষমতা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করার প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হলো। 

(৪) শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা তারা অন্য কর্তৃপক্ষের নিকট তুলে দেয়।

(৫) কোন নিয়ম অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ শাসনকার্য পরিচালনা করবে সেগুলো জনগণ স্থির করে দিতে সম্মত হলো।

সামাজিক চুক্তির বৈশিষ্ট্যঃ লকের সামাজিক চুক্তি বিশ্লেষণ করলে নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো লক্ষ্য করা যায়। যথাঃ

(১) সংখ্যাগরিষ্ঠ্যের শাসনঃ জন লকের সামাজিক চুক্তির মুলনীতি হল সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন। লকের মতে, চুক্তির পেছনে প্রতিটি নাগরিকদের সম্মতি থাকবে। স্বাভাবিক কাজকর্ম পরিচালনার জন্য তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠের মতকে একমাত্র গ্রহণযোগ্য পদ্ধতির মর্যাদা দিয়েছেন।

(২) বাতিলযোগ্য নয়ঃ লকের মতে, চুক্তি একবার সম্পাদিত হলে তা আর বাতিলযোগ্য নয় বা জনগণ বাতিল করতে পারবে না। কারণ চুক্তি বাতিল করার অর্থ প্রকৃতির রাজ্যে আবার ফিরে যাওয়া।

(৩) পরবর্তী প্রজন্মকে মেনে চলতে হবেঃ একটি জনগোষ্ঠী একটা নির্দিষ্ট সময়ে চুক্তি করে পুরো সমাজ গঠন করলেও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সেই চুক্তি বাধ্যতামূলক হয়ে থাকবে।

(৪) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বৈশিষ্ট্যপূর্ণঃ লকের মতে, সামাজিক চুক্তিতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ সীমাহীন ক্ষমতা জনগণের ওপর আরোপ করতে পারে না।

সামাজিক চুক্তির কারণঃ লকের সামাজিক চুক্তি রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। জন লকের মতে প্রধানত তিনটি কারণে সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এগুলো নিম্নরূপ-

প্রথমতঃ লকের মতে প্রাকৃতিক আইন সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন নয়। সকল মানুষ যদি প্রকৃত যুক্তি দ্বারা পরিচালিত হতো তা হলে আইনের এই অস্পষ্টতা বা দ্ব্যর্থবোধতা থাকত না। কিন্তু মানুষ সচরাচর প্রকৃত যুক্তি দ্বারা পরিচালিত হয় না। ব্যক্তিগত স্বার্থবোধ তাদের মধ্যে পক্ষপাতিত্বের সৃষ্টি করে। তারা প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ স্বার্থের পক্ষে যা অনুকূল তাকেই সাধারণ বিধান বলে চালাতে চায়। একারণে মানুষ সামাজিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়।

দ্বিতীয়তঃ প্রকৃতির রাজ্যে বিবদমান দু’টি পক্ষই বিচারের মালিক। বিচারের ক্ষেত্রে তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্বার্থের আকর্ষণে আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে ন্যায় বিচার অপেক্ষা প্রতিহিংসার মনোভাবই তাদের কাছে অধিক প্রাধান্য পায়। নিরপেক্ষতার জন্য একটি তৃতীয়পক্ষ বিচারকের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কিন্তু প্রকৃতির রাজ্যে তা দুষ্কর। একারণে মানুষ সামাজিক চুক্তিতে উপনীত হয়।

তৃতীয়তঃ প্রকৃতির রাজ্যে প্রত্যেকের ন্যায় বিচার পাবার অধিকার রয়েছে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত দুর্বল পক্ষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত ছিল। তার পক্ষে নিজের ক্ষমতায় এই ন্যায়বিচার অর্জন করা সম্ভবপর হতো না। কাজেই প্রকৃতির রাজ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষ সমাজ গঠন করতে বাধ্য হয়।

লকের সামাজিক চুক্তির সুফলঃ উল্লেখিত কারণের ভিত্তিতে সামাজিক চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তির ফলে মানুষ কিছু কিছু সুফল ভোগ করেছিল যা নিম্নরূপ।

(১) সুস্পষ্ট আইন প্রতিষ্ঠিতঃ সামাজিক চুক্তির ফলে প্রকৃতির রাজ্যে সুস্পষ্ট আইন প্রতিষ্ঠা পায়। এই চুক্তির ফলে প্রাকৃতিক আইনের অনিশ্চয়তা দূরীভূত হয়ে সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন আইন প্রতিষ্ঠিত হয়।

(২) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাঃ লকের মতে, মানুষ সামাজিক চুক্তিতে আবদ্ধ হবার পূর্বে সমাজে ন্যায়বিচারের স্থান ছিল না। প্রভাবশালী ব্যক্তিগণ বিচারের রায়কে তাদের অনুকূলে নিত। বিবাদের দুর্বলপক্ষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত ছিল। বিবাদের দুর্বল পক্ষ যাতে আইনসম্মত ন্যায়বিচার লাভ করতে পারে তার জন্য সামাজিক চুক্তি মতবাদে কার্যকরী ব্যবস্থা গৃহীত হয়।

(৩) স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তাঃ সামাজিক চুক্তির ফলে প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ স্বাভাবিক জীবন ফিরে পায়। লকের মতে সমাজ গঠনের পূর্বে প্রকৃতির রাজ্যে শক্তি ও বল, ছলনা ও প্রতারণা, লালসা, প্রতিপত্তির প্রভাব বিদ্যমান ছিল। সামাজিক চুক্তির ফলে তা দূরীভূত হয়। মানুষ স্বাভাবিক জীবন ফিরে পায়৷

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, এতক্ষণের আলোচনায় পরিশেষে বলা যায় যে, কতিপয় সমালোচনা সত্ত্বেও লকের সামাজিক চুক্তিটির অবদান অনস্বীকার্য। এ চুক্তির মাধ্যমে মানুষ রাষ্ট্র নামক সংগঠনটি সৃষ্টি করে। ফলশ্রুতিতে মানুষ ধীরে ধীরে সভ্য জগতে ফিরে আসে। তাই সেবাইনের ভাষায় আমরা বলতে পারি যে, ‘It is a better way of protecting natural right than the self help to which each man is naturally entitled.’