‘সুভা’ নামক গল্পটি মূক বালিকার সহিত মৌন বিরাট প্রকৃতির নিগূঢ় ঐক্যের পরিচয়ে আগাগোড়া পরিপূর্ণ।— আলোচনা করো।

কয়েকটি ছোটগল্পে রবীন্দ্রনাথের কবিপ্রতিভা ও কবিসুলভ সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি গল্পের সহায়তাবিধানে অগ্রসর হয়েছে। স্বভাবসিদ্ধ কবিত্ব-শক্তির বলে তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলির কার্যকলাপ ও চিন্তাধারার সঙ্গে বিশাল বহিঃপ্রকৃতির এক নিগূঢ় সম্বন্ধ করে অতি তুচ্ছ ঘটনাগুলিবও আশ্চর্যরূপ রূপান্তর সাধন করেছেন। নিতান্ত অনায়াসে সামান্য দু’একটি রেখাপাতের দ্বারা তিনি মানবমনের সঙ্গে বহিঃপ্রকৃতির অন্তরঙ্গ পরিচয়ের সিংহদ্বারটি খুবলে দিয়েছেন তার তুচ্ছ গ্রাম্য কাহিনীগুলিও প্রকৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে অপরূপ গৌরবে মণ্ডিত হয়ে উঠেছে।

‘সুভা’ গল্পটির মধ্যে রবীন্দ্রনাথের কবিস্বরূপটি প্রকাশ পেয়েছে মুকবালিকার হৃদয়স্থিত ভাবের আন্দোলনের বর্ণনায়। বাক্যহীন ও সঙ্গীহীন এই বালিকা যেন গভীরভাবে প্রকৃতির নিগূঢ় অন্তরে অবস্থান করত। প্রকৃতির সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বর্ণনা করেছেন, “প্রকৃতি যেন তাহার ভাষার অভাব পূরণ করিয়া দেয়। যেন তাহার হইয়া কথা কয়। নদীর কলধ্বনি লোকের কোলাহল, মাঝির গান, পাখির ডাক, তরুর মর্মর সমস্ত মিশিয়া চারিদিকের চলাফেরা-আন্দোলন-কম্পনের সহিত এক হইয়া, সমুদ্রের তরঙ্গরাশির ন্যায়, বালিকার চিরনিস্তব্ধ হৃদয়-উপকূলের নিকটে আসিয়া ভাঙিয়া ভাঙিয়া পড়ে। প্রকৃতির এই বিবিধ শব্দ এবং বিচিত্র গতি, ইহাও বোবার ভাষা বড়ো বড়ো চক্ষুপল্লববিশিষ্ট সুভার যে ভাষা তাহারই একটা বিশ্বব্যাপী বিস্তার; ঝিল্লিরবপূর্ণ তৃণভূমি হইতে শব্দাতীত নক্ষত্রলোক পর্যন্ত কেবল ইঙ্গিত, ভঙ্গী, সংগীত, ক্রন্দন এবং দীর্ঘনিশ্বাস।” বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সুভা যেন প্রকৃতিকে আরও গভীরভাবে অনুভব করতে পারল। তার অন্তরাত্মা যেন এক নতুন অনির্বচনীয় চেতনাশক্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে লাগল। গভীর পূর্ণিমারাত্রে যে এক-একদিন দ্বার খুলে ভয়ে ভয়ে মুখ বাড়িয়ে বাইরের দিকে চেয়ে দেখে। “পূর্ণ-প্রকৃতিও সুভার মতো একাকিনী সুপ্ত জগতের উপর জাগিয়া বসিয়া যৌবনের রহস্যে পুলকে বিষাদে অসীম নির্জনতার একেবারে শেষসীমা পর্যন্ত, এমন কি তাহা অতিক্রম করিয়াও থমথম করিতেছে, একটি কথা কহিতে পারিতেছে না। এই নিস্তব্ধ ব্যাকুল প্রকৃতির প্রান্তে একটি নিস্তব্ধ ব্যাকুল বালিকা দাঁড়াইয়া।”

রবীন্দ্রনাথের বর্ণনার মধ্য দিয়ে জ্যোৎস্নাস্নাত নিস্তব্ধ প্রকৃতির যে সৌন্দর্যপূর্ণ রূপটি ফুটে উঠেছে, তার হৃদয়স্পর্শী বর্ণনা দেওয়া একমাত্র কবির পক্ষেই সম্ভব। মূক বালিকা সুভার সঙ্গে বিরাট মৌন প্রকৃতির নিগূঢ় ঐক্যের উদ্ঘাটন একটি তুচ্ছ গ্রাম্য বালিকার চরিত্রটিকেও অসাধারণ দীপ্তিমান করে তুলেছে। সাধারণ প্রত্যক্ষ বাস্তব গ্রাম্য বালিকাকে প্রকৃতির স্পর্শ যেন রূপান্তর ঘটিয়ে দিয়েছে।

ছোটগল্পরূপে রবীন্দ্রনাথের ‘সুভা’ গল্পটির বিচার করো।

রবীন্দ্রনাথের ‘সুভা’ গল্পটি একটি গ্রাম্য বোবা মেয়ের কাহিনী। শৈশবে এবং বাল্যে সে প্রকৃতির মধ্যেই গড়ে উঠেছে। এই বোবা মেয়েটির বড়ো হয়ে ওঠা এবং সামাজিক চাপে তার ট্র্যাজিক পরিণতি অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী বর্ণনায় লেখক উপস্থাপিত করেছেন। সামাজিক জীবনে এই তুচ্ছ ঘটনাটির মধ্যেও যে অবিচার ও নিষ্ঠুরতা তাকে এক বিপুল মানবিক ব্যাপ্তি দিতে পারে ‘সুভা’ গল্পের ট্র্যাজিক পরিণতিতে তার পরিচয় পাওয়া যায়।

গল্পস্রষ্টার চেতনা উপলব্ধির মধ্যে চলমান জীবনের যে কোনো মুহূর্তই ছোটগল্পে রূপায়িত হতে পারে। আপাত বিচারে তুচ্ছ একটি গ্রাম্য জীবনের অংশকে নিয়ে এই গল্পে যে রসের সঞ্চার ঘটান হয়েছে তা বিশ্বজনীন মানবচিত্তের বেদনাকেই গল্পটিতে সঞ্চার করে দিয়েছে।

ড. ভূদেব চৌধুরী যে প্রধান তিনটি উপাদানের কথা উল্লেখ করেছেন তাদের নিরিখেই রবীন্দ্রনাথের ‘সুভা’ গল্পটির বিচার করে দেখা যেতে পারে তা কতখানি রসোত্তীর্ণ হয়েছে। ড. চৌধুরী উপাদানগুলি সম্পর্কে লিখেছেন –

প্রথমত, অপার বিস্তৃত রহস্য জটিল আধুনিক জীবনভূমি, যার প্রতি বিন্দুতে জমে আছে অতলান্ত গভীরতা। তার যে-কোনো একটি বিন্দুর গহনে তলিয়ে পূর্ণজীবনের একটি অখণ্ড ছায়ারূপকে প্রত্যক্ষ করা যেতে পারে।

ছোটগল্পের দ্বিতীয় উপাদান শিল্পী-ব্যক্তির ঘন-নিবিড অনুভব-তন্ময়তা-চলমান জীবন সম্বন্ধে তাঁর ধ্যানীজনোচিত আত্মস্থতা। সেই সুস্থির চেতনার মুকুরে জীবনের যে কোনো মুহূর্ত যেন পূর্ণ জীবনের ছায়া ফেলতে পারে।

তৃতীয়ত, চাই রচনার ব্যঞ্জনাধর্মিতা। যেন একটি জীবনের বিশেষ মুহূর্তের অবস্থান অভিঘাত বা আবেগ সর্বদেশকালের জীবনভূমিতে উৎক্রমণ (trauocend) করতে পারে।

এই উপাদান বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই ছোটগল্পের অসমাতুলা স্বাতন্ত্র্য। মুহূর্তের বিন্দুমূলে জীবনসিন্ধুর পূর্ণ-চেতনা যে গল্পের পরিণামে ব্যঞ্চিত হয় না, সে গল্প ছোট হলেও ছোটগল্প নয়, আখ্যান, উপাখ্যান, উপকথা বা যা খুশি হতে পারে তার বাধা নেই। অতএব, সীমায়িত জীবনের ক্ষণবৃত্তে অনন্ত জীবনের ব্যঞ্জনা রচনাতেই ছোটগল্পের রূপশৈলীর বিশিষ্টতা।

‘সুভা’ গল্পটি একটি গ্রাম্য মৃক বালিকার কাহিনী। তার সঙ্গে মৌন বিরাট প্রকৃতির নিগূঢ় ঐক্যের পরিচয়ে আগাগোড়া পরিপূর্ণ। আপাতদৃষ্টিতে সুভার মতো গ্রামের একটি বোবা মেয়ের অকিঞ্চিৎকর জীবন অতি তুচ্ছ ব্যাপার। কিন্তু সেই আপাততুচ্ছ জীবনটিকে গ্রহণ করে তার অন্তরের বেদনাকে প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে লেখক এক অসাধারণ করুণ রসের সৃষ্টি করেছেন। একটি মূক বালিকাকে প্রকৃতির সঙ্গে বৃহৎ একাত্মতায় লগ্ন করে লেখক তাকে প্রকৃতি তন্ময়তার সাঙ্কেতিক-গৌরবমণ্ডিত করেছেন এবং সেই প্রচেষ্টার সফলতায় গল্পটি একটি সার্থক ছোটগল্পে পরিণত হয়েছে। একটি জীবনের বিশেষ মুহূর্তের অবস্থান সর্বদেশকালের জীবনভূমিতে উৎক্রমণ করতে পেরেছে।

গল্পটি বর্ণনায় লেখক রবীন্দ্রনাথের চলমান জীবন সম্পর্কে যে ধ্যানীজনোচিত আত্মস্থতা অনুভব করা যায় তা আলোচ্য গল্পটিকে সার্থক ছোটগল্পের মর্যাদা দিয়েছে। নিম্নোদ্ধৃত অংশে লেখকের যে আত্মলীল বর্ণনা লক্ষ্য করা যায় তা কবিসুলভ এবং আলোচ্য গল্পে তা কবির এক জীবনদর্শনেরই প্রকাশ। প্রকৃতির সঙ্গে সুভার একাত্মতা উল্লেখ করে লেখক বর্ণনা করছেন, “প্রকৃতির এই বিবিধ শব্দ এবং বিচিত্র গতি, ইহাও বোবার ভাষা—বড়ো বড়ো চক্ষুপল্লব বিশিষ্ট সুভার যে-ভাষা তাহারই একটা বিশ্বব্যাপী বিস্তার ; ঝিল্লিরবপূর্ণ তৃণভূমি হইতে শব্দাতীত নক্ষত্রলোক পর্যন্ত কেবল ইঙ্গিত, ভঙ্গী, সংগীত, ক্রন্দন এবং দীর্ঘ নিশ্বাস এবং মধ্যাহ্নে যখন মাঝিরা, জেলেরা খাইতে যাইত, গৃহস্থেরা ঘুমাইত, পাখিরা ডাকিত না, খেয়া নৌকা বন্ধ থাকিত, সজন জগৎ সমস্ত কাজ কর্মের মাঝখানে সহসা থামিয়া গিয়া ভয়ানক বিজন মূর্তি ধারণ করিত, তখন রুদ্র মহাকাশের তলে কেবল একটি বোবা প্রকৃতি এবং একটি বোবা মেয়ে মুখোমুখি চুপ করিয়া বসিয়া থাকিত—একজন সুবিস্তীর্ণ রৌদ্রে আর একজন ক্ষুদ্র তরুচ্ছায়ায়।

আলোচ্য গল্পটিতে বিন্দুতে সিন্ধুর যে স্বাদ সঞ্চারিত হয়েছে তা ছোটগল্পের সার্থকতা লাভের পক্ষে অপরিহার্য। একটি গ্রাম্য বোবা মেয়ে ‘সুভা’কে গ্রহণ করে চলমান জীবনের সেই বালিকা বিন্দুটির মধ্যে যে বিশাল মানবিক সত্যটিকে লেখক প্রতিফলিত করেছেন এবং সুভার বিষণ্ণ পরিণতিতে যে বেদনার তরঙ্গ পাঠকের হৃদয়ে আঘাত করে তা ‘সুভা’ গল্পটিকে সার্থক ছোটগল্পরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

কি জীবনবিন্দুতে পূর্ণজীবনের ছায়াঘন প্রতিফলিত করায়, কি শিল্পীব্যক্তির নিবিড় অনুভব তন্ময়তার, কি রচনার ব্যঞ্ছনাধর্মিতায় ‘সুভা’ গল্পটি একটি সার্থক ছোটগল্পরূপে গড়ে উঠেছে।