প্রশ্নঃ জন লকের সরকারের শ্রেণীবিভাগের ধারণা দাও। তাকে কেন গণতন্ত্রের জনক বলা হয়?
অথবা, জন লকের সরকারের শ্রেণীবভিাগ আলোচনা কর। ‘জন লক আধুনিক সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রথিকৃত’- আলোচনা কর।
ভূমিকাঃ জন লক বৃটেনের সংসদীয় গণতন্ত্রের মানস পুত্র। তিনি বৃটেনের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক যুগ সন্ধিক্ষণে জন্মগ্রহণ করেন। ‘শাসন করার অধিকার জন্মায় শাসিতের সম্মতির মাধ্যমে’- এ নীতিকে পুঁজি করে রাজনৈতিক জগতে পদার্পণ করেন। একাধারে তিনি ছিলেন ডাক্তার, কূটনীতিক, সরকারী কর্মচারী, অর্থনীতিবিদ এবং দার্শনিক। তার Two Treatise of Civil Government গ্রন্থটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। এই গ্রন্থে তিনি মূলত রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে আলোচনা করেন।
লকের সরকারের ধারণাঃ জন লক ছিলেন এক কর্মতৎপর প্রতিভাবান ব্যক্তি। তার মতে ক্ষমতার প্রকৃত উৎস হল জনগণ। কিন্তু জনগণ সর্বদা নিজ হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে রাখে না। ক্ষমতার প্রয়োগকারীদের সংখ্যা অনুসারে লক সরকারকে গণতন্ত্র, কতিপয়তন্ত্র ও রাজতন্ত্র এই তিনভাগে বিভক্ত করেছেন। রাজতন্ত্রকে তিনি আবার বংশ পরম্পরার রাজতন্ত্র ও নির্বাচিত রাজতন্ত্র নামে দেখিয়েছেন।
গণতন্ত্রঃ তিনি গণতন্ত্রের সংজ্ঞা সুস্পষ্টভাবে দিয়েছেন। তিনি বলেন, আইন প্রণয়নের ক্ষমতা যখন খোদ সম্প্রদায়ের হাতে ন্যস্ত থাকে এবং সম্প্রদায় এই ক্ষমতা তার সংখ্যাগুরু অংশের দ্বারা বাস্তবে প্রয়োগ করে তখন তাকে পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র বলে।
কতিপয়তন্ত্রঃ বৃটেনের গণতন্ত্রের পুরোধা জন লক গণতন্ত্রের ন্যায় কতিপয়তন্ত্রকেও সংজ্ঞায়িত করেছেন। তার মতে, ক্ষমতা যখন নির্দিষ্ট সংখ্যক কতিপয় লোকের দ্বারা বা তাদের বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকারীদের দ্বারা কার্যকর হয় তখন তাকে বলা হয় কতিপয়তন্ত্র।
রাজতন্ত্রঃ রাজতন্ত্র জন লকের সরকারের শ্রেণীবিভাগের একটি বিশেষ রূপ। ক্ষমতা যখন একজন রাজার হাতে ন্যস্ত থাকে তখন তাকে বলা হয় রাজতন্ত্র। রাজা যখন বংশানুক্রমিক ভিত্তিতে নিযুক্ত হন, তখন তাকে বলা হয় বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র। আবার যখন রাজার মৃত্যুর পর সম্প্রদায় নতুন করে অন্য কাউকে তার উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করে, তখন তাকে বলা হয় নির্বাচিত রাজতন্ত্র।
জন লককে আধুনিক গণতন্ত্রের জনক কেন বলা হয়ঃ জন লক ছিলেন বৃটেনের গণতন্ত্রের পুরোধা। তাকে আধুনিক গণতন্ত্রের জনক নামে অভিহিত করা হয়। এর অন্যান্য কারণসমূহ নিম্নরূপ-
(১) প্রাকৃতিক অধিকারের প্রবক্তাঃ রাজনৈতিক চিন্তাধারায় জন লকের উল্লেখযোগ্য অবদান হলো প্রাকৃতিক অধিকার মতবাদ। এক্ষেত্রে তিনি স্বাতন্ত্রবাদীদের চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হন। জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তি অধিকার ব্যক্তির বিশেষ অধিকার।
(২) ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের প্রবর্তকঃ জন লক ছিলেন ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের বিশেষ প্রবক্তা। ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদী হিসেবে লকের নাম টমাস হবসের সাথে উচ্চারিত হয়ে থাকে। ব্যক্তির অধিকার ও স্বার্থকে তিনি মুখ্য করে দেখেছেন।
(৩) সংসদীয় গণতন্ত্রের পুরোধাঃ জন লককে সংসদীয় গণতন্ত্রের পুরোধাও বলা চলে। তিনিই রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য চিহ্নিত করেছেন। তার মতে রাষ্ট্র অক্ষয় ও অমর কিন্তু সরকারের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ।
(৪) সম্পত্তি তত্ত্বের প্রবক্তাঃ সম্পত্তি তত্ত্ব প্রবর্তনের ক্ষেত্রে জন লকের অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। সম্পত্তির অধিকার জনগণের একটি প্রাকৃতিক অধিকার। তার মতে সম্পত্তির অধিকার ছাড়া ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটতে পারে না।
(৫) গণ সার্বভৌমত্বের স্রষ্টাঃ গণসার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তার অবদান কম নয়। তিনি অন্যান্য তত্ত্বের ন্যায় গণসার্বভৌমত্ব তত্ত্বের কথা ব্যক্ত করেন। মূলত তার রাজনীতি গণতান্ত্রিক। তিনি গণনির্বাচন, গণতান্ত্রিক সরকার ও আইন পরিষদের মাধ্যমে গণসার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন।
(৬) ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের প্রবক্তাঃ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি লকের রাজনৈতিক দর্শনের একটি বিশেষ দিক। তিনি ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রবর্তনের মাধ্যমে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে নিরাপদে রাখতে চেয়েছেন। ফরাসী দার্শনিক মন্টেস্কু এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে আরও কার্যকরী করে তোলেন।
(৭) নিয়মতন্ত্রের পুরোধাঃ জন লক প্রথমে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও রাষ্ট্র কল্যাণের জন্য নিয়মতন্ত্রের কথা বলেন। তিনি বলেন, নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা গ্রহণের মধ্যে রাষ্ট্রের কল্যাণ নিশ্চিত। তার মতে রাজার ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করা একটি অপকৌশল মাত্র।
(৮) সম্মতি তত্ত্বের প্রবক্তাঃ সম্মতি তত্ত্ব জন লকের রাজনৈতিক দর্শনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। তিনি একনায়ক বা স্বেচ্ছাচারী উপায়ে ক্ষমতা দখল করার চরম বিরোধিতা করেছেন। সরকারকে জনগণের সম্মতির প্রতি গুরুত্ব প্রদান করতে হবে।
(৯) ক্ষমতার সুষম বন্টনঃ ক্ষমতার সুষম বন্টন প্রসঙ্গে জন লক বিশেষ অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি ক্ষমতাকে সরকারের হাতে এককভাবে ন্যস্ত করতে নারাজ। তার মতে সরকারের হাতে ব্যাপক ক্ষমতা ন্যস্ত থাকলে সরকার স্বৈরাচারী রূপ নেয়।
(১০) আইন বিভাগের প্রাধান্যঃ জন লককে আধুনিক গণতন্ত্রের জনক বলার পেছনে যুক্তি হলো তিনি হলেন আইন বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা। তার মতে আইন বিভাগের মাধ্যমে রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা রক্ষা করা যায়। উপযুক্ত ও সময়োপযোগী আইন প্রণয়নে তিনি আইন প্রণয়নকারীদের পরামর্শ দিয়েছেন।
(১১) মৌলিক অধিকার সংরক্ষণঃ গণতন্ত্রের অন্যতম লক্ষ্য হলো মানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা। জীবন, স্বাধীনতা, সম্পত্তির অধিকার মূলত গণতান্ত্রিক ধারণা। জন লক এ অধিকারের কথা বলে গণতন্ত্রের নীতিকে উদ্ঘাটন করেছেন। তাই জন লককে আধুনিক গণতন্ত্রের জনক বলা হয়।
মূল্যায়নঃ জন লকের উপরোক্ত মতবাদগুলো সমালোচিত হয়েছে এ কথা অস্বীকার করার জো নেই। তবুও এ কথা ঠিক যে তার রাজনৈতিক দর্শন গণতন্ত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত। আর তিনিই গণতন্ত্রের মূল্যবোধ ও গণতান্ত্রিক চেতনার ক্ষেত্রে নতুন স্রোতধারা প্রবাহের পথ উন্মুক্ত করেন। তার মতে, ‘May I have a right to act and conclude the reason. তবে তিনি সংখ্যালঘিষ্ঠের মতকেস অস্বীকার করেননি। তার মতে, ‘Minority should be respected.
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, পরিশেষে বলা যায় যে, উল্লেখিত কারণে জন লককে আধুনিক গণতন্ত্রের জনক বলা চলে। তিনি গণতন্ত্র সম্পর্কে বাস্তব সম্মত ব্যাখ্যা দিয়েছেন যা বর্তমানকালেও প্রযোজ্য। তার বাস্তবধর্মী চিন্তাধারা, গণতান্ত্রিক চেতনা তাকে আধুনিক গণতন্ত্রের পুরোধায় ভূষিত করেছে।
Leave a comment