অথবা, জন লকের সম্পত্তি তত্ত্ব আলোচনা কর। তুমি কি তাকে একজন রক্ষণশীল চিন্তাবিদ মনে কর?
ভূমিকাঃ জন লক ছিলেন একজন কর্মতৎপর প্রতিভাবান ব্যক্তি। ১৬৮৮ সালে ইংরেজ দার্শনিক ইংল্যান্ডের পুঁজিবাদী বিপ্লবের তাত্ত্বিক জন লক তার ‘সম্পত্তি তত্ত্ব’-এর ধারণাটি ‘Of civil government’ নামক গ্রন্থে তুলে ধরেন। জন লকের সম্পত্তি সংক্রান্ত মতবাদ তার রাজনৈতিক দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। Proff Sibly বলেন- সম্পত্তি তত্ত্ব লকীয় রাষ্ট্রদর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। লকের সম্পত্তি তত্ত্ব সামন্তবাদী ধারণাকে নস্যাৎ করে এক বৈপ্লবিক পদক্ষেপের সূচনা করে। সেখানে সকল প্রাকৃতিক সম্পদকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তাছাড়াও লকের এই সম্পত্তি তত্ত্ব ১৭৮৮ সালের গৌরবময় বিপ্লবের ফলে উদীয়মান নতুন নতুন রাজনৈতিক শক্তি বুর্জোয়া শ্রেণীর বিন্যাসকে ত্বরান্বিত করে।
সম্পত্তি সম্পর্কে লকের ধারণাঃ সম্পত্তি তত্ত্ব জন লকের রাষ্ট্রদর্শনের একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিক। জন লক ব্যাপক অর্থে সম্পত্তি বলতে মানুষের জীবন, স্বাধীনতা ও বৈষয়িক সম্পদকে বুঝিয়েছেন। কিন্তু সংকীর্ণ অর্থে শুধু বৈষয়িক সম্পদকে বুঝিয়েছেন। দ্বৈত অর্থে এর ব্যবহার হলেও জন লক সম্পত্তি শব্দটিকে ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। ফলে জন লকের নিকট থেকে প্রাপ্ত সম্পত্তি তত্ত্ব নিছক একটি নৈতিক তত্ত্ব বা মতবাদ নয়। এই তত্ত্বের মাঝে মানুষের জীবন, স্বাধীনতা ও পার্থিব সুখ শান্তির সমস্ত বিষয় পরিব্যাপ্ত। জন লক বিশ্বাস করেন যে, মানুষের সম্পত্তি রক্ষা করা সরকারের প্রধান লক্ষ্য এবং এই লক্ষ্য অর্জনে মানুষ প্রকৃতির রাজ্য পরিত্যাগ করে সমাজ বা কমনওয়েলথ গঠন করেছে।
শ্রম ও সম্পত্তিঃ তিনি প্রকৃতির রাজ্যে মানুষের দেহকে সম্পত্তির সঙ্গে এক করে দেখেছেন। মানুষ ও তার দেহই সম্পত্তি ভোগ করে এবং তার দেহ সকল প্রকার সম্পত্তির ভিত্তি। তিনি উল্লেখ করেন যে, মানুষ যখন কোন বস্তুর সঙ্গে দৈহিক শ্রম মিশ্রিত করে তখন সে বস্তুর উপর তার স্বাভাবিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি বলেন যেহেতু দেহের শ্রম ও হাতের কর্ম মানুষের একান্তভাবে নিজস্ব সুতরাং এসব জিনিস যখন কোন বস্তুর সাথে মিশ্রিত হয় তখন সে বস্তুটিও তার দেহের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়। তাই শ্রমই সম্পত্তি সৃষ্টি করে এবং এটাই ব্যক্তিগত সম্পত্তির ভিত্তি। মানুষ তার শ্রম নিয়োগ করেই ব্যক্তিগত সম্পত্তি সৃষ্টি করেছে।
জনলকের সম্পত্তি তত্ত্বের যুক্তি ব্যাখ্যাঃ জন লকই সর্বপ্রথম ব্যক্তি যিনি ব্যক্তিগত সম্পত্তির একটি যুক্তিভিত্তিক ব্যাখ্যা প্রদানের চেষ্টা করেছেন। লকের মতে, প্রাকৃতিক রাজ্যে মানুষের প্রাকৃতিক অধিকার বিরাজমান ছিলো। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার মানুষের একটি অন্যতম প্রাকৃতিক অধিকার। লক ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের কথা বলতে গিয়ে গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটলের রাজনৈতিক দর্শন দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবান্বিত হন। এরিস্টটল যেমন ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে ব্যক্তির মানসিকতা বিকাশের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন ঠিক তেমনি জন লকও ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে জনগণের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয়তা মেটানোর এবং তাদের ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশের জন্য অপরিহার্য বলে মনে করেছেন।
সম্পত্তি তত্ত্বের বৈশিষ্ট্যঃ জন লকের সম্পত্তি তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য নিম্নে আলোচনা করা হলো-
(১) সম্পত্তি কায়িক পরিশ্রমের ফলঃ জন লকের মতে প্রাকৃতিক রাজ্যে সকলের নিকটই সম্পত্তির অবাধ অধিকার বিদ্যমান ছিলো। যে যার ইচ্ছেমতো সম্পত্তি ব্যবহার করতে পারতো। তিনি বলেন যে, মানুষ কায়িক পরিশ্রমের সংযোগসাধন করে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার সৃষ্টি করেছে।
(২) উৎপাদন ও কল্যাণ একই সূত্রে গাঁথাঃ যে ব্যক্তি যত বেশী সম্পত্তি চাষাবাদ করতে পারবে সে তত বেশী সম্পত্তির অধিকারী হবে। লক মনে করেন যে সম্পত্তির উপর অধিকার থাকলে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই জমি চাষাবাদ করে ফসল ফলাবে। তিনি ব্যক্তিগত কৃষি, অর্থনীতির ওপর অধিক জোর দিয়েছেন। এতে জমির ফসল বৃদ্ধি পাবে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে সমাজের প্রতিটি মানুষের কল্যাণ ও জীবনধারণের মান অনেক বেশী উন্নততর হবে।
(৩) উৎপাদিত বস্তুই শ্রমের মর্যাদা নির্ণায়কঃ ব্যক্তিগত সম্পত্তির উপরে জন লকের জোর দেয়ার আরো কারণ আছে। তার প্রধান যুক্তি হলো এই যে, ব্যক্তিগত সম্পত্তি মানুষকে শ্রমের মর্যাদা পুরোপুরি দেয় এবং শ্রমের মাধ্যমে উৎপাদিত বস্তু সমুদয়ের মধ্যে তার ব্যক্তিসত্তাকে সঞ্চারিত ও সম্প্রসারিত করে দেয়। শ্রমের মর্যাদা ও মূল্য নিরুপিত হয় তার উৎপাদিত বস্তুর মাধ্যমে।
(৪) সম্পত্তি মানুষের চুক্তিহীন অধিকারঃ আদিম সমাজকে জন লক প্রাকৃতিক রাজ্য বলে আখ্যায়িত করেছেন। তার এই ধারণা স্বভাবতই সম্পত্তির ধারণা থেকে সৃষ্টি হয়েছে। তার মতে, ‘সম্পত্তি’ কোনো প্রকার চুক্তি ছাড়াই জনগণের অধিকারভুক্ত। দৈহিক শক্তির মতো এই অধিকার ব্যক্তি তার ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে সমাজে আনয়ন করে থাকে।
(৫) সীমাহীন সম্পত্তি ন্যায়সঙ্গত নয়ঃ একজন লোক তার নিজের জন্য ন্যায়সঙ্গতভাবে কী পরিমাণ সম্পত্তি দাবি করতে পারে সে সম্পর্কে জন লক যদিও কোনো সুস্পষ্ট মতামত উল্লেখ করেননি তথাপি তিনি সাধারণভাবে বিশ্বাস করেন যে, কোন লোকই সীমাহীনভাবে সম্পত্তি অর্জনের দাবি করতে পারেন না।
(৬) উদ্বৃত্ত সম্পত্তি ন্যায়সঙ্গত অধিকার নয়ঃ যখন ব্যক্তিগত সম্পত্তি তার প্রয়োজন মিটিয়ে ফেলে তখন উদ্বৃত্ত অংশের ওপর সে কোনো মালিকানা দাবী করতে পারে না। এবং উদ্বৃত্ত সম্পত্তিটা ন্যায়সঙ্গতভাবে তার প্রাপ্য ও নয়, যা অন্যদের প্রয়োজনে লাগবে।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, সম্পত্তির অধিকারকে জন লক পবিত্রতম অধিকার বলে বর্ণনা করে মানব জাতির কল্যাণ সাধন করেছেন। শ্রমিক শ্রেণীর দাবির ভিত্তি হিসেবে তার ভূমিকা অগ্রগণ্য। বিংশ শতাব্দীতেও সীমাবদ্ধ ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রবক্তা হিসেবে তার গুরুত্ব অনুভূত হয়। তিনি সম্পত্তি তত্ত্বের মাধ্যমে ‘মূল্যের নীতি’ বিকাশ সাধন করেছেন এবং পরিবর্তীতে পুঁজিবাদী ও সমাজতন্ত্র উভয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিশ্লেষণে এ নীতি সাফল্যজনকভাবে প্রয়োগ করা হয়। এখানেই লকের সম্পত্তি তত্ত্বের সার্থকতা।
Leave a comment