প্রশ্নঃ চেতনা প্রবাহরীতি কী? সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাসসমূহে চেতনা প্রবাহরীতি কতটুকু ক্রিয়াশীল তা আলােচনা কর।

উত্তরঃ আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের এক অন্যতম পথিকৃৎ এবং নতুন ধারার প্রবর্তক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৯২২-১৯৭১)। অসামান্য মেধা, অসাধারণ চেষ্টা, মনন ও চিন্তাচেতনার সমন্বয়ে সৃষ্ট তার উপন্যাসগুলাে বাংলা সাহিত্যে এক উজ্জলতম আসন দখল করে আছে। সমস্যা সংকুল এ পূর্ব বাংলার সমাজ বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকার জটিলতা, হিংস্রতা, ধর্মীয় ভণ্ডামি এবং তাদের অন্তঃস্থায়ী সত্তার টানা পােড়েনের নিপুণ বাস্তবতায় রূপায়িত তার উপন্যাসগুলাে। তিনি তার উপন্যাসগুলােতে নব নব তত্ত্ব ও তথ্যের সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সাহিত্যকর্মে যে তত্ত্বটি প্রধান হয়ে উঠেছে তা হচ্ছে Stream of consciousness বা চেতনা প্রবাহরীতি। আমরা আলােচ্য নিবন্ধে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাস অবলম্বনে তার রচনাতে চেতনা প্রবাহরীতি দর্শনের সৰুপ ও তার প্রয়ােগ আলােচনায় সচেষ্ট হবে।

Stream of consciousness বা চেতনা প্রবাহরীতি এক দার্শনিক প্রত্যয়, আত্মসমাহিত চেতনা থেকে উৎসারিত এক দার্শনিক প্রজ্ঞা। এই ধারায় যুক্তির শৃঙ্খলার চেয়ে অনুষঙ্গই প্রধান। পট ও চরিত্রাবলি প্রবাহিত হয় প্রধান চরিত্র পাত্রের মানসের ভিতর দিয়ে এবং তারই চেতনা প্রবাহে আভাসিত হয় সমস্ত, চুম্বন করে চলে সমস্ত কিছু এক মুহূর্তে একটি বাইরের ঘটনা মনােলােকে যেসব ভাষা অনুষঙ্গ ও স্মৃতিচূর্ণ গড়ে তােলে তারই সমাকৃতি। এই ধরনের উপন্যাস আধুনিক কালেরই আবিষ্কার প্রায় মনােবিদ্যা থেকেই পরিগৃহীত ‘অবাধ অনুষঙ্গ’ এর প্রধান চরিত্র। এই জাতীয় তত্ত্বের প্রথম স্রষ্টা একজন ফরাসি ঔপন্যাসিক ‘এদুয়াদ দুজদা’। তার উপন্যাসের নাম ‘অরণ্যে আর না’ (১৮৮৭)। পরবর্তীতে ‘জেমস জয়েস’ এবং ‘ভার্জিনিয়া উলফ’ এ ধারার আরাে সফলতার দাবিদার। বাংলা উপন্যাসে চেতনা প্রবাহরীতি আসে আরাে একটু পরে, তিরিশের ঔপন্যাসিকদের মধ্য দিয়ে। সর্ব প্রথম বাংলা উপন্যাসে এ ধারার প্রয়ােগ দেখান ‘ধূর্জটি প্রসাদ মুখােপাধ্যায়’ তার ‘অন্তশীল’ উপন্যাসে ১৯৩৫ সালে। এবং প্রায় সমকালে এ ধারার প্রয়ােগ দেখায় ‘বুদ্ধদেব বসু’ তার ‘তিথিডাের’ (১৯৪৯), ‘নির্জন স্বাক্ষর’ (১৯৫১) এবং ‘কালাে হাওয়া’ (১৯৪২) প্রভৃতি উপন্যাসে। সবমিলিয়ে বিচার করলে এই শ্রেণির লেখকদের মধ্যে এই ধারাবাহিকতার সার্থক প্রয়ােগকর্তা হিসেবে আমরা পাই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে। বিশেষ করে তার শেষ দিকের উপন্যাসে।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সমস্ত জীবনে মাত্র তিনটি উপন্যাস লিখেছেন। ১৯৪৮ সালে তার প্রথম উপন্যাস ‘লালসালু’, ১৯৬৪ সালে ‘চাঁদের অমাবস্যা’ এবং ১৯৬৮ সালে ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ প্রকাশিত হয়। ‘লালসালু’তে প্রথম অস্তিত্ববাদের সমম্বয় ঘটেছে এবং পরবর্তী উপন্যাস দুটিতে অস্তিত্বের পাশাপাশি চমৎকারভাবে স্থান পেয়েছে চেতনা প্রবাহরীতি। এমনকি এ উপন্যাস দু’টি প্রকাশের পর লেখক সর্বাধুনিক চেতনা প্রবাহরীতি প্রবক্তা হিসেবে সবার কাছে পরিচিতি লাভ করেন।

চেতনা প্রবাহরীতির ধারা মূলত দু’টি- (এক) আত্মবিশ্লেষণরীতি (Internal analysis), (দুই) অনুচ্চার মনােকথনরীতি (Interior monologue)। আত্মবিশ্লেষণরীতিতে লেখক চরিত্রের বাইরে থেকেও চরিত্রের অন্তরজগৎ দেখেন এবং প্রতিটি মুহূর্তকে ধরার চেষ্টা করেন। অন্যদিকে অনুচ্চার মনােকথনরীতিতে বর্ণনার রীতি ও দৃষ্টি কোননা কোন চরিত্রের চেতনার উপর নির্ভরশীল। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর শেষ দিকের উপন্যাস দু’টিতে এ রীতিদ্বয়ের স্বরূপ উদঘাটনে আমরা সচেষ্ট হবাে।

‘চাদের অমাবস্য’কে আমরা বলতে পারি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর চেতনা প্রবাহরীতির প্রথম ফসল। যদিও ভার্জিনিয়া উলফ এ উপন্যাসের মতাে সবিস্তারে বিধৃত হয়নি। কারণ তিনি তাদের হুবহু অনুকরণ করেননি। এই উপন্যাসে একটি ঘটনাই বাঁশঝাড়ে একটি যুবতী নারীর হত্যাকাণ্ড উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করেছে এবং সেই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জ্ঞাত আরেফ আলীর চিন্তা চেতনা যেভাবে ধরাশায়ী হয়ে উঠেছে সেটুকু তিনি তুলে ধরেছেন। যেমন-

“দুনিয়াতে নিষ্ঠুরতা, পাপ-কলুষতা আছে সে জানে এবং তার প্রমাণ বাঁশঝাড়ের মৃতদেহটি। কিন্তু সর্বত্র ছড়িয়ে নেই। আগাছার মতাে সর্বত্র জন্মায়ও না তা। তা যদি হতাে, তবে মানুষে মানুষে বিশ্বাস সম্ভব হতাে না, জীবন দুর্বিষহ হতাে, বস্তুতপক্ষে জীবনের কোনােই অর্থ থাকতাে না।”

মনােসমীক্ষণে ও চরিত্রের মনােচিত্রণে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর আগ্রহ অপূর্ব। তার অধিকাংশ ছােটোগল্পেও এরুপ | মনােবিশ্লেষণের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। তবে তার চেতনা প্রবাহরীতিতে রচিত এ কথা বলা ঠিক হবে না। সেগুলাে সাধারণ ও আংশিক মনােবিবরণ মাত্র। এদিক দিয়ে সীমিত অর্থে হলেও চাদের অমাবস্যায় তিনি রীতিতে চেতনা প্রবাহ এবং দর্শনে অস্তিত্ববাদ নিয়ে নিরীক্ষা করেছেন। যুবক শিক্ষক আরেফ আলীকে সাধারণের দৃষ্টিতে কিছুটা অস্বাভাবিক টাইপ চরিত্র মনে হলেও মূলত চেতনা প্রবাহরীতির বাহক হিসেবে লেখক তাকে উপস্থাপন করেছেন। শুরু থেকে শেষপর্যন্ত একটা বিশেষ চিন্তাচেতনা তার মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে। যুবতী নারীর মৃত্যু রহস্য, কাদেরের দরবেশ উপাধি নিয়ে সন্ধিহান, এ মুহূর্তে তার কি করা উচিত বা অনুচিত সবকিছুই যুবক শিক্ষককে যেন দগ্ধ করে সমতালে প্রবাহিত। অতএব বলা চলে প্রতি মুহুর্তের অনুভূতি এবং আত্মােপলব্ধি এবং মানস জটিলতাকে প্রকাশ করতে গিয়ে লেখকের মূল চিন্তা প্রবাহকে অতলগভীরতায় প্রকাশ করেছেন ‘চাঁদের অমাবস্যা’ উপন্যাসে।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর তৃতীয় উপন্যাস ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসে চেতনাপ্রবাহরীতির সফলতম প্রয়ােগ লক্ষ করা। যায়। ‘কাদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসে চেতনাপ্রবাহ বয়ে গেছে স্মৃতি অনুষঙ্গের সূত্র ধরে। কথক/২ এর গল্প ধরে কথক/১ এর মনে জমাট বেঁধেছে স্মৃতি এবং দু’জনে মিলে যেন সমগ্র উপন্যাসের কাহিনিটি বুনে গেছে। চেতনাপ্রবাহ রীতির উপন্যাস বলেই এ উপন্যাসের প্রকৃত বিষয় ও রসমাধুর্য স্টিমার যাত্রার বাস্তব চিত্রের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না বরং কথক দু’জনের অন্তর্লোকে বর্ণিত স্মৃতিকাহিনির গভীরে প্রকৃত স্বাদ খুঁজে পাওয়া যায়। বস্তুত চেতনা প্রবাহরীতি অবলম্বনেই এই উপন্যাসের গল্পের কাঠামাে, কাহিনি বর্ণনা, চরিত্র রূপায়ণ সবকিছুকেই তাৎপর্যময় করে তােলা হয়েছে। যেমন-

“বাকাল নদীতে চড়া পড়া ও স্টিমার চলাচল বন্ধ হওয়ার ঘটনাকে কীভাবে নিয়েছিল কুমারডাঙ্গাবাসী? আশা আকাক্ষার মূলে টান পড়লে কেমন ভাবে তাকে নেয় মানুষ?”

একজন বিব্রত ও জাগ্রত যাত্রীর মনােসংলাপ ও অন্তরস্থ স্বগতােক্তি যেভাবে উপস্থাপিত হয়েছে তাতে চেতনা প্রবাহরীতির ক্ষেত্রে প্রযােজ্য সকল উপাদান বিশেষভাবে বিদ্যমান। এ দিক দিয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর চেতনা স্রোতে আবর্তিত চরিত্রদের চিত্রণে বিশেষভাবে সার্থকতার দাবিদার। এ উপন্যাসে ঔপন্যাসিক কেন্দ্রীয় চরিত্র অন্তর্দ্বন্ধে ক্ষত-বিক্ষত মুহাম্মদ মােস্তফার মনে যে সব স্পষ্ট-অস্পষ্ট ভাবনা, অনুভূতি, স্মৃতি ও ভীতি এবং আত্মবিলুপ্তির বিশেষ বিবরণ আমাদের দিয়েছেন তাতে ব্যক্তি চেতনার অন্তঃসলিল প্রবাহের চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সজাগ মনে। ভাগ্যের তরীতে ভাসা, আঘাতে, বেদনায়, শঙ্কায়, জড়তায় আর সীমাহীন বিহবলতায় খােদেজার অত্মহত্যার জন্য বিশেষভাবে নিজেকে দায়ী মনে করা এই মুহাম্মদ মােস্তফার মনে হয় কুমারডাঙ্গার অসম্ভব ছায়ার কারণ তিনি তার অতৃপ্ত আত্মার পরবর্তী পর্বের শঙ্কা অর্থাৎ সহসা খােদেজার কণ্ঠের কান্না শুনতে পাওয়া এবং মতিভ্রম তাকে তাড়া করে চলেছে এবং শেষ পর্যন্ত আত্মহননেই আত্মমুক্তি পাবার উপায় বলে তার বােধ হয়েছে। এভাবে কথকের অন্তগূঢ় বিষয়কে আলােতে নিয়ে আসা কঠিন কাজটিতে নিঃসন্দেহে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সার্থকতার দাবিদার। আর এদিক বিচারে ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসটি যে চেতনা প্রবাহরীতির উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত সে সত্য এক বাক্যেই স্বীকার্য।

যে সমস্ত গুণে একটা উপন্যাস সার্থকতার মর্যাদায় অভিসিক্ত হয়, তার অনেকগুলাে দিকের দুর্বলতা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাসে বয়ে গেছে একথা হয়তাে অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু যে বিশেষগুণে তার উপন্যাসগুলাে শুধু বাংলা সাহিত্য নয় আজ বিশ্ব সাহিত্যেও সমাদৃত; তা হলাে পাশ্চাত্যরীতি ও দর্শনের প্রয়ােগ। বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে কথা সাহিত্য এ্যারস্ট্রাকন এর ডে সূত্রপাত হয় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাসের কাহিনি মননের প্রতি স্তরে স্তরে রয়েছে। তার সুস্পষ্ট স্বাক্ষর এক অবিভাজ্য সমগ্রতা নির্মাণ করে, বিচ্ছন্ন বিভিন্ন কুলের একত্র গ্রথিত ফুলের তােড়ার মতাে করে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ তার উপন্যাসে চেতনা প্রবাহরীতির প্রয়ােগ করেছেন।