ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক বিষয়ক একটি ভাষণ তৈরি কর।
সম্মানিত সভাপতি, সমবেত সুধীবৃন্দ
‘ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রথমেই আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণের উদ্দেশ্যে, যাঁদের অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলে আমি শিক্ষিত হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে পারছি। জলকে যেমন কেটে দুভাগ করা যায় না তেমনি ছাত্র ও শিক্ষকের সম্পর্ককেও আলাদা করা যায় না। এ সম্পর্ক চিরন্তন এবং পবিত্র।
ছাত্র-শিক্ষকের মধুর সম্পর্ক বিষয়ে অসংখ্য দৃষ্টান্ত ও অজস্র গল্প সমাজে প্রচলিত আছে। মানব সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই এ সম্পর্কের সূত্রপাত। আজও বিনিসুতার মালার মতো একই মালায় গেঁথে আছে ছাত্র-শিক্ষকের মন। তবে সম্প্রতি এ সম্পর্কের কিছুটা ফাটল পরিলক্ষিত হচ্ছে। ব্যস্ত এবং যান্ত্রিক জীবনযাপনই সম্ভবত এজন্য দায়ী। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমাদের জীবনে ব্যস্ততা এবং টানাপোড়ন আগের চেয়ে অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এর ঢেউ লেগে ছাত্র-শিক্ষকের মধুর সম্পর্কের গায়ে।
আজকাল অনেককেই বলতে শোনা যায়, ছাত্র-শিক্ষকের আগের সেই সম্পর্ক এখন আর নেই। পুরনো দিনের শিক্ষকদের মতো এখনকার শিক্ষকরা শিক্ষার্থীকে অতটা আপনভাবে গ্রহণ করে না। আগেকার মতো অমন ছাত্রও আজকাল নেই; যে গুরু বাক্যকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। এরকম ঢালাও মন্তব্য সত্য নয়। দেশে এখনো আদর্শ শিক্ষক আছেন এবং আদর্শ ছাত্রও আছে। বিষয়টি খুবই আপেক্ষিক। তাই এ ব্যাপারে মন্তব্য করার আগে সমস্যাটির গভীরে প্রবেশ করা প্রয়োজন। আপনারা অবশ্যই স্বীকার করবেন যে, শিক্ষকরাই হচ্ছে মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষক তাঁর জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, মেধা আর মনন দিয়ে ছাত্রকে বিনির্মাণ করেন। তাকে খাঁটি মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। কিন্তু আমাদের দেশে একজন শিক্ষকের সামাজিক মূল্য কতটুকু? সভ্য দেশগুলোতে শিক্ষককে সবাই সম্মানের চোখে দেখে থাকে এবং তাঁদেরকে যথেষ্ট পারিশ্রমিক দেয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষক সমাজ বরাবরই অবহেলার শিকার। উন্নত জীবনযাপনের আস্বাদ থেকে তারা বঞ্চিত। তাঁদেরকে সমাজে অত্যন্ত করুণার দৃষ্টিতে দেখা হয়। শিক্ষকরা যে বেতন পান, তা দিয়ে তাঁদের পরিবার নির্বাহ করাই কঠিন। ফলে বেঁচে থাকার তাগিদে তাঁরা টিউশনি, কিংবা খণ্ডকালীন অন্য কোন কাজ বেছে নিচ্ছেন। এতে করে একজন শিক্ষকের নৈতিকতা অক্ষুণ্ণ রাখা বিষম দায় হয়ে পড়েছে। যে শিক্ষক শিক্ষকতার মতো একটি মহান পেশাকে ব্রত হিসেবে নিয়ে শিক্ষায়তনে ঢুকেছিলেন তিনিই ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছেন তাঁর মনোবল । অপরদিকে ছাত্র কিংবা ছাত্রের অভিভাবক শিক্ষককে মনে করছেন নম্বর তোলার হাতিয়ার। কিছু অভিভাবক আছেন যারা মনে করেন, সন্তান ভালো একটা পাস দিক। আদর্শ মানুষ হোক এটা ভাবেন না। এর ফলে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক দাঁড়ায় নিছক টাকা পয়সার সম্পর্কে। এভাবে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে। দেশে চলমান পঙ্কিল রাজনীতিও ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ককে কলুষিত করার জন্য অনেকাংশে দায়ী। বাঁধ ভাঙা প্লাবনের মত সন্ত্রাস ঢুকে পড়েছে বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনে। যেখানে সেখানে যত্রতত্র ছাত্ররা পেশী শক্তির পরিচয় দিচ্ছে। আর শিক্ষকরা ধীরে ধীরে মেরুদণ্ডহীন হয়ে পড়ছেন। স্নেহ- মমতা দিয়ে তাঁরা আর পারছেন না ছাত্রকে ধরে রাখতে।
জাতীয় মঙ্গলের জন্য এ অবস্থার পরিবর্তন হওয়া অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষকরা যদি ন্যায্য পারিশ্রমিক এবং মর্যাদা পায়, সমাজ এবং দেশের বুকে স্থিতিশীল সুস্থ পরিবেশ বিরাজ করে তাহলে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের অবশ্যই উন্নতি হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ ।
Leave a comment