চুরি (Theft): বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩৭৮ ধারায় চুরির সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এই ধারানুসারে কারো দখল হতে তার সম্মতি ব্যতিরেকে কোন অস্থাবর সম্পত্তি অসাধুভাবে গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে ঐ সম্পত্তি স্থানান্তর করলে তাকে চুরি বলা হয়।
এই অপরাধ সম্পর্কে এই ধারায় ৫টি ব্যাখ্যা সংযোজিত হয়েছে। এগুলি নিম্নরূপ-
প্রথম ব্যাখ্যাঃ কোন বস্তু অস্থাবর সম্পত্তি ব্যতিরেকে যতক্ষণ মাটির সহিত সংযুক্ত থাকে ততক্ষণ তা চুরির বিষয়বস্তু বলে গণ্য হবে না। কিন্তু মাটি হতে বিচ্ছিন্ন করার সঙ্গে সঙ্গে উহা চুরির বিষয়বস্তু হবার যোগ্য বলে বিবেচিত হবে।
দ্বিতীয় ব্যাখ্যাঃ সে একই কাজ যে উক্ত বিচ্ছিন্নতা ঘটায়, তার স্থানান্তরকরণ চুরি বলে গণ্য হতে পারে।
তৃতীয় ব্যাখ্যাঃ কোন ব্যক্তি কোন বস্তুর গতির প্রতিবন্ধক অপসারণ করলে বা একে অন্য কোন বস্তু হতে বিচ্ছিন্ন করলে উক্ত বস্তু স্থানান্তর বলে গণ্য হবে।
চতুর্থ ব্যাখ্যাঃ কোন ব্যক্তি জন্তুকে যে গতিতে হাঁটায়, সে ব্যক্তি সেই জন্তুকে অনুরূপ গতিতে না হাঁটায়ে যদি অন্য গতিতে হাঁটায়, নতুন গতিতে হাঁটানোর ফলে উক্ত জন্তু কর্তৃক স্থানান্তরিত প্রত্যেক বস্তুকে স্থানান্তর করা হয় বলে গণ্য হবে।
পঞ্চম ব্যাখ্যাঃ এই ধারায় চুরির সংজ্ঞায় সম্মতির যে বিধান রয়েছে তা স্পষ্ট বা পরোক্ষ হতে হবে এবং উক্ত সম্মতি দখলদার কর্তৃক বা যথাযথ ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি কর্তৃক হতে হবে। এ ক্ষমতা প্রদান স্পষ্ট বা পরোক্ষ হতে পারে।
উদাহরণঃ
১. ক, খ এর জমিতে অবস্থিত খ এর একটি গাছ কেটে ফেলে। খ এর সম্মতি ব্যতীত গাছটি অসাধুভাবে নিয়ে যাওয়াই তার উদ্দেশ্য। এক্ষেত্রে যে মুহুর্তে ক গাছটি নিয়ে যাবার উদ্দেশ্যে কেটেছে, সেই মুহুর্তে চুরি সংঘটিত হয়েছে।
২. ক, খ এর বাসায় গিয়ে তার টেবিলে খ এর একটি আংটি দেখে। এটা অসাধুভাবে নিয়ে যাবার উদ্দেশ্যে আংটিটি অন্যত্র লুকায়ে রাখে। এক্ষেত্রে ক আংটিটি চুরি করেছে বলা হবে।
৩. ক, খ এর কোন সম্পত্তি নিজের সম্পত্তি মনে করে সরল বিশ্বাসে খ এর দখল হতে নিয়ে যায়। এক্ষেত্রে যেহেতু অসাধুভাবে ক ওটা নিয়ে যায় নি সেহেতু তা চুরি হিসেবে গণ্য হবে না।
চুরির উপাদানঃ চুরির অপরাধ সংঘটনের জন্য নিম্নোক্ত ৫টি উপাদান আবশ্যক-
১. অসাধু অভিপ্রায়ঃ চুরির অন্যতম উপাদান হচ্ছে অসাধু অভিপ্রায়। কোন ব্যক্তি অসাধু অভিপ্রায় ব্যতিরেকে সরল বিশ্বাসে অন্যের সম্পত্তি নিজের মনে করে স্থানান্তর করলে তা চুরি হয় না। অপরদিকে নিজের জিনিস অপসারণ করলেও অসাধু অভিপ্রায়ের কারণে তা চুরি হিসেবে গণ্য হতে পারে। যেমন, ক, খ এর নিকট তার ঘড়িটি মেরামত করতে দেয়। মেরামতের পর তার প্রাপ্য ফাঁকি দেয়ার জন্য তার সম্মতি ছাড়াই ঘড়িটি নিয়ে যায়। এক্ষেত্রে অসাধু অভিপ্রায়ের জন্য তা চুরি হিসেবে গণ্য হবে।
২. অস্থাবর সম্পত্তি অপসারণঃ স্থাবর সম্পত্তি চুরি করা যায় না। তাই একটি গাছ চুরির বিষয় বস্তু হতে পারে না যতক্ষণ তা মাটির সাথে যুক্ত থাকে। কিন্তু মাটি হতে বিচ্ছিন্ন করার সাথে সাথে তা চুরির বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়।
৩. অপরের দখল হতে অপসারণঃ যে বস্তু সরানো হয়েছে তা কারো দখলে থাকতে হবে। যে বস্তু কারো দখলে নেই তা অপসারণ করলে চুরি হয় না। তাই বনের পশু, পাখী কেউ নিলে তা চুরি হয় না কিন্তু কারো পোষা প্রাণী বা পাখী নিয়ে গেলে তা চুরি হিসেবে গন্য হয়।
৪. সম্মতি ব্যতিরেকে অপসারণঃ মালিক বা দখলকারের সন্মতিতে কোন বস্তু অপসারণ করলে চুরি হয় না। এই সম্পতি প্রকাশ্য হতে পারে বা অনুমিত হতে পারে। সংশ্লিষ্ট সন্মতির অধিকারী কিংবা প্রকাশ্য বা অনুমিত ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিও এরূপ অনুমতি দিতে পারে।
৫. অসাধুভাবে নেবার উদ্দেশ্যঃ অসাধু অভিপ্ৰায় ছাড়াও উদ্দেশ্যটা অসাধু হতে হবে। আশু পদক্ষেপ হচ্ছে অভিপ্রায় কিন্তু যাকে কেন্দ্র করে এরূপ পদক্ষেপ তা হচ্ছে উদ্দেশ্য। অবশ্য অভিপ্রায় যদি অসাধু হয় তবে উদ্দেশ্যও অসাধু হিসেবে গণ্য হয়। তাই কারো হোটেলের খাবার চুরি করে যদি কেউ অভূক্ত লোকদের খাওয়ায় তার উদ্দেশ্য অসাধু না হলেও অভিপ্রায়টি অসাধু। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে উদ্দেশ্যও অসাধু হয়ে থাকে। যেমন, ক, তার পকেটে একটি কুকুরের টোপ রাখে। ফলে খ এর কুকুর তাকে অনুসরণ করতে থাকে। ক এর উদ্দেশ্য যদি খ এর সম্মতি ব্যতিরেকে কুকুরটি অন্যায়ভাবে নেয়া হয়, তবে যে মুহুর্তে খ এর কুকুর ক কে অনুসরণ করতে শুরু করেছে সেই মুহুর্তেই চুরি সংঘটিত হয়েছে বলা যায়।
Leave a comment