রবীন্দ্রনাথের অনেক ছোটোগল্প রচনার বীজ ছিন্নপত্রে ইতস্তত ছড়িয়ে রয়েছে।
অবিশ্রাম বারি বর্ষণের পূর্বে নীল আকাশ জুড়ে জমতে থাকে খণ্ড খণ্ড মেঘের ভেলা। বাধাবন্ধ হীন স্রোতে ভাসতে থাকে দিক থেকে দিগন্তে। আপন খেয়ালে স্বচ্ছ বারিধারায় প্লাবিত করে সরস শ্যামলা বসুন্ধরাকে। এমনিই এক উদ্যোগ পর্বের ভাবধারা দৃষ্ট হয় ছিন্নপত্রের লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যে। তাঁর লেখনীর স্পর্শে সৃষ্টি হয়েছিল ছোটোগল্পের। সেখানে ছিল না কাব্য কবিতার কল্পনা বিলাসিতা, ছিল না প্রবন্ধের গুরুগম্ভীর তথ্য। বাস্তব পৃথিবীর অভিজ্ঞতা মাটি ও মানুষের হৃদয়ের যৌথ সমন্বয়েই গড়ে ওঠে কথাশিল্প। তাই পদ্মাতীরে বসবাস, নদীবক্ষে ভ্রমণ, মানুষের সঙ্গে পরিচয়ই, রবীন্দ্রনাথকে হাজির করিয়েছে ছোটোগল্পের তরঙ্গময় স্রোতধারায়। আর তা সম্ভব হয়েছে ১৮৮৯ খ্রিঃ জমিদারির কাজ দেখাশোনার সূত্রে তাঁর শিলাইদহে চলে আসায়। খাঁটি অভিজ্ঞতার নির্যাস হয়ে যে ছোটোগল্পে সাহিত্য কলস পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল ছিন্নপত্রগুলি ছিল তার প্রিয় দোসর। একই সঙ্গে তাদের সহাবস্থান।
ছিন্নপত্রাবলি ঐতিহাসিক কারণেই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ছোটোগল্পের পূর্বসূত্র রূপেই এর আত্মপ্রকাশ। পত্রে স্থান পায় সমকালীন সমাজ পরিবেশ মানসিকতা, যাকে চিহ্নিত করা যায় ছোটোগল্পের উপাদান হিসাবে। ১০৬ সংখ্যক পত্রে প্রকাশ পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের অকপট স্বীকারোক্তি : “গল্প লেখবার একটা সুখ এই, যাদের কথা লিখবো তারা আমার দিনরাত্রির সমস্ত অবসর একেবারে ভরে রেখে দেবে, আমার একলা মনের সঙ্গী হবে, বর্ষার সময় আমার বদ্ধ ঘরের সঙ্কীর্ণতা দূর করবে, এবং রৌদ্রের সময় পদ্মাতীরের উজ্জ্বল দৃশ্যের মধ্যে আমার চোখে ধরা পড়বে।” প্রাত্যহিক জীবনের উৎস রূপে যে ছিন্নপত্রাবলি নির্দেশিত ছোটোগল্পের সঙ্গে তার অচ্ছেদ্দ্য সম্পর্ক। প্রতিটি পত্রের প্রতিটি পঙ্ক্তিতে ছোটোগল্পের বর্ণাঢ্য সমারোহ। হিতবাদী পত্রিকায় দু’ সপ্তাহে পরপর যে দুটি গল্প প্রকাশিত হয়েছিল ‘পোস্টমাস্টার’ তার দ্বিতীয় ও অন্যতম গল্প। তিনি সাজাদপুর থেকে ২৯ সংখ্যক পত্রে দ্বিধাহীন চিত্তে লিখেছেনঃ “যখন আমাদের এই কুঠিবাড়ির এক তলাতেই পোস্ট অপিস ছিল এবং আমি এঁকে প্রতিদিন দেখতে পেতুম, তখনই আমি একদিন দুপুরবেলায় এই দোতলায় বসে সেই পোস্টমাস্টারের গল্পটি লিখেছিলুম।” আর পোস্টমাস্টার সম্পর্কে ২১ সংখ্যক পত্রে লিখেছিলেন : পোস্টমাস্টারের গল্প শুনতে আমার বেশ ভালো লাগে। বিস্তর অসম্ভব কথা বেশ গম্ভীরভাবে বলে যান।” এর সাথে গল্পের পোস্টমাস্টারের মিল খুঁজে না পেলেও—পরিচিত ঘটনার সূত্রেই গল্পটি লিখিত।
সমাপ্তি গল্পের স্পষ্ট আভাস ৩০ সংখ্যক চিঠিতে বেশ ফুটে উঠেছে। গল্পে নায়িকা চরিত্র বর্ণনায় পাই “মৃন্ময়ী দেখিতে শ্যামবর্ণ। ছোটো কোঁকড়া চুল পিঠ পর্যন্ত পড়িয়াছে, ঠিক যেন বালকের মতো মুখের ভাব….শরীর দীর্ঘ পরিপুষ্ট সুস্থ সরল….।” পত্রে পাই— “ওদের মধ্যে একটি মেয়ে আছে….বোধহয় বয়সে বারো তেরো হবে। কিন্তু একটু হৃষ্টপুষ্ট হওয়াতে চোদ্দো পনেরো দেখাচ্ছে!…. ছেলেদের মতো চুল ছাটা, তাতে মুখটি বেশ দেখাচ্ছে।” ‘মংপুতে রবীন্দ্র’ গ্রন্থে মৈত্রেয়ী দেবী রবীন্দ্রনাথের আলাপ চারিতায় লিখেছিলেন—“ভারি দুঃখ হল তার শ্বশুরবাড়ি যাওয়া দেখে, চঞ্চলা হরিণীকে বন্দিনী করবে। ওর কথা মনে করেই গল্পটা লিখেছিলুম।” অনুরূপ, মেঘ ও রৌদ্র গল্পের সূত্র মেলে ১০৬ সংখ্যক পত্রে : “আজ সকালবেলায় তাই গিরিবালা নাম্নী উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ একটি ছোটো অভিমানী মেয়েকে আমার কল্পনা রাজ্যে অবতারণ করা গেছে।…কাল বৃষ্টি হয়ে গেছে, আজ বর্ষণ অন্তে চঞ্চল মেঘ এবং চঞ্চল রৌদ্রের শিকার চলছে।” গল্পে পাই : পূর্বদিনে বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে। আজ ক্ষান্তবর্ষণ প্রাপ্তঃকালে ম্লান রৌদ্র ও খণ্ড মেঘে মিলিয়া পরিপক্ব প্রায় আউশ ধানের খেতের উপর পর্যায়ক্রমে আপন আপন সুদীর্ঘ তুলি বুলাইয়া যাইতেছে…।” এইভাবে সমাপ্তি গল্পটি মূর্ত হয়ে উঠেছে ৩০ সংখ্যক পত্র জুড়ে।
দুটি গল্পের পরিকল্পনা নির্ণয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া না গেলেও ২৮ সংখ্যক পত্রের এক স্থানে আছে—ডাঙার উপর একটা মস্ত নৌকার মাস্তুল পড়েছিল।…একটি ছোটো মেয়ে বিনা বাক্যব্যয়ে গম্ভীর প্রশান্ত ভাবে সেই মাস্তুলটার উপর চেপে বসল।… ওদের মধ্যে একজন এসে পরীক্ষাচ্ছলে মেয়েটাকে একটু একটু ঠেলতে চেষ্টা করলো।” ‘ছুটি’ গল্পের শুরুতেই পাই : “নদীর ধারে একটা প্রকাণ্ড শালকাষ্ঠ মাস্তুলে রূপান্তরিত হইবার প্রতীক্ষায় পড়িয়াছিল ; স্থির হইল সেটা সকলে মিলিয়া গড়াইয়া লইয়া যাইবে…এমন সময় ফটিকের কনিষ্ঠ মাখনলাল গম্ভীরভাবে সেই গুঁড়ির উপরে গিয়া বসিল…” গল্পের সঙ্গে পত্রের সাদৃশ্য অবশ্য লক্ষ্য করবার বিষয়। আবার ‘অতিথি’ গল্পে যে প্রকৃতি বর্ণনা পাই : “ছেলেরা জলের মধ্যে পড়িয়া মাতামাতি করিতেছে, মেয়েরা উচ্চকণ্ঠে সহাস্যে গল্প করিতে করিতে আবক্ষ জলে বসনাঞ্চল প্রসারিত করিয়া দুই হস্তে তাহা মার্জন করিয়া লইতেছে।” ৪৩ সংখ্যক পত্রে এমনই একটা প্রকৃতি চিত্র ফুটে উঠেছে : “ঘাটে মেয়েরা কাপড় কাচছে, জল তুলছে, স্নান করছে……যারা অল্পবয়সী মেয়ে তাদের জলক্রীড়া আর শেষ হয় না। একবার স্নান সেরে উপরে উঠছে, আবার ঝুপ করে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।” পত্র হলেও প্রকৃতি বর্ণনায় তিনি সর্বদা তৎপর তার প্রমাণ মেলে।
রবীন্দ্রনাথের দৈনন্দিন জীবনের স্বচ্ছ অভিজ্ঞতাই প্রতিফলিত হয়েছে আত্মীয়কে লেখা সাধারণ পত্রে। সেই পত্র সাহিত্যের উত্তরণ ঘটেছে শুধুমাত্র তত্ত্ব ও তথ্যের ভারে নয় ভাব রাজ্য ও জাগতিক সত্য একাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার ফলে (সকল পত্রের মধ্য দিয়ে সাবলীল ভঙ্গিতে যাত্রা শুরু করেছিল।) এ পত্র কেবলমাত্র নিজের কথা নয়। নিজের কথার মধ্য দিয়েই সবার কথা সবার অলক্ষ্যেই প্রকাশ করা। একাকী মনের নিঃসঙ্গ বীণায় যা বেজে ওঠে ও তা সর্বকালের সর্বযুগের মানুষের মনের কথা নির্দেশ করে। তাই ছিন্ন পত্রাবলি সমগ্র সাহিত্য কাজে বিশেষভাবে সমাদৃত। ক্ষুধিত পাষাণ গল্পে যে বাদশাহি মহলের সংবাদ মেলে তা যুগে যুগে মানুষের অনুসন্ধিৎসু সৃষ্টির প্রতিফলিত রূপ। সাজাদপুর থেকে লেখা ১১৯ সংখ্যক পত্রে লিখেছেন : “পথের ধারে বৃহৎ রাজপ্রাসাদ, ভিতরে ধূপের গন্ধ, জানালার কাছে বৃহৎ তাকিয়া এবং কিংখাব বিছানো—জরির চাট, ফুলো পায়জামা এবং রঙিন এবং কাঁচলি পরা আমিনা জোবেদি সুকি….।” হয়তো এই জাতীয় মিলেতে ভাষাগত ও প্রাসঙ্গিক দিকে থেকে বিশেষ ভাবে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়, তবুও এর বর্ণনা ও রচনাভঙ্গি ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ এর সেই শিহরণ জাগানো পরিবেশকেই নির্দেশ করে।
ছিন্নপত্রের ৩৯ সংখ্যক পত্রের এক স্থানে পাই “নদীতে একটি রেখা মাত্র ছিলনা, ওই সেই চরের পরপারে যেখানে পদ্মার জলের শেষ প্রান্ত দেখা যাচ্ছে সেখান থেকে আর এ পর্যন্ত একটি প্রশস্ত জ্যোৎস্না রেখা ঝিক ঝিক করছে।” এই অপূর্ব নির্জন জ্যোৎস্নারাত্রির চিত্র রবীন্দ্র সাহিত্যের প্রায় স্থানেই দৃষ্ট হয়। বোধ করি লেখকের নিকট জ্যোৎস্নার মোহময়ী রূপ বড়ো প্রিয় ছিল। আশ্চর্য অভিজ্ঞতা সমন্বিত বিচিত্র বর্ণনার সন্ধান মেলে ‘নিশীথে’ গল্পের পটভূমি রচনায় : “পদ্মা সরিয়া যাওয়ার পর সেইখানে জল বাধিয়া আছে। সেই মরু বালুকা বেষ্টিত নিস্তরঙ্গ নিযুপ্ত নিশ্চল জলটুকুর উপরে একটি সুদীর্ঘ জ্যোৎস্নার রেখা মুর্ছিতভাবে পড়িয়া আছে।” এ থেকে সহজেই অনুমেয় ব্যক্তিগত জীবনের সহজ কথা সমগ্র পত্র জুড়ে বিরাজ করলেও তা থেকে একটা একটা কাহিনি নিয়ে রচিত হয়েছে গল্পের মালিকা। পাশাপাশি পত্র সাহিত্য ও গল্প সাহিত্য রেখে বিশ্লেষণে মনোনিবেশ করলে নির্দ্বিধায় বলা যাবে—পত্র সাহিত্য আর কিছু নয়–নয় ছোটোগল্পের বীজতলামাত্র।
অন্তিম পর্বে বলা যেতে পারে কাব্যের জগৎ হল ভাবলোকের জগৎ। আর কথা সাহিত্যের জগৎ মৃত্তিকা লগ্ন যার মধ্যে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা সুখ দুঃখ ব্যথা-বেদনা বিধৃত হয়। সত্যিকারের বাস্তব অভিজ্ঞতায় মাটি ও মানুষের অঙ্গাঙ্গি সংমিশ্রণের মধ্য দিয়ে লেখক সার্থক কথাশিল্পী রূপে পরিচিতি লাভ করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বিপুল পত্রসম্ভারে যে ছোটোছোটো অভিজ্ঞতার দ্বারা বাস্তব রূপ পরিস্ফুটনে অগ্রণী ছিলেন তাতে তিনি সার্থক। এই সার্থকতার শিখর দেশে তিনি উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। প্রতিটি পত্রের মধ্য দিয়ে এক একটি ছোটোগল্পের আত্মপ্রকাশ শুরু হয়েছিল আলোকোজ্জ্বল আভায়।
Leave a comment