শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ছোটগল্প ‘চুয়াচন্দন’। চুয়া এবং চন্দন দুই যুবক ও তরুণীর প্রেম, এবং তারপরে সে সংক্রান্ত নানান ঘটনাবলীই প্রাধান্য পেয়েছে এই ছোটগল্পটিতে।
শেক্সপিয়র তাঁর ‘রোমিও এ্যান্ড জুলিয়েট’ নাটকে জুলিয়েটের মুখে সংলাপ হিসাবে মন্তব্য করেছিলেন, ‘What’s in a name ?’ কিন্তু নাম পরিচয়ের গুরুত্ব ঐ মন্তব্য সত্ত্বেও কেউ অস্বীকার করেন না। ব্যক্তিনামের ক্ষেত্রে নাম-পরিচয়টি সর্বদা ব্যক্তিত্ব চিহ্নিত না হয়ে উঠলেও সাহিত্য বিশেষত কথা সাহিত্যে নামকরণটি বস্তুত বিষয়ের মর্মবস্তুর পরিচয়জ্ঞাপক বলেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কথা সাহিত্যের নামকরণ নানা দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচিত হয়ে থাকে। প্রথমত, কথাবস্তুর কোনো প্রধান বা কেন্দ্রীয় চরিত্রের নামে গল্প-উপন্যাসের নামকরণ বহু প্রচলিত। এ ছাড়া প্লট বা ঘটনাকে ইঙ্গিত করেও বহু সময় নামকরণ করা হয়ে থাকে। আবার কোনো সংকেত বা প্রতীকী শব্দ প্রয়োগেও সাহিত্যের নামকরণ হয় বিষয়ের মর্মগত সত্যটিকে উদ্ঘাটনের জন্য।
শরদিন্দুর ‘চুয়াচন্দন’ গল্পে নায়ক ও নায়িকা যথাক্রমে চুয়া এবং চন্দন। তাদের ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে গল্পের যাবতীয় ঘটনা সুতরাং নামকরণে লেখক তাদের নাম দুটিকে প্রাধান্য দান করেছেন এটাই স্বাভাবিক।
গল্পটি ঐতিহাসিক। ইতিহাস-রসসমৃদ্ধ। এই গল্পের কেন্দ্রে রয়েছেন স্বয়ং নদিয়া নাগর নিমাই। কিন্তু তবুও গল্পটির নায়ক হয়েছে লেখকের কল্পনাপ্রসূত চরিত্র চন্দনদাস। সে বণিকতনয় এবং নিজে একজন বণিকও বটে। সে অগ্রদ্বীপের বিখ্যাত সদাগর রূপচাদ সাধুর পুত্র। চন্দনদাস বিদেশ থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য করে দেশে ফেরার সময় নবদ্বীপে বিশ্রাম নিতে অবস্থান করে এবং তখনই গল্পের মধ্যে নাটকীয়তা, উত্তেজনা, থ্রিলিং সবকিছু শুরু হয়। তার চোখ দিয়ে চুয়ার রূপ, এবং সেই রূপের অন্তরালে ম্লান মুখের বিষাদ, চাঁপার প্রতিহারীর মত চুয়াকে পাহারা দেবার ব্যবস্থা, চুয়ার এত বয়স পর্যন্ত অনূঢ়া থাকা এ সবই পাঠকদের জানিয়ে দেন গল্পকার।
এই গল্পে অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে দেখা দিয়েছে চন্দনদাস চরিত্র। সে প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের বলে বলীয়ান। বৃদ্ধা আয়ির সঙ্গে অচিরেই আলাপ জমিয়ে চুয়ার দুঃখের কাহিনী জেনে নিয়েছে। আপন ঔদার্য্যগুণে দখল করে নিয়েছে চুয়ার মন। সমাজে জাতিচ্যুত জেনেও চুয়াকে জীবনসঙ্গিনী করতে চেয়েছে। চন্দনদাস এক মুক্তপ্রাণ পুরুষ। সৎ, নিৰ্ভীক, প্রেমিক মন তার। এবং সে অমিত বলশালী যুবকও বটে। প্রবল পরাক্রমশালী মাধবকে সে ঘায়েল করে বুদ্ধি ও বীর্যের বশে। ফলে চন্দন একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। চুয়াকে উদ্ধার এবং মাধবকে বুদ্ধির বলে পরাজিত করার একমাত্র নায়ক চন্দনদাস অবশ্য এতে তার নিমাই পণ্ডিতের সাহচর্য ছিল পুরোপুরি।
নায়িকা চুয়া সক্রিয় না হলেও প্রেমধর্মে, প্রেমের প্রতি নিষ্ঠায়, সততায় নায়িকা চরিত্রের মর্যাদা পায় বৈকি।
মাধবের ও চাঁপার অত্যাচারের ভয়ে সে অন্তরালবর্তিনী। কিন্তু একটুকরো মুক্তির জন্য সে চন্দনের সঙ্গে অনিশ্চিতের পথে পা বাড়াতে চায়। তবে তার জন্য চন্দনকেও ঠিকমতো চিনে নিতে ভোলে না। যখন সে বুঝতে পারে চন্দন মাধবের মতো কোনো ক্ষতিকারক মানুষ নয় এবং যথার্থভাবেই সে চুয়াকে ভালোবাসে। তারা জাতিচ্যুত জেনেও কুসংস্কারের বেড়াজাল ছিন্ন করে উড্ডীন করে রেখেছে প্রেমের জয়পতাকা, ঠিক তখনই সে ভরসা করতে শুরু করেছে চন্দনকে। বৃদ্ধার অমূলক আশঙ্কাকে গুরুত্ব না দিয়ে তাই সে বলে- “তুমি আজ রাত্তিরে এসো। নিমাই পণ্ডিত যদি রাজী না হন, তবু তোমার ধর্মের ওপর বিশ্বাস করে আমি তোমার সঙ্গে যাব।”
এই প্রেমধর্মকে মর্যাদা দিয়েছে বলে চুয়া চরিত্রের মূল্য এতখানি। রাতের অন্ধকারে চন্দন চুপিচুপি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলে— “চুয়ার নিশ্বাসের মতো মৃদু চাপা স্বর থরথর করিয়া কাঁপিতে লাগিল; সে বলিল, “তুমি আসবে বলেছিলে, তাই আমি তোমার জন্যে সারা রাত জেগে আছি।” এ কোন সাধারণ নারীর উচ্চারণ নয়। এ যেন একজন অভিসারিকার কণ্ঠস্বর।
প্রেমিকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে চুয়া তার জীবন যৌবন চন্দনকে সমর্পণ করে পরিপূর্ণা প্রেয়সী নায়িকায় উত্তরিত হয়েছে—“চুয়া অশ্রু-আর্দ্র হাসিমুখ একবার চন্দনদাসের বুকের উপর রাখিল, অস্ফুটস্বরে কহিল—“চুয়া নয় চুয়া বউ, এই আমাদের বিয়ে।” একটা অনিশ্চিত জীবন শুরু করতে যাবার জন্য তার দ্বিধা-দ্বন্দুও কম ছিল না—“দুই হাতে পা জড়াইয়া কাঁদিয়া কহিল, “একটা কথা বলো।” চন্দনদাস চুয়ার মুখ তুলিয়া ধরিবার চেষ্টা করিতে করিতে বলিল, “চুয়া, চুয়া কি কথা?”
“বলো, আমায় বিয়ে করবে? তুমি আমায় প্রবঞ্চনা করছ না?” চন্দনদাস জোর করিয়া চুয়ার মুখ তুলিয়া তাঁহার চোখের উপর চোখ রাখিয়া বলিল, “চুয়া, আমার মায়ের নামে শপথ করছি, তোমাকে যদি বিয়ে না করি, যদি আমার মনে অন্য কোনও অভিসন্ধি থাকে, তবে আমি কুলাঙ্গার।” এতে ভবিষ্যৎ জীবনে এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে চুয়ার বিচক্ষণতা ও চন্দনের সততা প্রস্ফুটিত হয়েছে।
এইরকম নায়ক-নায়িকার নামেই নামকরণ করেছেন শরদিন্দুবাবু। ফলে এই বিখ্যাত ছোটগল্পটির নামকরণ একদিক দিয়ে দেখতে গেলে একেবারে সার্থক। নায়ক-নায়িকার চরিত্র, তাদের প্রেমের বন্ধন, বন্ধন শেষপর্যন্ত বিবাহ বন্ধনে পরিণত ও সর্বোপরি হিংসা-দ্বেষ-কুশ্রীতার বিরুদ্ধে শান্ত সুন্দর ও প্রেমের জয়গানকেই মর্যাদা দিতে গিয়ে নামকরণের গুরুত্বটিকে নায়ক-নায়িকার নামের সঙ্গে মিলকরণ করে রেখেছেন।
আর একটি দিক দিয়ে দেখতে গেলেও ‘চুয়াচন্দন’ নামকরণ সার্থক। আর এব্যাপারে আলোকপাত করতে গেলে বোঝা যায় যে নামকরণের এই ব্যানাটিকে হয়তো সজ্ঞানেই এনেছেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। নায়ক নায়িকার নামকরণের মাধ্যমে গল্পের নামকরণের থেকেও এধরনের ব্যঞ্জনার গুরুত্ব কম নয়।
নায়ক-নায়িকার নামে নামকরণের রীতি বহুল প্রচলিত। ‘চুয়াচন্দন’ গল্পের নায়িকা চুয়া, তার প্রেমিক চন্দন। জমিদারের ভাইপো মাধবের কাপালিক লীলার হাত থেকে চন্দনের চুয়া উদ্ধারের কাহিনীই এ গল্পের বিষয়বস্তু। ইতিহাস নির্ভর এই রোমান্টিক কাহিনীর নায়ক ইতিহাসের প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব নিমাই পণ্ডিত। কিন্তু নায়িকা চুয়ার দোসর যে চন্দন। তাই প্রেমাকাঙ্ক্ষিত এই যুগলমূর্তির মিলনকে অমরত্ব দান করতেই হয়তো এ গল্পের নামকরণে ‘চ’ বর্ণের অনুপ্রাস এনে প্রেমী যুগলের নাম চুয়াচন্দন সম্মিলিতভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। ‘চুয়া’ কথার আভিধানিক অর্থ হল—“চুয়াইয়া তৈয়ারী সুগন্ধ নির্যাস।” [বাংলা ভাষার অভিধান, শ্রী জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস সংকলিত ও সম্পাদিত, সাহিত্য সংসদ।]
অর্থাৎ চুয়া হল বিশিষ্ট সুগন্ধি দ্রব্য আর চন্দন হল সুগন্ধি কাষ্ঠ। সুতরাং চুয়া ও চন্দন সাজসজ্জার সামগ্রী। বৈষুবদের আরাধ্য শ্রীকৃষ্ণের অন্যতম অঙ্গরাগ চুয়াচন্দন—’কালার কপালে চাঁদ চন্দনের ঝিকিমিকি।’ স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের প্রসাধন সামগ্রীর প্রধান দুই উপকরণের অনুষঙ্গে রোমান্টিক কাহিনীতে ভগবৎ সাধনার আবহ তৈরি হয়েছে।
চুয়াচন্দনের প্রেমাকর্ষণ দেখানো লেখকের অভিসন্ধি ছিল, তাই প্রথম থেকেই তিনি চুয়াচন্দন কথাটি গল্পের সর্বত্রই প্রয়োগ করেছেন। বুড়ি ঠান্দির সঙ্গে চন্দনের আলাপ জমাবার অছিলায় ‘চুয়া’ শব্দটির প্রথম প্রয়োগ ঘটিয়েছেন লেখক সচেতনভাবে – “তাহার হঠাৎ মনে পড়িয়া গেল, তাহার মা তাহাকে নবদ্বীপ হইতে ভালো চুয়া কিনিয়া আনিতে বলিয়াছিলেন। সে-কথা সে ভুলে নাই, আজ নগর ভ্রমণের সময় কিনিয়া লইবে স্থির করিয়া ছিল; কিন্তু চুয়া কিনিবার অছিলা এমনভাবে সদ্ব্যবহার করিবার কথা এতক্ষণ তাহার মনেই আসে নাই।”
প্রথম দিকে ‘চুয়া’ কথাটি প্রেমিক চন্দনের কাছে তার প্রেয়সীর নিকটে পৌঁছবার অছিলামাত্র ছিল। তারপর আয়ি বুড়ির কাছে তার নাতনীর দুঃখের বারমাস্যা শুনে চন্দন নবদ্বীপের ঘাটে ক্ষণিক দেখা কন্যাটির প্রেমে মজ্জমান, মনে মনে তার দুঃখ মোচনের সংকল্প নিয়েছে। কিন্তু আয়ি বুড়ির সম্বোধনে যখন চন্দন-প্রেমিকা চুয়া এসে সামনে দাঁড়িয়েছে তখন বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো ঝাঁকুনি খেয়েছে চন্দন আবার মনে মনে উল্লসিত হয়েছে এই ভেবে– “সে চুয়া কিনিতে এখানে আসিয়াছে। এ কি দৈব যোগাযোগ।”
সহজিয়া সাধনার উচ্ছৃঙ্খলতা রুখতে বৈষুবীয় সাধন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন লেখক। তাই শাক্ত সাধনার প্রধান উপকরণ ‘রক্তচন্দনের বিপরীতে ‘চুয়াচন্দন’ কথাটি প্রয়োগ করে বৈষুবীয় ধর্মান্দোলনের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে চেয়েছিলেন শরদিন্দুবাবু। গল্পটির ‘চুয়াচন্দন’ নামকরণ উদ্দেশ্যগত সফলতা এনেছে। সর্বশেষে বলা যায় যে নিমাই পণ্ডিতের মধ্যস্থতায় চুয়াচন্দনের রাক্ষসমতে বিবাহ দানের মধ্যে দিয়ে ‘চুয়াচন্দন’ নামকরণ ঐতিহাসিক সফলতা লাভ করেছে।
Leave a comment