জমিদারি কার্যোপলক্ষে রবীন্দ্রনাথকে সুদীর্ঘকাল নদীবিধৌত পল্লিবাংলায় পরিভ্রমণ করতে হয়েছিল। শিলাইদহ-সাজাদপুর-পতিসর প্রভৃতি অঞ্চলে কিংবা ওড়িশার সমুদ্রতীরেও এই সময় রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘকাল অতিবাহিত করেছেন। এই পর্বে স্নেহের ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে লিখিত চিঠিপত্রগুলির সংকলনই ‘ছিন্নপত্র’ বা ‘ছিন্নপত্রাবলী।’
শৈশবাবধি রোমান্টিক কবিস্বভাবসম্পন্ন রবীন্দ্রনাথ মুক্ত প্রকৃতি-সম্ভোগের পিপাসায় ব্যাকুল। জোড়াসাঁকোয় ‘ভৃত্যরাজকতন্ত্র’র অধীন প্রায় বন্দি জীবনের বাতায়নপথে চলেছে সেই তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের প্রকৃতি-সম্ভোগ। পরবর্তীকালে পিতার সঙ্গে বোলপুর-ডালহৌসি-হিমালয় ভ্রমণকালে অথবা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে কৈশোরে শিলাইদহ ভ্রমণকালে এই প্রকৃতি-পিপাসা অনেকখানি তৃপ্ত হতে পেরেছিল। তবে জমিদারির কাজে তৎকালীন নদীয়া (কুষ্টিয়া) জেলার বিরাহিমপুর পরগনা, রাজসাহীর কালীগ্রাম পরগনা এবং পাবনার ইসব্সাহী পরগনার নদীবক্ষে বা সদর কাছারির কুঠিগৃহে বাসকালে পল্লি বাংলা ও পল্লিপ্রকৃতির যে নিবিড় পরিচয় রবীন্দ্রনাথ লাভ করেছিলেন, তা তাঁর সমগ্র সাহিত্য জীবনকেই যেমন সমৃদ্ধ করেছে, তেমনই তাঁর জীবন দর্শনকেও অনেকখানি পরিণত করে তুলেছে।
জমিদারি পরিদর্শন ও পরিচালনাকালে দেখা রবীন্দ্রনাথের এই পল্লি বাংলা মূলত নদীমাতৃক বাংলা। আর এই নদী প্রধানত পদ্মা। বিশেষ করে বিরাহিমপুর পরগনার সদর কাছারি শিলাইদহ এবং ইসব্সাহী পরগনার সদর কাছারি সাহাজাদপুর একান্তই ছিল পদ্মা তীরবর্তী। পদ্মার তীরে তীরে ভ্রমণ করে পদ্মা তীরে বোট লাগিয়ে বা পদ্মা বক্ষে জল ভ্রমণ করে এসময় দীর্ঘকাল ধরে পদ্মার সৌন্দর্য রবীন্দ্রনাথের অন্তর্গত রক্তপ্রবাহে মিশ্রিত হবার অবকাশ পেয়েছিল। পদ্মার নির্জন চর, নদীর কলতান এবং নদী তীরবর্তী প্রকৃতি ও মানুষের কলগানই রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী বৃহৎ জীবন-অধ্যায়ের পটভূমিকা নির্মাণ করেছিল। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এই সময়ের মহৎ অর্জন সম্পর্কে ‘সোনার তরী’-র ভূমিকায় লিখেছিলেন– “বাংলা দেশের নদীতে গ্রামে গ্রামে তখন ঘুরে বেড়াচ্ছি……কতবার সমস্ত বৎসর ধরে পদ্মার আতিথ্য নিয়েছি, বৈশাখের খর রৌদ্রতাপে, শ্রাবণের মুষলধারা বর্ষণে। পরপারে ছিল ছায়াঘন পল্লীর শ্যামশ্রী, এপারে ছিল বালুচরের পাণ্ডুবর্ণ জনহীনতা, মাঝখানে পদ্মার চলমান স্রোতের পটে বুলিয়ে চলেছে দ্যুলোকে শিল্পী প্রহরে প্রহরে নানাবর্ণের ছায়ার তুলি। এইখানে নির্জন সজনের নিত্যসংগত চলেছিল আমার জীবনে”।
যথার্থই পদ্মাতীরের জীবনের অনুপুঙ্খ ছড়িয়ে আছে ‘ছিন্নপত্র’র চিঠিগুলিতে। পদ্মার ঘাটে ঘাটে, তার অগাধ বিস্তৃত চরের নিস্তব্ধ, নিঃসঙ্গ রহস্যময়ী সৌন্দর্যের মধ্যে, পদ্মা তীরবর্তী জনপদবাসীদের সঙ্গে আত্মীয়তায় যেন ‘ছিন্নপত্র’র অধিকাংশ চিঠি এক শ্যামল স্নিগ্ধতায় সিক্ত।
নদীর একপারে নিস্তব্ধ চর অন্যদিকে ছায়াচ্ছন্ন জনপদ দেখে রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়েছেন। পল্লিবাংলার সাধারণ মানুষের চলচ্ছবি উঠে এসেছে ‘ছিন্নপত্র’-তে— “ও পারে হাট, তাই খেয়া নৌকায় এত ভিড়। কেউ বা ঘাসের বোঝা, কেউ বা একটা চুপড়ি, কেউ বা একটা বস্তা কাঁধে করে হাটে যাচ্ছে এবং হাট থেকে ফিরে আসছে……”
কখনো পদ্মার নির্জনতা কবির চোখে মায়াঞ্জন এঁকে দিয়েছে। সেই নির্জনতার মধ্যে পদ্মার সৌন্দর্য-সত্তোগ করতে করতে এক গভীর দার্শনিকতায় মগ্ন হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ— “……নদী আর এই দিগন্ত বিস্তৃত চর আর ওই ছবির মতন পরপারধরণীর এই উপেক্ষিত প্রান্তভাগ—এই বা কী বৃহৎ নিস্তব্ধ নিভৃত পাঠশালা।”
পদ্মা-নামক নদীর সুস্নিগ্ধ রূপের পাশাপাশি পদ্মার ভয়ংকরী রাক্ষসী মূর্তিও কবি দেখেছেন। রাইচরণের সর্বনাশের জন্য দায়ী সেই ভয়ংকরী পদ্মার রূপ আঁকা আছে ‘ছিন্নপত্র’তেও— “নদীর যে রোখ। যেন লেজ-দোলানো কেশর-ফোলানো তাজা বুনো ঘোড়ার মতো।”
পদ্মা নদী যে এ-সময় রবীন্দ্র-চেতনায় নিগূঢ়ভাবে মিশ্রিত হয়েছিল, তার পরিচয় আছে ‘ছিন্নপত্র’-তে। পদ্মাবিধৌত এই প্রকৃতি এবং এই পদ্মার সঙ্গে যেন তাঁর জন্মজন্মান্তরের সম্পর্ক— “আমাদের দুজনকার মধ্যে একটা খুব গভীর এবং সুদূরপ্রসারী চেনাশোনা আছে।”
পদ্মাকে ভালোবাসার স্পষ্ট স্বীকারোক্তিও এখানে পাওয়া যাবে— “বাস্তবিক পদ্মাকে আমি বড়ো ভালোবাসি। ইন্দ্রের যেমন ঐরাবত আমার তেমনি পদ্মা— আমার যথার্থ বাহন।…… আমি যখন শিলাইদহে বোটে থাকি তখন পদ্মা আমার পক্ষে সত্যিকারের একটি স্বতন্ত্র মানুষের মতো।…..।”
শুধু পদ্মাকে মানবরূপে চৈতন্যময় দেখেছেন রবীন্দ্রনাথ তা নয়, বিপরীত পক্ষে মানুষকেও তিনি দেখেছেন নদীরূপে। ‘ছিন্নপত্র’-তে শুধু নারীকেই তিনি নদীর সঙ্গে তুলনা করেননি, মানব জীবনই এখানে নদীর সঙ্গে তুলনীয়— “মানুষও নানা শাখা-প্রশাখা নিয়ে নদীর মতোই চলেছে।”
কেবলমাত্র পদ্মার বৈচিত্র্যময়ী রূপ দর্শনই নয়, এই পদ্মাই ‘ছিন্নপত্র’-র যুগে কবিচিত্তে জন্ম দিয়েছে অজস্র কবিতার বীজ এবং অনেকগুলি গল্পের অঙ্কুর। ‘ছুটি’ গল্পের ফটিক, ‘সমাপ্তি’র মৃন্ময়ী, ‘অতিথি’র তারাপদ ছাড়াও রাইচরণ, পোষ্টমাষ্টার, গিরিবালা সকলেই উঠে এসেছে সেই পদ্মা তীরের মাটি থেকেই। পরবর্তীকালের গতিবাদী রবীন্দ্রনাথ বা তাঁর ‘বলাকা’ কাব্যগ্রন্থের বীজও সম্ভবত অঙ্কুরিত হয়েছে এই পদ্মা তীরেই, ‘ছিন্নপত্র’-তে তার আভাস আছে— “বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে গতিটাকে যদি কেবল গতিভাবেই উপলব্ধি করতে ইচ্ছা করি তা হলে নদীর স্রোতে সেটি পাওয়া যায়।”
—সেদিনের সেই পদ্মাই তো ‘বলাকা’ পর্বের ‘চঞ্চলা’ হয়ে দেখা দিয়েছে বলে মনে হয়।
অর্থাৎ ‘ছিন্নপত্র’-র যুগে পদ্মা এবং পদ্মা তীরই যেন সমগ্র রবীন্দ্র-মানসকে অধিকার করে ছিল। পদ্মার স্রোতধারা, তার কলধ্বনি, তার দিগন্তে সন্ধ্যা ও প্রভাত, সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়, তার বর্ষার গৈরিক রূপ, শীতের শান্ত মূর্তি, নিদাঘ তপ্ত দ্বিপ্রহর, জ্যোৎস্না প্লাবিত রাত্রি, পদ্মা চরের নির্জনতা, পদ্মা তীরের কোলাহল—এই সমস্ত কিছুই কখনও চিত্রের মতো রবীন্দ্রনাথের ইন্দ্রিয়ের উপরিতলে, কখনও আত্মার গভীর প্রদেশে আলোড়ন জাগিয়েছে। সেই চিত্ত-আন্দোলনের প্রকাশ ঘটেছে অনবদ্য আন্তরিক ভাষায়, অফুরন্ত আনন্দের প্রকাশরূপে ‘ছিন্নপত্র’র পত্রাবলিতে।
আত্ম-অনুভবের প্রকাশের নামই তো কাব্য। বস্তুত ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের অনুভব এবং কবি রবীন্দ্রনাথের অনুভবে কোনো প্রভেদ নেই। ‘ছিন্নপত্র’র মধ্যেই আমরা সুস্পষ্টরূপে আবিষ্কার করি যে, ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ ও কবি রবীন্দ্রনাথের মানস্ কাঠামো একই উপাদানে গঠিত। ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ জমিদারির দায়িত্বভার স্কন্ধে নিলেও তাঁর অনুভূতির প্রতিটি তন্ত্রীতে ‘ছিন্নপত্রে’র পত্রগুলিতে যে অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি প্রকাশিত, তা যেন আদ্যোপাত্ত কাব্যময়। ‘ছিন্নপত্র’কে বিদগ্ধ রবীন্দ্র-সমালোচক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাই বলেছেন ‘পদ্মাতীরের পত্রকাব্য।’
একথা মনে রাখতে হবে, ‘ছিন্নপত্র’র চিঠিগুলি কেবলমাত্র পদ্মা তীর থেকেই লিখিত হয়নি। কলকাতা থেকেও যেমন ইন্দিরাকে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ, কটক থেকেও তেমনই লিখেছেন। ‘ছিন্নপত্র’-তে দার্জিলিং যাত্রার কৌতুককর চিত্র যেমন আছে, তেমনই আছে বোলপুরের প্রলয়ংকর ঝড়ের সংবাদ। এখানে নদী হিসাবে পদ্মা আছে, কিন্তু তারও সঙ্গে আছে নাগর নদী, গড়াই নদী, ইছামতী, আত্রেই, বড়াল ইত্যাদি পূর্ববঙ্গের আরও কত নদী। তবু একথা অস্বীকার করার উপায় নেই, ‘ছিন্নপত্র’র মূল প্রেরণাদাত্রী পদ্মাই। পদ্মাই এই পর্বের কেন্দ্রীয় শক্তি, রবীন্দ্র-মানসলোকের হ্লাদিনী শক্তি স্বরূপিণী নায়িকা। বহু বৎসর পরে ‘ভানুসিংহের পত্রাবলী’তে রাণু অধিকারীকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন— “যখন আমি পদ্মার কোলে বাস করতুম তখন পাশাপাশি আমার দুইরকম বাসাই ছিল। ঘরের মধ্যে আমার অন্তরাত্মার নিশ্বাস, আর চরের মধ্যে তার প্রশ্বাস। একদিকে তার অন্দরের দরজা, আর একদিকে তার সদর দরজা।”
—বাস্তবিকই রবীন্দ্রনাথের পদ্মালালিত জীবনের সদর ও অন্দর একযোগে কাব্যসুষমামণ্ডিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে যে রচনায়, সেটি সেই ‘পদ্মাতীরের পত্রকাব্য’—ইন্দিরাকে লেখা ‘ছিন্নপত্রাবলী।’
Leave a comment