ভাবকল্পনার সুউচ্চ শিখরলোকে বিচরণ করলেও স্বরূপত রবীন্দ্রনাথ চিরকাল মানুষের সপক্ষে। তাঁর প্রথম ও প্রধানতম অন্বিষ্ট মানুষ। নিসর্গ-মুগ্ধতা যেমন রবীন্দ্র-মানসের এক আশৈশব লালিত ধর্ম, মানব প্রীতিও তেমনি তাঁর স্বভাবগত। ‘প্রভাতসঙ্গীতে’ বা ‘কড়ি ও কোমল’-এ যেমন সেই মানবপ্রেম উচ্ছ্বল আবেগে প্রবাহিত, তেমনি জীবন সায়াহ্নেও তিনি ঘোষণা করে গেছেন সেই একই মানব-স্বীকৃতি। ‘পুনশ্চ’-র শিশু তীর্থে যেমন বলেছেন— জয় হোক মানুষের, তেমনি ‘আত্মপরিচয়’তে লিখেছেন— “আমি এসেছি এই ধরণীর মহাতীর্থে—এখানে সর্বদেশ সর্বজাতি ও সর্বকালের ইতিহাসের মহাকেন্দ্রে আছেন নরদেবতা….।”
তবু একথা অবশ্যস্বীকার্য যে, শৈশবে যে কবি উচ্চারণ করেছিলেন, ‘মানুষের মাঝে’ বাঁচবার আকাঙ্ক্ষা, সেই মানব জীবন-সম্ভোগের পিপাসা অনেকখানি স্পষ্ট ও পরিণত হতে পেরেছিল ‘ছিন্নপত্র’-পর্বেই। যে প্রকৃতি ও মানব জীবন একটা ভাবকল্পনার বিষয় হিসাবে রবীন্দ্রমানসে পুঞ্জীভূত ছিল, জমিদারি পরিদর্শন ও পরিচালনা কর্মে নিযুক্ত হয়ে সুদীর্ঘকাল পল্লিবাংলার নদীতে—কাছারি কুঠিতে অবস্থানকালে প্রকৃতি ও মানুষের ঘনিষ্ঠ সংসর্গে তা অনেকখানি বাস্তব ও মৃত্তিকালগ্ন হয়ে উঠতে পেরেছে। সদর স্ট্রিটের সূর্যোদয়-দর্শন রবীন্দ্র সৃষ্টিকে জীবন সম্পর্কে যে জ্যোতির্ময় আনন্দবিভায় পূর্ণ করেছিল, সেই মানব জীবনদৃষ্টি পূর্ণ সার্থকতা লাভ করেছিল শিলাইদহ-সাজাদপুর-পতিসরের শ্যামল-সজল মুক্ত প্রকৃতির কোলে।
পরিণত রবীন্দ্রনাথকে ভাববিলাসিতার জন্য এবং গ্রাম জীবন সম্পর্কে অনভিজ্ঞতার জন্য অনেকবার ভ্রান্ত সমালোচনার লক্ষ্য হতে হয়েছে। যে অভিযোগ রবীন্দ্রনাথ বারংবার বিভিন্ন প্রসঙ্গে খণ্ডন করেছেন। মৈত্রেয়ী দেবীকে তিনি বলেছিলেন— “বাংলাদেশের গ্রাম আমি জানিনে, দরিদ্র, সাধারণ বাঙালী জীবন জানিনে আমি, সে ছবি আঁকিনি?”
‘পল্লীপ্রকৃতি’ গ্রন্থেও একস্থানে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন— “যখন আমি পদ্মানদীর তীরে গিয়ে বাস করেছিলাম, …… তখন পল্লীগ্রামের মানুষের জীবনের যে পরিচয় পেয়েছিলাম তাতে এই অনুভব করেছিলাম যে, আমাদের জীবনের ভিত্তি রয়েছে পল্লীতে।”
—এই বাস্তব অভিজ্ঞতার বুক থেকেই উঠে এসেছে, ‘ছিন্নপত্র’-র সুখ-দুঃখে আন্দোলিত, অভাব-অভিযোগ মুখরিত, সারল্যে-নির্মমতায় উদ্ভাসিত, দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় নদী স্রোতের মতো প্রবাহিত প্রকৃতি সংলগ্ন মানুষের অজস্র ছবি।
রবীন্দ্রনাথ যদিও মুক্ত প্রকৃতির অবাধ বিস্তারে নিমগ্ন হয়ে উচ্চারণ করেছিলেন—“এখানে মানুষ কম এবং পৃথিবীটাই বেশি” (৩৮ সংখ্যক পত্র), তথাপি ‘ছিন্নপত্র’-তে ছড়িয়ে আছে নদী তীরবর্তী জনপদবাসী মানুষের অজস্র খণ্ডচিত্র।
সাজাদপুরের ঘাটে সেই ‘গোপাল সা’র মেয়ের স্বামী গৃহে যাত্রার দৃশ্য, শিলাইদহে এক ছোটো নদীর ঘাটে কাদা-মাখা ছেলেদের উল্লাস, আসন্ন ঝড়ের সংকেতে দ্রুত ধাবমান কৃষকদের ছবি ছাড়াও আছে নিতান্ত তুচ্ছ অবহেলিত চিত্রও— “একজন মেয়ে তার একটি ছোটো উলঙ্গ শীর্ণ কালো ছেলেকে এই খালের জলে নাওয়াতে এসেছে।… তারপরে ভিজে গায়ে সেই উলঙ্গ কম্পান্বিত ছেলের নড়া ধরে বাড়ির দিকে টেনে নিয়ে গেল।”
কখনো-কখনো এই মানুষের ছবি অতি সংক্ষিপ্ত যেন কালির আঁচড়ে আঁকা ছবির মতো— “কেউ বা ঘাসের বোঝা, কেউ বা একটা চুপড়ি, কেউ বা একটা বস্তা কাঁধে করে হাটে যাচ্ছে এবং হাট থেকে ফিরে আসছে …। মনুষ্য জীবনের এই একটুখানি স্রোত অতি ধীরে ধীরে চলেছে।”
প্রকৃতির নির্বাধ বিস্তারে বিমুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ স্বভাবতই নির্জনতাপ্রিয়। দূর থেকে চলমান মানুষের নানা ছবি দেখে তাঁর মনে হয়েছে “মানুষ ও নানা শাখা-প্রশাখা নিয়ে নদীর মতোই চলেছে” (৩৮ সংখ্যক পত্র)। ক্ষুদ্র তুচ্ছ অকিঞ্চিৎকর এই ব্যস্ততা বৃহৎ প্রকৃতির পটভূমিতে হাস্যকর ও নিরর্থক বলে মনে হয়েছে তাঁর— “…… নানান রকমের নানান লোক কেন যে আসছে, কেন যে যাচ্ছে কেন যে বুকের মধ্যে নিজের দুটো হাঁটুকে আলিঙ্গন করে ধরে উবু হয়ে বসে আছে, কেন যে অবাক হয়ে বিশেষ কোনো কিছুর দিকে না তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার কোনো অর্থ পাওয়া যায় না।”
—তবু এই নিরর্থক জীবনকে দেখেও সেইসব তুচ্ছ জীবনকে জানার-চেনার-অনুভব করার একটা দুরন্ত আকাঙ্ক্ষা রবীন্দ্রনাথের মনে জেগে উঠতে দেখি। সাজাদপুরে একদল বেদের অস্থায়ী উপনিবেশ ও তাদের আশ্চর্য জীবনযাত্রা দেখে রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছে— “এরা, নিতান্তই মাটির সন্তান, নিতান্তই পৃথিবীর গায়ের সঙ্গে লেগে আছে যেখানে সেখানে জন্মাচ্ছে, পথে পথেই বেড়ে উঠছে, এবং যেখানে-সেখানে মরছে—এদের ঠিক অবস্থাটা, ঠিক মনের ভাবটা ভারী জানতে ইচ্ছে করে।”
শুধু এই নাম-পরিচয়হীন মানুষদের দূর থেকে দেখাই নয়, রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘকাল পল্লিবাসের সূত্রে, জমিদারি কার্যের দৌলতে বহু মানুষকে নিকট থেকেও দেখেছেন। তাদের নাম-পরিচয় নিয়েই তারা উঠে এসেছে ‘ছিন্নপত্র’-র পাতায়। সাজাদপুরের গল্পপ্রিয় পোস্টমাস্টার, গোপাল সাহার মায়্যা, কটকাভিমুখী স্টিমারের যাত্রাসঙ্গী সেই অঘোরবাবু—যিনি পৃথিবীর যাবতীয় জড় ও চেতন পদার্থকে বলেন ‘সামাশ্বশুরের ভাগনে’, শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের অতিথি সেই সাহেব-মেম, অবিশ্রান্ত কথা বলে যাওয়া সেই মৌলবি—সবাই যেন কথাশিল্পের অপ্রধান চরিত্রের মতো সারিবদ্ধভাবে এসে দাঁড়িয়েছে এই পত্রাবলিতে।
কখনও আবার চোখে দেখা এই সব সাধারণ মানুষেরাই রবীন্দ্রনাথের কল্পনারসে জারিত হয়ে সত্য সত্যই তাঁর ছোটো গল্পের চরিত্ররূপে দেখা দিয়েছে। ‘আপন-পর জ্ঞান’-হীনা গোপাল সাহার সেই দুরন্ত মেয়ে হয়ে উঠেছে ‘সমাপ্তি’ গল্পের মৃন্ময়ী, সাজাদপুরের সেই পোস্টমাস্টারই হয়েছে গল্পের ‘পোস্টমাস্টার’, কিংবা মাস্তল-গড়ানো খেলার নায়ক হয়ে উঠেছে ‘ছুটি’ গল্পের ফটিক। এই নদী তীরবর্তী মানুষের সঙ্গে দীর্ঘকাল বসবাসের সুত্রেই রবীন্দ্র-ছোটো গল্পের অজস্র মানুষের মুখ জীবন্ত হয়ে দেখা দিয়েছে।
শুধুমাত্র ছোটো ছোটো সুখ-দুঃখে কম্পমান মানুষকেই নয়, জমিদারি কর্মের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দরিদ্র মানুষের গভীর জীবন সংগ্রাম কুসংস্কার ও অশিক্ষায় বদ্ধ মানুষের মর্মান্তিক জীবন-যন্ত্রণাও রবীন্দ্রনাথ চিনেছিলেন। এইসব দরিদ্র-অসহায় দুর্বল মানুষের প্রতি আত্যন্তিক মমতায় প্রতি মুহূর্তে দ্রবীভূত হচ্ছিল জমিদার রবীন্দ্রনাথের মন— “আমার এই দরিদ্র চাষী প্রজাগুলোকে দেখলে আমার ভারী মায়া করে, এরা যেন বিধাতার শিশু সন্তানের মতো নিরুপায়।”
অন্যত্রও বলেছেন— “আমার কাছে এই সমস্ত দুঃখপীড়িত অটলবিশ্বাস-পরায়ণ অনুরক্ত প্রজাদের মুখে বড়ো একটি কোমল মাধুর্য আছে, বাস্তবিক এরা যেন আমার একটি দেশজোড়া বৃহৎ পরিবারের লোক।”
—তাই জমিদারের স্বভাবসিদ্ধ প্রজা-শোষক ভূমিকা থেকে সরে এসে রবীন্দ্রনাথ প্রজা-কল্যাণের জন্য আদর্শ পল্লিগঠনের দুশ্চর সাধনায় ব্রতী হয়েছিলেন সেই ‘ছিন্নপত্র’ পর্ব থেকেই। ‘পল্লীপ্রকৃতি’ গ্রন্থে সংকলিত একটি ভাষণে রবীন্দ্রনাথ পরবর্তীকালে বলেছেন— “শিলাইদহ থেকে পতিসর, নদীনালা-বিলের মধ্য দিয়ে তখন গ্রামের বিচিত্র দৃশ্য দেখেছি। …….ক্রমে এই পল্লীর দুঃখদৈন্য আমার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠল। তারপর থেকে চেষ্টা করতুম—কী করলে এদের মনের উদবোধন হয়, আপনাদের দায়িত্ব এরা আপনি নিতে পারে।”
‘ছিন্নপত্র’-র মানব জীবনালেখ্য তাই শুধুমাত্র একজন কবির চোখে দেখা রোমান্টিক ছবি নয়, স্বরূপত এই মানুষের ছবি বাস্তব অভিজ্ঞতার দ্বারা প্রাপ্ত সুখে-দুঃখে, সারল্যে জটিলতায়, বিশ্বাসে-বিক্ষোভে, প্রাপ্তিতে বঞ্চনায় তপ্ত ‘নরদেবতা’রই ছবি। ‘ছিন্নপত্র’র মানুষ আসলে অপরিচিত পল্লির বাতায়ন বা কাছারি ঘরের দূরত্ব থেকে ক্রমে রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক জীবন-চেতনার, তাঁর কর্মসাধনার স্বদেশ ভাবনার কেন্দ্রে অন্তরঙ্গ ‘নরদেবতা রূপে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।
Leave a comment