মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রথম ‘বীরাঙ্গনা শব্দটি তাঁর কাব্যগ্রন্থের নামকরণে ব্যবহার করেছেন। এটি একটি পত্র কবিতা সংকলন। ১১ জন পৌরাণিক নারীচরিত্র সমাজ, লােক, লজ্জা উপেক্ষা করে বীরের মতাে তাদের মনের ক্ষোভ, অভিমান ব্যক্ত করেছে। মনের দুঃখ, বেদনা, ব্যথা, ক্ষোভ ইত্যাদির অকপট প্রকাশ তাদের সংস্কারের গণ্ডি পেরিয়ে বীরত্বের শীর্ষে উন্নীত করেছে।
পাঠ্য নীলধ্বজের প্রতি জনা পত্ৰকবিতাটিতে বর্ণিত জনা মাহেশ্বরী পুরীর রাজা নীলধ্বজের পত্নী। তার একমাত্র পুত্র বীরযােদ্ধা প্রবীর পাণ্ডবদের অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘােড়ার গতিরােধ করে। এর ফলশ্রুতিতে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ পার্থের হাতে নিহত হতে হয় তাকে। পুত্রহত্যার প্রতিশােধ নেওয়ার পরিবর্তে রাজা নীলধ্বজ পার্থকে দেবতাজ্ঞানে রাজসভায় সিংহাসনে বসিয়ে নাচে গানে তাঁর মন তুষ্ট করতে চেয়েছেন। তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনের সখ্যলাভই হয়েছে তাঁর পরম আকাঙ্ক্ষিত। ক্ষত্রিয় রাজার বিপরীতধর্মী এই গর্হিত কাজে জনা লজ্জিত হয়েছেন। কারণ তিনি ক্ষাত্রধর্ম ভুলে যাননি। তাই তিনি পার্থের নিন্দা করে রাজা নীলধ্বজের কাজের বিরুদ্ধে অভিযােগ করেছেন। তিনি তাঁর পুত্রশােক এতটুকু ভুলতে পারেননি। তাই তাঁর শেষ পদক্ষেপ হিসেবে জাহ্নবীর জলে আত্মবিসর্জন দিয়ে তার চরম প্রতিবাদ জানিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। এখানেই জনার প্রকৃত মাতৃসত্তা ফুটে উঠেছে। ক্ষত্রিয় কুলের উপযুক্ত বীর নারীচরিত্র হিসেবে জনা চরিত্রটি উত্তীর্ণ। অর্থাৎ প্রকৃত অর্থেই জনা একজন বীরাঙ্গনা নারী।
উক্ত লাইনটি মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখা বীরাঙ্গনা কাব্য নামক পত্ৰকাব্যের অন্তর্গত নীলধ্বজের প্রতি জনা পত্রকবিতার অংশ। মহাভারতের ঘটনা অবলম্বনে লেখা স্বামী নীলধ্বজের প্রতি রানি জনার এই অভিযােগ পত্রটিতে পার্থের চরিত্র বিচার করতে গিয়ে পাঞ্চাল রাজকন্যা দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভার উল্লেখ করেছেন তিনি। এই স্বয়ংবর সভায় বিশিষ্ট ধনুর্ধর তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন ছলনা করেছিলেন।
দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় বিভিন্ন দেশের রাজা এবং যুবরাজরা আমন্ত্রিত ছিল। কিন্তু পার্থ তথা অর্জুন কোনাে রাজা বা রাজপুত্র নন। সেইসময় পাণ্ডবরা কৌরবদের ষড়যন্ত্রের ফলে রাজ্যের অধিকার পাননি। কিন্তু অর্জুন মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে স্বয়ংবর সভায় উপস্থিত হয়েছিলেন।
দ্রৌপদীর বিবাহের শর্ত রূপে ঘূর্ণায়মান মাছের চোখকে জলের মাধ্যমে সঠিক নিশানা লাগাবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বিভিন্ন রাজারা অকৃতকার্য হলে পার্থ তথা অর্জুন এই দুঃসাধ্য সাধন করে দ্রৌপদীকে বিবাহ করেছিলেন। এটাই ছিল অর্জুনের ছলনা। তিনি ব্রাত্মণের ছদ্মবেশে সমস্ত রাজবংশকে ছলনা করেছিলেন, তা না হলে সেই স্বয়ংবর সভায় প্রবেশের অধিকার তার ছিল না। এই গর্হিত কাজটি ছিল ক্ষত্রিয়দের পক্ষে চরম অপমানকর ও লজ্জাজনক। এখানে এই ছলনার কথাই বলা হয়েছে।
মধুসূদন দত্তের লেখা বীরাঙ্গনা কাব্য নামক পত্ৰকাব্যের অন্তর্গত নীলধ্বজের প্রতি জনা পত্রকবিতায় পুত্র বলতে প্রবীরের কথা বলা হয়েছে। অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্ব আটকে রাখার জন্য পার্থ তথা অর্জুন অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মাহেশ্বরী রাজ্যের যুবরাজ প্রবীরকে হত্যা করেন। রাজা নীলধ্বজ তার একমাত্র পুত্রের হত্যাকারীকে যুদ্ধে পরাজিত না করে তাকে তার সিংহাসনে বসিয়ে প্রভুজ্ঞানে সেবা করেছেন। ক্ষত্রিয়কুলের এই অনুচিত কার্যে রানি জনা অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে রাজা নীলধ্বজের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু পরক্ষণেই পতি পরম গুরু এই সত্য মনে করে ক্ষান্ত হয়েছেন এবং নিজের ভাগ্যের প্রতি এবং পুত্র প্রবীরের প্রতি অভিযােগ ব্যক্ত করেছেন।
গর্ভধারিণী মা দশ মাস দশ দিন পুত্রকে আপন গর্ভে ধারণ করে লালন-পালন ও রক্ষা করেন। সেই কারণে পুত্রের ওপর চিরকালীন এই মাতৃ ঋণ বজায় থাকে। মা আপন পুত্রের মা ডাক শুনে এবং তার উন্নতি লক্ষ করে আনন্দ পান। এইভাবেই তার ঋণ কিছুটা হলেও শােধ হয়। কিন্তু অকালে সেই পুত্র মারা গেলে মায়ের আশা পরিণত হয় হতাশায় এবং প্রকৃত মাতৃমন জীবনে বাঁচার অর্থই হারিয়ে ফেলে। জীবনের প্রতি তার আর কোনাে উৎসাহই থাকে না। তাই সে তার জীবন শেষ করতে উদ্যত হয়।
এই কারণেই জনা তাঁর পুত্রের প্রতি এই অভিযােগ করেছেন যে সে অকালে প্রাণত্যাগ করে তার মায়ের বাঁচার সমস্ত রসদ একেবারে নিঃশেষ করে দিয়েছে।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্য’-এর একাদশতম পত্র নীলধ্বজের প্রতি জনা’তে স্বামী নীলধ্বজ মাহেশ্বরী পুরীর রাজা হয়েও পুত্রহস্তা পার্থকে দেবতাজ্ঞানে আপন সিংবাসনে বসিয়ে তার সেবায় নিয়ােজিত হয়েছেন, তার মনােরঞ্জনের জন্য সচেষ্ট হয়েছেন। এই ঘটনায় জনা ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর স্বামীকে একটি অভিযােগ পত্র লিখেছেন। পত্রে তিনি নানা দৃষ্টান্তের সাহায্যে অর্জুন চরিত্রের নীচতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও জনা স্বামীর মনে পুত্রহন্তার বিরুদ্ধে প্রতিশােধস্পৃহা জাগিয়ে তুলতে ব্যর্থ হন।
স্বামী গুরুজন, তাই তাঁকে দোষারােপ করা উচিত কাজ নয় জেনেও পুত্রশােকাতুরা জনা তার মনের দুঃখ ও অভিমানের কথা স্বামীকে না-জানিয়ে পারেননি। এমনকি স্বামীকে তিনি ক্ষত্রিয়ধর্ম সম্পর্কেও স্মরণ করিয়ে তাঁর এইরূপ গহিত কার্যের সমালােচনা করেছেন। সবশেষে রাগ ও অভিমানের জ্বালা ভুলতে তিনি জাহ্নবীর জলে প্রাণবিসর্জনের সংকল্প করেন। এখানেই তার কুদ্ধ, অভিমানী স্বর তীব্র আকারে ধরা পড়েছে। স্বামীর মনােযােগ না পাওয়ায় তাই তাকে বলতে শােনা যায়, “এ জনাকীর্ণ ভবস্থল আজি/বিজন জনার পক্ষে”। এর জন্য তিনি অবশ্য তার ভাগ্যকেই দোষারােপ করেছেন। এই ধরনের খেদোক্তির মধ্যে দিয়েই জনার অভিমানী কণ্ঠস্বর স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
নীলধ্বজের প্রতি জনা কী ধরনের রচনা তার ব্যাখ্যা করাে।
পৌরাণিক চরিত্র নিয়ে ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা রচিত হলেও সেখানে কবি মধুসূদনের যে স্বাতন্ত্রের পরিচয় পাওয়া যায় তা লেখাে।
রেনেসাঁর লক্ষণগুলি কীভাবে ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ পত্রকাব্যে প্রতিফলিত হয়েছে লেখাে।
পত্ৰকাব্যের সংজ্ঞা দাও। কোন্ পত্রকাব্য দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মধুসূদন তাঁর নীলধ্বজের প্রতি জনা লিখেছিলেন?
পত্ৰকবিতা হিসেবে ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’-র সার্থকতা আলােচনা করাে।
নীলধ্বজের প্রতি জনা কাব্যাংশ অবলম্বনে নীলধ্বজ চরিত্রটিকে বিশ্লেষণ করাে।
নীলধ্বজের প্রতি জনা’ কাব্যাংশে উল্লিখিত জনা চরিত্রটি সম্পর্কে আলােচনা করাে।
নীলধ্বজের প্রতি জনা কাব্যাংশে নীলধ্বজের প্রতি জনার যে ক্ষোভ ও অভিমানের প্রকাশ ঘটেছে, তা নিজের ভাষায় লেখাে।
নীলধ্বজের প্রতি জনা কাব্যাংশে জনা কেন কুন্তীর নিন্দায় সরব হয়েছেন? কুন্তী সম্পর্কে জনা যে মূল্যায়ন করেছেন তা নিজের ভাষায় বর্ণনা করাে।
নীলধ্বজের প্রতি জনা কাব্যাংশে জনা কেন দ্রৌপদীর নিন্দায় সরব হয়েছেন? দ্রৌপদী সম্পর্কে জনা যে মূল্যায়ন করেছেন তা নিজের ভাষায় বর্ণনা করাে।
নীলধ্বজের প্রতি জনা কাব্যাংশে জনা কেন অর্জুনের নিন্দায় সরব হয়েছেন? অর্জুন সম্পর্কে জনা যে মূল্যায়ন করেছেন তা নিজের ভাষায় বর্ণনা করাে।
“সত্যবতীসুত ব্যাস বিখ্যাত জগতে!” -মন্তব্যটির পৌরাণিক প্রসঙ্গ উল্লেখ করাে। কাব্যাংশে এটি উল্লেখের কারণ আলােচনা করাে।
“বসুন্ধরা গ্রাসিলা সরােষে/ রথচক্র যবে, হায়;” -মন্তব্যটির প্রসঙ্গ উল্লেখ করাে। মন্তব্যটিতে যে পৌরাণিক প্রসঙ্গের উল্লেখ করা হয়েছে তার বিস্তৃত বর্ণনা দাও।
“হতজ্ঞান আজি কি হে পুত্রের বিহনে” -বক্তা এই মন্তব্যটি কখন করেছেন? তার এরূপ মন্তব্যের কারণ কী?
“কি কহিবে, কহ/ যবে দেশ-দেশান্তরে জনরব লবে/ এ কাহিনী” -মন্তব্যটির তাৎপর্য আলােচনা করাে।
“…কী গুণে তুমি পূজ, রাজরথি,/ নরনারায়ণ-জ্ঞানে?”- মন্তব্যটির তাৎপর্য আলােচনা করাে।
“এই তাে সাজে তােমারে, ক্ষত্রমণি তুমি,” -বক্তার এই মন্তব্য কি যথার্থ ছিল?
“ভুলিব এ জ্বালা,/এ বিষম জ্বালা, দেব, ভুলিব সত্বরে। বক্তা এখানে কোন জ্বালা ভুলতে চেয়েছেন? শেষপর্যন্ত কীভাবে এই জ্বালা থেকে তিনি মুক্তি খুঁজেছেন?
“কি লজ্জা! দুঃখের কথা, হায়, কব কারে?” -বক্তা কোন্ দুঃখ এবং লজ্জার কথা বলতে চেয়েছেন?
“মিথ্যা কথা, নাথ। বিবেচনা কর,” -এক্ষেত্রে বক্তা কীভাবে নিজের মত প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন?
“মহারথী-প্রথা কি হে এই, মহারথি?”— বক্তার এই ধরনের মন্তব্যের যৌক্তিকতা আলােচনা করাে।
“কিন্তু বৃথা এ গঞ্জনা। গুরুজন তুমি; / পড়িব বিষম পাপে গঞ্জিলে তােমারে।” -বক্তার এই আক্ষেপ কেন? এ বিষয়ে তার প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
“ক্ষত্রধর্ম, ক্ষত্রকম্ম সাধ ভুজবলে” -মন্তব্যটির তাৎপর্য আলােচনা করে তার পরিণতি বিশ্লেষণ করে দেখাও।
“হায়, ভােজবালা কুন্তী-কে না জানে তারে, স্বৈরিণী?” -বক্তার এই মন্তব্যের যথার্থতা আলােচনা করাে।
“দহিল খাণ্ডব দুষ্ট কৃয়ের সহায়ে।/ শিখণ্ডীর সহকারে কুরুক্ষেত্রে রণে”- ‘খাণ্ডব’ দহন ও ‘শিখণ্ডী’ সম্বন্ধে পৌরাণিক সত্য লেখাে।
“চণ্ডালের পদধূলি ব্রাহ্মণের ভালে?/ কুরঙ্গীর অশ্রুবারি নিবায় কি কভু/ দাবানলে? কোকিলের কাকলি-লহরী/ উচ্চনাদী প্রভঞ্জনে নীরবয়ে কবে?”— উদ্ধৃতিটির পশ্চাৎপট আলােচনা করাে।
“কি কুছলে নরাধম বধিল তাঁহারে” -মন্তব্যটির পৌরাণিক প্রেক্ষাপট উল্লেখ করাে। এই মন্তব্যের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করাে।
Leave a comment