জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর ‘চোর’ গল্পটি আদ্যোপান্ত গভীর ইঙ্গিতধর্মী। বর্তমান সমাজের আভ্যন্তরীণ শ্রেণিসম্পর্কের মধ্যে যে চোরা-স্রোত প্রবহমান, ‘চোর’ গল্পে এক নিরাবেগ বিবরণসূত্রে সেই চোরা-স্রোতের স্বরুপটি উন্মোচিত করেছেন লেখক। গল্পের নামকরণেও সেই ইঙ্গিতময় চোরা-স্রোতটির সংকেত আছে।
কথাসাহিত্যে নামকরণটি নিঃসন্দেহে বক্তব্য বিষয়ের পরিচয়বাহী হিসাবেই গুরুত্বপূর্ণ। আলোচ্য গল্পে চরিত্রগুলি সে অর্থে পূর্ণাঙ্গ বিকশিত চরিত্র নয়। মদন, সুকুমার বিশেষ বিশেষ শ্রেণির প্রতিনিধি হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও চরিত্র হিসাবে বিশ্লেষণযোগ্য নয়। এমনকি গল্পের কথক মিন্টুও কিছুটা আত্মমুখী। এ চরিত্রটিও নিটোল নয়। তাই চরিত্রনামে গল্পের নামকরণ এ গল্পে সম্ভব ছিল না।
‘চোর’ গল্পটি কাহিনীপ্রধানও নয়। আদি-মধ্য-অন্তযুক্ত একটি সুসংবদ্ধ প্লটের প্রয়োজন এখানে অনুভব করেননি লেখক। তাই প্লট বা আখ্যানভাগের কোনো ঘটনা এই গল্পে প্রধান ওঠে নি। তবে ঘটনা বা আখ্যানে চুরির ঘটনা ঘটেছে। তবে সেই চুরির পরিপ্রেক্ষিতে গল্পের নাম ‘চোর’ খুব সঙ্গত বলে মনে হয় না।
গল্পের সূচনায় মিন্টু যে পেঁপেচারাটি নিয়ে এসে রান্নাঘরের পিছনের ছাইগাদায় পৌঁতে, সেটি চুরির নয়। পথের ধারে নর্দমার কিনারে অযত্নলালিত পেঁপেগাছটি তুলে এনেছিল মিন্টু। মিন্টুদের বাড়ি মদন কাজে যোগ দেবার পর সুকুমারদের প্রতি ক্রোধবশত তাদের বাগান থেকে গাছের ভালো ভালো চারা চুরি করে আনার চক্রান্ত করে মিন্টুর সঙ্গে। কিন্তু এই চুরি সফল হয়নি। তবে এটা ব্যাখ্যা করা চলে যে মদন বা মিন্টুর মনের মধ্যে গোপনে একটা চোর অবস্থান করে। যাদের লক্ষ্য থাকে উচ্চবিত্ত সুকুমারদের সাজানো বাগান থেকে পুষ্ট সতেজ ফল-ফুলের চারাগুলির দিকে। উচ্চতর বিত্ত বা সমৃদ্ধি বা সুখ-বৈভবের প্রতি হিংসা বা লোভই নিম্নস্তরবর্তী মানুষের মধ্যে এক একটি চোরের জন্ম দেয়। সমাজ-মনস্তত্ত্বের এই নির্মম সত্যটি ‘চোর’ নামকরণে যথার্থভাবেই ধরা পড়েছে একথা স্বীকার করতে হবে।
কিন্তু গল্পের মধ্যে প্রত্যক্ষভাবে চুরির ঘটনাটি ঘটেছে প্রায় বিপরীত প্রক্রিয়ায়। সুকুমারের গায়ে কাদা-জল ছিটিয়ে দেওয়ায় যখন মদন ধরা পড়ে যায় এবং সুকুমারের মায়ের নির্দেশে যখন তাদের বাড়িতেই পুনর্বহাল হয়ে উৎফুল্লভাবেই মিন্টুকে জানিয়ে দেয় যে, তাদের বাড়ি আর সে কাজ করবে না, তখনই সূচিত হয় প্রকৃত চুরির প্রেক্ষাপট। একদিন ঝড়বৃষ্টির রাতে মদন সম্ভবত মিন্টুদের বাড়ি থেকে নিজের হাতে তৈরি বেড়া তছনছ করে তারই পরিচর্যায় বড় করে তোলা পেঁপেচারাটি চুরি করে নিয়ে গিয়ে সুকুমারদের বাগানে লাগায়।
মদনের এই চুরিটি যে গভীর তাৎপর্যবাহী, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে আরো পরে, যখন সুকুমারের সঙ্গে মিন্টুর ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায় এবং মিন্টু আবিষ্কার করে সুকুমারদের বাড়ির বৈভব ও স্বাচ্ছন্দ্য তাকেও গভীরভাবে আকর্ষণ করছে। সুকুমারদের বাড়ির বাগানে এই সময় নধর সবুজ সতেজ পেঁপেগাছটা দেখতে পেয়ে একটা অদ্ভুত চিন্তা মিন্টুর মাথায় আসে। মিন্টুর মনে হয়—’মদন পেঁপেগাছটা চুরি করে নিয়ে যায়নি। আমার বারবার মনে হচ্ছিল পেঁপে চারাটাই মদনকে আমাদের বাড়ি থেকে চুরি করে নিয়ে গেছে। কেবল মদনকে নয়, আমাকেও।
মিন্টুর এই অনুভবটিই গল্পের নামকরণটিকে গভীর সংকেতময় করে তোলে। দেখা যায় পেঁপেগাছটি প্রায় এখানে প্রতীকের পর্যায়ে উন্নীত হয়ে উঠেছে। পেঁপেচারার লালন-পালন মিন্টুর কাছে, ওদের বাড়ির পরিবেশ, ছাইগাদায় ঠিক হচ্ছিল না। সুকুমারদের বাগানেই ঐ গাছটার যথার্থ স্থান। যেন সুকুমারদের বাগানে আশ্রয় নেবার জন্যে পেঁপেগাছটাই ভিতরে ভিতরে ব্যস্ত ছিল। পেঁপে চারাকে প্রায় চরিত্রায়িত করে লেখক যেন গল্পের মূল বক্তব্যকে এখানে অনেকখানি স্পষ্ট করে তুলেছেন।
পেঁপেগাছ-এর চুরি প্রসঙ্গ শ্রেণিবিভক্ত সমাজের মনস্তত্ত্বটিকে তাৎপর্যময় করে তোলে। পেঁপেগাছটি মদন চুরি করেছে বলে মিন্টু তার ওপর রাগ করে না। মদন চুরি করেছে কেন,— এই ব্যাখ্যায় মিন্টু ভাবে—‘কেবল চাকরি না, আমাদের রান্নাঘরের পিছনের ছায়ায় ঢাকা স্যাঁতসেতে জমির চেয়ে ও-বাড়ির রোদালো বিশাল বাগানের মালী ওর কাছে প্রিয় হবে, তাতে অবাক হবার কি আছে।’ অর্থাৎ উচ্চবিত্ত জগতের সুখী, স্বচ্ছন্দ, বিলাসী জীবনের প্রতি মদনের লোভের আকর্ষণ তার নিজ শ্রেণি থেকে সুবিধাবাদী ওপরে উঠে আসার কথাকেই বড় করে দেখায়। শুধু মদনের কথাই বা কেন, মিন্টু আত্মবিশ্লেষণ করে নিজের মধ্যেও সেই একই লোভ বা মোহ কিংবা প্রলোভনকে দেখতে পায়। অর্থাৎ পেঁপেগাছটা শুধু মদনের প্রতীক আর থাকে না, সেটি হয়ে ওঠে বিত্তের মৌহসঞ্চারী ঔজ্জ্বল্যের প্রতীক। রামায়ণের সোনার হরিণের মতো এই নির্মম বৈশ্যযুগে আসলে বিত্তই সমস্ত সহজ সরল চিত্তের, মানসিক সম্পর্কের হরণকারী। এই গল্পের ‘চোর’ নামকরণ যুগগত এই বৈশিষ্ট্যটিকেই তীব্রভাবে দ্যোতিত করে সার্থক হয়ে ওঠে।
Leave a comment