ইতিহাসে দেখা যায়, অনেক সময় একটি ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে, জাতির নবজাগরণের মাঙ্গলিক উৎসব শুরু হয়। শ্রীচৈতন্যদেব সেই ধ্রুবতারা, যাঁকে কেন্দ্র করে অনাগত কালের বিচিত্র সম্ভাবনা মূর্ত হয়ে উঠেছিল। বাঙালীর সমাজ-জীবন-সাহিত্যে তার প্রভাব হয়ে উঠেছিল সুদূরপ্রসারী। তাকে কেন্দ্র করে যুগজাগৃতির যে লক্ষণ দেখা গিয়েছিল। তাকে ব্যাখ্যা করেছেন একজন ঐতিহাসিক এইভাবে“….. it was the period which witnessed the efflorescence of the Bengali Mind symbolized by the Lord Gouranga by whose message of love and forgiveness the whole Eastern India was carried under its feet. The Bengali Mind burst its bonds and found its voice in the sweet lyricism of the cult of Radha and Krishna in the emotional intensity of Vaisnavism.” (History of Bengal’, Vol II, pp. 143-44, Dr. A.B.N. Habibullah).
সেই কারণে তাঁর দিব্যজীবনকে অবলম্বন করে বাংলা সাহিত্যে এক নতুন ধারার সূচনা হয়। প্রকৃতপক্ষে, যে জীবনের আকর্ষণে জীবনীগ্রন্থ রচনার ধারাটি বিকশিত হয়, সেই ধরনের অপাপবিদ্ধ কোন মানুষের ব্যক্তিত্ব মধ্যযুগের দেব-নির্ভর সমাজের উপর আপন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে নি। ষোড়শ শতকে শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবে সেই ধরনের ব্যাপ্ত ঘটনাবহুল উত্তাল জীবনের প্রথম পরিচয় পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক Dr. S.K. Dey বাংলা চরিতসাহিত্য সৃষ্টির মূলে বৈষ্ণব ধর্মান্দোলনের প্রভাব লক্ষ্য করেছেনঃ “Biography is distinctively Vaisnava contribution to Middle Bengali, and by creating it, the movement added a new genre to the literature of the century”. (“The Vaisnava Faith and Movement’)
বস্তুত, চৈতন্যদেবের আবির্ভাব এবং বাঙালীর আত্মচেতনার উজ্জীবন যেন প্রায় একই সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়। সেইজন্য গবেষকের দৃষ্টিতে,— “Chaitannyaism having practically created a greater Bengal”. (“Cultural Fellowship Brajabuli’, The Presidency College Magazine, 1950, p. 30).
তাই চৈতন্যচরিত সাহিত্য শুধু ভক্তিকাব্য নয়, সমকালীন শ্রেষ্ঠ মানবের জীবনকাহিনীও বটে। চৈতন্যমন্ত্রে জাতির কুসংস্কার ও ভেদবিচার দূর করে তার শুদ্ধ চৈতন্য সম্পাদনে ব্রতী হয়েছিলেন কবিরা।
সংস্কৃত রচনাশ্রীচৈতন্যের জীবৎকালে তাঁকে প্রকাশ্যে কৃষ্ণ-অবতার রূপে আরাধনা করেন পণ্ডিত-ভক্ত অদ্বৈত আচার্য। তারপরে তাঁর জীবনীকে সংস্কৃতে শ্লোকবদ্ধ করার প্রথম প্রয়াস দেখা যায় মুরারি গুপ্ত এবং স্বরূপ দামোদরের মধ্যে। দুজনের গ্রন্থের নামই ‘কড়চা’। এর মধ্যে মুরারি গুপ্তের গ্রন্থটি ৭৮টি সর্গে, চার ভাগে বিভক্ত। রচনাকাল সংশয়াচ্ছন্ন। ভাষা সংস্কৃত হলেও সহজ, প্রাঞ্জল এবং অলৌকিক ভাবনায় ভাবিত।
চৈতন্যদেবকে নিয়ে দুখানি নাটক লেখা হয়েছিল। প্রথমটির রচয়িতা একজন বঙ্গদেশীয় বিপ্র, যার একটি মাত্র শ্লোক ছাড়া অন্য সমস্ত অংশ অবলুপ্ত। আর একটির নাম ‘চৈতন্যচন্দ্রোদয়’, নাট্যকার শিবানন্দ সেনের পুত্র পরমানন্দ সেন, ‘কবিকর্ণপুর’ নামে যিনি সমধিক প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাঁর রচিত আর একটি মহাকাব্যও ছিল, নাম— ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’।
কবি কর্ণপুরের মতে, চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের কারণ— (১) ত্রিতাপক্লীষ্ট জীবগণের উদ্ধার, (২) মায়াবাদ এবং অদ্বৈতবাদের অবসান ঘটান, (৩) রাগানুগা ভক্তি মন্ত্রে জীবকে দীক্ষা দান। গ্রন্থটি অলঙ্কার ও বাগবৈদগ্ধ্যে প্রোজ্জ্বল। রচনা সমাপ্তিকাল ১৪৩৪ শকাব্দ। এছাড়া রঘুনাথ দাসের ‘গৌরাঙ্গস্তবকল্পবৃক্ষ’, ‘চৈতন্যাষ্টক’, রূপ গোস্বামী এবং সদাশিব কবিরাজের ‘বিলক্ষণ চতুৰ্দশক’ প্রভৃতি চৈতন্যবন্দনার নামোল্লেখ করা যায়।
Leave a comment