“চেতনাগত দিক থেকে বাউলসংগীত অসাম্প্রদায়িক।”

উত্তর: মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বাউলগান বা বাউল পদাবলী বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। বাউল সম্প্রদায়ের রচিত এসব গান মূলত বাংলা মরমী দর্শন তথা সাধনতত্ত্বের বাহন। আঠারো উনিশ শতকে একদল রহস্যবাদী সাধক বাউল নামে পরিচিতি লাভ করে। তারা এই নামে একটি সম্প্রদায় বা গোষ্ঠী গড়ে তুলেছিলেন। এরা বিশেষ কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্ত নন। উনিশ শতকের বাউল সম্প্রদায়ের মধ্যে ফকির লালন শাহ্ সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে গণ্য হন। তিনি নিজেকে ঈশ্বর বা স্রষ্টার পথে সম্পূর্ণ সমর্পণ করেছিলেন। বাউলরা মুখে মুখে এক ধরনের গান রচনা করে সেগুলো সুর করে গেয়ে তাদের জীবনদর্শন ও সাধনতত্ত্বের কথা প্রকাশ করেছেন। এসব বাউলগানে অসাম্প্রদায়িক চেতনা সুন্দরভাবে প্রকাশিত হয়েছে।

বাংলাদেশের বাউল সম্প্রদায়ের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং পরিচিত বাউল লালন শাহ। তিনি ছিলেন কায়স্থ পরিবারে। সন্তান। কিন্তু বাস্তব জীবনে এ সংকীর্ণ জাতিপরিচয়ের বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন না। মনকে উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন উদার অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিশাল প্রান্তরে। লালন শাহ্ অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। জাতি-বিভাজন তিনি মানতেন না। তিনি ছিলেন বাউলদের শিরোমনি। বাউলদের মধ্যে যেমন ধর্মীয় ভেদজ্ঞান নেই তেমনি তারা জাত বা সম্প্রদায় গোষ্ঠী বিভাজনেও বিশ্বাস করে না। জাতিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে তাই লালন সাঁই বলেন:

“জাতের কিরূপ, দেখলাম এ নজরে।

সুন্নত দিলে হয় মুসলমান

নারী লোকের কি হয় বিধান?

বামন চিনি পৈতায় প্রমাণ

বামনী চিনি কি প্রকারে ॥”

বাউলদের কাছে মানবজীবনের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ তারা মনে করেন, অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার পর মানবজন্ম ঘটে। তাছাড়া পৃথিবীতে যত সৃষ্টি আছে তার মধ্যে মানুষ শ্রেষ্ঠ। তাই বাউলদের ধারণা সৃষ্টি-জগতের সকল প্রাণীসহ ফেরেশতারা বা দেব-দেবীরা পর্যন্ত মানবভজনা করে। বাউলরা তাই ধর্মের নীতিকথা তুলে মানুষে মানুষে বিভেদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। বাউলদের গানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা নানাভাবে ব্যক্ত হয়েছে। ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী প্রভৃতি বিভাজনের পরিবর্তে বাউলদের নিকট মানবধর্ম বড়ো ধর্ম। বাউল সম্প্রদায়ের প্রচারিত সংগীতগুলোয় বাঙালি জাতির নিজস্ব অসাম্প্রদায়িক চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। বাঙালির নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এরা প্রাচীনকালে নিরীহ এবং উদার মানবতাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই বাউল সম্প্রদায়ের রচিত গানগুলোও ছিল অসাম্প্রদায়িক।