[1] সমুদ্রমন্থন: মহাভারতের বর্ণনানুযায়ী- অসুরদের সঙ্গে ক্রমাগত যুদ্ধ করে দেবতারা তাদের শক্তি হারিয়ে ফেলেন। তাই তারা বিষ্ণুর কাছে গিয়ে শক্তি ও অমরত্ব লাভের প্রার্থনা করেন। বিষ্ণু দেবতাদের উপদেশ দেন সমুদ্র মন্থন করে অমৃত সংগ্রহ করার। সত্যযুগে দেবতা ও অসুরগণ ঠিক করেন যে তারা অমৃত পান করে অমর হবেন। অমৃত লাভের আশায় তারা মন্দার পর্বতকে মন্থনদণ্ড এবং সর্পরাজ বাসুকিকে রজ্জু করে ক্ষীরসমুদ্র মন্থন করতে শুরু করেন। কয়েক হাজার বছর মন্থনের পর লক্ষ্মীদেবী অমৃতভাণ্ড নিয়ে সমুদ্র থেকে উঠে আসেন। অমৃতের অধিকার নিয়ে দেবতা ও অসুরদের মধ্যে লড়াই শুরু হয়। নারায়ণ মােহিনীরূপে অসুরদের মােহিত করে অমৃত হরণ করেন। দেবতাগণ নারায়ণের কাছ থেকে সেই অমৃত পান করেন। অতঃপর দারুণ যুদ্ধে অসুরদের পরাস্ত করে দেবতাগণ ত্রিলােক অধিকার করেন।
[2] গঙ্গার মর্ত্যে অবতরণ: পুরাকালে অযােধ্যায় সগর নামে এক রাজা ছিলেন। কপিলমুনির অভিশাপে সগর রাজার ৬০ হাজার পুত্র ভস্মীভূত হয়ে যায়। সগর রাজার প্রপৌত্র ভগীরথ কঠোর তপস্যা দ্বারা ব্ৰত্মাকে সন্তুষ্ট করেন এবং স্বর্গ থেকে গঙ্গাকে পৃথিবীতে আনার অনুমতি পান। কিন্তু গঙ্গার অবতরণকালে তাকে ধারণ করার ক্ষমতা মহাদেব ছাড়া আর কারও ছিল না, তাই ভগীরথ মহাদেবের তপস্যা করে তাকে সন্তুষ্ট করেন। মহাদেব গঙ্গাকে নিজের মাথায় ধারণ করেন। ভগীরথকে অনুসরণ করে গঙ্গা সগর রাজার ৬০ হাজার সন্তানের ভস্মরাশির ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলে সগর রাজার ৬০ হাজার পুত্র জীবিত হয়ে ওঠেন।
[3] অনন্ত বা শেষনাগের পৃথিবী বহন: নাগ বংশের রাজা ও পাতালের অধিনায়ক হলেন অনন্ত বা শেষনাগ। নাগদের মধ্যে অনন্ত বা শেষনাগ হলেন সর্বপ্রধান। কদ্রুর গর্ভে ও কশ্যপমুনির ঔরসে এঁর জন্ম। অনন্তদেবের অন্য দুটি নাম হল বাসুকি ও গােলক। বিষ্ণুপুরাণ মতে অনন্তনাগ হলেন বলরামের অবতার। ভাইদের অসৎ ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হয়ে তাদের ত্যাগ করে অনন্তনাগ কঠোর তপস্যা করতে শুরু করেন। ব্রহ্মা তার তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বর দেন এবং পৃথিবীকে তার মাথার ওপর এমনভাবে ধারণ করতে বলেন যাতে পৃথিবী বিচলিত না হয়। ব্রহ্মা আরও বলেন পৃথিবীকে বহন করার কাজে গরুড় অনন্তকে সাহায্য করবেন। অনন্ত যখন দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তখন সমস্ত পৃথিবী কেঁপে ওঠে, ভূমিকম্প হয়। প্রতি কল্পের শেষে শেষনাগ মুখ থেকে আগুন বের করে সমস্ত সৃষ্টি ধ্বংস করেন। কালিকাপুরাণ মতে প্রলয়ের শেষে নারায়ণ লক্ষ্মীকে নিয়ে অনন্তের মধ্যম ফণায় শয়ন করেন।
[4] অহল্যার কাহিনি: ব্রহ্মার মানস কন্যা ও শতানন্দের জননী হলেন অহল্যা। অদ্বিতীয় সুন্দরী ও সত্যপরায়ণা বলে ব্রহ্মা তার নাম দেন অহল্যা। ব্রহ্মা অহল্যাকে ঋষি গৌতমের কাছে রেখে যান। গৌতম অতি যত্ন সহকারে দেখাশােনা করে তাকে পবিত্র ও নিষ্কলঙ্ক অবস্থায় ব্রহ্মার কাছে ফিরিয়ে দেন। ব্রহ্মা এতে সন্তুষ্ট হয়ে গৌতমের সঙ্গে অহল্যার বিবাহ দেন। এদিকে দেবরাজ ইন্দ্র ভেবেছিলেন অহল্যা তার স্ত্রী হবেন। কিন্তু তা না হওয়ায় একদিন গৌতম স্নান করার জন্য আশ্রম থেকে বের হলে ইন্দ্র গৌতমের রূপ ধারণ করে অহল্যার কাছে যান এবং তার সঙ্গম প্রার্থনা করেন। চিনতে পেরেও ইন্দ্রের প্রস্তাবে তিনি সম্মত হন। ইন্দ্র চলে যাওয়ার আগেই গৌতম এসে পড়েন। ঋষি গৌতম প্রথমে ইন্দ্রকে অভিশাপ দিয়ে বলেন তিনি নপুংসক হবেন। আর অহল্যাকে গৌতম সহস্র বছর এখানে অদৃশ্য অবস্থায় বায়ুভুক হয়ে অনাহারে পাথর হয়ে থাকার অভিশাপ দেন। পরে শান্ত হয়ে গৌতম বলেন রামচন্দ্রের পাদস্পর্শে অহল্যা মুক্তি পাবে। পরে বিশ্বামিত্র মুনির প্রচেষ্টায় রামচন্দ্রের পাদস্পর্শে অহল্যা মুক্তি পান।
[5] নরসিংহের হিরণ্যকশিপু বধ: সত্যযুগে বিয়ুর চতুর্থ অবতার হলেন নরসিংহ। অর্ধেক নর ও অর্ধেক সিংহ রূপ। গােলােকে বিয়ুর ভক্ত দাররক্ষক জয় ও বিজয় শাপগ্রস্ত হয়ে মর্তে তিনবার নারায়ণের শত্রুরূপে জন্ম নেন। প্রথম জন্মে এরা যথাক্রমে হিরণ্যাক্ষ ও হিরণ্যকশিপু রূপে জন্মান। হিরণ্যকশিপু ছিলেন দৈত্যরাজ। তিনি হরি বিদ্বেষী হলেও তার কনিষ্ঠ পুত্র প্রহ্লাদ ছিলেন হরিভক্ত, ব্ৰত্মার বরে হিরণ্যকশিপু মানুষ ও পশুর অবধ্য ছিলেন। প্রহ্লাদকে তিনি হরিভক্তি দেখাতে নিষেধ করেন। কিন্তু প্রহ্লাদ তা না শােনায় তাকে হাতির পায়ের নীচে ফেলে বা অগ্নিকুপ্ডে বা সাগরগর্ভে নিক্ষেপ করে হত্যার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদকে হত্যা করতে ব্যর্থ হন। হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদকে জিজ্ঞাসা করেন কে তাকে বারবার রক্ষা করে? উত্তরে প্রহ্লাদ বলেন শ্রীহরি তাকে রক্ষা করেন। হিরণ্যকশিপু আরও জিজ্ঞাসা করেন শ্রীহরি কোথায় আছেন? উত্তরে প্রহ্লাদ বলেন শ্রীহরি সর্বত্র বিরাজমান, এমনকি রাজসভার স্ফটিকস্তম্ভের মধ্যেও তিনি বিরাজমান। হিরণ্যকশিপু তখন স্ফটিকস্তম্ভে পদাঘাত করেন। প্রহ্লাদের বাক্য মতাে স্তম্ভ থেকে নরসিংহ মূর্তি প্রকাশিত হয়। নিজের জানুর ওপর হিরণ্যকশিপুকে স্থাপন করে নখের দ্বারা বুক চিরে নরসিংহ হিরণ্যকশিপুকে হত্যা করেন। হিরণ্যকশিপুর মৃত্যুর পর প্রহ্লাদ রাজা হন।
বৈজ্ঞানিক মতে, পৌরাণিক কাহিনিগুলির কোনো সত্যতা না থাকলেও এগুলির সাহিত্যমূল্য ও জনপ্রিয়তা যথেষ্ট।
Leave a comment