রবীন্দ্রনাথ আশৈশব সৌন্দর্য-পূজারি তথা সৌন্দর্য-পিয়াসী। তাঁর রচিত ‘ছিন্নপত্রে’র বহু পত্রেই তিনি প্রকৃতির সাথে অন্তরঙ্গ ভাব বিনিময়ের কাহিনি ব্যক্ত করেছেন। ১৮ নং পত্রটিও তার ব্যতিক্রম নয়।

আলোচ্য পত্রে বরীন্দ্রনাথ পৃথিবীর প্রাণময় সত্তাকে উপলব্ধি করেছেন। সৃষ্টির বিবর্তনের ইতিহাসে কবি পৃথিবীকে জড়পদার্থ মনে করেননি। আকাশে, বাতাসে, মেঘে রৌদ্রে ফলে, ফুলে, পল্লবে, কুসুমে অনুভব করেছেন বিশ্ব সৌন্দর্যের সেই লীলাকে। তিনি বলেছেন—’এই গাছপালা, নদী, মাঠ, কোলাহল, নিস্তব্ধতা, প্রভাত সন্ধ্যা সমস্তটা শুধু দু হাতে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করে। জগতের এই বৃহৎ হার্মনি রবীন্দ্রনাথের কবি হৃদয়ে সমুদ্রের তরঙ্গের ন্যায় বিপুল সংগীতের তরঙ্গ হয়ে ছুটে বেড়িয়েছে। ‘সোনার তরী’ কাব্যের বসুন্ধরা কবিতায় বলেছেন—

হে সুন্দরী বসুন্ধরে, তোমাপানে চেয়ে

কতবার প্রাণ মোর উঠিয়াছে গেয়ে

প্রকাণ্ড উল্লাস ভরে?

পদ্মাপারে এসে যে পৃথিবীকে কবি দেখেছেন—এত বড়ো পৃথিবী এর আগে কখনো দেখেননি। জমিদারির কাজ দেখাশোনা করতে এখানে না এলে মানুষকে এতো কাছ থেকে তিনি কখনো দেখতে পেতেন না। এরা সব পৃথিবীর ‘আদরের ধন’। স্বর্গের তুলনায় এইসব মাটির মানুষদের সঙ্গলাভ এক বিশেষ অর্জন বলে মনে হয়েছে কবির। পৃথিবীকে তাঁর মনে হয়েছে মাটির মা। এই অতি সাধারণ দরিদ্র মা তাঁর আপন সন্তানদের ভালোবাসেন, পরম যত্ন ও মমতায় লালন করেন কিন্তু মৃত্যু নামক বিশ্ববিধানকে লঙ্ঘন করে সেই সন্তানদের রক্ষা করতে পারেন না। তবুও সেই দুঃখিনী মা যথাসাধ্য স্নেহরস সিঞ্চনে লালন করেন। এখানে পৃথিবীর মায়ের এক অনবদ্য বিষাদ মূর্তি রচনা করা হয়েছে। আর ভাবে কল্পনার সুউচ্চ শিখর লোকে বিচরণ করলেও রবীন্দ্রনাথ তো সর্বদাই ‘সবার উপর মানুষ সত্য’ এই নীতিবাক্যে চরম বিশ্বাসী। তাই সেই মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও সহমর্মিতা এই পত্রে ব্যক্ত হয়েছে। সেইসঙ্গে পৃথিবীর প্রতি অকৃত্রিম আকর্ষণও এই পত্রে অভিব্যক্ত হয়েছে।

আলোচ্য পত্রের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, এ পত্রে সুন্দরী প্রকৃতি রবীন্দ্র সৃষ্টিতে রহস্য লাবণ্যময়ী, মোহসঞ্চারী মূর্তিতে আবির্ভূতা নন। প্রকৃতি এখানে যেন দুঃখিনী মাতৃমূর্তি। অপার বাৎসল্য সিঞ্চনে তার মানবরূপী সন্তানকে সে লালন করে কিন্তু মৃত্যু সেই স্নেহের শাসন মানে না। বিশ্বের অদৃশ্য প্রবল শক্তি তার স্নেহের কোল থেকে অবলীলায় সন্তানগুলিকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। আলোচ্য পত্রে সেই প্রকৃতির বিষাদময়ী মাতৃমূর্তি অঙ্কিত—যা এই ১৮ সংখ্যক পত্রটিকে অসামান্য ভাষারূপ দান করেছে।