‘অতিথি’ গল্পটির নামকরণের সার্থকতা বিচার করো।
গল্পের নামকরণ সাধারণত চবিত্র, বিষয়বস্তু বা ভাববস্তুকে অবলম্বন করে গড়ে ওঠে। ‘অতিথি’ গল্পটি একটি চরিত্র প্রধান গল্প, কিন্তু সে চরিত্রের মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ আপন ভাবনাকেও রূপ দিয়েছেন। সুতরাং চরিত্রের নামে গল্পটি চিহ্নিত হলে সেই ভাবনাটি পরিস্ফুট হত না। রবীন্দ্রনাথ এমন একটি গ্রামীণ চরিত্রের কল্পনা করেছেন এ পৃথিবীতে সে যেন অতিথি, কোনো বস্তু বা ব্যক্তির সঙ্গে সে কোনো বন্ধন অনুভব করে না। সে প্রকৃতি ও জীবনলীলার সঙ্গে ভেসে চলে কোনো গোষ্ঠী বা পরিবারে আশ্রয় নেয় অতিথির মতোই; তারপর বন্ধন প্রগাঢ় হওয়ার আগেই চলে যায়। কোনো বিশেষ কাজে আবদ্ধ না থাকায়, পল্লীসমাজের সমস্ত কাজে তার অসাধারণ নৈপুণ্য। তার মন কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয়ে সে পল্লীজীবনের সম্পর্কের সঙ্গে নিজ প্রীতিবন্ধন সহজেই স্বীকার করে নিতে পারে। আর বাইরে প্রকৃতির ঋতু পরিবর্তনের সময়ে যে আনন্দ অনুভব করে তা অপ্রতিরোধ্য। সেই আনন্দের তীব্র আকর্ষণ সমস্ত স্নেহ-সংস্কারকে সবলে ছিন্ন করে তাকে নিরুদ্দেশযাত্রায় প্রকৃতির সহযাত্রী হতে প্রণোদিত করে। এরকম চরিত্রের উদ্ভব বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে নয়, লেখকের মানস কল্পনার উৎস থেকে।
‘অতিথি’ নামের মধ্যে কল্পিত আদর্শ চরিত্র ও সে চরিত্রের মধ্য দিয়ে লেখকের জীবন-অভিজ্ঞতা ও শিল্পসঙ্গতির মধ্যে একটি অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। নায়কের নামে নামকরণ করলে বা বিশুদ্ধ ভাবনা প্রতিফলিত অভিধায় চিহ্নিত করলে এই সমন্বয়টি পরিস্ফুট হত না।
তারাপদ চরিত্রটি বিশ্লেষণ করে লেখক তার বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট করে তুলেছেন। তিনি লিখেছেন, “কিন্তু বন্ধন, এমন-কি, স্নেহবন্ধনও তাহার সহিল না; তাহার জন্মনক্ষত্র তাহাকে গৃহহীন করিয়া দিয়াছে; সে যখনই দেখিত নদী দিয়া বিদেশী নৌকা গুণ টানিয়া চলিয়াছে, গ্রামের বৃহৎ অশ্বত্থ গাছের তলে কোন দূরদেশ হইতে এক সন্ন্যাসী আসিয়া আশ্রয় লইয়াছে, অথবা বেদেরা নদীতীরের পতিত মাঠে ছোটো ছোটো চাটাই বাঁধিয়া বাঁখারি ছুলিয়া চাঙারি নির্মাণ করিতে বসিয়াছে, তখন অজ্ঞাত বহিঃপ্রকৃতির স্নেহহীন স্বাধীনতার জন্য তাহার চিত্ত অশান্ত হইয়া উঠিত। উপরি-উপরি দুই-তিনবার পলায়নের পর তাহার আত্মীয়বর্গ এবং গ্রামের লোক তাহার আশা পরিত্যাগ করিল।” উদ্ধৃত অংশে লেখক তারাপদর মূল বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলেছেন যে বৈশিষ্ট্যের মধ্য দিয়ে তাঁর কল্পনাজাত আদর্শ চরিত্রটির সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং ‘অতিথি’ নামকরণে লেখকের তত্ত্ব ও চরিত্র-বৈশিষ্ট্য উভয়ই পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে; সুতরাং এই গল্পের নামকরণ সম্পূর্ণ সার্থক হয়েছে।
ছোটোগল্পরূপে রবীন্দ্রনাথের ‘অতিথি’ গল্পটির সার্থকতা বিচার করো।
সবকিছুই ছোটগল্পের বিষয়বস্তু হতে পারে। গল্পস্রষ্টার চেতনা ও উপলব্ধিতে ধৃত চলমান জীবনের যে কোনো মুহূর্ত বা মানবচরিত্র ছোটগল্পে রূপায়িত হতে পারে। ছোটগল্পের মধ্যে সাধারণত তিনটি উপাদান লক্ষ্য করা যায় –
(১) অপার বিস্তৃত রহস্য-জটিল আধুনিক জীবনভূমি, যার প্রতিবিন্দুতে জমে আছে অতলান্ত গভীরতা ; তার যে কোন একটি বিন্দর গহনে তলিয়ে পূর্ণ-জীবনের একটি অখণ্ড ছায়ারূপকে পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে ছোটগল্পে।
(২) ছোটগল্পের দ্বিতীয় উপাদান শিল্পী-ব্যক্তির ঘন-নিবিড় অনুভব-তন্ময়তা–চলমান জীবন সম্পর্কে তাঁর ধ্যানীজনোচিত আত্মমগ্নতা। সেই সুস্থির চেতনার মুকুরে যেন পূর্ণ জীবনের ছায়া পড়ে।
(৩) ব্যানাধর্মিতা ছোটগল্পের অন্যতম প্রধান শর্ত। যেন একটি জীবনের বিশেষ মুহূর্তের অভিঘাত বা আবেগ সর্বজনীনতায় উত্তীর্ণ হয়ে থাকে।
ছোটগল্পে জীবন-অভিজ্ঞতার যেটুকু তুলে নেওয়া হয় আর যে বৃহৎ অংশ পরিত্যক্ত হয় উভয় উভয়ের পরিপূরকরূপে প্রতিভাত হয়। যা বাইরে থাকে তা ব্যানার রঞ্জনরশ্মিতে বোধশক্তির বিষয়ভূত হয়। ‘অতিথি’ গল্পে এই লক্ষণগুলি অতি চমৎকারভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
‘অতিথি’ গল্পে সংসারবন্ধনহীন, মুক্ত স্বভাব তারাপদ বহিঃপ্রকৃতির প্রাণলীলাচল, নিয়ত-অগ্রসরমান মর্মসত্তার একটি অপূর্ব স্ফুরণ। প্রকৃতির সহযাত্রী হয়ে বালক তারাপদ সকল মানবিক বন্ধন ও স্নেহসংস্কারকে ছিন্ন করে নিরুদ্দেশযাত্রায় অগ্রসর হয়ে চলে। এই চরিত্র খুব স্বাভাবিক বা বাস্তব নয়। তাকে স্বাভাবিক করার জন্য যে পল্লী-পরিবেশ রচিত হয়েছে, অন্যান্য মানুষের সঙ্গে তার যে সম্পর্ক, বর্ণনা ও ঐ সম্পর্কের প্রভাবে তার যে মানস প্রতিক্রিয়াগুলি নির্দেশ করা হয়েছে তাতে লেখকের জীবন-অভিজ্ঞতা ও শিল্পসঙ্গতির মধ্যে একটা অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। তরুণ বয়সে আধ্যাত্মিক প্রেরণায় গৃহত্যাগ করা এমন কিছু দুর্লভ ঘটনা নয়, যাত্রা বা কবিগানের আকর্ষণে কোনো কোনো বালক ঘরছেড়ে বেরিয়ে পড়ে; কিন্তু তারাপদর মতো কোনো বালকই বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক আকর্ষণে মুগ্ধ হয়ে, আবেষ্টনের কলুষিত প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থেকে স্বেচ্ছাবিহারের ভূমিকা গ্রহণ করেনি। রবীন্দ্রনাথ চিরপরিচিত পল্লীদেহের মধ্যে এক চিরমুক্ত, উদাসীন কিশোর কুমারের আত্মা সমাবেশ করে পাঠকের বাস্তববোধ ও আদর্শসৌন্দর্যকল্পনা উভয়েরই যুগপৎ পরিতৃপ্তি সাধন করেছেন।
“তারাপদর জীবনবর্ণনাই লেখকের উদ্দেশ্য। সে জীবনের মধ্যে তাঁর জীবনদর্শনও প্রকাশিত হয়েছে। তারাপদর মধ্য দিয়ে জীবনের যে খণ্ড অংশটি লেখক রূপায়িত করেছেন তাতে পল্লীপ্রকৃতি ও পল্লীজীবনের আশ্চর্য সৌন্দর্য ও মাধুর্য প্রকাশিত হয়েছে, সে জীবনের মালিন্য ও কদর্যতা গল্পের প্রয়োজনেই অপ্রকাশিত থেকেছে। একটি মুক্তমন উদাসীন চরিত্র অঙ্কিত করে রবীন্দ্রনাথ এক পূর্ণ জীবনের আভাস দিয়েছেন যা ছোটগল্পের একটি বিশেষ ধর্ম। তারাপদ চরিত্রের রূপায়ণে মানুষের চিত্তে অসীমের আহ্বানের সাড়া রবীন্দ্রনাথের ‘মানুষের ধর্ম’-এর দর্শনও প্রতিফলিত হয়ে এক গভীর ব্যানার সৃষ্টি করে। তারাপদর শেষ নিরুদ্দেশ হওয়ার ঘটনাও এক প্রতীকী তাৎপর্য লাভ করেছে। বাস্তব পল্লীজীবনের পরিবেশে এক বিশেষ চরিত্র সৃষ্টি করে রবীন্দ্রনাথ -তাঁর দার্শনিক ভাবনাকে তার মধ্যে অনুস্যুত করে দিয়েছেন কিন্তু গল্পের প্রয়োজনে সম্পূর্ণ গ্রহণযোগ্য করে তুলেছেন।
সুতরাং ছোটগল্পের তাত্ত্বিক দিক থেকে ‘অতিথি’ গল্পটি বিচার করলে একে একটি রসোত্তীর্ণ ছোটগল্প বলে স্বীকার করতেই হয়।
Leave a comment