চৈতন্যজীবনী রচনার কারণ :

চৈতন্যজীবনী সাহিত্য-বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে প্রথমেই একটু বুঝে নেওয়া প্রয়ােজন, কোন্ কারণে মধ্যযুগে চৈতন্য জীবনীগুলি রচিত হয়েছিল।

স্বকালে অনেক ধর্মগুরুই ‘পুরুষােত্তম’-রূপে বন্দিত হয়ে থাকেন এবং তদীয় ভক্ত-শিষ্যাদি দ্বারা পূজার্যাদি লাভ করে থাকেন। কচিৎ কোন ভক্ত হয়তাে তার অলৌকিক জীবনের মাহাত্ম্য রচনায় তৎপরও হয়ে থাকেন। কিন্তু ঐ ধর্মগুরুগণ উল্কা কিংবা ধূমকেতুর সঙ্গেই বড় জোর উপমিত হতে পারেন, ফলে এদের ক্ষণভাস্বর মাহাত্ম্য তাদের অন্তর্ধানের সঙ্গে সঙ্গেই তিরােহিত হয়। কিন্তু চৈতন্য মহাপ্রভু ক্ষণজন্মা পুরুষ, লােকোত্তর প্রতিভার অধিকারী এই মহাপুরুষের দীপ্তি তার অন্তর্ধানের পরও বাঙলা তথা ভারতের আকাশমণ্ডলকে জ্যোতিষ্মান করে রেখেছে। তাই তার ভক্তবৃন্দ শুধু তার তিরােধানের অব্যবহিত পরেই নয় দীর্ঘকাল পরেও এর উপযােগিতা উপলব্ধি করে চৈতন্যজীবনী রচনায় তৎপরতা দেখিয়ে গেছেন। এটা অবশ্য যথার্থ যে, জীবনীকারগণ সকলেই ছিলেন চৈতন্যভক্ত এবং চৈতন্য জীবনী অথবা বৈষ্ণবতত্ত্ব মাহাত্ম প্রচার করবার জন্যই চৈতন্য-চরিত রচনা করেছিলেন। কিন্তু আমরা একালের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে চৈতন্যজীবনী রচনার অপর একটি বিশেষ কারণেরও সন্ধান পাই।

বাঙালীর জাতীয় জীবনে ইতঃপূর্বে এমন কোন মহৎ বা বৃহৎ পুরুষের আবির্ভাব ঘটেনি, যাকে আদর্শরূপে বাঙালীর সামনে উপস্থাপিত করা যায়। এই উদ্দেশ্যসিদ্ধির প্রয়ােজনেই পূর্বে রামায়ণ মহাভারতাদি অনুবাদ দ্বারা রামকৃষ্ণ-পাণ্ডব-আদি মহৎ পুরুষদের কীর্তিগাথা এবং বিভিন্ন মঙ্গলকাব্য রচনার মধ্য দিয়ে কালকেতু চাঁদসদাগর, লাউসেন প্রভৃতি কল্পিত বীর পুরুষদের চরিত্র সৃষ্টি করা হয়েছে। চৈতন্যদেবের আবির্ভাবে একজন প্রকৃত বাস্তব পুরুষের সন্ধান পাওয়া গেল, যার জীবনচরিত পূর্বোক্ত উদ্দেশ্য সিদ্ধ করেছে। অতএব সামাজিক এবং ঐতিহাসিক প্রয়ােজনেই চৈতন্য-চরিতসমূহ রচিত হয়েছিল—একথাও সমান সত্য।

আধুনিক চরিত সাহিত্যের সঙ্গে তুলনা :

চৈতন্যদেবের আবির্ভাব বাঙলা সাহিত্যে যে প্রবল প্রভাব বিস্তার করেছিল, তার অতি প্রত্যক্ষ এবং প্রধান ফল চৈতন্যজীবনী সাহিত্যের সৃষ্টি। চৈতন্যদেবের পূর্ববর্তী গাের্খনাথ, গােপীচাঁদ বা ময়নামতীর জীবনকাহিনী। অবলম্বনে কিছু কিছু গ্রন্থ রচিত হলেও তাদের কারাে ঐতিহাসিকতা যেমন নিঃসংশয়িত নয়, তেমনি কাহিনীগুলিও জীবনধর্মী নয়, এগুলিকে বড় জোর কল্পকাহিনীরূপেই গ্রহণ করা চলে। ফলতঃ বাঙলা সাহিত্যে চৈতন্যজীবনীগুলিকেই আদি জীবনীগ্রন্থের মর্যাদা দান করা চলে।

অনেকে প্রশ্ন উত্থাপন করে থাকেন—আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে চৈতন্যজীবনীসাহিত্যকে কি জীবনীগ্রন্থ বলে গ্রহণ করা চলে? বিষয়টি একটু বিচার করে দেখা আবশ্যক। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের বিচারবুদ্ধি এবং দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন ঘটে থাকে। চৈতন্যদেব যে কালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যে কোন মানদণ্ডে ওটাকে মধ্যযুগ’ বলেই অভিহিত করতে হয়। মধ্যযুগ বলতেই আমরা মােটামুটি অজ্ঞতাকুসংস্কারাচ্ছন্ন একটা তমসাবৃত পরিবেশকেই বুঝে থাকি। তারপর অল্প সময়ের মধ্যেই সভ্যতার রথে চড়ে দ্রুত অনেক পথ এগিয়ে এসেছি। ফলে কালের দিক থেকে খুব বেশি দূরে না এলেও বিজ্ঞান বুদ্ধির দৌলতে দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে আমরা সেকাল থেকে অনেক দূরে। কাজেই পরিপূর্ণ এ কালের দৃষ্টি নিয়ে সেকালের বিচারে সেকালের প্রতি অবিচারই করা হবে। কাজেই যে-কালে এই চৈতন্যজীবনীগ্রন্থগুলি রচিত হয়েছিল, সেকালের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই এর বিচার আবশ্যক।

চৈতন্যদেবের আবির্ভাব-কালে বাঙলাদেশ সবেমাত্র একটা অরাজক অবস্থার হাত থেকে কোনক্রমে অব্যাহতি পেয়েছে। দেশবাসীর মনে শাস্তিস্বত্তি যে তখনে সংস্থাপিত হয়নি, তার সাক্ষ্য দিয়েছেন চৈতন্যজীবনীকারগণ। অন্ধকারের অবসানে সদ্যজাগরিত জাতি কোনক্রমে আপনাকে প্রকাশ করবার সুযােগ পেয়েছে। বিভিন্ন সংস্কৃত মহাকাব্য, পুরাণ ও লৌকিক কাহিনী থেকে কিছু কিছু চরিত্রকে তুলে এনে জাতির সম্মুখে আদর্শরূপে দাঁড় করাতে চেষ্টা করা হচ্ছে। জাতির মনে বিশ্বাস ও শক্তি সঞ্চারের উদ্দেশ্যে ঐ সমস্ত চরিত্রে অলৌকিক গুণও আরােপ করা হয়েছে। তৎকালীন মানসিকতা ও বিশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে এ সমস্ত অলৌকিক কাহিনীর সত্যতায় সন্দেহ পােষণ করবার অবকাশ ছিল না। যে কোন মহৎ ও বৃহৎ চরিত্রই অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন—জনগণের মনে এই বিশ্বাসই ছিল দৃঢ়মুূল। দেশের মানসপটভূমি যখন এরূপ, তখনই সেখানে আবির্ভূত হলেন প্রেমের ঠাকুর মহাপ্রভু চৈতন্যদেব। চৈতন্যদেব মাত্র ২৪বৎসর বয়সে সন্ন্যাস গ্রহণ করে স্বভূমি ত্যাগ করেন। এরি মধ্যে তিনি ঈশ্বমহিমায় ভূষিত। অতিশয় অহিংস তার আচরণ-অথচ তাঁর ভয়ে রাজসরকারও সন্ত্রস্ত। তাঁর নামে ‘শান্তিপুর ডুবুডুবু নদে ভেসে যায়’। এ কালের দৃষ্টিভঙ্গিতেও কি এই চরিত্রকে আমরা সাধারণ বলে মেনে নিতে পারি? যার চরিত্রে ছিল এত অসাধারণত্ব, তার উপর একটু অলৌকিক মহিমার আলােকেই তাে চরিত্র স্বচ্ছ হয়ে ফুটে উঠবার অবকাশ পায়।

এই বােধে অনুপ্রাণিত হয়ে চৈতন্যজীবনীকারগণ যে সকল চৈতন্যজীবনকাহিনী রচনা করেছেন, তৎকালােচিত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই তাদের বিচার-বিবেচনা আবশ্যক। বিশেষতঃ চৈতন্যদেব একটি নব ধর্মমতের প্রবর্তন করেন এবং জীবনীকারগণ ঐ ধর্মেই দীক্ষিত। কোন নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাদের পক্ষে চৈতন্যজীবনী রচনা সম্ভবপর ছিল না। শাস্ত্রবিশ্বাসী এই ভক্তগণ এই শাস্তুবাক্যে আস্থাশীল ছিলেন যে ‘কৃষ্ণের যতেক লীলা সর্বোত্তম নরলীলা’—এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্যজীবনী রচনা করেছেন, তাদের কেউ বা প্রত্যক্ষদ্রষ্টার দিক থেকেই তার সম্বন্ধে জানতে পরেছেন। অতএব তাঁদের রচনায় চৈতন্য-জীবনের উপাদান সংগ্রহ বিষয়ে বিভ্রান্তি ঘটবার কোন কারণ নেই।

চৈতন্যজীবনীগ্রন্থগুলিকে আধুনিক জীবনীগ্রন্থ বলে মেনে নেবার ফলে প্রধান বাধা এই- ভক্তের দৃষ্টিতে দেখবার ফলে তাঁরা কখন কখন চৈতন্যের জীবনে অলৌকিক ঘটনার সমাবেশ ঘটিয়েছেন। এটি অবশ্য তাদেরই দোষ নয়-এ আমাদের বাঙালীর জাতীয় চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। আমরা প্রায়শঃ দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা। কোন মহামানবকে দেবচরিত্রে উন্নীত করে আমরা আত্মানন্দ লাভ করে থাকি। ভাগবতপুরাণে বর্ণিত কৃষ্ণলীলার কাঠামােয় চৈতন্যলীলা পরিবেষণ করতে গিয়ে ভক্তকবিও নিছক বাস্তবতার মধ্যে আপনাকে সীমাবদ্ধ রাখতে পারেন নি। ভক্তির প্রবলতা ও উচ্ছলতায় মহাপ্রভু চৈতন্যদেব তাদের দৃষ্টিতে আপনি দেববিগ্রহ পরিগ্রহ করেন। কিন্তু লক্ষ্য করবার বিষয় কবিরা ইচ্ছাকৃতভাবে কোথাও সত্যের অপলাপ করেন নি, বরং তাঁদের বক্তব্যের যাথার্থ্য প্রতিপন্ন করবার জন্য তারা যথাসম্ভব উৎস নির্দেশও করেছেন। যে সূত্রে যে তথ্যের সন্ধান লাভ করেছেন, তাদের উল্লেখে কবিদের ঐতিহাসিক মনােবৃত্তি এবং সত্যপ্রচারস্পৃহারই পরিচয় পাওয়া যায়।

এই সমস্ত কারণে চৈতন্যজীবনীগ্রন্থগুলি একালের দৃষ্টিতে ‘জীবনীগ্রন্থ-রূপে স্বীকৃত না হলেও সাধারণভাবে মহাপুরুষ-জীবনী’রূপে গৃহীত হতে পারে। সাধারণের জীবনের সঙ্গে মহাপুরুষ-জীবনের পার্থক্য সর্বদেশে সর্বকালে স্বীকৃত। তাঁদের জীবনে ঐহিক বাস্তবতা কখনই চরম এবং একমাত্র সত্যরূপে গৃহীত হয় না। অধ্যাত্মলােকের অলৌকিক ঘটনার বর্জনে তাঁদের জীবনের কোন মাহাত্ম্য আর অবশিষ্ট থাকে না। এ বিষয়ে প্রাজ্ঞ অধ্যাপক অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিমত উদ্ধারযােগ্য। তিনি বলেন- “চৈতন্য- জীবনীকাব্যগুলি Hagiography বা সন্ত-সাধন জীবনীর অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং এতে নিছক বাস্তব কাহিনী কখনই একমাত্র উপাদান বলে স্বীকৃত হয় না—অলৌকিক, অধ্যাত্মলােকের রহস্যময় ব্যঞ্জনা মহাপুরুষজীবনীর প্রধান উপাদান বলে সর্বযুগেই গৃহীত হয়েছে। এই কথাগুলি মনে রাখলে, চৈতন্যজীবনীকাব্যগুলি যথার্থ জীবনী হয়েছে, কি হয়নিএই নিয়ে অর্থহীন বাগবিতণ্ডায় মন্ত হবার প্রয়ােজন হবে না।”

সংস্কৃত ভাষায় চৈতন্যজীবনী :

মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের জীবদ্দশাতেই তার সহচর অনুচরদের মধ্যে কেউ কেউ জীবন-কাহিনী অবলম্বনে সংস্কৃত ভাষায় কিছু কিছু গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থকারদের কেউ চৈতন্যলীলার প্রত্যক্ষ দ্রষ্টা ছিলেন বলেই তাদের রচিত গ্রন্থগুলি আকরগ্রন্থরূপে বিবেচিত হয়ে থাকে। পরবর্তী জীবনীকারগণ এই সমস্ত গ্রন্থ থেকে চৈতন্যজীবনের বহু উপাদানই সংগ্রহ করেছেন। সেইদিক থেকে বাঙলা ভাষায় রচিত না হলেও এই জীবনীগ্রন্থগুলির মূল্য অস্বীকার করা যায় না।

চৈতন্যদেবের প্রথম জীবনচরিত রচনা করেন চৈতন্যের বয়ােজ্যেষ্ঠ সহপাঠী মুরারি গুপ্ত। মুরারি গুপ্তের গ্রন্থের নাম ‘শ্রীশ্রীকৃষ্ণচৈতন্যচরিতামৃত’—প্রচলিত ভাষায় এটি মুরারি গুপ্তের ‘কড়চা’ নামেই পরিচিত। গ্রন্থটি নিঃসন্দেহে ১৫১৬-৪২ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যেই রচিত হয়েছিল—অনেকে অনুমান করেন, এটি চৈতন্যদেবের জীবৎকালেই প্রণীত হয়েছিল। মুরারি গুপ্ত চৈতন্যদেবের অতিশয় অন্তরঙ্গ ছিলেন বলেই এই গ্রন্থটির প্রামাণিকতা স্বীকৃত হয়।

চৈতন্যদেবের সহচর শিবানন্দ সেনের পুত্র পরমানন্দ সেন চৈতন্য-প্রদত্ত ‘কবিকর্ণপুর নাম গ্রহণ করে চৈতন্যদেবের জীবন কাহিনী অবলম্বনে তিনখানি গ্রন্থ রচনা করেন। প্রায় দুই হাজার শ্লোকে গ্রথিত চৈতন্যচরিতামৃতম নামে চৈতন্যজীবনী মহাকাব্যে কবির পাণ্ডিত্য প্রকাশিত হলেও তাদৃশ কবিত্বশক্তির পরিচয় পাওয়া যায় না। কবিকর্ণপুর-এর দ্বিতীয় গ্রন্থ চৈতন্যচন্দ্রোদয়’ নামক দশ অঙ্ক-বিশিষ্ট নাটক। নাটকে ভক্তিতত্ত্ব প্রাধান্য লাভ করাতে এর নাট্যগুণ কিছুটা খর্ব হয়েছে। কবি এই নাটকটিই প্রথম রচনা করেছিলেন। কবিকর্ণপুর-এর তৃতীয় গ্রন্থ ‘গৌরগণােদ্দেশ-দীপিকা’ সম্ভবতঃ ১৫৭৬-৭৭ খ্রীঃ রচিত হয়েছিল। এতে বৈষ্ণব দর্শন, সমাজ ও ইতিহাস বিষয়ে অনেক মূল্যবান্ তথ্য পাওয়া যায়। এগুলি ছাড়া আরও কিছু কিছু চৈতন্যজীবনী বিষয়ক গ্রন্থ সংস্কৃত ভাষায় রচিত হলেও তুলনামূলকভাবে এদের পরিচিতি অনেক কম। সংস্কৃত ভাষায় রচিত চৈতন্যজীবনীগুলিই বহির্বঙ্গে চৈতন্যমহিমা-প্রচারে সর্বাধিক সহায়ক হয়েছিল—এদিক থেকে এদের মূল্যবত্তা অবশ্যই স্বীকার করতে হয়।

(ক) বৃন্দাবনদাস : চৈতন্যভাগবত :- বৃন্দাবন দাস-রচিত চৈতন্যভাগবত ই সম্ভবতঃ বাঙলা ভাষায় রচিত চৈতন্যচরিতগ্রন্থসমূহের মধ্যে প্রাচীনতম। চৈতন্যভাগবতের প্রথম নামকরণ করা হয়েছিল চৈতন্যমঙ্গল’। তারপর বৃন্দাবনের মােহান্তদের অনুরােধ অথবা মা নারায়ণীর নির্দেশে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় চৈতন্যভাগবত। গ্রন্থকার বৃন্দাবন দাসের ব্যক্তি-জীবন-সম্বন্ধে কিছু জনশ্রুতি ছাড়া প্রামাণিক তথ্য বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না। তাঁর মাতার নাম নারায়ণী এবং তিনি চৈতন্য-পার্ষদ শ্রীবাসের ভ্রাতুষ্পুত্রী ছিলেন। বৃন্দাবনদাসের পিতৃপরিচয় অজ্ঞাত, তবে গুরু নিত্যানন্দ প্রভুর গুণকীর্তনে কবি ছিলেন পঞ্চমুখ। চৈতন্যভাগবতের উপাদান সংগ্রহের মূল উৎস নিত্যানন্দ এবং চৈতন্যদেবের অপরাপর ভক্তগণ-এ তথ্য গ্রন্থকার প্রয়ােজনীয় স্থলে সর্বত্র উল্লেখ করেছেন।

বৃন্দাবনদাসের জীবৎকাল বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়। তিনি সক্ষোভে স্বীকার করেছেন

‘হইল পাপিষ্ঠ জন্ম নহিল তখনে।

হইয়াও বঞ্চিত সে সুখ-দরশনে।।

এ থেকে অনুমান করা হয় যে, চৈতন্যদেবের জীবকালেই কবি জন্মগ্রহণ করলেও হয়তাে মহাপ্রভুর দর্শন থেকে তিনি বঞ্চিত ছিলেন। তিনি নিত্যানন্দ প্রভুর সাক্ষাৎ এবং উপদেশও লাভ করেছিলেন। এ সব বিচারে বৃন্দাবন দাস ১৫১০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৫২০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং নিত্যানন্দ প্রভুর পুত্র বীরচন্দ্রের জন্মের পূর্বেই অর্থাৎ ১৫৫০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যেই গ্রন্থ রচনা সমাপ্ত করেছিলেন—এই অনুমান অসঙ্গত নয়।

চৈতন্যদেবের জীবন কাহিনী বিষয়ে বৃন্দাবনদাস যে সব ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন তাদের প্রামাণিকতায় সন্দেহের কোন কারণ নেই—তবে কবির স্বকৃত ব্যাখ্যার সঙ্গে অপরের মতের গরমিল হওয়া অসম্ভব নয়, আর এই দায়িত্ব কবির নয়।

‘চৈতন্যভাগবত’ তিন খণ্ডে বিভক্ত এক সুবৃহৎ গ্রন্থ। এর আদি খণ্ডে পনেরােটি অধ্যায়এতে সমসাময়িক যুগের পরিচয় এবং চৈতন্যদেবের জন্মগ্রহণ থেকে আরম্ভ করে গয়া থেকে প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। মধ্যখণ্ডে সাতাশটি অধ্যায় এতে প্রধানতঃ চৈতন্যদেবের সন্ন্যাসগ্রহণই বিবৃত হয়েছে। অন্ত্যখণ্ডের দশটি অধ্যায়ে নীলাচলে মহাপ্রভুর গুণ্ডিচাযাত্রা কাহিনী পর্যন্ত স্থান পেয়েছে। মহাপ্রভুর শেষ জীবনের কাহিনী অনুপস্থিত থাকায় গ্রন্থটি যে অসম্পূর্ণ অবস্থায় সমাপ্ত হয়েছে, তাতে সন্দেহের কোন কারণ নেই। এই অসম্পূর্ণতার কারণ সম্বন্ধে কেউ কেউ মনে করেন যে বৃন্দাবনদাস বৃদ্ধ বয়সে কাব্য রচনা আরম্ভ করেছিলেন এবং আকস্মিক মৃত্যুহেতু গ্রন্থ রচনা শেষ করে যেতে পারেন নি। কিন্তু বৃন্দাবনদাসের প্রায় সমকালীন কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজের উক্তি থেকে ভিন্ন কারণ অনুমিত হয়। তিনি বলেন

‘নিত্যানন্দ-লীলাবর্ণনে হইল আবেশ। 

চৈতন্যের শেষ লীলা রহিল অবশেষ।।

নিত্যানন্দ শিষ্য বৃন্দাবনদাস যে গুরুর গুণখ্যাপনে অধিকতর গুরুত্ব আরােপ করেছিলেন, এ সত্য অনস্বীকার্য তাই কৃষ্ণদাসের অনুমান সত্য হওয়াই সম্ভব।

বৃন্দাবনদাসের কাব্য বিচার করতে গিয়ে তার কাব্য-রচনার মূল উদ্দেশ্যটির বিষয়ে পূর্বেই অবহিত হওয়া প্রয়ােজন, অন্যথায় কবির প্রতি অবিচার হবার আশংকা বর্তমান থেকে যেতে পারে। কাব্য-রচনার কোন মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে বৃন্দাবনদাস ‘চৈতন্যভাগবত’ রচনা করেন নি। তিনি চৈতন্যপরিকরের অন্তর্ভুক্ত নিষ্ঠাবান্ বৈষ্ণব পরিবেশে এবং চৈতন্যদেবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত একটি বৈষ্ণব-পরিবারে, জন্মগ্রহণ করেছিলেন। চৈতন্যদেবের প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের সর্বপ্রধান প্রচারক নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর নিকট বৃন্দাবনদাস দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন—তার কাব্য-আলােচনা প্রসঙ্গে এই দুটি তথ্য সর্বদা স্মরণে রাখা প্রয়ােজন।

অর্থাৎ কাব্যালােচনা নয়, বৈষ্ণবধর্ম প্রচারই যে কবির অভিপ্রেত ছিল এবং সেই উদ্দেশ্যেই যে কবি এই মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন, এ কথা মনে রাখা দরকার। অর্থাৎ একটি সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যেই কবি কাব্য রচনা করেছিলেন, অতএব এতে সর্বজনীন উদার পরিপূর্ণ মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি আশা করা সঙ্গত নয়। বস্তুতঃ কবির মনে সাম্প্রদায়িকতা বােধ ছিল প্রখর, তাই চৈতন্যমঙ্গল’ রূপেই কাব্যটি রচনা করলেও মঙ্গলকাব্যানুযায়ী বিভিন্ন দেবদেবীর বর্ণনা তিনি করেন নি। ভিন্ন সম্প্রদায় সম্বন্ধে অসহিষ্ণুতা- বশতঃ কবি তাদের উপর যথেষ্ট কটাক্ষপাত করে সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক বুদ্ধিরও পরিচয় দিয়েছে এবং তুলনামূলকভাবে অপর সম্প্রদায় অপেক্ষা আপন সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠত্ব বিষয়েও তিনি সােচ্চার ছিলেন। কবির এই অনুদারতা উদ্দেশ্যময়তা এবং প্রচারধর্মিতা, চৈতন্যভাগবতের কাব্যধর্মকে যেমন সুস্থ করেছে, তেমনি এটিকে খাঁটি জীবনকাব্য-রূপেও গড়ে উঠতে দেয়নি।

কবির দৃষ্টিভঙ্গির এই সঙ্কীর্ণতা এবং অনুদারতা ছাড়াও তার বিশেষ উদ্দেশ্যধর্মিতা কীভাবে চৈতন্যজীবনেও অসম্পূর্ণতার সৃষ্টি করেছে তার প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে গ্রন্থের সর্বত্র। মহাপ্রভু চৈতন্যদেব ছিলেন একজন যুগন্ধর পুরুষ। তিনি যে শুধু গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম প্রচারেই জীবনপাত করেন নি, তাঁর আবির্ভাব যে সমগ্র গৌড়বঙ্গের সমাজে ও সাহিত্যে বিপুল আলােড়ন সৃষ্টি করেছিল, সেই পরিচয়টি কিন্তু গ্রন্থে অনুদঘাটিত। চৈতন্যদেবের জীবন ছিল কর্মবহুল। ধর্মচিন্তা তাঁর জীবনের একটা বিশেষ দিক হলেও তার জীবনের একমাত্র দিক নয়। কিন্তু বৃন্দাবনদাস চৈতন্যজীবনে এমন সকল উপাদানই শুধু গ্রহণ করেছেন যাতে তাঁর ধর্মভাবটি প্রকাশিত হয়েছে। কবির দৃষ্টিতে ধর্মপ্রচারের অনুকূল বিষয়গুলিই শুধু গৃহীত হওয়াতে চৈতন্যজীবনী সর্বাঙ্গীণরূপে প্রকাশ লাভের সুযােগ পায়নি। তার কর্মময় জীবনের ঘটনাসমূহ যদি গ্রন্থে রূপায়িত হয়ে উঠতাে, তবে শুধু জীবনী গ্রন্থটিই সর্বাঙ্গ-সুন্দর হতাে না—আমরাও সর্বাতিশায়ী গুণের অধিকারী এই যুগন্ধর পুরুষের প্রকৃত পরিচয় জানবার সুযােগ পেতাম। চৈতন্য-জীবনের কর্মময় দিকের প্রতি কবি কিরূপ উপেক্ষা প্রদর্শন করেছেন, নিম্নে তার দু’একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা হলাে। চৈতন্যদেবের আবির্ভাবে সমকালীন সমাজ যে একটা প্রবল ভাঙনের মুখ থেকে ফিরে এসেছিল, গ্রন্থে তার কোন উল্লেখ নেই। চৈতন্যদেবের কর্মপ্রণালী এবং ভাবধারার মধ্যে যে ভারতব্যাপী একটা সমন্বয়ের আদর্শ স্থাপনের প্রচেষ্টা সক্রিয়ভাবেই বর্তমান ছিল, তদ্বিষয়েও কবির নীরবতা বিস্ময়কর।

বৈষ্ণব ভক্তগণ চৈতন্যদেবকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অবতার বলেই বিশ্বাস করেন। এই কারণেই কৃষ্ণ জীবনের সঙ্গে সাদৃশ্য-প্রদর্শন ও সামঞ্জস্য-বিধান ক’রেই বৃন্দাবনদাস চৈতন্য-ভাগবত রচনার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। মহামুনি ব্যাসদেব-রচিত ভাগবতপুরাণে যেমন কৃষ্ণকাহিনী বর্ণিত হয়েছে, বৃন্দাবনদাস অনেকটা সচেতনভাবেই তার অনুকরণ করেছেন। কবিরাজ গােস্বামী এই কারণেই সশ্রদ্ধভাবে উল্লেখ করেছেন-

‘চৈতন্যলীলার ব্যাস বৃন্দাবনদাস।

চৈতন্যজীবনীকে কৃষ্ণজীবনের অনুরূপ করে গড়ে তুলতে গিয়েই কবি কিছু কিছু অলৌকিক কাহিনীর আশ্রয় নিয়েছেন। ভক্তের দৃষ্টিতে এতে চৈতন্যমাহাত্ম্য বৃদ্ধি পেলেও সাধারণ পাঠক ও ঐতিহাসিকের নিকট এই সমস্ত কাহিনী বিশ্বাসযােগ্যতা হারিয়েছে। অন্যথায় কবি চৈতন্যজীবনের বাল্যলীলার চিত্র-অঙ্কনে আপন সামর্থ্যের যথােপযুক্ত পরিচয় দান করেছেন। চৈতন্য-চিত্র অঙ্কনে একটা সসম্রম ভক্তির ভাব বজায় রাখতেন বলেই তাঁকে দৈনন্দিন তুচ্ছতার মধ্যে কখনাে স্থাপন করতে চাননি। এই কারণেই চৈতন্য চরিত্রের বাস্তবতা সর্বত্র সন্দেহের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। পক্ষান্তরে কবি নিত্যানন্দ প্রভুর শিষ্য হওয়া সত্ত্বেও তার এবং অদ্বৈত প্রভুর চরিত্র-চিত্রণে অতিশয় বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। নিত্যানন্দের সঙ্গে কবি ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত ছিলেন, “চৈতন্যভাগবতে’ এই চরিত্রটিই সর্বাধিক স্পষ্ট, উজ্জ্বল ও বাস্তব হয়ে উঠেছে। নিত্যানন্দ-জীবনের তুচ্ছতাও এতে বর্জিত হয়নি। ধর্মান্ধতায় কবির দৃষ্টি আচ্ছন্ন ছিল বলেই তৎকালীন ভক্ত বৈষ্ণব কবিদের পক্ষে চৈতন্যদেবের প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করা সম্ভবপর ছিল না। ডঃ তারাপদ ভট্টাচার্য বলেন, শ্রীচৈতন্যের ক্ষুরধার বুদ্ধি ও কর্মকৌশল, তাহার সংগঠন শক্তি, উদ্ভাবনী প্রতিভা, সংঘ পরিচালনা দক্ষতা, এমন কি দূরদর্শিতা, বৈপ্লবিক চিন্তা প্রভৃতি ব্যবহারিক গুণপনায় বৃন্দাবনদাস ও কৃষ্ণদাসের চিত্ত আকৃষ্ট হয় নাই। …ধর্মজীবনের আধ্যাত্মিক আদর্শের দিক দিয়া চৈতন্যদেবের কার্যকলাপে যে যে অসঙ্গতি দেখা দেয়, কর্মজীবনের ব্যবহারিক দিক্ দিয়া দেখিলে বুঝা যায় তিনি সংঘ-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যই সেগুলি করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। অত্যন্ত দুঃখের কথা চৈতন্যচরিতকারগণ শ্রীচৈতন্যের কর্মজীবনই উপেক্ষা করিয়াছেন, সেইজন্যই শ্রীচৈতন্যদেব ভাবােন্মত্ত সন্ন্যাসীরূপেই পরিচিত হইয়া আছেন, তাহার কর্মময় জীবন অন্ধকারেই থাকিয়া গিয়াছে। ইহা বাংলার ও বাঙ্গালীর দুর্ভাগ্য।

সচেতনভাবে বৃন্দাবদা ধর্মীয় প্রচারমূলক কাব্য-রচনায় প্রবৃত্ত হয়ে সমকালীন নবদ্বীপের অবৈষ্ণব সমাজের যে চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন তাতে তাঁর ইতিহাস-চেতনার সুন্দর পরিচয় পাওয়া যায়। চৈতন্যদেবের আবির্ভাবকালে সমগ্র দেশের রুচি কোনদিকে প্রবাহিত হয়েছিল, ধর্মকর্মের অবস্থা কেমন ছিল, তার একটা নির্ভরযােগ্য বিশ্বস্ত চিত্র আমরা চৈতন্যভাগবতে পাই। সমসাময়িক নবদ্বীপের জনসংখ্যা, নবদ্বীপবাসীদের সম্পদসমৃদ্ধি এবং শিক্ষাদীক্ষার বিষয়ে তিনি লিখেছেন

নবদ্বীপ সম্পত্তি কে বর্ণিবারে পারে।

এক গঙ্গাঘাটে লক্ষ লােক স্নান করে।।

ত্রিবিধ বৈসে এক জাতি লক্ষ লক্ষ।

সরস্বতী প্রসাদে সবাই মহাদ।।

যে কোন অল্পবয়সী বালকও যে মহাপণ্ডিতের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হবার যােগ্যতা রাখতাে, তার স্বীকৃতি জানিয়েছেন বৃন্দাবনদাস। মনসা-চণ্ডী-আদি অনার্য দেবদেবীগণ যে সমাজে যথাযােগ্য স্বীকৃতি পেয়েছেন এবং চৈতন্য-পূর্ব যুগেই যে এঁদের মাহাত্ম্সূচক বিভিন্ন মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছিল, এ সংবাদটি আমরা চৈতন্য-ভাগবত থেকেই জানবার সুযােগ পেয়েছি।

ধর্মকর্ম লােকে সবে এই মাত্র জানে। 

মঙ্গলচণ্ডীর গীত করে জাগরণে।।

দম্ভ করি বিষহরি পূজে কোন জন। 

পুত্তলী পুজয়ে কেহ নিয়া বহু ধন।..

বাসলী পূজয়ে কেহ নানা উপহারে। 

মদ্যমাংস দিয়া কেহ যক্ষ পূজা করে।

চৈতন্য-আবির্ভাবের পূর্বে বিষ্ণুভক্তের সংখ্যা ছিল নগণ্য, বৈষ্ণবরা ছিল উপহাসের পাত্র।

অতি বড় সুকৃতি যে স্নানের সময়।

গােবিন্দ পুণ্ডরীকাক্ষ নাম উচ্চারয়।… 

জগৎ প্রমত্ত ধন পুত্র বিদ্যারসে।

দেখিলে বৈষ্ণবমাত্র সবে উপহাসে।

বৃন্দাবনদাসের কবিপ্রতিভা অতি উচ্চশ্রেণীর না হলেও তাঁর রচনাপ্রবাহ যে স্বচ্ছন্দগতিতে অগ্রসর হয়েছে, তা অনস্বীকার্য। ডঃ সুকুমার সেন যথার্থই বলেছেন “কাব্যটির মধ্যে কবিত্ব ফলাইবার কিছুমাত্র চেষ্টা দেখা যায় না, তথাপি চৈতন্যচরিত্রের অপরিসীম মাধুর্য কবির অন্তর হইতে স্বতঃ-উৎসারিত অজস্র ভক্তিরস চৈতন্য ভাগবতকে শ্রেষ্ঠ কাব্যের মর্যাদা দান করিয়াছে। চৈতন্য-ভাগবতের যে কোন স্থান পড়িলেই ভক্ত কবির আবেগ পাঠকের মনে সঞ্চারিত হইতে বিন্দুমাত্র বিলম্ব হয় না।…এইরূপ human in terest হিসাবে চৈতন্যভাগবত পুরাতন বাংলা সাহিত্যে একক এবং অদ্বিতীয়।”

(খ) লােচনদাস : চৈতন্যমঙ্গল –

বৈষ্ণবপদকর্তারূপে বিশেষভাবে পরিচিত লােচনদাস চৈতন্য-জীবনকাহিনী অবলম্বনে রচনা করেন চৈতন্যমঙ্গল’ কাব্য। তাঁর রচনায় বৃন্দাবনদাসের নামের উল্লেখ থেকে এ অনুমান অসঙ্গত নয় যে তাঁর কাব্য বৃন্দাবনদাসের চৈতন্য ভাগবতে’র পরে রচিত হয়েছিল। কবি লােচনদাস তাঁর কাব্যে বিস্তৃতভাবেই আত্মপরিচয় দিয়েছেন। তার পিতার নাম কমলাকর এবং মাতা সদানন্দী। কবি লােচনদাসের গুরু তৎকালীন বিশিষ্ট চৈতন্যপরিকর নরহরি সরকার ঠাকুর। কবি তাঁর কাব্যে শিক্ষাদীক্ষা-আদি বিষয়ে উল্লেখ করলেও তার জন্ম তারিখ বা কাব্য রচনার তারিখ উল্লেখ করেন নি। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে অনুমান করা হয় যে কবির কাব্যটি সম্ভবতঃ ১৫৬০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৫৭৫ খ্রীষ্টাব্দ মধ্যবর্তী কোন এক সময় রচিত হয়ে থাকবে।

লােচনদাসের চৈতন্যমঙ্গল’ কাব্যে বহুবিধ রাগ-রাগিণীর উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া কবিরও যে স্বীকৃতি রয়েছে, তা থেকে অবশ্যই অনুমান করা চলে যে, আসরে গীত হবার জন্যই তিনি এই কাব্যটি রচনা করেন। এদিক থেকে এর মঙ্গল’ নামকরণ সার্থক। অবশ্য কবি যে অপর সকল মঙ্গলকাব্যের অনুকরণেই এটিকেও মঙ্গলকাব্যরূপেই রচনা করেছিলেন তার আরও কিছু প্রমাণ বর্তমান। কবি নিষ্ঠাবান ভক্ত বৈষ্ণব হওয়া সত্ত্বেও গ্রন্থারত্ভে অপর সকল মঙ্গলকাব্যের মতাই বিভিন্ন দেব-দেবীর বন্দনাগীতি রচনা করেছেন। এ থেকে স্পষ্টতঃই বােঝা যায় যে কবি লােচনদাস বৃন্দাবনদাসের মতাে সাম্প্রদায়িকতাবােধে উদ্বুদ্ধ হ’য়ে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারে ব্রতী হননি, তিনি সচেতনভাবে কাব্য রচনাতেই প্রবৃত্ত হয়েছিলেন।

লােচনদাসের চৈতন্যমঙ্গল চারি খণ্ডে বিভক্ত। সূত্রখণ্ডে অপরাপর মঙ্গলকাব্যের মতােই বিভিন্ন পৌরাণিক আখ্যায়িকা স্থান লাভ করেছে। মহাভারত, জৈমিনি ভারত, ব্রহ্মসংহিতা এবং বিভিন্ন পুরাণ থেকে উপাদান সংগ্রহ করে কবি এই খণ্ডটিকে সাজিয়ে তুলেছেন। আদিখণ্ডে মহাপ্রভুর জন্মলীলা থেকে গয়া গমন ও প্রত্যাবর্তন কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।

মধ্যখণ্ডে পুরী যাত্রার ও সার্বভৌম-উদ্ধার পর্যন্ত কাহিনীর বিবরণ পাওয়া যায়। অন্তখণ্ডটি অসম্পূর্ণ বলেই মনে হয়। মহাপ্রভুর লীলাবসান বিষয়ে তার বক্তব্যের সমর্থন অন্য কোথাও নেই। তিনি লিখেছেন যে, মহাপ্রভু জগন্নাথ-দেহে বিলীন হয়ে গিয়েছিলেন।

লােচনদাসের কাব্য যেমন উদ্দেশ্যমূলক বা প্রচারধর্ম নয়, তেমনি এ থেকে ঐতিহাসিক উপাদান আহরণও বিপজ্জনক। যদিও তিনি বহুক্ষেত্রেই মুরারি গুপ্তের কড়চা’র সহায়তা নিয়েছেন এবং কোথাও কোথাও তার রচনায় বৃন্দাবনদাসের প্রভাবও সুস্পষ্ট তবু এ কথা সত্য যে তিনি সচেতনভাবে কাব্য রচনায় ব্রতী ছিলেন বলেই ঐতিহাসিক তথ্যের কিংবা বৈষ্ণবীয় তত্ত্বের প্রতি বিশেষ আগ্রহ বােধ করেন নি। তিনি কবি, বৈষ্ণবপদকর্তাও বটে, তার দৃষ্টি ছিল জনসাধারণের দিকে। তাদের মনােরঞ্জনের উদ্দেশ্যেই তিনি কাব্য রচনা করেন। কাব্যিক উৎকর্ষের দিক থেকে লােচনদাসের কৃতিত্বকে অবশ্যই মর্যাদা সহকারে স্বীকৃতি দান করতে হয়। লােচনদাসের কাব্য বিষয়ে ডঃ সুকুমার সেনের অভিমত- “চৈতন্য-ভাগবতের তুলনায় চৈতন্যমঙ্গল বিষয়বস্তুর বর্ণনায় কিছু উন বটে, তবে পল্লবিত কবিতাংশে লােচনের কাব্য বৃন্দাবনদাসের কাব্য অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ তাহা স্বচ্ছন্দে বলা যাইতে পারে। বৃন্দাবনদাসের রচনা মুখ্যতঃ বর্ণনাত্মক আর লােচনের রচনা প্রধানতঃ রসাত্মক।” লােচনের কাব্যে রয়েছে ইতিহাস-বিমুখতা এবং পূর্বাপর সঙ্গতির অভাব। এ সকল অপূর্ণতা স্বীকার করেও অধ্যাপক ভূদেব চৌধুরী তাঁর রসগ্রাহিতার পরিচয় দিয়েছেন নিম্নোেক্ত বক্তব্য-মাধ্যমে – “কিন্তু খণগুবিচ্ছিন্ন এমনি বহু মনােরম চিত্র রচনা করেছেন লােচন, স্বতন্ত্রভাবে যাদের মধ্যে গল্প ও জীবনরস সুনিবিড় হয়ে আছে, জীবনীকাব্যকার হিসেবে লােচন ব্যর্থ, মর্মস্পর্শী গল্পরসিক হিসেবে অবশ্য সমুল্লেখ্য।”

লােচনদাস ছিলেন চৈতন্য-পার্ষদ নরহরি সরকার ঠাকুরের শিষ্য, কাজেই বৈষ্ণব-সম্প্রদায়ের ঐ বিশেষ শাখায় চৈতন্যমঙ্গলের বিশেষ সমাদর ছিল। নরহরি সরকার যে গৌীরপারম্যবাদ বা নদীয়ানাগর-বাদের কবি লােচনদাসের কাব্যে গৌরাঙ্গসুন্দরের সেই নদীয়ানাগর রূপটিই পরিস্ফূট হয়ে ওঠায় ঐ বিশেষ সম্প্রদায়ের নিকট কাব্যটি আদরণীয় হয়ে উঠেছিল। গৌরনাগর-বাদের স্বরূপ এবং লােচনের কাব্যে এই ভাবের আত্মপ্রকাশ-বিষয়ে ডঃ তারাপদ ভট্টাচার্য বলেন- গৌরপারম্যবাদে বলা হইয়াছে স্বয়ং কৃষ্ণও উপাস্য নহেন। গৌরাঙ্গই একমাত্র উপাস্য, এই গৌরাঙ্গ আবার সন্ন্যাসী শ্রীচৈতন্য নহেন, গৃহী গৌরাঙ্গ। সন্ন্যাসী চৈতন্য পূর্ণ হইতে পারেন, কিন্তু পূর্ণতম হইতেছেন গৃহী শৃঙ্গারবেশী গৌরাঙ্গ। গৌরাঙ্গ ‘নদীয়ানাগর’ এবং ভক্তেরা ‘নদীয়া-নাগরী’। ভক্তের সহিত শ্রীকৃষ্ণের লীলার অনুরূপ।

শ্রীগৌরাঙ্গের রমণীমােহন রূপ, কটাক্ষ, হাস্য, হাবভাব বর্ণনা করিয়া লােচনদাস অপূর্ব কাব্য রচনা করিয়াছে। লােচনের কাব্যে নদীয়ার কুলবধূগণ গৌরাঙ্গদর্শনে নিজের সতীধর্ম পর্যন্ত বিসর্জন দিয়াছেন- “রসালসে আবেশে লােলি পড়ে গােরাপাশে গরগর কামে উনমতা।” লােচনের চৈতন্যমঙ্গল আদ্যন্ত দেবলীলা মাত্র, তাহাতে ঐতিহাসিকতার চিহ্ন নাই—তাহা আগাগােড়া চমৎকার রােম্যান্টিক কাব্য।

(গ) জয়ানন্দ : চৈতন্যমঙ্গল –

লােচনদাসের মতােই আরো একজন বৈষ্ণব কবি জয়ানন্দ মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের জীবন কাহিনী অবলম্বনে রচনা করলেন আর এক চৈতন্য-চরিত—এরও নাম ‘চৈতন্যমঙ্গল’। জয়ানন্দ আত্মপরিচয় দান প্রসঙ্গে জানিয়েছেন যে তার পিতার নাম সুবুদ্ধি মিশ্র এবং মাতা রােদনী দেবী তাঁদের নিবাস ছিল বর্ধমান জেলার আমাইপুর গ্রাম। মহাপ্রভু চৈতন্যদেবই সুবুদ্ধি মিশ্রের এক বৎসর বয়স্ক পুত্রের নাম রেখেছিলেন ‘জয়ানন্দ’ অতএব কবি জয়ানন্দ যে মহাপ্রভুর জীবৎকালেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন, এ বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। ঐতিহাসিকদের অনুমান জয়ানন্দ আঃ ১৫৬০ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ চৈতন্যমঙ্গল কাব্যটি রচনা করেন।

জয়ানন্দ সচেতনভাবেই কাব্যের নামকরণ করেছিলেন ‘চৈতন্যমঙ্গল’—কারণ তিনি মঙ্গল কাব্যের ধারারই অনুসরণ করেছিলেন। অপরাপর মঙ্গলকাব্যের মতােই তিনিও গ্রন্থারম্ভে বিভিন্ন দেব-দেবীর স্তুতিবন্দনা করেন এবং নানা পুরাণ থেকে বহু উপাদান সংগ্রহ করে গ্রন্থের কলেবর পুষ্ট করেন। অনেকে মনে করেন, জয়ানন্দের কাব্যে পৌরাণিক কাহিনীই যেন সমধিক গুরুত্ব লাভ করে। কবি নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব হওয়া সত্ত্বেও মনােভাবের দিক থেকে যে অপেক্ষাকৃত সংস্কারমুক্ত ছিলেন, তার পরিচয় যেমন এখানে বিবৃত, তেমনি অন্যত্র অনেক স্থলেই তার অসাম্প্রদায়িক বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। সম্ভবতঃ একসময় কবির কাব্যটি এই কারণেই জনসাধারণের মধ্যে বেশ আদরের সঙ্গেই গৃহীত হয়েছিল।

জয়ানন্দ ‘চৈতন্যমঙ্গল’ পরিকল্পনায় যথেষ্ট নােতুনত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর কাব্যটি নয় খণ্ডে বিভক্ত — আদি খণ্ড, বৈরাগ্য খণ্ড, সন্ন্যাস খণ্ড, উৎকল খণ্ড, প্রকাশ খণ্ড, তীর্থ খণ্ড, বিজয় খণ্ড ও উত্তর খণ্ড। মূলতঃ চৈতন্যমহাপ্রভুর জীবন কাহিনীই গ্রন্থের প্রধান বর্ণনীয় বিষয় হলেও বিভিন্ন খণ্ডগুলি খুব সুগ্রথিত নয়। কবি ছিলেন মূলতঃ গায়েন, অতএব আসরে গীত হবার উপযােগী ক’রেই তিনি গােটা বিষয়কে পালার আকারে সাজিয়েছিলেন। এই গ্রন্থেও আছে, বিভিন্ন রাগরাগিণীর উল্লেখ। এটি যে আসরে গীত হতাে, এ বিষয়ে কবির স্বীকৃতি রয়েছে

ইবে শব্দ চামর সঙ্গী বাদ রসে।

জয়ানন্দ চৈতন্যমঙ্গল গাএ শেষে।।

জয়ানন্দের কাব্যে শুধু পরিকল্পনার অভিনবত্ব নয়, বিষয়ের দিক থেকেও তিনি প্রচলিত কাহিনীর। বাইরে পদক্ষেপ নিয়েছেন। তার এই স্বাতন্ত্রের জন্যই এক সময় অনেকের ধারণা ছিল যে কবি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চৈতন্যদেবের একটি প্রামাণিক জীবনী রচনা করেছেন। কিস্তু তাঁর স্ববিরােধিতা এবং কল্পনার আতিশয্য প্রমাণিত হবার পরই ধরা পড়ে যে আসর জমানাের জন্যই তিনি প্রচুর গালগল্পের অবতারণা করেছেন। ঐতিহাসিকগণ গবেষণার সাহায্যে প্রমাণ করেছেন যে জয়ানন্দ-বর্ণিত অনেক বিষয় অভিনব বলেই দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে কিন্তু এদের বাস্তব ভিত্তি নেই। তৎসত্ত্বেও জয়ানন্দ লিখিত কোন কোন বিষয়ের বিশ্বাসযােগ্যতা থাকা সম্ভব বলেও ঐতিহাসিকগণ মনে করেন। যেমন- চৈতন্যদেবের লীলা অবসানের ব্যাপারে প্রায় সকল গ্রন্থকারই নীরব, কিংবা অলৌকিক বিষয়ের অবতারণা করেছেন। এদের মধ্যে একমাত্র জয়ানন্দ-বর্ণিত কাহিনীটিই বাস্তব এবং বিশ্বাস্য বলে মনে হয়। তিনি বলেন, আষাঢ় পঞ্চমীতে রথযাত্রায় মহাপ্রভু যখন নেচে নেচে যাচ্ছিলেন তখন তার পায়ে ইটের আঘাত লাগে—এরই পরিণতিতে বিষক্রিয়ার ফলে তাঁর ইহলীলার অবসান ঘটে। মহাপ্রভুর লীলাবসান বিষয়ে এই লৌকিক কাহিনী ভক্তজনের মনঃপুত না হওয়াই স্বাভাবিক। সম্ভবতঃ এরূপ রচনার অপরাধেই তিনি বৈষ্ণবসমাজে উপেক্ষিত হয়েছিলেন এবং তার গ্রন্থটি প্রায় বিলুপ্তির পথে চলছিল। কবি গঙ্গাধর সম্প্রদায়ভুক্ত অভিরাম গােস্বামীর শিষ্য ছিলেন বলেই সম্ভবতঃ তার গ্রন্থটি শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পেরেছিল।

জয়ানন্দের কাব্যে প্রাচীনতর কবি ও গ্রন্থের উল্লেখ ঐতিহাসিকদের সমাদর লাভ করেছে। তবে তাঁর রচনার কাব্যমূল্য কিংবা ঐতিহাসিক মূল্য—কোনটাই স্বীকৃতি লাভ করেনি। তার কাব্যকে ‘গায়েনসুলভ, চিত্ত চমৎকারসৃষ্টির চেষ্টা এবং অপরিণত পাঁচালী’ বলেও এখনও অনেকে মনে করে থাকেন।

(ঘ) কৃষ্ণদাস কবিরাজ : চৈতন্যচরিতামৃত –

কৃষ্ণদাস কবিরাজ গােস্বামী মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের জীবনকাহিনী অবলম্বনে চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থের রচয়িতা-রূপে পরিচিত হলেও প্রকৃতপক্ষে বৈষ্ণবসম্প্রদায়ের মধ্যে বৈষ্ণব ধর্ম ও দর্শনের অন্যতম প্রবক্তারূপেই বিশেষ খ্যাতিমান। তিনি একালে জন্মগ্রহণ করলে কাব্য না লিখে যে প্রবন্ধ সাহিত্য রচনায়ই প্রবৃত্ত হতেন, এ বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। বস্তুতঃ তার রচিত ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ যতখানি চৈতন্যের জীবনী, তার চেয়েও অনেক বেশি বৈষ্ণব ধর্ম ও দর্শন গ্রন্থ। আসলে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মদর্শন প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলা ভাষায় একটি সহজবােধ্য শাস্ত্রগ্রন্থ রচনা করাই ছিল কৃষ্ণদাস কবিরাজের লক্ষ্য।

কৃষ্ণদাস তার কাব্যে যে আত্মপরিচয় দান করেছেন, তাতে জানা যায়, তিনি ঝামটপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। স্বপ্নে নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর আদেশ লাভ করে তিনি বৃন্দাবনধাম গমন করে রূপ গােস্বামী ও সনাতন গােস্বামীর সান্নিধ্যলাভ করেন ও ষঙ় গােস্বামীর অন্যতম রঘুনাথ গােস্বামীর নিকট দীক্ষা গ্রহণ করেন। ভিন্নসূত্রে জানা যায় যে, কৃষ্ণদাসের পিতার নাম ছিল ভগীরথ ও মাতা সুনন্দা, জাতিতে বৈদ্য। পরবর্তীকালে রচিত কোন কোন গ্রন্থে কথিত হয়েছে যে, বৃন্দাবন থেকে বিভিন্ন গ্রন্থ যখন গৌড়ে প্রেরণ করা হয়, তখন তা দস্যুদল-কর্তৃক লুষ্ঠিত হয়এই গ্রন্থরাজির মধ্যে কৃষ্ণদাস বিরচিত ‘চৈতন্য চরিতামৃতও’ ছিল। এই দুঃসংবাদ শ্রবণে কবিরাজ গােস্বামীর মৃত্যু হয়। এ ঘটনার সত্যতা অবশ্য সংশয়িত।

গ্রন্থরচনার কাল বিষয়ে কৃষ্ণদাসের রচনা থেকে অনুমিত হয় যে তিনি ১৬১৫ খ্রীষ্টাব্দে গ্রন্থ রচনা করেন। কিন্তু প্রৌঢ় কৃষ্ণদাস বৃন্দাবনে সনাতনের সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন—১৫৫৪ খ্রীষ্টাব্দে সনাতন গােস্বামীর তিরােভাব ঘটে। কাজেই এই তারিখের পরও অন্ততঃ ৬০ বৎসর জীবিত থাকা সম্ভবপর ছিল বলে মনে হয় না। যদিও গ্রন্থ রচনাকালে তিনি অতিশয় বৃদ্ধ হয়েছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন, তবু তার পক্ষে এত দীর্ঘজীবী হয়ে থাকা সংশয়জনক বলে মনে হয়। নিজের অবস্থা সম্বন্ধে তিনি বলেন

“বৃদ্ধ জরাতুর আমি অন্ধ বধির।

হস্ত হালে মনােবুদ্ধি নহে মাের স্থির।।

নানা রােগগ্রস্থ চলিতে বসিতে না পারি।

পঞ্চরােগের পীড়ায় ব্যাকুল রাত্রিদিনে মরি।”

যা হােক, সবদিক বিবেচনা করে ঐতিহাসিক পণ্ডিতগণ অনুমান করেন যে কৃষ্ণদাস সম্ভবতঃ ১৫৬০-৮০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে তার চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন।

চৈতন্যজীবনীর প্রথম কবি বৃন্দাবনদাসের ‘চৈতন্যভাগবতে’ মহাপ্রভুর শেষ জীবনের কাহিনী বিশদভাবে বর্ণিত না হওয়াতে বৈষ্ণব ভক্তদের নির্বন্ধাতিশষ্যেই নিজের অক্ষমতা সত্ত্বেও চৈতন্যজীবন-কাহিনী রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন বলে কৃষ্ণদাস উল্লেখ করেছেন। চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থ তিন খণ্ডে বিভক্ত। আদিলীলায় সতেরােটি পরিচ্ছেদ—তার প্রথম বারােটি বস্তুতঃ মুখবন্ধরূপেই রচিত হয়েছে। এতে বৈষ্ণবতত্ত্বের বিভিন্ন দিক আলােচিত হয়েছে। পরবর্তী পাঁচটি পরিচ্ছেদে চৈতন্যদেবের জন্ম থেকে নবদ্বীপ বাসকাল পর্যন্ত বর্ণিত হয়েছে।

মধ্যলীলার পাঁচিশ পরিচ্ছেদে মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের পরিব্রাজক জীবনের বিভিন্ন ঘটনা এবং তৎপ্রসঙ্গে বিভিন্ন বৈষ্ণবতত্ত্ব আলােচিত হয়েছে। অন্ত্যলীলায় বিশটি পরিচ্ছেদএতে নীলাচলবাসী চৈতন্যজীবনের ভাবােন্মাদ অবস্থার পরিচয় ফুটিয়ে তােলা হয়েছে। মহাপ্রভুর শেষ জীবনের কাহিনী বিস্তৃতভাবে পরিবেষণ করলেও কবিরাজ গােস্বামী মহাপ্রভুর লীলাসংবরণ বিষয়ে সম্পূর্ণ নীরব। তার এই নীরবতা-বিষয়ে বিভিন্ন কারণ অনুমিত হয়- মহাপ্রভুর লীলাবসান একান্ত প্রকৃত ব্যাপার বলেই তিনি তা’ এড়িয়ে গেছেন। অথবা শারীরিক অশক্ততা নিবন্ধন কবি গ্রন্থ সমাপ্ত করতে পারেন নি, কিংবা গ্রন্থ-সমাপ্তির পূর্বেই কবির মৃত্যু ঘটে।

চৈতন্যজীবনের প্রথমাংশ বর্ণনায় কবি বাহুল্য বর্জন করেছেন। পূর্বসূরী বৃন্দাবনদাস বিস্তৃতভাবেই এই সমস্ত বিষয় বর্ণনা করেছেন বলেই কৃষ্ণদাস তার প্রতি শ্রদ্ধাবশতঃই এই সমস্ত বিষয়ে সংক্ষিপ্ততা অবলম্বন করেছিলেন। বস্তুতঃ বৃন্দাবনদাসের গ্রন্থের পরিপূরকরূপেই তিনি তার গ্রন্থের পরিকল্পনা করেছিলেন এ কথা তিনি একাধিকবার উল্লেখ করে গেছেন।

কৃষ্ণদাস-বিরচিত ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ শুধু যে চৈতন্যজীবনের প্রামাণিক কাহিনীরূপেই সমাদৃত, তা’ নয়, বৈষ্ণবধর্ম ও দর্শনের প্রামাণিক ব্যাখ্যাও রয়েছে এত যে কোন গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ভুক্ত ভক্তই এ কথা বিশ্বাস করেন। ডঃ সুকুমার সেন বলেন – “চৈতন্যচরিতামৃত চৈতন্যচরিত কাব্যমাত্র নহে। জীবনীবর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে ইহাতে চৈতন্য প্রবর্তিত বৈষ্ণবধর্ম ও তত্ত্বের স্থূল, সূক্ষ্ম, অতি সূক্ষ্ম বিবরণ ও বিশ্লেষণ আছে। তত্ত্ব বিচার গ্রন্থটির বাহ্যাংশ নহে; চৈতন্যলীলা, বৈষ্ণব নীতি, দর্শন ও রসতত্ত্ব ইহার মধ্যে অঙ্গাঙ্গিরূপে অচ্ছেদ্যরূপে বিবৃত ও বিচারিত হইয়াছে। বৈষ্ণব দর্শন ও রসতত্ত্ব কৃষ্ণলীলা-কাহিনীর সহিত ওতপ্রােত ; সুতরাং ইহাতে কৃষ্ণলীলা যে অনেক পরিমাণে মুখ্যভাবে বিবৃত ও বিচারিত হইয়াছে তাহাতে অনেকে বিস্ময়বােধ করলেও প্রকৃত প্রস্তাবে তাহাতে বিস্ময়ের হেতু নাই।”

বৃন্দাবনদাসের মতােই কৃষ্ণদাস কবিরাজও মহাপ্রভুর জীবনকাহিনী অবলম্বনে বৈষ্ণব-ধর্ম প্রচারের ব্রত গ্রহণ করেই আলােচ্য গ্রন্থ রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। বৃন্দাবাদাস সম্ভবতঃ কবিপ্রাণ ছিলেন বলেই তার রচনায় কখন কখন গীতিপ্রাণতা বা আবেগ প্রকাশ পেয়েছে, কিন্তু কবিরাজ গােস্বামী ছিলেন একান্তই রসকষহীন নৈষ্ঠিক বৈষ্ণব পণ্ডিত, তাই তাঁর গ্রন্থ আকারে মহাকাব্যতুল্য হলেও এতে কবির কবিধর্মের কোনই পরিচয় পাওয়া যায় না।

অধ্যাপক পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য লিখেছেনঃ “বাঙলা ভাষায় বস্তুনিষ্ঠ মননশীল সাহিত্যের অপেক্ষাকৃত স্বল্পতা এই যুগেও বর্তমান। সমগ্র প্রাচীন ও মধ্যযুগে এই ধরনের রচনা প্রায় দুর্লভ বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। এইদিক হইতে বিচার করিলে, শুধু প্রাচীন ও মধ্যযুগের নহে, সমগ্র বঙ্গ সাহিত্যের ইতিহাসেই কৃষ্ণদাস কবিরাজ গােস্বামীর চৈতন্যচরিতামৃতের স্থান অতি উচ্চে। বৈষ্ণবধর্ম ও দর্শন-সম্বন্ধীয় যাবতীয় আলােচনাই অপেক্ষাকৃত সরল ভাষায় ইহাতে বর্ণিত হইয়াছে-সমসাময়িক যুগে সাহিত্যে গদ্যভাষার প্রয়ােগ ছিল না বলিয়াই হয়তাে কবিরাজ গােস্বামী পদ্যের শরণাপন্ন হইয়াছিলেন, নতুবা হয়তাে গদ্যই হইত তাঁহার ভাবের বাহন। দৃঢ়বদ্ধ ভাব, ভাবােচ্ছাসের স্বল্পতা এবং সরল প্রকাশভঙ্গী তাহার রচনাকে গদ্যধর্মী করিয়া তুলিয়াছে। গ্রন্থে পল্লবিত কবিত্বের অবকাশ কম, কবিত্বের বিকাশও কম। কবি যুক্তি ও নিষ্ঠার সঙ্গে গদ্যাত্মক রচনায় আপনার প্রয়ােজন সাধন করিয়াছেন।”

বৃন্দাবনের ষড় গােস্বামীর সান্নিধ্যপ্রাপ্ত কবিরাজ গােস্বামী বৈষ্ণবধর্মে যে নিষ্ণাত ছিলেন, তা বলাই বাহুল্য। গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের বিভিন্ন তাত্ত্বিক দিক দিয়ে এই গােস্বামীগণ যে সকল মহামূল্য গ্রন্থ রচনা করেছেন, তাদের সবকটিই সংস্কৃত ভাষায় রচিত বলে জনসাধারণের নিকট সহজবােধ্য ছিল না। কবিরাজ গােস্বামী চৈতন্যজীবনী রচনা-প্রসঙ্গে বৈষ্ণবধর্ম, দর্শন ও তত্ত্বকে জনসাধারণের গ্রহণােপযােগী করে প্রকাশ করলেন বাঙলা ভাষায়।

চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থ অনেকের নিকট যে দুর্বোধ্য বলে বিবেচিত হয়, তার কারণ ভাষার কঠোরতা নয় বিষয়ের কাঠিন্যই গ্ন্থটিকে সাধারণের নিকট কিছুটা দুর্বোধ্য করে তুলেছে। তিনি গ্রন্থটিকে প্রামাণিক করে তােলবার উদ্দেশ্যে যখনই কোন বিষয়ের উল্লেখ করেছেন, তখনই তার সমর্থনে শাস্ত্রীয় বাক্যও উদ্ধার করেছে। এর ফলে গ্রন্থে সাত শতাধিক সংস্কৃত শ্লোকও স্থান লাভ করেছে—অবশ্য এর মধ্যে শত পরিমাণ শ্লোক কবিরাজ গােস্বামী রচিত। কবিরাজ গােস্বামী যে অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন এখানেই তার প্রমাণ বর্তমান। ডঃ তারাপদ ভট্টাচার্য বলেন – “দার্শনিক চিন্তার জগতে চৈতন্যচরিতামৃতের দান অল্প নহে। স্পষ্ট ভাষায় কৃষ্ণদাস কবিরাজই প্রথম প্রচার করিয়াছেন, ভুক্তির ইচ্ছার ন্যায় মুক্তির ইচ্ছাও বর্জনীয়-‘মােক্ষবাঞ্ছাকৈতবপ্রধান’। চতুর্বর্গের উর্ধ্বে পঞ্চম বর্গ বা পুরুষার্থ হইতেছে ‘প্রেম’। এই প্রেম কাম নহে- ‘কৃষ্ণন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা ধরে প্রেম নাম’ এবং এই প্রেম—:বাহ্যে বিষজ্বালা হয়, ভিতরে আনন্দময়’, ‘বিষামৃতে এক্ষেত্রে মিলন’। ইহা কৃষ্ণদাসেরই নূতন বাণী। বৈধী ভক্তি অপেক্ষা অহৈতুকী রাগানুগা ভক্তি শ্রেষ্ঠ, ঐশ্বর্য নহে মাধুর্যই ঈশ্বরের স্বরূপ, ‘কৃষ্ণের যতেক খেলা, সর্বোত্তম নরলীলা, নরবপু তাহার স্বরূপ’- প্রভৃতি বহু দার্শনিক তত্ত্ব চৈতন্যচরিতামৃত হইতেই জনসমাজে প্রচারিত হইয়াছে। তত্ত্বের শুধু প্রচার নহে, তত্ত্বকে সুপ্রতিষ্ঠিত করিবার জন্যও কৃষ্ণদাস অল্প চেষ্টা করেন নাই। তাহার কৃতিত্ব চৈতন্যবাণী ব্যাখ্যায়। চৈতন্য ধর্মের ব্যাখ্যাতা হিসাবেই তিনি বঙ্গসাহিত্যে অমর হইয়া থাকিবেন।”

বহুগুণে গুণান্বিত হওয়া সত্ত্বেও চৈতন্যচরিতামৃত ও গ্রন্থকারদের কিছু ঊনতা ও ত্রুটির উল্লেখ প্রয়ােজন। বৈষ্ণবধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যেই গ্রন্থটি রচিত হয়েছিল বলেই কাব্যটি এত বেশি প্রচারধর্মী হয়ে উঠেছে যে এর কোন কাব্যগুণ প্রায় চোখেই পড়ে না। অসাধারণ বিনয়ী বলে পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও কবিরাজ গােস্বামীর ভিন্ন সম্প্রদায় সম্বন্ধে অসহিষ্ণুতা বড় বেশি পীড়াদায়ক বলে মনে হয়। অবৈষ্ণবের রসনা, নাসা ও দেহকে কবিরাজ গােস্বামী বিভিন্ন নিকৃষ্ট বস্তুরূপে বর্ণনা করেছেন। বৈষ্ণব তত্ত্ব-বিচারে তিনি যথেষ্ট যুক্তি, বিচারবুদ্ধি ও নিষ্ঠার পরিচয় দিলেও চৈতন্যদেবের পরিচয় দান-প্রসঙ্গে তিনি বাস্তব সত্যকে এড়িয়ে গিয়ে অলৌকিকতার আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। ফলে চৈতন্যদেবের জীবনকে অবলম্বন করে বাঙলা ভাষায় যে একটি ঐতিহাসিক জীবনী রচিত হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, তা একেবারেই তিরােহিত হলাে। চৈতন্যচরিতামৃত যেমন খাঁটি জীবনী হয়নি, তেমনি ঐতিহাসিক গ্রন্থরূপে বিবেচিত হবার যােগ্যতাও হারিয়েছে। তাই তার কাব্য যথার্থ অর্থে ‘চরিত’ কাব্য নয়, তা প্রকৃতপক্ষেই ‘চরিতামৃত। চরিত-রচনার মধ্য দিয়ে অমৃতলােকের তত্ত্ব ও সুগন্ধ বিতরণই ছিল কবিরাজ গােস্বামির আন্তরিক উদ্দেশ্য।

(ঙ) অন্যান্য কবিগণ – বাঙলা ভাষায় রচিত চৈতন্যজীবনীর সংখ্যা খুব বেশি নয়। বৃন্দাবনদাস, কৃষ্ণদাস কবিরাজ, লােচনদাস এবং জয়ানন্দ ব্যতীত অপর দুজন মাত্র কবির নামই উল্লেখ করা যায়, যারা চৈতন্যজীবনী রচনায় সার্থকতা লাভ করেছিলেন। চৈতন্যদেবের জীবনী ছাড়াও চৈতন্যপরিবারভুক্ত আরাে কিছু মহাপুরুষের জীবনীও সেকালে রচিত হয়েছিল, যাঁদের মধ্যে অদ্বৈতাচার্য প্রভু এবং তৎপত্নী সীতাদেবীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। ঈশান নাগর-রচিত ‘অদ্বৈতপ্রকাশ’, ‘হরিচরণের ‘অদ্বৈতমঙ্গল’ নরহরি দাসের ‘অদ্বৈতবিলাস’ এবং লােকনাথ দাসের সীতাচরিত্র ও বিষ্ণুদাস আচার্যের সীত-গুণ কদম্ব’ প্রভৃতির নাম বিশেষভাবেই উল্লেখযােগ্য। এছাড়াও ভক্তিরত্নাকর, নরােত্তমবিলাস, গৌরচরিতচিন্তামণি, প্রভৃতি গ্রন্থে চৈতন্যপরিকরদের জীবনী বর্ণিত হয়েছে।

‘গােবিন্দদাসের কড়চা’- জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গল’-এ. চৈতন্য-সহচররূপে গােবিন্দ কর্মকারের নাম উল্লেখ করা হয়েছে-অপর কোন সূত্রে এই নামটি পাওয়া যায় না। মাত্র ১৮৯৫ খ্রীঃ ‘গােবিন্দদাসের কড়চা’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হলে গ্রন্থটির প্রামাণিকতা নিয়ে পণ্ডিতমহলে তুমুল আলােড়নের সৃষ্টি হয়। গ্রন্থটিতে গ্রন্থকার আত্মপরিচয়সূত্রে জানিয়েছেন যে অস্ত্র হাতা,…বেড়ি গড়াই ছিল তার পেশা; তিনি ‘নিগুণ মুখ বলে স্ত্রীদ্বারা অপমানিত হয়ে গৃহত্যাগ করেন এবং চৈতন্যের ভৃত্যের পদ গ্রহণ করেন। মহাপ্রভুর দাক্ষিণাত্য-ভ্রমণকালে তিনি ছিলেন মহাপ্রভুর সেবক ও নিত্য-সঙ্গী। তিনি দাক্ষিণাত্য-ভ্রমণকালে দিনলিপি বা কড়ুচা রেখেছিলেন। এই ভ্রমণকাহিনী ব্যতীত মহাপ্রভু জীবনের অপর কোন বিবরণ এই গ্রন্থে নেই। গ্রন্থের ভাষা, বিষয়বস্তু আদি বিচার করে মৃণালকান্তি ঘােষ তাঁর ‘গােবিন্দদাসের কড়চা রহস্য নামক গ্রন্থে এবং বিপিনবিহারী দাশগুপ্ত ‘Govinda Das’s Kadcha-a black Forgery’ নামক গ্রন্থে ‘গােবিন্দদাসের ‘কড়চা’কে নিঃসন্দিগ্ধভাবেই জাল বলে প্রমাণ করেছেন। উঃ সুকুমার সেনও এই গ্রন্থের প্রামাণিকতা সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেন। আবার ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন আদি প্রাচীনগণ এটির প্রামাণিকতাকে স্বীকার করে নিয়েছেন। ডঃ বিমানবিহারী মজুমদার মধ্যপন্থা গ্রহণ করে মন্তব্য করেছেন, “গােস্বামী মহাশয় হয়ত কোন কীটদষ্ট প্রাচীন পুঁথি সংক্ষিপ্তভাবে যাহা পাইয়াছিলেন, তাহাই পল্লবিত করিয়া নিজের ভাষায় লিখিয়া গােবিন্দদাসের কড়চা নাম দিয়া প্রকাশ করিয়াছিলেন।” গ্রন্থটির প্রামাণিকতা নিয়ে মতভেদ থাকলেও এর বর্ণনায় হৃদ্যতা এবং কবির কবিত্বশক্তিকে স্বীকৃতি জানাতেই হয়।

চূড়ামণি দাস : গৌরাঙ্গবিজয়- বৈষ্ণব-পদকর্তা চুড়ামণিদাস-রচিত চৈতন্যজীবনী বিষয়ক একখানি গ্রন্থ ‘ভুবন-মঙ্গল’ বা ‘গৌরাঙ্গ বিজয়’ নামে পরিচিত। গ্রন্থকার ছিলেন নিত্যানন্দ প্রভুর অনুচর ধনঞ্জয় পণ্ডিতের শিষ্য। অতএব কবি সম্ভবতঃ চৈতন্যলীলার প্রত্যক্ষদ্রষ্টা ছিলেন। ডঃ সুকুমার সেন অনুমান করেন, চুড়ামণিদাস সম্ভবতঃ ১৫৪২-১৫৫০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে কোন একসময় গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন।

কবি সম্ভবতঃ আদি, মধ্য ও অন্ত্য—এই তিন খণ্ডে গ্রন্থ রচনার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁর গ্রন্থের অংশবিশেষ মাত্রই পাওয়া গেছে। আলোচ্য গ্রন্থে কবি চৈতন্যমহাপ্রভু এবং নিত্যানন্দ প্রভু সম্বন্ধে কিছু নােতুন তথ্য পরিবেষণ করেছেন। মাধবেন্দ্রপুরী-বিষয়ে কিছু অতিরিক্ত সংবাদ, নিত্যানন্দের বাল্যজীবন এবং চৈতন্যদেবের সহিত তার পত্র-ব্যবহার আদি বিষয়ে অনেক কৌতূহলােদ্দীপক সংবাদ পাওয়া যায়। কবি চৈতন্যদেবকে ভগবানের অবতার বলে বিশ্বাস করতেন—কিন্তু এই বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য তিনি যেমন কোন তত্ত্ব উপস্থাপিত করেন নি, তেমনি কোন অলৌকিক কাহিনীরও অবতারণা করেন নি। গ্রন্থের কোন কোন চরিত্রসৃষ্টিতে এবং ঘটনা-বর্ণনায় কবি মােটামুটিভাবে বাস্তবতাবােধের পরিচয় দিয়েছেন।