ছড়া কি বা কাকে বলে :-
লোক সাহিত্যের প্রাচীনতম শাখা ‘ছড়া‘। ‘ছড়া’ শব্দটি দেশজ। যোগেশ চন্দ্র রায় তাঁর বাঙ্গলা শব্দকোষে (২য় খন্ড) এ বলেছেন সংস্কৃত ‘ছটা’ শব্দ থেকে ‘ছড়া’ শব্দটি এসেছে। ছড়া শব্দটি অর্থ ‘শ্লোক’ পরম্পরা।
পূর্ব ও পশ্চিমের বঙ্গের অধিবাসীরা ছড়াকে শ্লোক বলে থাকেন। ছড়ার এক একটি অংশ শৃঙ্খল বা শ্লোকে মতো গ্রথিত থাকে। মধ্যযুগীয় সাধারণ জন জীবনে ছড়া নারী ও পুরুষ সমাজে সমভাবে প্রচলিত ছিল। সেই কারণে ছড়াকে এভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে যে –
“গানের মাধ্যমে ছড়ানো এবং পরপর গ্রন্থিত হল ছড়া।”
লোক সাহিত্যের আদিম কাল থেকে এই শাখাটির বিকাশ। ছড়া দেশ কাল অতিক্রম করে বিভিন্ন ভাবে মানুষের মনোরঞ্জন করে থাকে। ছড়ায় যে জীবন চিত্র ধরা পড়ে তা বাস্তব সম্মত ও সমাজ সম্মত ভাবে ফুটে ওঠে। সেই সঙ্গে লোক সাহিত্যের এই শাখাকে সমৃদ্ধ করে।
বাংলা ছড়ার বৈশিষ্ট্য :-
১ – ছড়ায় যুক্তিসংগত ভাবের পারম্পর্য থাকে না।
২ – ছড়ায় ঘটনা বা কাহিনীর ধারাবাহিকতা থাকে না।
৩ – ছড়া মূলত ধ্বনিপ্রধান ও সুরাশ্রয়ী।
৪ – ছড়ায় রস ও চিত্র বর্মা, তবে উপদেশ নেই বললেই চলে।
৫ – ছড়ায় ছন্দ মূলত শ্বাসাঘাত।
৬ – ছড়া বাহুল্য বর্জিতও সংক্ষিপ্ত
৭ – ছড়ায় ভাষা সাধারণত হাল্কা চালের লঘু ও চপল।
৮ – ছড়ার রস স্নিগ্ধ ও সরস।
ছড়ার প্রকারভেদ গুলি কি কি :-
অধ্যাপক নির্মলেন্দু ভৌমিক তাঁর “বাংলা ছড়ার ভূমিকা” গ্রন্থে বাংলা ছড়াকে মোটামুটি দুটি ভাগে ভাগ করেছেন। যথা-
১ – আনুষ্ঠানিক ছড়া
২ – অনানুষ্ঠানিক ছড়া।
১ – আনুষ্ঠানিক ছড়া:
- – বিবাহ ছড়া – বিবাহ অনুষ্ঠানের সাথে সম্পর্কিত
- – জন্ম ছড়া – শিশুর জন্মের সময় গান
- – ভাতি ছড়া – ভাতি পূজার সময় গান
- – হালি ছড়া – দোল পূর্ণিমার সময় গান
- – কৃষ্ণ জন্মাষ্টমী ছড়া
- – দুর্গা পূজা ছড়া
এছাড়াও শৃঙ্খলা, প্রতিদান, জাতি উৎসব ইত্যাদি অনুষ্ঠানের সাথে জড়িত বিভিন্ন ধরনের ছড়াকে আনুষ্ঠানিক ছড়া বলা হয়।
২ – অনানুষ্ঠানিক ছড়া:
- – প্রেম ছড়া – প্রেম, ভালোবাসা নিয়ে ছড়া
- – প্রকৃতি ছড়া – প্রকৃতির বর্ণনামূলক ছড়া
- – সমাজ সমালোচনা ছড়া – সামাজিক সমস্যা নিয়ে ছড়া
- – ধর্মীয়/আধ্যাত্মিক ছড়া
- – নৈতিক ছড়া – নৈতিকতা নিয়ে উপদেশমূলক ছড়া
- – ঐতিহ্য ছড়া – ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে ছড়া
- – লোক ছড়া – সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে ছড়া
এসব ছড়া কোন নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানের সাথে সম্পর্কিত না হলেও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে রচিত।
লোক সাহিত্যের গবেষক ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য তাঁর “বাংলার লোক সাহিত্য”২য় খন্ড গ্রন্থে ছড়াকে ছয়টি শ্রেনীতে ভাগ করেছেন।
১ – শিশু বিষয়ক
- – শিশুর জন্ম ছড়া
- – শিশুর খেলাধুলা নিয়ে ছড়া
- – শিশুর স্কুলের জীবন নিয়ে ছড়া
- – শিশুর পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে ছড়া
- – শিশুর স্বপ্ন নিয়ে ছড়া
- – শিশুর মনোভাব বর্ণনা করা ছড়া
- – শিশুদের জন্য নৈতিক শিক্ষামূলক ছড়া
- – শিশুর সঙ্গে পরিচিত প্রাণী পক্ষিদের নিয়ে ছড়া
এসব ছড়ার ভাষা, বিষয়বস্তু ও মানসিকতা শিশুদের বুঝতে সহজ এবং আকর্ষণীয় হয়।
শিশুতোষ ছড়ার বৈশিষ্ট্য :-
শিশুতোষ ছড়ার কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য নিম্নে বর্ণিত:
- – সহজ ভাষা: শিশুতোষ ছড়ার ভাষা সহজ, সাধারণ ও সহজবোধ্য। জটিল শব্দ, প্রতিশ্রুতিবাদী ভাষা এড়ানো হয়।
- – সংক্ষিপ্ততা: এসব ছড়া সাধারণত খুব ছোট, মাত্র দু-এক পারার।
- – ললনাময়: এরা রসপ্রবণ, ললনাময় এবং শিশুদের আকর্ষণীয় লাগে।
- – ছবিসহ: শিশুদের জন্য ছবিসহ শিশুতোষ ছড়া সহজ বোঝার।
- – ছন্দবদ্ধতা: এরা সবই ছন্দবদ্ধ, যা শিশুদের মনে রাখা সহজ করে তোলে।
- – ব্যাক্তিগত উপদেশ: এরা শিশুদের জীবনের বিভিন্ন বিষয়ে উপদেশ দেয়।
- – ছোট গল্প: এগুলো ছোট একটি গল্প বলে, যা শিশুদের আগ্রহ সৃষ্টি করে।
২ – নারী বিষয়ক
নারী বিষয়ক ছড়া বলতে বোঝায় যেসব ছড়ায় নারীর জীবন, অভিজ্ঞতা ও মনোভাব তুলে ধরা হয়েছে। কিছু উদাহরণ:
- – নারীর প্রেম ও বিয়োগ নিয়ে ছড়া
- – বধূর জীবন ও অনুভূতি নিয়ে ছড়া
- – মায়ের ভালোবাসা নিয়ে ছড়া
- – নারীর স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে ছড়া
- – নারী শিক্ষা নিয়ে উৎসাহজনক ছড়া
- – সমাজে নারীর অবস্থান নিয়ে ছড়া
- – নারী কর্মক্ষেত্রে সম্মানজনক ভূমিকা তুলে ধরা ছড়া
- – নারী জীবনের সৌন্দর্য তুলে ধরা ছড়া
এসব ছড়া নারী জীবনের বিভিন্ন পর্ব ও মর্মবোধকে তুলে ধরে।
৩ – পশুপক্ষী বিষয়ক
পশু-পক্ষী বিষয়ক ছড়া বলতে বোঝায় যেসব ছড়ায় বিভিন্ন পশু-পক্ষীর বর্ণনা বা তাদের সাথে সম্পর্কিত ঘটনাকে তুলে ধরা হয়েছে। এর কিছু উদাহরণ:
- – পাখির ডাক নিয়ে ছড়া
- – হাঁস-বাতাসীর কাহিনী নিয়ে ছড়া
- – বাঘ-শাবকের কৌতূহল নিয়ে ছড়া
- – ঘোড়া নিয়ে ছড়া
- – গরু নিয়ে গ্রাম্য জীবনের ছবি তুলে ধরা ছড়া
- – মাছ ধরা নিয়ে ছড়া
- – পশু-পক্ষীর মধ্যে বন্ধুত্ব নিয়ে ছড়া
এরকম ছড়াগুলো প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং মানুষ-প্রাণীর মিলন-মিশ্রণকে তুলে ধরে।
৪ – প্রকৃতি বিষয়ক
প্রকৃতি বিষয়ক ছড়া বলতে বোঝায় যেসব ছড়ায় প্রকৃতির বিভিন্ন দিককে তুলে ধরা হয়েছে। কিছু উদাহরণ:
- – বসন্ত ঋতুর সৌন্দর্য তুলে ধরা ছড়া
- – বর্ষা ঋতু নিয়ে রোমান্টিক ছড়া
- – হাওয়া, বাতাস ও মেঘ নিয়ে ছড়া
- – নদী, পাহাড়, সমুদ্র বর্ণনামূলক ছড়া
- – ফুল, গাছ, পাখি নিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য ফুটে উঠা ছড়া
- – সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত বর্ণনা ছড়া
- – বনভূমির প্রশান্ততা তুলে ধরা ছড়া
- – চন্দ্র-তারা নিয়ে রোমান্টিক ছড়া
এরকম ছড়া প্রকৃতি সৌন্দর্যকে বিবেচনা করে রচনা করা হয়।
৫ – সমসাময়িক ঘটনা নির্ভর
সমসাময়িক ঘটনা নির্ভর ছড়া বলতে বোঝায় যেসব ছড়ায় সেসময়ের সামাজিক, রাজনৈতিক বা অন্য কোন ঘটনাকে ভিত্তি করে রচনা করা হয়েছে। কিছু উদাহরণ:
- – স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে ছড়া
- – মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ছড়া
- – কোন জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতার উপর ছড়া
- – প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে সচেতনতামূলক ছড়া
- – কোন খেলাধুলার ইভেন্ট উপলক্ষে ছড়া
- – সামাজিক যে কোন নাটকীয় ঘটনা নিয়ে ছড়া
– বর্তমান যুগের চিত্র তুলে ধরা ছড়া
এভাবে সমসাময়িকতাকে কেন্দ্র করে ছড়ার রচনা করা হয়।
৬ – উপকথার ছড়া।
- – – সিন্ধুকান্য উপকথার ছড়া
- – – কাবুলিওয়ালা বা অন্যান্য প্রচলিত উপকথার ঘটনাক্রম ফুটিয়ে তুলে ছড়া
- – প্রচলিত কিছু প্রবন্ধ উপকথার ভিত্তিতে ছড়া
- – উপকথার শিক্ষামূলক বার্তা ফুটিয়ে তোলা ছড়া
এভাবে উপকথাকে কেন্দ্র করে সৃজনশীলতার চ্যালেঞ্জ নিয়ে ছড়া রচনা করা হয়।
আবার ছড়ার সৃষ্টির নিরিখে ছড়াকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
১ – লৌকিক ছড়া কাকে বলে :
লৌকিক ছড়া বলতে বোঝায় সাধারণ মানুষের জীবন, অভিজ্ঞতা ও মনোভাব নিয়ে যে ছড়াগুলো রচিত হয়ে থাকে। লৌকিক ছড়ার কিছু উদাহরণ:
- – গ্রাম্য জীবন নিয়ে ছড়া
- – নৌকা ভাড়াটের কষ্ট নিয়ে ছড়া
- – কৃষকের পরিশ্রম নিয়ে ছড়া
- – দরিদ্র মানুষের দুঃখ বেদনা নিয়ে ছড়া
- – দেশে ফিরে আসা প্রবাসীর মনোভাব নিয়ে ছড়া
- – নির্যাতিত নারীর কান্নাকাটি নিয়ে ছড়া
- – পথ ভিক্ষুকের জীবনযাপনের সংগ্রাম নিয়ে ছড়া
লৌকিক ছড়ার বৈশিষ্ট্য :
- – সাধারণ মানুষের জীবন, অভিজ্ঞতা ও মনোভাব তুলে ধরা।
- – গ্রাম্য লোকজীবনের বর্ণনা।
- – সহজ, আদর্শ বাংলায় রচনা।
- – সহজ গেয়ে শোনার মত সুলভ সুর ও তাল।
- – লোকসঙ্গীতের মত প্রচলিত রাগের ব্যবহার।
- – সংক্ষিপ্ত গদ্য শৈলী বা দীর্ঘ গান উভয় রকম।
- – সমাজ সমালোচনা ও নৈতিকতার বার্তা প্রদান।
- – কিছু ছড়ায় ব্যঙ্গ ও সতিরের ব্যবহার।
২ – সাহিত্যিক ছড়া কাকে বলে:
- – কবিতার মতো উচ্চারণ, ছন্দ, রস ব্যবহারকারী ছড়া
- – গল্পের মতো ঘটনাক্রম আছে এমন ছড়া
- – ব্যঙ্গ, সতিরের মাধ্যমে সমালোচনামূলক ছড়া
- – প্রতীক, রূপক ব্যবহারকারী ছড়া
- – চরিত্র আখ্যা দিয়ে গল্প বলা ছড়া
- – উপমা, অলংকারমুখর ভাষার ছড়া
- – কাব্যিক প্রতিপাদ্য উপস্থাপনী ছড়া
এরকম ছড়ায় সাহিত্যিক মানদণ্ড মেনে রচনা করা হয়।
ছড়ার পাঠান্তর এর কারণ :-
ছড়া পাঠান্তরের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ নিম্নে তুলে ধরা হল:
- – শিল্পসৌষ্ঠব: কবিরা নিজেদের শিল্পসৌষ্ঠব প্রকাশ করার জন্য পাঠান্তর করেন।
- – নতুন ধারা: সময়ের সাথে নতুন সাহিত্যিক ধারার সাথে মিল রেখে পাঠান্তর করা হয়।
- – প্রচলিত করা: কোন পুরাতন ছড়াকে আধুনিক করে প্রচলনে আনার জন্য পাঠান্তর করা হয়।
- – উপদেশ প্রদান: নতুন যুগের পাঠকদের জন্য উপদেশ দেওয়ার জন্য পাঠান্তর করা হয়।
- – বিষয় পরিবর্তন: প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখার জন্য বিষয় পরিবর্তন করে পাঠান্তর করা হয়।
- – ভাষা আধুনিকীকরণ: পুরাতন ভাব ও ভাষাকে আধুনিক করে তুলতে পাঠান্তর করা হয়।
ছোটদের বাংলা হাসির মজার ছড়া ও কবিতা :-
“করেছি পন, নেব না পন
বৌ যদি হয় সুন্দরী
কিন্তু আমায় বলতে হবে
স্বর্নদেবে কয় ভরি।”
———– অন্নদাশঙ্কর
আরও পড়ুন :- মহাকাব্য কি? এর বৈশিষ্ট্য?
“খুড়ো হে খুড়ো গর্ত খুঁড়ো
সঙ্গে ঢুকে গল্প জুড়ো
হঠাৎ হাঁচির কামান ছুঁড়ো।
খুড়ো গো খুড়ো হামাগুড়ি
খাটের তোলায় লেপের মুড়ি।
সঙ্গে রেখে টাকা কুড়ি
নইলে কখন যাবেচুরি।”
“নাচতে নাচতে খুলে যায় কারো কেশ
কারো খসে পড়ে বেশ।
নগ্নতনুর সীমাহীন শিখা
হয়না তো নিঃশেষ।”
——–আচার্য শঙ্করন
“শ্রীমতি অনামিকা দে
কেমন মধুর নাচে সে
সবকটি ভালো ভালো মে
সকলে হয়ে গেছে বে”
‘প্রশ্ন’ ছোটদের বাংলা ছড়া কবিতা :-
মা গো, আমায় ছুটি দিতে বল্,
সকাল থেকে পড়েছি যে মেলা।
এখন আমি তোমার ঘরে ব’সে
করব শুধু পড়া-পড়া খেলা।
তুমি বলছ দুপুর এখন সবে,
নাহয় যেন সত্যি হল তাই,
একদিনও কি দুপুরবেলা হলে
বিকেল হল মনে করতে নাই?
আমি তো বেশ ভাবতে পারি মনে
সুয্যি ডুবে গেছে মাঠের শেষে,
বাগ্দি-বুড়ি চুবড়ি ভরে নিয়ে
শাক তুলেছে পুকুর-ধারে এসে।
আঁধার হল মাদার-গাছের তলা,
কালি হয়ে এল দিঘির জল,
হাটের থেকে সবাই এল ফিরে,
মাঠের থেকে এল চাষির দল।
মনে কর্-না উঠল সাঁঝের তারা,
মনে কর্-না সন্ধে হল যেন।
রাতের বেলা দুপুর যদি হয়
দুপুর বেলা রাত হবে না কেন
————রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আরও পড়ুন :- বিখ্যাত কিছু উপন্যাস সমূহ ?
পূজার সাজ বাংলা ছড়া :-
আশ্বিনের মাঝামাঝি উঠিল বাজনা বাজি,
পূজার সময় এল কাছে।
মধু বিধু দুই ভাই ছুটাছুটি করে তাই,
আনন্দে দু-হাত তুলি নাচে।
পিতা বসি ছিল দ্বারে, দুজনে শুধালো তারে,
“কী পোশাক আনিয়াছ কিনে।’
পিতা কহে, “আছে আছে তোদের মায়ের কাছে,
দেখিতে পাইবি ঠিক দিনে।’
সবুর সহে না আর — জননীরে বার বার
কহে, “মা গো, ধরি তোর পায়ে,
বাবা আমাদের তরে কী কিনে এনেছে ঘরে
একবার দে না মা, দেখায়ে।’
ব্যস্ত দেখি হাসিয়া মা দুখানি ছিটের জামা
দেখাইল করিয়া আদর।
মধু কহে, “আর নেই?’ মা কহিল, “আছে এই
একজোড়া ধুতি ও চাদর।’
রাগিয়া আগুন ছেলে, কাপড় ধুলায় ফেলে
কাঁদিয়া কহিল, “চাহি না মা,
রায়বাবুদের গুপি পেয়েছে জরির টুপি,
ফুলকাটা সাটিনের জামা।’
মা কহিল, “মধু, ছি ছি, কেন কাঁদ মিছামিছি,
গরিব যে তোমাদের বাপ।
এবার হয় নি ধান, কত গেছে লোকসান,
পেয়েছেন কত দুঃখতাপ।
তবু দেখো বহু ক্লেশে তোমাদের ভালোবেসে
সাধ্যমত এনেছেন কিনে।
সে জিনিস অনাদরে ফেলিলি ধূলির ‘পরে–
এই শিক্ষা হল এতদিনে।’
বিধু বলে, “এ কাপড় পছন্দ হয়েছে মোর,
এই জামা পরাস আমারে।’
মধু শুনে আরো রেগে ঘর ছেড়ে দ্রুতবেগে
গেল রায়বাবুদের দ্বারে।
সেথা মেলা লোক জড়ো, রায়বাবু ব্যস্ত বড়ো;
দালান সাজাতে গেছে রাত।
মধু যবে এক কোণে দাঁড়াইল ম্লান মনে
চোখে তাঁর পড়িল হঠাৎ।
কাছে ডাকি স্নেহভরে কহেন করুণ স্বরে
তারে দুই বাহুতে বাঁধিয়া,
“কী রে মধু, হয়েছে কী। তোরে যে শুক্নো দেখি।’
শুনি মধু উঠিল কাঁদিয়া,
কহিল, “আমার তরে বাবা আনিয়াছে ঘরে
শুধু এক ছিটের কাপড়।’
শুনি রায়মহাশয় হাসিয়া মধুরে কয়,
“সেজন্য ভাবনা কিবা তোর।’
ছেলেরে ডাকিয়া চুপি কহিলেন, “ওরে গুপি,
তোর জামা দে তুই মধুকে।’
গুপির সে জামা পেয়ে মধু ঘরে যায় ধেয়ে
হাসি আর নাহি ধরে মুখে।
বুক ফুলাইয়া চলে — সবারে ডাকিয়া বলে,
“দেখো কাকা! দেখো চেয়ে মামা!
ওই আমাদের বিধু ছিট পরিয়াছে শুধু,
মোর গায়ে সাটিনের জামা।’
মা শুনি কহেন আসি লাজে অশ্রুজলে ভাসি
কপালে করিয়া করাঘাত,
“হই দুঃখী হই দীন কাহারো রাখি না ঋণ,
কারো কাছে পাতি নাই হাত।
তুমি আমাদেরই ছেলে ভিক্ষা লয়ে অবহেলে
অহংকার কর ধেয়ে ধেয়ে!
ছেঁড়া ধুতি আপনার ঢের বেশি দাম তার
ভিক্ষা-করা সাটিনের চেয়ে।
আয় বিধু, আয় বুকে, চুমো খাই চাঁদমুখে,
তোর সাজ সব চেয়ে ভালো।
দরিদ্র ছেলের দেহে দরিদ্র বাপের স্নেহে
ছিটের জামাটি করে আলো।’
———–রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
জ্যোতিষ-শাস্ত্র ছড়া কবিতা :-
আমি শুধু বলেছিলেম —
“কদম গাছের ডালে
পূর্ণিমা-চাঁদ আটকা পড়ে
যখন সন্ধেকালে
তখন কি কেউ তারে
ধরে আনতে পারে।’
শুনে দাদা হেসে কেন
বললে আমায়, “খোকা,
তোর মতো আর দেখি নাইকো বোকা।
চাঁদ যে থাকে অনেক দূরে
কেমন করে ছুঁই;
আমি বলি, “দাদা, তুমি
জান না কিচ্ছুই।
মা আমাদের হাসে যখন
ওই জানলার ফাঁকে
তখন তুমি বলবে কি, মা
অনেক দূরে থাকে।’
তবু দাদা বলে আমায়, “খোকা,
তোর মতো আর দেখি নাই তো বোকা।’
দাদা বলে, “পাবি কোথায়
অত বড়ো ফাঁদ।’
আমি বলি, “কেন দাদা,
ওই তো ছোটো চাঁদ,
দুটি মুঠোয় ওরে
আনতে পারি ধরে।’
শুনে দাদা হেসে কেন
বললে আমায়, “খোকা,
তোর মতো আর দেখি নাই তো বোকা।
চাঁদ যদি এই কাছে আসত
দেখতে কত বড়ো।’
আমি বলি, “কী তুমি ছাই
ইস্কুলে যে পড়।
মা আমাদের চুমো খেতে
মাথা করে নিচু,
তখন কি আর মুখটি দেখায়
মস্ত বড়ো কিছু।’
তবু দাদা বলে আমায়, “খোকা,
তোর মতো আর দেখি নাই তো বোকা।’
————রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মাস্টার বাবু মজার ছড়া কবিতা :-
আমি আজ কানাই মাস্টার,
পোড়ো মোর বেড়াল ছানাটি।
আমি ওকে মারি নে মা বেত,
মিছিমিছি বসি নিয়ে কাঠি।
রোজ রোজ দেরি করে আসে,
পড়াতে দেয় না ও তো মন,
ডান পা তুলিয়ে তোলে হাই
যত আমি বলি, ‘শোন্, শোন্’।
দিনরাত খেলা খেলা খেলা,
লেখা পড়ায় ভারি অবহেলা।
আমি বলি ‘চ ছ জ ঝ ঞ’,
ও কেবল বলে ‘মিয়োঁ’ মিয়োঁ’।
প্রথম ভাগের পাতা খুলে
আমি ওরে বোঝাই মা, কত-
চুরি করে খাস্ নে কখনো,
ভালো হোস্ গোপালের মতো।
যত বলি সব হয় মিছে,
কথা যদি একটিও শোনে-
মাছ যদি দেখেছে কোথাও
কিছুই থাকে না আর মনে।
চড়াই পাখির দেখা পেলে
ছুটে যায় সব পড়া ফেলে।
যত বলি ‘চ ছ জ ঝ ঞ’
দুষ্টুমি করে বলে ‘মিয়োঁ’।
আমি ওরে বলি বার বার
‘পড়ার সময় তুমি পোড়ো,-
তার পরে ছুটি হয়ে গেলে
খেলার সময় খেলা কোরো’।
ভালোমানুষের মতো থাকে,
আড়ে আড়ে চায় মুখপানে,
এমনি সে ভান করে যেন
যা বলি বুঝেছে তার মানে।
একটু সুযোগ বোঝে যেই
কোথা যায় আর দেখা নেই।
আমি বলি ‘চ ছ জ ঝ ঞ’,
ও কেবল বলে ‘মিয়োঁ মিয়োঁ।
————রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রশ্ন ছড়া কবিতা :-
ভগবান, তুমি যুগে যুগে দূত, পাঠায়েছ বারে বারে
দয়াহীন সংসারে,
তারা বলে গেল “ক্ষমা করো সবে’, বলে গেল “ভালোবাসো–
অন্তর হতে বিদ্বেষবিষ নাশো’।
বরণীয় তারা, স্মরণীয় তারা, তবুও বাহির-দ্বারে
আজি দুর্দিনে ফিরানু তাদের ব্যর্থ নমস্কারে।
আমি-যে দেখেছি গোপন হিংসা কপট রাত্রিছায়ে
হেনেছে নিঃসহায়ে,
আমি-যে দেখেছি প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে
বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে
আমি-যে দেখিনু তরুণ বালক উন্মাদ হয়ে ছুটে
কী যন্ত্রণায় মরেছে পাথরে নিষ্ফল মাথা কুটে।
কণ্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে, বাঁশি সংগীতহারা,
অমাবস্যার কারা
লুপ্ত করেছে আমার ভুবন দুঃস্বপনের তলে,
তাই তো তোমায় শুধাই অশ্রুজলে–
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো।
————রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
Leave a comment