জনগণই ক্ষমতার উৎস: চরম রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবেই জনগণের সার্বভৌমিকতা সংক্রান্ত তত্ত্বের সৃষ্টি হয়। রাজতন্ত্রবিরোধী লেখকগণই এই তত্ত্বের মুখ্য প্রবক্তা। ‘সার্বভৌমিকতার প্রকৃত অধিকারী হল জনগণ’—এই হল এই মতবাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। জনগণের সম্মতিই হল রাষ্ট্রের ভিত্তি এবং জনগণের নির্দেশই হল আইন। রাষ্ট্রের এলাকার ভিতরে এই গণশক্তির উপরে আর কোনও ঊর্ধ্বতন শক্তি নেই।
প্রবক্তাদের মত: প্রাচীনকালে রোমে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারকে স্বীকার করা হয়েছিল। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতা থেকে জনগণের সার্বভৌমিক বিষয়ে ধারণার হয়। মধ্যযুগে মারসিগুলিও (Marsiglio of Padua), উইলিয়াম (William of Ockam), আলথুসিয়াস (Althusius) প্রভৃতি লেখকগণ প্রচার করেন যে জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। লক্ প্রচার করেন যে জনগণই চরম ক্ষমতার অধিকারী। জনগণের ইচ্ছা অনুসারে আইন প্রণীত হয়। শাসক জনগণের প্রতিনিধি হিসাবে তাদের ইচ্ছা অনুসারে শাসনকার্য পরিচালনা করবেন। রুশো তাঁর ‘সমষ্টিগত ইচ্ছার’ (General Will) মাধ্যমে গণ সার্বভৌমিকতার তত্ত্ব ঘোষণা করেন। তিনি বলেছেন: “Voice of the people is the voice of God.” রুশো ‘সমষ্টিগত ইচ্ছা’ বা ‘সাধারণ ইচ্ছা’-কে সার্বভৌম ক্ষমতার চরম অধিকারী হিসাবে ঘোষণা করেছেন এবং বলেছেন যে এই ক্ষমতা কোনদিনই হস্তান্তরিত হয়নি। তাঁর মতানুসারে এই সার্বভৌম ক্ষমতা চরম, অভ্রান্ত ও অহস্তান্তরযোগ্য। ইংল্যাণ্ডের গৌরবময় বিপ্লবে গণ-সার্বভৌমিকতার তত্ত্বটি আংশিকভাবে হলেও প্রযুক্ত হয়েছে। আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম (১৭৭৬) এবং ফরাসী বিপ্লব (১৭৮৯)-এর মাধ্যমে জনগণের চূড়ান্ত ক্ষমতার সদম্ভ আত্মপ্রকাশ ঘটে। জনসাধারণের অধিকার প্রতিষ্ঠার পিছনে রাশিয়ার মহান অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এবং চীনের গণ-বিপ্লবের অবদানও অনস্বীকার্য।
তত্ত্বটির বিকাশ: জেফারসন (Jafferson)-ও এই তত্ত্বের দৃঢ় সমর্থক। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রিচি (Ritchie)-র মতানুসারে জনসাধারণের সমষ্টিগত ক্ষমতার তুলনায় বড় ক্ষমতা আর নেই। জনগণের এই সম্মিলিত ক্ষমতাকে উপেক্ষা করে কোন সরকার টিকে থাকতে পারে না। জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে এবং জনমতের চাপ ও বিপ্লব-বিদ্রোহের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে সার্বভৌম ক্ষমতা ব্যবহার করে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার ব্যাপক প্রসার ঘটে। তার ফলে জনমতের সার্বভৌমিকতাও সুদৃঢ় স্বীকৃতি ও সমর্থন লাভ করে। ব্রাইস (Lord Bryce) -এর মতানুসারে জনগণের সার্বভৌমিকতা গণতন্ত্রের বনিয়াদ ও নীতিবাক্যস্বরূপ। তিনি বলেছেন: “Popular sovereignty has become the basis and watchword of democracy.” তাই এখনকার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত শাসনব্যবস্থা’ (popular control), ‘জনপ্রিয় শাসনব্যবস্থা’ (popular government) প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে মার্কসীয় মতবাদ ও উদারনীতিক ধ্যান-ধারণার মধ্যেও জনগণের সার্বভৌমিকতার মূল কথা নিহিত আছে।
সমালোচনা (Criticism): বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে গণ-সার্বভৌমত্বের তত্ত্বের সমালোচনা করা হয়।
(১) জনগণের সার্বভৌমিকতার ধারণা অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট। এর কোন বিজ্ঞানসম্মত ও নির্দিষ্ট অর্থ করা যায় না। সার্বভৌমিকতা জনগণের হলে, ‘জনগণ’ বলতে ঠিক কি বোঝায় তা পরিষ্কার হয় না। গার্নার বলেছেন: “Those who attribute sovereignty to the people and who proclaim that the will of the people is the voice of God, rarely tell us what they mean by the people.” গার্ণার আরও বলেছেন: “The term popular sovereingty is a frequently and generally used by writers in a loose and inexact sense, and when so used it may lead to misconception and even to mischief.”
(২) সাধারণভাবে জনগণ অসংগঠিত। অসংগঠিত জনগণ কখনই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে না।
(৩) অনেকের মতে জনগণের সার্বভৌমিকতা বলতে জনমতের ক্ষমতাকেই বোঝায়। কিন্তু জনমত অসংগঠিত ও অনির্দিষ্ট। আইনের দৃষ্টিতে তা সার্বভৌম হতে পারে না। গার্নার বলেছেন: “Unorganised public opinion however powerful, is not sovereignty unless it is clothed in legal form….”
(৪) এখনকার সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রতিনিধিরাই আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ভোগ করেন। কার্যক্ষেত্রে তাঁরাই হলেন সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। গেটেলের মতে এই শ্রেণীর নির্বাচকদের সংখ্যা দেশের মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ মাত্র। দেশের জনগণের এক-পঞ্চমাংশের এই ক্ষমতাকে জনগণের সার্বভৌমিকতা বলা যায় না।
(৫) অনেকের মতে জনগণের বিপ্লবের দ্বারা সরকার পরিবর্তনের ক্ষমতাই হল সার্বভৌমিকতা। কিন্তু বিপ্লব আইনসঙ্গত হতে পারে না। অথচ সার্বভৌমিকতার ধারণা হল আইনগত। তাই জনগণের সার্বভৌমিকতার ধারণাকে গেটেল বলেছেন: “A contradiction in terms.”
(৬) আবার সরকার ও জনগণের সঠিক সম্পর্ক নিয়েও প্রশ্ন জাগে। এই তত্ত্ব অযৌক্তিক ও অবাস্তব। তেমনি আবার ভোটাধিকারকে জনগণের সার্বভৌমিকতা হিসাবে গণ্য করা যায় না।
মূল্যায়ন: বহু বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে গণ-সার্বভৌমত্বের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় গণ-সার্বভৌমত্বের গুরুত্ব অপরিসীম। লর্ড ব্রাইসের মতানুসারে এ হল ‘গণতন্ত্রের ভিত্তি ও মূলমন্ত্র’। এই মতবাদ গণশক্তির বিপুল ক্ষমতা ও ব্যাপক প্রভাবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বর্তমানে সরকার জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার অনুগামী হয়। এখন জনমতই হল গণতন্ত্রের ভিত্তি ও প্রাণস্বরূপ। বর্তমানে ভোটাধিকার, স্বায়ত্তশাসন, দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা এবং গণভোট, গণউদ্যোগ, পদচ্যুতি প্রভৃতি প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রকাশ ঘটে। তাই গিলক্রিস্ট এর অভিমত হল ‘জনগণের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাই হল জনগণের সার্বভৌমিকতা।’ তিনি বলেছেন: “The phrase ‘popular control’ better indicates the idea underlying popular sovereignty.” আধুনিক গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হল গণ-সার্বভৌমত্বের তত্ত্ব। ব্যক্তির অধিকার সংরক্ষণ, সরকারের স্বৈরী ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ, জনকল্যাণমূলক তত্ত্বের বাস্তবায়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে জনগণের সার্বভৌমত্বের ধারণার গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না।
Leave a comment