রাষ্ট্রের কার্যাবলী সম্পর্কিত প্রচলিত মতবাদগুলির মধ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও সমাজতন্ত্রবাদ বহু আলোচিত ও উল্লেখযোগ্য। কিন্তু রাষ্ট্রের কর্মপরিধি নির্ধারণের ক্ষেত্রে এ-দুটি মতবাদের কোনোটিই এককভাবে গ্রহণ না করে বর্তমানে অনেকে মধ্যপন্থা অবলম্বনের পক্ষপাতী। অর্থাৎ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও সমাজতন্ত্রবাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্র নির্ধারণ করা। একেই বলে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণবাদ। এই মতবাদ অনুসারে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার ও ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত। কিন্তু জনকল্যাণকে এখানে প্রাথমিক গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং এই উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপ স্বীকার করা হয়। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণবাদে এমন এক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয় যেখানে রাষ্ট্র সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করবে কিন্তু ব্যক্তিগত মালিকানাধীনে পরিচালিত হবে। তবে যে সকল শিল্পবাণিজ্য ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হওয়া দুষ্কর, এই মতবাদ সেই সমস্ত ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ স্বীকার করে। এই মতবাদে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যেই রাষ্ট্রের হাতে অধিক পরিমাণে কল্যাণমূলক কাজের দায়িত্ব ন্যস্ত করে ‘জনকল্যাণকর রাষ্ট্র’ (welfare state)-এর কথা বলা হয়। জনকল্যাণমূলক নীতিতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও সমাজতন্ত্রবাদের চরমতার মধ্যে একটি ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা হয়। জনকল্যাণের প্রয়োজনে এই তত্ত্বে ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের মধ্যে একটি সামঞ্জস্য বিধানের প্রয়াস দেখা যায়। এই ব্যবস্থাকে অনেকে ‘রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা’ (State Regulation System) বলে থাকেন। অনেকে আবার এই ব্যবস্থাকে ‘সমাজকল্যাণকর ব্যবস্থা’ বলে অভিহিত করেন।
সমাজকল্যাণকর ব্যবস্থা: রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণবাদে ব্যক্তিগত মালিকানায় কিন্তু রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়। জনকল্যাণের স্বার্থে কতকগুলি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও নিয়ন্ত্রণ কাম্য বিবেচিত হয়। সেই সকল ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকাকে সমর্থন করা হয়। সকল ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সরাসরি হস্তক্ষেপ সমর্থন করা হয় না। এই সকল রাষ্ট্র সমাজকল্যাণকর রাষ্ট্র বা আংশিক সমষ্টিবাদী রাষ্ট্র হিসাবে গণ্য হয়। বর্তমানে বিশ্বের অ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহে এই মতবাদের ভিত্তিতেই রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধি নির্ধারিত হয়ে থাকে। পশ্চিমী পুঁজিবাদী উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহে এবং এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলিতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও সমাজতন্ত্রবাদের কোনোটিকেই এককভাবে গ্রহণযোগ্য মনে করা হয় না। এই সমস্ত দেশে রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধি নির্ধারণের ব্যাপারে সমাজকল্যাণকর ব্যবস্থা বা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে গ্রহণ করা হয়েছে।
জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের ধারণা:
আধুনিককালের উদারনীতিক গণতন্ত্র বাস্তবে গণতান্ত্রিক জনকল্যাণকর রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়েছে। জনকল্যাণকর রাষ্ট্র কাকে বলে এ বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। হাবার্ট লেম্যান (Herbert Lehman)-এর মতানুসারে যেখানে জনগণের ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে এবং তাদের প্রতিভা যথাযথভাবে পুরস্কৃত হয় তাকে জনকল্যাণকর রাষ্ট্র বলে। কোল (G.D.H. Cole) জনকল্যাণকর রাষ্ট্র বলতে একটি বিশেষ সমাজব্যবস্থাকে বুঝিয়েছেন যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের ন্যূনতম জীবনযাত্রার মান বজায় রাখার মতো প্রয়োজনীয় সমান সুযোগ-সুবিধা বর্তমান থাকে। সমাজতন্ত্রবাদী কোল বলেছেন: “The welfare state is a society in which an assured imum standard of living and opportunity becomes the possession of every citizen.” হবম্যান (Hobman)-এর মতানুসারে জনকল্যাণকর রাষ্ট্র হল সমাজতন্ত্র ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের সমন্বয় সাধনের ফল। তিনি বলেছেন: “A compromise between Communism on the one side and unbridled individualism on the other.” অস্টিন রেনি (Austin Ranney) ও সমমত পোষণ করেন। তাঁর মতানুসারে জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের অবস্থান হল পূর্ণ সমাজতন্ত্র ও পূর্ণ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের মধ্যবর্তী স্থানে। আর্থার স্লেসিংগার জনকল্যাণকর রাষ্ট্র বলতে এমন একটি ব্যবস্থার কথা বলেন যেখানে সরকার সকল নাগরিকের কর্মসংস্থান, রুজি-রোজগার, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে।
ব্যক্তিগত মালিকানার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ: এই সমস্ত সমাজকল্যাণকর রাষ্ট্রের কার্যাবলীই হল আধুনিক রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধি। এই তত্ত্ব অনুসারে বলা হয় যে পরিকল্পিত অর্থব্যবস্থা ছাড়া সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করা যায় না। কিন্তু তার জন্য ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট করার দরকার হয় না। আংশিকভাবে ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্পবাণিজ্য থাকতে পারে। বস্তুত জনগণের কল্যাণের স্বার্থে ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও সম্পত্তির উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার। সরকারী উদ্যোগে যে সকল বিষয় সম্পাদিত হওয়া উচিত নয় বা যেগুলি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে আরও ভালোভাবে সম্পাদিত হতে পারে সেগুলি রাষ্ট্রের মালিকানায় ও নিয়ন্ত্রণে থাকা বাঞ্ছনীয়। অর্থাৎ ব্যক্তিগত মালিকানার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণও বলবৎ থাকবে। বর্তমানে রাষ্ট্রের জনকল্যাণমূলক ভূমিকা সর্বজনস্বীকৃত। রাষ্ট্রই কেবল ব্যক্তির সর্বাধিক কল্যাণসাধনের নিশ্চয়তা সৃষ্টি করতে পারে। ব্যক্তিস্বাধীনতাকে বজায় রেখে সমাজজীবনের সার্বিক কল্যাণ সাধন করাই হল জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের নীতি ও আদর্শ।
জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য:
বর্তমানে মনে করা হয় যে কেবলমাত্র জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের মধ্যেই সুন্দর ও সুখী জীবন সম্ভব। এই উদ্দেশ্যগত ভিত্তিতে জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের কতকগুলি মৌলিক বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করা যায়।
(ক) জনকল্যাণকর রাষ্ট্রতত্ত্বে পূর্ণ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী বা পূর্ণ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে মধ্যপন্থা অনুসরণের কথা বলা হয়। এই মতবাদের প্রবক্তাদের কাছে রাষ্ট্র অকল্যাণকর বা ক্ষতিকর নয়; বরং ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য অপরিহার্য। তবে এঁরা সর্বাত্মক রাষ্ট্রের সর্বব্যাপী নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে।
(খ) সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব বা বুর্জোয়া শ্রেণীর বিলোপ কোনোটাই জনকল্যাণকর রাষ্ট্রতত্ত্বে স্বীকার করা হয় না। এই মতবাদ শ্রেণী সমঝোতার নীতিতে বিশ্বাসী।
(গ) জনকল্যাণকর রাষ্ট্র উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আস্থাশীল। রাজনীতিক সাম্যের প্রতিষ্ঠা, রাজনীতিক ও পৌর অধিকারসমূহের স্বীকৃতি, সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার, একাধিক রাজনীতিক দল, নিরপেক্ষ আদালত, ন্যায়বিচার প্রভৃতিকে কল্যাণকর রাষ্ট্রে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
(ঘ) জনকল্যাণকর রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত অর্থব্যবস্থার পক্ষপাতী। এই রাষ্ট্রে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে স্বীকার করা হয়। কিন্তু অবাধ ব্যবসা-বাণিজ্যকে সমর্থন করা হয় না। পূর্ণ স্বাতন্ত্র্যবাদী বা পূর্ণ সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার ত্রুটিগুলি থেকে মুক্তিলাভের জন্য মিশ্র অর্থব্যবস্থার নীতি অনুসরণ করা হয়।
(ঙ) বিভিন্ন সংস্কারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে ধনতন্ত্রকে সংকটমুক্ত করার এবং স্থিতাবস্থা সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা, শিল্প-বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ, কিছু কিছু শিল্প-বাণিজ্যের জাতীয়করণ, গতিশীল করব্যবস্থা প্রভৃতি ব্যবস্থা সামাজিক ও অর্থনীতিক বৈষম্য দূর করার জন্য জনকল্যাণকর রাষ্ট্রে গ্রহণ করা হয়ে থাকে।
জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের কার্যাবলী
আধুনিক গণতান্ত্রিক জনকল্যাণকর রাষ্ট্রগুলিতে জনসাধারণের ভালোমন্দ ও সুখ-শান্তির সামগ্রিক দায়িত্ব রাষ্ট্রকে গ্রহণ করতে হয়। এই কারণে আধুনিক জনকল্যাণকর রাষ্ট্রকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহুবিধ দায়িত্ব সম্পাদন করতে হয়। জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের বিভিন্ন ও ব্যাপক কার্যাবলীর মধ্যে নিম্নলিখিতগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
(১) প্রতিরক্ষা ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা: বৈদেশিক আক্রমণ থেকে দেশের নিরাপত্তা রক্ষা করা এবং আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের মৌলিক ও প্রাথমিক কর্তব্য। এগুলি রাষ্ট্রের অপরিহার্য বা অবশ্যকরণীয় কাজ। এগুলি সম্পাদনের উপর রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও স্থায়িত্বের সঙ্গে সঙ্গে নিরাপত্তাও নির্ভরশীল। এই উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রকে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, পুলিশি ব্যবস্থা, দেওয়ানি, ফৌজদারি ও অন্যান্য আইন এবং বিচার ব্যবস্থা প্রভৃতি করতে হয়।
(২) ব্যক্তিত্ব বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি: বর্তমানে নাগরিকদের ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযোগী প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা বা অধিকার সৃষ্টি ও সংরক্ষণের দায়িত্বও রাষ্ট্রের অপরিহার্য কর্তব্যের অঙ্গীভূত বলে বিবেচিত হয়।
(৩) ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ: আধুনিক গণতান্ত্রিক জনকল্যাণকর রাষ্ট্রে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে মানুষের অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার হিসাবে গণ্য করা হয়। তাই প্রত্যেকের ব্যক্তিগত সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব রাষ্ট্রকে পালন করতে হয়। কিন্তু সমাজের বৃহত্তর কল্যাণ সাধনের স্বার্থে রাষ্ট্র প্রয়োজনবোধে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের উপর নিয়ন্ত্রণমূলক আইন-কানুন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করতে পারে।
(৪) আর্থনীতিক দায়িত্ব: জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রকে আর্থনীতিক ক্ষেত্রেও গুরুদায়িত্ব পালন করতে হয়। রাষ্ট্রকে একাধারে উৎপাদকের স্বার্থরক্ষার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিক, ভোক্তা প্রভৃতি অন্যান্য ব্যক্তিবর্গের স্বার্থরক্ষার ব্যবস্থা করতে হয়। এই উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রকে কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রেও হস্তক্ষেপ করতে এবং প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করতে হয়।
(৫) উৎপাদন ও বণ্টন নিয়ন্ত্রণ: উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রকে বণ্টন ব্যবস্থার উপর প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হয়। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সাফল্যের পথে ধনবৈষম্য একটি বড়ো বাধা। তাই রাষ্ট্রকে বণ্টনব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে ধনবৈষম্য হ্রাসের ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হয়।
(৬) পারিবারিক স্বাচ্ছন্দ্য সংরক্ষণ: কল্যাণমূলক রাষ্ট্রকে ব্যক্তিমানুষের পারিবারিক জীবনে সুখ স্বাচ্ছন্দ্য সৃষ্টি ও সংরক্ষণের ব্যাপারেও প্রয়োজনীয় কর্তব্য সম্পাদন করতে হয়। পারিবারিক জীবনের সুখ সমৃদ্ধির কথা বিবেচনা করে রাষ্ট্র বিবাহ, বিবাহ-রিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার পরিবার পরিকল্পনা প্রভৃতি বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করে। তা ছাড়া জনসংখ্যার চাপ হ্রাসের উদ্দেশ্যে পরিবার পরিকল্পনার সফল রূপায়ণের জন্য রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
(৭) আর্থনীতিক পরিকল্পনা: কতকগুলি ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কাজকর্ম সম্ভব হলেও যথাযথভাবে সম্পন্ন হতে পারে না। সেইজন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ কাম্য বিবেচিত হয়। উদাহরণ হিসাবে শিক্ষা-ব্যবস্থার বিস্তার, জনস্বাস্থ্যমূলক ব্যবস্থা সংরক্ষণ, বেকার সমস্যার সমাধান ও অন্যান্য জনসেবামূলক কার্যাদির উল্লেখ করা যায়। এই সকল উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রকে আর্থনীতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও রূপায়ণ করতে হয়।
(৮) রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ: আবার কতকগুলি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও পরিচালনা অপরিহার্য বিবেচিত হয়। উদাহরণ হিসাবে রেল, ডাক ও তার বিমান প্রভৃতি যোগাযোগ ও যাতায়াত ব্যবস্থার সংরক্ষণ ও উন্নতি সাধন সরকারী উদ্যোগে হওয়া আবশ্যক। তা ছাড়া জাতীয় মুদ্রা ও ঋণ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার দায়িত্বও অপরিহার্যভাবে রাষ্ট্রের উপরই এসে পড়ে।
সমালোচনা:
রাষ্ট্রের কার্যাবলী সম্পর্কিত জনকল্যাণমূলক তত্ত্ব বা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণবাদ বিরূপ সমালোচনার হাত এড়িয়ে যেতে পারেনি।
-
(১) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীদের মতানুসারে এই তত্ত্ব রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্র নির্ধারণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণকে স্বীকার করেছে এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও ব্যক্তিস্বাধীনতাকে ব্যাহত করেছে।
-
(২) অপরদিকে সমাজতন্ত্রবাদীদের অভিযোগ হল, এই মতবাদ ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিচালিত শিল্প বাণিজ্যের পরিচালনা সংক্রান্ত কতকগুলি শর্ত নির্ধারণ করে এবং সেগুলিকে বাস্তবায়িত করার দায়িত্ব ব্যক্তির হস্তেই ন্যস্ত করে। তার ফলে জনসাধারণের স্বার্থ বিপন্ন হয়ে পড়ে।
-
(৩) মার্কসবাদীদের মতানুসারে রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধি সংক্রান্ত এই তত্ত্ব হল আসলে পুঁজিবাদী উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা বজায় রাখার একটি কৌশল মাত্র।
মার্কসীয় দর্শন অনুসারে বলা হয় যে, ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের স্বীকৃতি এবং সঙ্গে সঙ্গে জনগণের আর্থনীতিক মুক্তি ও সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ অসম্ভব। একমাত্র ধনবৈষম্যহীন, শ্রেণীহীন, শোষণহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণের সামগ্রিক ও সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সাধন করা সম্ভব।
উপসংহার: বস্তুতপক্ষে, জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রতত্ত্বের মূল উদ্দেশ্য হল প্রচলিত সামাজিক কাঠামোর মধ্যেই জনগণের ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা ভোগের ব্যবস্থা করা। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও সমাজতন্ত্রবাদের মধ্যে এক আপসমূলক ব্যবস্থার ভিত্তিতে এই মতবাদের উদ্ভব হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমী অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশসমূহে জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের আদর্শকে স্বীকার, সমর্থন ও অনুসরণ করা হয়।
Leave a comment