কাব্যের জগৎ ভাব-কল্পনার জগৎ হতে পারে, কিন্তু কথাশিল্পের জগৎ আবশ্যিকভাবেই মৃত্তিকালগ্ন। বাস্তব পৃথিবীর অভিজ্ঞতা, মাটি ও মানুষের স্পর্শে হৃদয়ের পুষ্টি না ঘটলে কথাশিল্প রচনায় সার্থকতা অর্জন অসম্ভব। রবীন্দ্রনাথ প্রধানত কবি। কিন্তু শিল্পের বিচিত্র শাখায় তাঁর প্রতিভার উৎসার। বিশেষত সাহিত্যের প্রতিটি প্রশাখায় তাঁর অবাধ সঞ্চরণ। কিন্তু কাব্যের জগতে অতি শৈশবেই সিদ্ধিলাভ করলেও কথাশিল্প বিশেষত ছোটো গল্পের শিল্পশাখায় সিদ্ধি অর্জন করার ক্ষেত্রে ভাষা-কৌশলের পাশাপাশি আরও এক অভিজ্ঞতা অর্জনের অপেক্ষা ছিল। বাংলার প্রাণময় জীবনের বাস্তবনিষ্ঠ নিবিড় পাঠ গ্রহণ না করলে রবীন্দ্রনাথের পক্ষে অসম্ভব ছিল ছোটো গল্প তথা ‘গল্পগুচ্ছ’র জগতে অনুপ্রবেশ।
১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে জমিদারি পরিদর্শন এবং পরবর্তীকালে জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর রবীন্দ্রনাথকে সুদীর্ঘকাল বিরাহিমপুর পরগনা, ইসব্সাহী পরগনা ও কালীগ্রাম পরগনায় কাটাতে হয়েছিল। এছাড়াও ছিল ওড়িশার জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব। এসময় তাঁর জীবনের অনেকখানি অধ্যায় কেটেছিল শিলাইদহ পতিসর-সাজাদপুর অঞ্চলের নদীনালা-বিল সংলগ্ন পদ্মিপ্রকৃতি ও পল্লিজীবনের কাছাকাছি। এই অধ্যায়ে যেমন একদিকে চলেছে অবাধ-উন্মুক্ত প্রকৃতির রস-সম্ভোগ, তেমনি অন্যদিকে ঘটেছে সুখ-দুঃখ আশা-নিরাশায় দোলায়িত, অভাবে বিক্ষোভে সংক্ষুব্ধ, প্রীতিতে বঞ্চনায় তপ্ত সাধারণ দরিদ্র মানুষের জীবন সংসর্গ। দূর থেকে রোমান্টিক দৃষ্টিতে দেখা সেই সব মানুষের ছবি ক্রমশ জমিদারির দায়িত্ব পালনের সূত্রেই হয়ে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের পল্লিভাবনা, স্বদেশ ভাবনার কেন্দ্রীয় শক্তি। ‘ছিন্নপত্র’-র জীবন-নদীতে ভাসমান সেই বুদ্বুদ্ প্রতিম মানুষেরাই ক্রমশ তাঁর কাছে হয়ে উঠেছে—“একটি দেশজোড়া বৃহৎ পরিবারের লোক” (৯৬ সংখ্যক পত্র)। পরবর্তীকালে নানা আলাপচারিতায় স্মৃতি রোমন্থনে, ‘পল্লীপ্রকৃতি’-তে সংকলিত ভাষণগুলিতে বারংবার রবীন্দ্রনাথ স্মরণ করেছেন সেই পল্লিপ্রকৃতি ও মানুষের মহৎ সংসর্গের কথা, বিশেষত তাঁর ছোটো গল্পের বীজ বপনের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার কথা— “বোট ভাসিয়ে চলে যেতুম পদ্মা থেকে পাবনার কোলের ইছামতীতে, ইছামতী থেকে বড়লে, হুড়ো সাগরে, চলন বিলে, আত্রাইয়ে, নাগর নদীতে, যমুনা পেরিয়ে সাজাদপুরের খাল বেয়ে সাজাদপুরে। দুই ধারে কত টিনের ছাদওয়ালা গঞ্জ, কত মহাজনী নৌকায় ভিড়ের কিনারায় হাট, কত ভাঙনধরা তট, কত বর্ধিষ্ণু গ্রাম। ছেলেদের দলপতি ব্রাহ্মণ বালক, গোচারণের মাঠে রাখাল ছেলের জটলা বনঝাউ-আচ্ছন্ন পদ্মা তীরের উঁচু পাড়ির কোটরে গাঙ শালিকের উপনিবেশ। আমার গল্পগুচ্ছের ফসল ফলেছে আমার গ্রাম-গ্রামাত্তরের পথে-ফেরা এই বিচিত্র অভিজ্ঞতার ভূমিকায়।”
রবীন্দ্রনাথ আরও একবার স্বীকার করেছেন— “সেই নিরন্তর জানাশোনার অভ্যর্থনা পাচ্ছিলুম অন্তঃকরণে, যে উদ্বোধন এনেছিল তা স্পষ্ট বোঝা যাবে ছোট গল্পের নিরন্তর ধারায়।”
যথার্থই ইতিপূর্বে ‘বৌঠাকুরাণীর হাট’ বা ‘রাজর্ষি’র ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বা ‘ঘাটের কথা’ বা ‘রাজপথের কথা’র রোমান্টিক কল্প-কাহিনির ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের কথাসাহিত্যের প্রেরণা কুণ্ঠিতভাবে আবর্তিত হচ্ছিল। কিন্তু ‘ছিন্নপত্র’-পর্বে বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা প্রকৃতি ও মানুষের গভীর সংসর্গ রবীন্দ্রনাথের ছোটো গল্প রচনার অভীষ্মাকে অজস্র উপকরণে পরিপূর্ণ করে তুলল। ১৮৯১-এর মে মাসে প্রকাশিত ‘হিতবাদী’ এবং নভেম্বর থেকে প্রকাশিত ঠাকুরবাড়ির ‘সাধনা’ পত্রিকায় তাই এসময় রবীন্দ্রনাথের ছোটো গল্পের ধারা পূর্ণ শক্তিতে আত্মপ্রকাশ করে।
‘ছিন্নপত্র’ পর্বে দৃষ্টি এবং হৃদয় দিয়ে যে অর্জন, তা-ই শিল্পরূপ নিয়ে অভিব্যক্ত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ছোটো গল্পগুলিতে। ‘গল্পগুচ্ছ’-র গল্পগুলির পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ অনেক উপকরণের সন্ধান পাওয়া যাবে ‘ছিন্নপত্রাবলী’তেই। পদ্মার ভ্রূক্ষেপহীন উদ্দাম স্রোত, ছোটো নদীর বুকে জেলেডিঙি, সন্ধ্যার ছায়াচ্ছন্নতায় ঢাকা নদী তীরবর্তী গ্রাম, মানুষের ব্যস্ত যাওয়া-আসা, পদ্মার বর্ষাস্ফীত মূর্তি, নিস্তব্ধ বালির চর, নদী চরে রাত চরা পাখির রহস্যময় ‘টি-টি’ ডাক, গ্রাম বধূদের ঘাটে আগমন, শিশুদের জলক্রীড়া বা অর্থহীন আমোদ, নদীর ভাঙন ইত্যাদি চোখে দেখা দৃশ্যগুলিই রচনা করেছে ‘গল্পগুচ্ছ’-র গল্পগুলির পটভূমি। বাংলার গ্রাম প্রকৃতিই গড়ে তুলেছে তাঁর ছোটো গল্পের ভূগোল। এমনকি রবীন্দ্রনাথের কোনো কোনো গল্পে যে অতিপ্রাকৃত পরিবেশ রচিত হয়েছে, সেই রহস্যাচ্ছন্ন মায়াময়তাও অনেকখানি ‘ছিন্নপত্র’—পর্বের সন্ধ্যা বা নিশাচারণার অভিজ্ঞতা সূত্রেই অর্জিত।
কিন্তু এ তো গেল পটভূমি-প্রতিবেশের কথা। রবীন্দ্রনাথের কোনো কোনো ছোটো গল্পের চরিত্র ও ঘটনার অপরিস্ফুট আভাসও মিলবে তাঁর ‘ছিন্নপত্র’-র পৃষ্ঠায়। যেমন ‘অতিথি’ গল্পে তারাপদর দেখা সেই বেদেদের জগৎ— “বেদেরা নদীর ধারে তীরের পতিত মাঠে ছোটো ছোটো চাটাই বাঁধিয়া, বাখারি ছুলিয়া চাঙারি নির্মাণ করিতে আসিয়াছে….”
এ জগৎ তো ‘ছিন্নপত্র’র রবীন্দ্রনাথেরই অর্জন— “ঠিক আমার জানালার সম্মুখে, খালের ওপারে, একদল বেদে বাখারির উপর খানকতক দর্মা এবং কাপড় টাঙিয়ে দিয়ে তারই মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। …..এখনো তারা নিশ্চিন্ত ভাবে বসে বসে বাখারি চিরছে, বাঁধছে-বাড়ছে, উকুন বাচছে।”
সাজাদপুরে ঘাটের কাছে সমাগত ‘জনপদবধূদের কন্যা-বিদায়ের’ দৃশ্যটি রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘকাল মনে রেখেছিলেন। পল্লিবালিকার স্বভাবগত লজ্জাশীলতা বা নারীসুলভ সুশীলতা বুদ্ধিসুদ্ধি না থাকায় স্বামী গৃহাভিমুখী এই বালিকাটির জীবন যে কতখানি বিষাদময় হয়ে উঠতে পারে, রবীন্দ্রনাথ তাৎক্ষণিকভাবেই তা উপলব্ধি করেছিলেন— “এই অজ্ঞাত ছোটো মেয়েটির ইতিহাস আমার যেন অনেকটা পরিচিত হয়ে গেল।”
দীর্ঘদিন পর মৈত্রেয়ী দেবীকে আলাপচারিতার সূত্রে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন— “ভারী দুঃখ হল তার শ্বশুরবাড়ি যাওয়া দেখে। চঞ্চলা হরিণীকে বন্দিনী করবে। ওর কথা মনে করেই এই গল্পটা লিখেছিলুম।”
এই গল্পটির নাম ‘সমাপ্তি’, যেখানে স্বামীগৃহগতা কন্যাটি মৃন্ময়ী নামে পাঠকের অতি পরিচিত।
সাজাদপুরেই বোট থেকে রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন কতকগুলি ছেলে মেয়ের পরিত্যক্ত মাস্তল নিয়ে নিরর্থক খেলা। সেই দৃশ্যটিই যেন রূপান্তরিত হয়ে প্রকাশ পেয়েছে ‘ছুটি’ গল্পের ফটিকের মধ্য দিয়ে। এ ছাড়াও গল্পপ্রিয় সেই পোস্টমাস্টার রবীন্দ্রকল্পনার সিঞ্চনে রূপ নিয়েছে ‘পোষ্টমাস্টার’ গল্পে। ‘অতিথি’র তারাপদ ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তনে’র রাইচরণ কিংবা সুভা, রতন, গিরিবালা—এরা সকলেই উঠে এসেছে ‘ছিন্নপত্র’ রচনাকালের বাস্তব জগৎ থেকেই। ‘পোষ্টমাস্টার’ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন— “আমি এঁকে প্রতিদিন দেখতে পেতুম, তখনি আমি একদিন দুপুর বেলায় এই দোতলায় বসে সেই পোষ্টমাস্টারের গল্পটি লিখেছিলুম এবং সে গল্পটি যখন হিতবাদীতে বেরোল তখন আমাদের পোষ্টমাস্টারবাবু তার উল্লেখ করে বিস্তর লজ্জামিশ্রিত হাস্যবিস্তার করেছিলেন।”
এ ছাড়াও ‘ছিন্নপত্র’তে প্রত্যক্ষভাবে গল্প-সাধনার উল্লেখ পাওয়া যাবে ১০৬ সংখ্যক পত্রে— “আজ সকালবেলায় তাই গিরিবালা-নাম্নী উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ একটি ছোটো অভিমানী মেয়েকে আমার কল্পনারাজ্যে অবতারণা করা গেছে।”
—এই গিরিবালা ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পের নায়িকা। ১৪৪ সংখ্যক পত্রেও ‘সাধনা’র জন্য ‘আষাঢ়ে গোছের গল্প’ লেখার প্রসঙ্গ আছে।
‘ছিন্নপত্র’ রচনাকালেই যে রবীন্দ্রনাথের মানসভূমিতে অজস্র উপকরণের অভিঘাতে গল্পরচনার প্রবল প্রণোদনা এসেছিল, তার প্রমাণও ছড়িয়ে আছে ‘ছিন্নপত্র’তেই— “এক-এক সময় মনে হয়, আমি ছোটো ছোটো গল্প অনেক লিখতে পারি এবং মন্দ লিখতে পারি নে—”
“যদি আমি আর কিছুই না করে ছোটো ছোটো গল্প লিখতে বসি তাহলে কতকটা মনের সুখে থাকি”
অতএব একথা অবিতর্কিতভাবেই বলা যায়, ‘ছিন্নপত্র’-পর্বেই রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতি ও মানুষের ঘনিষ্ঠ সংসর্গে গল্পকার রবীন্দ্রনাথ হিসাবে পরিণত হয়ে উঠেছেন। যে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “এবার ফিরাও মোরে লয়ে যাও সংসারের তীরে”, যে রবীন্দ্রনাথ দরিদ্র নিরন্ন অসহায় মানুষের মুখে ভাষা ও বুকে স্বনির্ভরতার মন্ত্র দিতে চেয়েছিলেন, যে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন—“কবি আমি ওদের দলে”, যিনি নিজেকে ‘ব্রাত্য’ ও ‘মন্ত্রহীন’ বলে ঘোষণা করেছিলেন, সেই রবীন্দ্রনাথের যথার্থ উদবোধন ঘটেছিল ‘ছিন্নপত্র’ পর্বেই। প্রকৃতি-মানুষও জীবনের ঘনিষ্ঠতাই বপন করেছে রবীন্দ্রমানসে ছোটো গল্পের বীজ। তাই ‘ছিন্নপত্র’র কালই বিকশিত হয়ে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের ছোটো গল্পের যুগ হিসাবে।
Leave a comment