অথবা, চর্যাপদের শব্দ ব্যবহারে ও উপমারূপক প্রয়োগে চর্যাকর্তারা সমসাময়িক পরিমণ্ডলকে উপজীব্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন- আলোচনা কর

উত্তর: চর্যাপদগুলো প্রাচীন বাংলার সমাজ চিত্রের বহু বিচিত্র চিত্র সম্বলিত একখানি এ্যালবাম বিশেষ। সন্দেহ নেই, কোনো একটি বিশেষ ধর্মতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের প্রয়োজনেই চর্যাগুলোর সৃষ্টি। সেই ধর্মীয় ইঙ্গিত চর্যাকারগণ একটি বিশেষ। ধরনের তত্ত্ববাদ ও গুহ্য সাধনাকে প্রাকৃত অপভ্রংশের প্রকীর্ণ কবিতার মতো স্বল্পতম আয়তনের মধ্যে নানা সংকেতের সাহায্যে ব্যক্ত করতে চেয়েছিলেন। তাই পদগুলো আধ্যাত্ম সাধনা সম্পৃক্ত এবং তত্ত্ববাদের বাহন- চর্যাপদের সাহিত্যিক মূল্য বিচারের সময় একথা আমাদের স্মরণ রাখতে হবে।

তবে একথা স্বীকার্য যে, চর্যার সমস্ত কবিতা নিছক তত্ত্বরূপ গ্রহণ করলে এর সাহিত্য বিচার নিষ্ফল হয়ে যাবে। চর্যাগীতিকাগুলো মূলত একটি বিশেষ রহস্যবাদী সম্প্রদায়ের গূঢ় ভজনাবলি হলেও এর মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত রসের আবেদন ও বাক্ নির্মিতির শিল্প কৌশল পরিকল্পিত হয়। তত্ত্ব দর্শনের প্রতি সাধকদের দৃষ্টি নিবন্ধ হলেও কেউ কেউ তত্ত্ব কথাকে নানা রূপক প্রতীকের সাহায্যে বলতে গিয়ে বাচ্যার্থ বা উদ্দিষ্টার্থকে চিত্রকল্পের সাহায্যে মনোরম করে তুলেছেন। এই চিত্র প্রতীকগুলো একদিকে যেমন উদ্দিষ্টার্থকে সংযত আকারে পরিবেশন করেছে, তেমনি চিত্রধর্ম এবং রূপকল্পকেও আবার অজ্ঞাতসারে একটি শিল্প মর্যাদা দান করেছে।

চিত্রকল্প: চর্যাপদে নানা পরিভাষা এবং সংকেতের বাহুল্য দৃষ্ট হয়। অনেক সময় রূপক ও প্রতীকের সাহায্যে দূরূহ তত্ত্বকে স্পষ্টতর করা হয়েছে। যেমন- ভবনদী পারাপার, হরিণ-হরিণী, শবর-শবরীর মদমত্ত উল্লাস, ডোম্বি, দারিদ্র্য গর্ভিনী রমণীর মনোবেদনা প্রভৃতি হাস্যরূপকের সাহায্যে আচার্যগণ চর্যার গূঢ় রহস্য অদীক্ষিতের নিকট সংবৃত করলেও দীক্ষিতের নিকট বিবৃত করেছেন। এর কোথাও চিত্রকল্প, কোথাও সৌন্দর্যানুভূতি, কোথাও বা লোক জীবনের প্রতিচ্ছবি ধরা পড়েছে। যেমন- শবরপাদের একটি পদ্যাংশ-

উষ্ণা উষ্ণা পাবত তহি’ বসই সবরী বালী।

মোরাঙ্গ পীচ্ছ পরিহাণ সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী ॥ [২৮নং চর্যা]

উচ্চ পার্বত্য প্রদেশে শবর বালিকার বাস। ময়ূরের পুচ্ছ সে পরিধান করেছে, গলায় দিয়েছে গুঞ্জার মালা। অপরূপ বেশে সজ্জিত শবরীকে দেখে শবর উন্মত্ত হয়ে উঠেছে, শবরী তাকে বলছে যে এত চঞ্চল হওয়ার কোন কারণ নেই। কেননা সে তো তারণী ধরণী। এই শবরী বালিকাকে যে পরিবেশে পাঠকের সামনে আনা হয়েছে, সেই পরিবেশটিও কত সুন্দর-

নানা তরুবর মৌলিল রে লাগেলী ডালী।

একেলী সবরী এ বন হিন্ডই কর্ণ কুন্ডল বজ্রধারী ॥ [পূর্বোক্ত]

চারদিকে নানা বৃক্ষের কত অগণিত বিচিত্র ফুল, গাছের ডালে ডালে আকাশ যেন ছেয়ে গেছে, আর সেই উদার বিস্তৃত মধুর সৌন্দর্যের মাঝখানে একলা দাঁড়িয়ে আছে শবরী পুষ্পিত একটি লতার মতো।

এ পরিবেশে নরনারীর জীবনে মিলন কামনার চাঞ্চল্য জাগে। শবর তাই শয্যা প্রস্তুত করল এবং শবরীর সাথে প্রেমানন্দে নিশা যাপন করল, কপূর তাম্বুলের সহযোগে তাদের দেহমিলন সুন্দরতর হয়ে উঠল। এই বর্ণনার মধ্যে কবির সুগভীর রূপানুরাগ ও বর্ণবিলাস লক্ষণীয়। ৩৩নং চর্যায় একটি দারিদ্র্যক্লিষ্ট গৃহিণীর বিড়ম্বিত জীবনটি স্বল্পতম রেখার সাহায্যে ছোটোগল্পের উপাদানে কবি ব্যক্ত করেছেন এভাবে,

টালত মোর ঘর নাহি পড়বেসী।

হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী ॥

একটি গৃহস্থ বধূ টিলার উপর বাস করে, পাড়া-পড়শী নেই, তবু অতিথি এসে ভিড় করে। ডেকের সংসারের মত বহু অপত্যাবিশিষ্ট দুঃখের জীবন। এর তাৎপর্য তত্ত্বানুসন্ধিৎসুর নিকট গভীর অর্থবহ সন্দেহ নেই; তবে কবি হৃদয়ের রস সংযোগেও সমৃদ্ধ।

৬নং চর্যাটিও ব্যক্তিক অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির চরম স্ফূর্তিতে সমৃদ্ধ। হরিণ শিকারের রূপকে হরিণ-হরিণীর প্রেম লীলার যে চিত্র অঙ্কিত তাতে মানবজীবনের বিরহ-মিলন-প্রেম-মৃত্যু-রোধের ব্যঞ্জনা আছে।

তিণ ন ছুবই হরিণা পিবই ন পাণী।

হরিণা হরিণির নিলঅ ণ জাণী ॥

হরিণী বোলই সুণ হরিণা তো।

এ বণ ছাড়ী হোহু ভান্তো ॥ [ভুসুকপাদ]

এই বর্ণনায় পতির ব্যঞ্জনা প্রকাশমান। অতি সহজে দু’চারটি রেখায় পদকর্তা পূর্ণতর চিত্র সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছেন। সহজ বর্ণনাভঙ্গি এবং চিত্রধর্মিতায় পদগুলো যেন ঐশ্বর্যময় হয়ে উঠেছে।

শব্দ ও অর্থালংকারের ব্যবহার: ভাব ব্যঞ্জনা ছাড়াও রূপক, উপমা, প্রতীক ব্যবহারে চর্যাপদ যেন আধুনিক শিল্পীর এক সুচারু শিল্পকর্ম। চর্যাপদে শব্দালংকার ও অর্থালংকারের ব্যবহার লক্ষণীয়। শব্দালংকারের মধ্যে প্রথম জিনিস অনুপ্রাস। চর্যাপদে অনুপ্রাসের অভাব নেই। দৃষ্টান্ত:

১. তুলা’ ধুণি ধুণি আঁসুরে আঁসূ।

আঁসু ধুণি ধুণি নিববব সেসু ॥ [২৬নং চর্যা]

২. তে তীনি তে তীনি তীনি হো ভিন্না। (৭)

৩. জিম জিম করিআ করিণিরে রিসই।

তিম তিম তথতা মঅগল বরিসই ॥ (৯)

উপমা, রূপক, সন্দেহ, নিশ্চয়, সমাসোক্তি, স্বভাবোক্তি ইত্যাদি নানা অর্থালংকার ব্যবহারে সিদ্ধচার্যরা সার্থকতার পরিচয় দিয়েছেন। চর্যাপদে উপমা, রূপক সংগ্রহ করা হয়েছে বাংলার অতি পরিচিত পরিবেশ ও সাধারণ জীবন থেকে। নদী, নৌকা, ঘাট, পনটনী, সোনা, রুপা, কুটীর, কাপাস ফুল এসব দ্রব্য চর্যাগীতিতে উপমারূপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। অন্যান্য অলঙ্কারগুলো হলো:

স্বভাবোক্তি: উষ্ণা উষ্ণা পাবত তহি বসই সবরী বালী। (২৮)

রূপক : দিবসহি বহুড়ী কাউহি ডর ভাই।

রাতি ভইলে কামরু জাই ॥ (২)

বিরোধভাস: জো সো বুধী সোহি নিবুধী।

জো সো চোর সোহি সাধী ॥ (৩৩)

সন্দেহ : জামে কাম কি কামে জাম। (২২)

উপমা : মরুমরীচি গন্ধব্বনঅরী দাপণপড়িবিম্বু জইসা। (৪১)

শব্দ ব্যবহার : অলংকারের পাশাপাশি শব্দ ব্যবহারেও পদকর্তারা সফল হয়েছে। তাঁরা ভাবানুযায়ী শব্দ ব্যবহার করে ধ্বনি মাধুর্যের সৃষ্টি করেছেন। ৫নং চর্যায় পদকর্তা চাটিল পাদ যখন বলেছেন,

‘ভবণই গহণ গম্ভীর বেঁগে বাহী।’

তখন গহন অতল ভবনদীর গম্ভীর শব্দে প্রবহমানতা এ পংক্তিতে শব্দ ঝংকারে মূর্ত হয়ে ওঠে। অনুরূপভাবে হরিণ কিভাবে বন ছেড়ে চলে গেল তার বর্ণনায় কবি একটি মাত্র ছত্রে সমগ্র ছবিটি ফুটিয়ে তুলেছেন-

‘তরঙ্গতে হরিণার খুর ন দীসই।’ (৬নং চর্যা)

দ্রুত পলায়নের বর্ণনায় এর চেয়ে সুন্দর সুমিত ভাষা আর আশা করা যায় না। কি সুন্দর সংক্ষিপ্ত এবং পরিচ্ছন্ন এই ভাষা-

কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল।

চঞ্চল চীএ পইঠা কাল । [১নং চর্যা]

শরীর বৃক্ষসদৃশ, তার পাঁচ ইন্দ্রিয় যেন পাঁচটি ডাল, চঞ্চল চিত্তে কাল প্রবিষ্ট হয়- এ ধরনের সংক্ষিপ্ত বাকবিন্যাস চর্যার একটি বৈশিষ্ট্য।

ছন্দ: চর্যার ছন্দে বাংলা ভাষায় রচিত পয়ারের প্রাচীনতম নিদর্শন আমরা পেয়েছি। চর্যাকারগণ দীর্ঘ পয়ার ও লঘু পয়ার দুই রকমের নিদর্শনই ব্যবহার করেছেন। যেমন, বারো মাত্রার পয়ার-

ডোম্বী বিবাহিআ আহরিউ জাম।

জউতুকে কিঅ অণুত্তর ধাম । [১৯নং চর্যা]

দীর্ঘ পয়ারের উদাহরণ:

১. ণাণা তরুবর মৌলিল রে লাগেলী ডালী। একেলী সবরী এ রণ হিন্ডই কর্ণকুন্ডল বজ্রধারী। [২৮নং চর্যা]

২. তোহোর অন্তরে মোএ ঘালিলি হাড়েরি মালী ॥ [১০নং চর্যা]

চর্যার ছন্দ মূলত মাত্রাবৃত্তরীতিতে গঠিত। মাত্রাবৃত্ত ছন্দের সুনির্দিষ্ট গণনা-পদ্ধতি এখানে মেনে চলা হয়নি। মাত্রা গণনার সুনির্দিষ্ট নিয়ম চর্যার ছন্দে নেই। এখানে দীর্ঘস্বর কখনো দু-মাত্রা কখনো এক মাত্রা বিশিষ্ট। যেমন-

কানেট চোরে নিল কাগই মা গই। [২নং চর্যা)

কানেট চোরে নিল অধ রাতী ॥

এখানে ‘চোরে’ ৪ মাত্রা ও দু’মাত্রা গণনা করা হয়েছে। চর্যার দীর্ঘ মাত্রাবিশিষ্ট পদ পরবর্তীকালে ত্রিপদী ছন্দে রূপান্তরিত হয়েছিল বলে মনে হয়- “উষ্ণা উষ্ণা পাবত তহি বসই সবরী বালী।” [২৮নং চর্যা]

চর্যাপদের ভাব, ভাষা, ছন্দ, অলংকার সম্পর্কে আলোচনায় স্পষ্ট বোঝা যায় যে, এগুলো শুধু সাধন তত্ত্বের কথা হিসেবেই নয়- সাহিত্যরস মণ্ডিত কবিতা হিসেবেও অতুলনীয়। এ প্রসঙ্গে অতীন্দ্র মজুমদার বলেছেন,

“চর্যাপদকে সুষ্ঠু সুন্দর কাব্য বলে স্বীকার করতে দ্বিধা করি না এই কারণে যে, চর্যাপদে আছে সুগভীর মানবতাবোধের নির্মল অনুভূতি প্রবণ নির্ঝর এবং প্রেম ভক্তির সম্বন্ধকেই তার সাহিত্য মূল্য। বাংলা কাব্যের আদি লগ্নে এই অপূর্ব সমন্বয়ের সূচনা বাংলা গীতি কবিতার মুক্তির দূত। সেদিক দিয়ে চর্যাপদ একটি অমূল্য সৃষ্টি।” [চর্যাপদ]

পরিশেষে বলা যায়, চর্যাকারগণ সম্পূর্ণ ধর্মীয় চেতনার বশে এই পদগুলো রচনা করলেও তাঁদের অনেকেই রীতিমত কবিত্ব শক্তির স্বাক্ষর রেখেছে। ছন্দ, বাণীবিন্যাস, ভাব ব্যঞ্জনা এবং রূপক প্রতীকের সাহায্যে চিত্র সৃষ্টি করে পদকর্তারা যে ভাবকে পরিস্ফুটিত করেছেন তা কাব্যরসে সজীব। তাই চর্যার সাহিত্যমূল্য একেবারে উপেক্ষণীয় নয়।