চোলদের নৌ-নীতি ও সামুদ্রিক অভিযান:

প্রাচীন ও আদি-মধ্যযুগের ভারতবর্ষে একাধিক শক্তিশালী আঞ্চলিক রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছিল। দক্ষিণ ভারতের এমনি শক্তি হিসেবে চোলদের উত্থান রাজনৈতিক গুরুত্ব ছাড়াও দুটি কারণে স্বাতন্ত্র্যের দাবি রাখে। একটি হল তাদের নৌ-অভিযান এবং অন্যটি হল গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার রূপায়ণ। আদি মধ্যযুগের ভারতে সামুদ্রিক অভিযান কিছুটা অভূতপূর্ব ঘটনা। স্বভাবতই চোলদের জঙ্গি নৌ-নীতি বিশিষ্টতার দাবি রাখে। এটি চোল-রাজাদের কোনো আকস্মিক রোমাঞ্চকর সিদ্ধান্ত ছিল না। যথেষ্ট পরিকল্পিত পথে এবং পূর্ণ প্রস্তুতিসহ একাধিক চোল-রাজা এই দুঃসাহসিক ও অভূতপূর্ব অভিযানে লিপ্ত হয়েছিলেন। ৯৮৫-১১২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চোলরা কার্যত বঙ্গোপসাগরকে একটি ‘চোল হ্রদে পরিণত করতেও সক্ষম হয়েছিলেন।

চোলদের সামুদ্রিক অভিযানের সূচনা করেন প্রথম রাজরাজ (৯৮৫-১০১৪ খ্রিঃ)। তাঁর চতুর্থ রাজ্যবর্ষের একটি লেখতে দেখা যায় যে, রাজরাজ চের বা কেরল রাজ্য আক্রমণ করে ‘কুন্দলুর স্পালৈ-কলমরুণ্ড ‘উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। তামিল শব্দ ‘স্পালৈ’-এর ইংরেজি প্রতিশব্দ Anchorage বা নোঙ্গর ফেলার স্থান। কুন্দলুর-স্পালৈ স্থানটিকে ঐতিহাসিকেরা বর্তমানের ত্রিবান্দ্রম অঞ্চল বলে শনাক্ত করেছেন। এইভাবে সমুদ্র উপকূলে কর্তৃত্ব স্থাপন করে রাজরাজ সামুদ্রিক অভিযানের সম্ভাবনা সৃষ্ট করেন। রাজরাজের অষ্টম রাজ্যবর্ষের একটি লেখতে (৯৯৩ খ্রিঃ) দাবি করা হয়েছে যে, তিনি উন্মুক্ত সমুদ্রে অবস্থিত ইলম জয় করেছিলেন। রাজরাজের পুত্র ও উত্তরাধিকারী রাজেন্দ্র চোলের ‘তিরুবালাঙ্গরু তাম্রপট্ট’ থেকে জানা যায় যে, তাঁর পিতা ইল্‌মণ্ডলম্ বা শ্রীলঙ্কা জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই লেখতে রাজরাজকে শ্রীরামচন্দ্রের বানর-সেনার সেতুবন্ধন করে শ্রীলঙ্কা অভিযানের চেয়েও বড়ো কৃতিত্ব দেওয়া হয়েছে। বৌদ্ধগ্রন্থ ‘দীপবংশ’ ও ‘মহাবংশ তৈ বলা হয়েছে যে, চোলদের আক্রমণে সন্ত্রস্ত হয়ে সিংহলরাজ পঞ্চম মহেন্দ্র দ্বীপের দক্ষিণ-পূর্বে পার্বত্য অঞ্চলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। সিংহলের উত্তরভাগ অর্থাৎ রাজরট দখল করে রাজরাজ তার নতুন নাম দেন মুম্মুডি-চোলমণ্ডলম্। অতঃপর রাজরাজ সিংহলের রাজধানী অনুরাধাপুর ধ্বংস করেন এবং ‘পোলন্নরুব’তে সিংহলস্থ চোল প্রদেশের নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। রাজরাজ এই বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য পোলন্নরুব’ তে একটি পাথরের শিবমন্দির নির্মাণ করেন। এটি হিন্দু-স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে আজও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। চোল নৌবহর সিংহলের গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ও বাণিজ্যকেন্দ্র ‘মহাতীটঠ’ দখল করে তার নতুন নাম দেয় ‘রাজরাজপুর’। পূর্ববর্তী তামিল শাসকদের সিংহল অভিযানের সাথে চোলদের অভিযানের একটি মৌলিক পার্থক্য লক্ষণীয়। পূর্ববর্তী শাসকেরা কেবল সিংহলরাজের বশ্যতা আদায় করতে উৎসাহী ছিলেন। কিন্তু রাজরাজের লক্ষ্য ছিল সমুদ্রপারে সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ ঘটানো।

রাজরাজের শেষ উল্লেখযোগ্য নৌ-অভিযান ছিল ভারত মহাসাগরের পশ্চিমদিকে অবস্থিত মালদ্বীপ (মালদিব) পুঞ্জের বিরুদ্ধে। ১০১২/১৪ খ্রিস্টাব্দের একটি লেখতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তাঁর (রাজরাজ) নৌবহর সমুদ্র অতিক্রম করে ‘দ্বাদশ সহস্র’ দ্বীপপুঞ্জ জয় করেছিল। সম্ভবত, ত্রিবান্দ্রাম অঞ্চল থেকে এই অভিযান পাঠানো হয়। ইতিমধ্যে আরব বণিকরা পশ্চিম উপকূলের বাণিজ্যে অনেকটাই কর্তৃত্ব করছিল। চোনদের শত্রু কেরল রাজ্য ছিল আরবদের পৃষ্ঠপোষক। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যে আরবদের প্রতিযোগিতা বন্ধ করার জন্য রাজরাজ আরব বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র মালদ্বীপপুঞ্জের বিরুদ্ধে নৌ-অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন বলে রোমিলা থাপার মনে করেন।

রাজরাজ যে নৌ-অভিযানের সূচনা করেন তাঁর পুত্র রাজেন্দ্র চোলের আমলে (১০১৪-১০৪৪ খ্রিঃ), তা আরও ব্যাপকাকার লাভ করে। বস্তুত, রাজেন্দ্রর সাফল্যের পটভূমি তৈরি করে দেন তাঁর পিতা প্রথম রাজরাজ। সম্রাট হিসেবে রাজেন্দ্র চোলের প্রথম উল্লেখযোগ্য নৌ-অভিযান হল সিংহল আক্রমণ ও দখল। তাঁর রাজত্বের পঞ্চম বর্ষের কয়েকটি লেখতে এই অভিযানের কথা উল্লেখ আছে। অবশ্য এই অভিযানের বিশদ বিবরণ লেখতে পাওয়া যায় না। তবে সিংহলী ইতিবৃত্ত ‘মহাবংশ’ গ্রন্থ থেকে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। মহাবংশে দাবি করা হয় যে, চোলরা শ্রীলঙ্কায় বিপুল সম্পদ লুণ্ঠন করেছিল। রাজার হিরের তৈরি অলংকার চোলরা দখল করে নেয়। এমনকি বৌদ্ধ বিহারগুলিও তাদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পায়নি। ‘মহাবংশ’ গ্রন্থে চোল সেনাবাহিনীকে রক্তপিপাসু মগ দস্যুদের সাথে তুলনা করা হয়েছে। রাজেন্দ্র সমগ্র সিংহলকে (শ্রীলঙ্কা) চোল সাম্রাজ্যের অন্তর্গত একটি প্রদেশে পরিণত করেন। তবে চোলরা সমগ্র সিংহলের ওপর তাদের নিরঙ্কুশ অধিকার দীর্ঘকাল বজায় রাখতে পারেনি। মহাবংশে দাবি করা হয়েছে যে, রাজা পঞ্চম মহেন্দ্রর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র কশ্যপের নেতৃত্বে জাতীয় প্রতিরোধ তৈরি হয় এবং দীর্ঘ যুদ্ধের পর সিংহলের দক্ষিণভাগে তিনি নিজ কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। ‘প্রথম বিক্রমবাহু’ নাম নিয়ে তিনি বারো বৎসর দক্ষিণ সিংহল শাসন করেন।

রাজেন্দ্র চোলের রাজত্বের দ্বাদশ বর্ষে একটি লেখতে দেখা যায় যে, তিনি ভারতের পূর্ব-উপকূলের উত্তরদিকে এক অভিযান পাঠান। বেঙ্গী রাজ্যের সাথে এই যুদ্ধে কলিঙ্গদেশ বেঙ্গীকে সাহায্য করলে ক্ষুব্ধ চোলরাজ কলিঙ্গ দেশকে সমুচিত শাস্তি দিতে অগ্রসর হন এবং সসৈন্যে গঙ্গানদীর মোহানা পর্যন্ত অগ্রসর হন। চোল-সেনা বঙ্গোপসাগরের পশ্চিম-উপকূল ধরে অগ্রসর হয়ে উড়িষ্যা (ওড্ডবিষয়), রায়পুর, বিলাসপুর, সম্বলপুর ও বঙ্গদেশ জয় করে গঙ্গার জল নিয়ে চোল রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করে এক্ষেত্রে কোনো অঞ্চলের ওপর চোলশাসন স্থাপিত হয়নি। তবে এই ঘটনা কাবেরী বদ্বীপ থেকে গঙ্গার বদ্বীপ পর্যন্ত চোলদের সামরিক সাফল্যের প্রমাণ দেয়। রাজেন্দ্র তাঁর চতুর্দশ রাজ্যবর্ষে বিখ্যাত ‘কড়ারম্’ (শ্রীবিজয়) অভিযান চালান। একটি লেখতে বলা হয়েছে যে, উত্তাল সমুদ্রে অনেকগুলি যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে রাজেন্দ্র কড়ারম্-এর শাসক সংগ্রাম বিজয়োতুঙ্গ বর্মনকে পরাজিত করেন। শ্রীবিজয় ছিল একটি সামুদ্রিক রাষ্ট্র। লয় উপদ্বীপ, যবদ্বীপ, সুমাত্রা এবং সন্নিহিত মোবিলিম্বগম, থলৈপ্পনদরু, তলৈটট্‌কোপ্রম, মাদমালিঙ্গম, মানক্কবারম প্রভৃতি দ্বীপ-এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। অবশ্য বিজিত কোনো অঞ্চলকেই তিনি চোল রাজ্যের অঙ্গীভূত করেননি।

রাজেন্দ্র চোলের পরবর্তী বংশধর ছিলেন রাজাধিরাজ (১০৪৪-৫৪ খ্রিঃ), দ্বিতীয় রাজেন্দ্র (১০৫৪-‘৬২ খ্রিঃ), বীর রাজেন্দ্র (১০৬২-‘৭০ খ্রিঃ), অধিরাজেন্দ্র (১০৭০ খ্রিঃ) প্রমুখ। এঁদের রাজত্বকালে চোল নৌবহর ব্যবহার হয়েছিল মূলত শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে। সিংহলের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য অবিরাম সংগ্রাম চালাচ্ছিল। ১০৫৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই বিদ্রোহ দমন করার জন্য চোল রাজারা মাঝে মাঝেই সিংহলে সেনা পাঠান এবং অনেক সময় বর্বরতার সাথে বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা করেন। সিংহলের রাজা প্রথম বিজয়বাহু চোল শাসনের অবসান ঘটাতে সচেষ্ট হলে বীর রাজেন্দ্র ১০৬৫ খ্রিস্টাব্দে সিংহল আক্রমণ করেন। বীর রাজেন্দ্রর একটি লেখতে দাবি করা হয় যে, তিনি বিজয়বাহুকে পরাজিত করে সমগ্র সিংহলের ওপর অধিকার পুনঃস্থাপন করেন।

প্রধান চোলবংশের শেষ শক্তিশালী রাজা ছিলেন প্রথম কুলোতুঙ্গ (১০৭০-১১২০ খ্রিঃ)। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর শাসনকালে তিনি শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে কোনো অভিযান পাঠাননি। ১০৭০ খ্রিস্টাব্দে সিংহল কার্যত চোলশাসন থেকে মুক্ত হয়ে যায়। ১০৭০-এর পর সিংহলে কোনো চোল লেখ পাওয়া যায়নি। ‘মহাবংশ’ গ্রন্থেও উত্তর সিংহলের স্বাধীনতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু তাঁর আমলে চোল নৌবাহিনীর শক্তি অক্ষুণ্ণ ছিল। ‘কলিঙ্গাত্তুপ্পারনি’ গ্রন্থে দাবি করা হয়েছে যে, কুলোতুঙ্গ উন্মুক্ত সাগর অতিক্রম করে ‘কড়ারম্’ অভিযান করেছিলেন।

চোল-রাজারা দীর্ঘ ১৩৫ বছর ধরে একটি পরাক্রান্ত নৌবহরের সাহায্যে সমুদ্রের বিভিন্ন দ্বীপ রাষ্ট্রে অভিযান চালান। কিন্তু একমাত্র সিংহল বা শ্রীলঙ্কা ছাড়া কোনো এলাকা তাঁর স্থায়ীভাবে সাম্রাজ্যভুক্ত করেননি। স্বভাবতই চোলদের সামুদ্রিক অভিযানগুলির প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটা সংশয় সৃষ্টি হয়। ঐতিহাসিকদের ব্যাখ্যার বিভিন্নতা সেই সংশয়কে দৃঢ়তর করে। রমেশচন্দ্র মজুমদার, কে. জি. কৃষ্ণান প্রমুখের মতে, রাজনৈতিক গৌরব অর্জনের লক্ষ্যে নতুন নতুন রাজ্যগ্রাস করে ‘দিগ্‌বিজয়ী’ আখ্যালাভের জন্যই এই সকল অভিযান কর্মসূচি গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু এই ব্যাখ্যা যুক্তি বা পরিস্থিতি দ্বারা সমর্থিত নয়। কারণ দিগ্‌বিজয়ের বাসনা কোনো বিশেষ এক/দুজন শাসকের মানসিকতায় দানা বাঁধতে পারে। কিন্তু ধারাবাহিকভাবে ছয় বা সাত জন শাসকের ক্ষেত্রে এই মানসিকতা থাকা সম্ভব নয়। তা ছাড়া দেখা গেছে যে, কোনো অভিযানে বিজয়ী হলেও এঁরা রাজ্যগ্রাস করেননি। অথচ দিগ্‌বিজয়ের প্রাথমিক বৈশিষ্ট্যই হল রাজ্যজয়।

মার্কিন ঐতিহাসিক বার্টন স্টাইন, জর্জ স্পেনসার প্রমুখ চোলদের সামুদ্রিক ক্রিয়াকলাপকে রাজনৈতিক কর্মসূচি না বলে ‘অর্থনৈতিক লালসাজাত পরিকল্পনা’ বলে মনে করেন। এঁদের মতে, চোল শাসনব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল কর্তৃত্বের বিকেন্দ্রীকরণ। রাজা কেন্দ্রে ছিলেন, কিন্তু রাজস্ব সংগ্রহের কাজ করত স্থানীয় কর্তৃপক্ষ উর, সভা, নাত্তার ইত্যাদি। উরাইয়ুর ও মানের লেখর ভিত্তিতে এঁরা দেখিয়েছেন যে, স্থানীয় সংস্থাগুলি রাজস্ব সংগ্রহ ও পুনর্বণ্টন করার ফলে খুব সামান্য সম্পদ কেন্দ্রীয় কোষাগারে জমা পড়ত। কিন্তু শাসন পরিচালনার জন্য অর্থের প্রয়োজন। তাই চোলরাজারা অর্থ সংগ্রহের কাজে সর্বদা লিপ্ত থাকতেন এবং সামুদ্রিক অভিযানগুলির প্রধান লক্ষ্যই ছিল অর্থ সংগ্রহ করা। অর্থাৎ চোলদের যুদ্ধগুলি ‘সংহতিমূলক কার্যধারা’ (Integrating activity) ছিল না, সেগুলি ছিল ‘লুণ্ঠনমূলক কর্মসূচি’ (Plundering activity)। স্টাইনও স্পেনসার চোলদের অভিযান কর্মসূচির পেছনে চোল সেনাবাহিনীর প্রকৃতির ভূমিকাও উল্লেখ করেছেন। এঁরা মনে করেন, চোলদের কোনো স্থায়ী সুগঠিত বাহিনী ছিল না। মূল ছোট্ট বাহিনীর সাথে যুদ্ধকালে ভাড়াটে সৈনিক নিয়োগ করা হত। এই পাঁচমিশেলি বাহিনীকে সদা কর্মরত না-রাখলে তাদের কর্মদক্ষতা ও আনুগত্যে ঘাটতি দেখা দিত। তাই চোলরাজারা নিরন্তর যুদ্ধে লিপ্ত থাকতেন।

বিগত শতকের আশির দশক থেকে স্টাইন ও স্পেনসারের বক্তব্যের প্রবল বিরোধিতা শুরু হয়েছে। অধ্যাপক ডি. এন. ঝা, আর চম্পকলক্ষ্মী, ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ দেখিয়েছেন যে, স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা থাকলেও গ্রামস্তর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কর্মচারীদের প্রশাসনিক প্রভাব কার্যকরী ছিল। চম্পকলক্ষ্মী চোল লেখগুলির নতুন ব্যাখ্যা করে প্রমাণ করেছেন যে, চোলযুগে তথাকথিত স্বাধীন গ্রামসভাগুলি কেন্দ্রীয় রাজকর্মচারীদের অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে ছিল। তাই রাজস্ব ঘাটতি মেটানোর জন্য চোলদের লুণ্ঠননীতি গ্রহণ করতে হয়েছিল, এই ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়। অধ্যাপক রণবীর চক্রবর্তী তাঁর Warfare for wealth (1986)’ শীর্ষক গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, দশম শতক থেকেই চোলরা নিয়মিতভাবে খমের (Khmer), বর্মা, উত্তর ভিয়েতনাম, চিন ও আরবদেশের সাথে বাণিজ্যসম্পর্ক বজায় রেখেছিল। চোলদের লেখ থেকে জানা যায় যে, শ্রীবিজয়ের রাজা চোলরাজাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন। শ্রীবিজয়ের রাজা সংগ্রাম বিজয়োতুঙ্গবর্মন চোলরাজ্যের নাগপট্টমে ‘চূড়ামনবিহার’ তৈরি করেছিলেন। এই সুসম্পর্ক নিয়মিত যোগাযোগ এবং আর্থিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থ ছাড়া সম্ভব হয় না। আসলে চিনের করমণ্ডল উপকূলের বাণিজ্যে শ্রীবিজয় অন্তর্বর্তীর ভূমিকা পালন করত। সেই অন্তর্বর্তীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য শ্রীবিজয়ের শাসকেরা চোলরাজাদের সাথে মিত্রতার সম্পর্ক রক্ষা করতে তৎপর ছিলেন। কিন্তু চোলরাজারা অন্তর্বর্তীকে এড়িয়ে সরাসরি চিনের সাথে বাণিজ্যে উদ্যোগী হন এবং বার বার ‘কড়ারম্’ আক্রমণ করেন। লক্ষণীয় যে, তাঁদের জয় করা প্রতিটি অঞ্চলই ছিল বাণিজ্যিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। নীলকণ্ঠ শাস্ত্রী মন্তব্য করেছেন যে, রাজেন্দ্রর গঙ্গা অভিযান ভারতের পূর্ব-উপকূল বরাবর চালিত হয়েছিল, কারণ ওই উপকূলের সমৃদ্ধ বন্দর ও তার বাণিজ্যের ওপর কর্তৃত্ব করাই ছিল তার লক্ষ্য। সাধারণভাবে একথা বলা যায় যে, চোলদের সামুদ্রিক অভিযানগুলি বিশুদ্ধ লুণ্ঠন প্রবৃত্তি-সঞ্জাত ছিল না। সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যেই একাধিক চোল নৃপতি এই অভিযান কর্মসূচি গ্রহণে তৎপর ছিলেন।