শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চুয়াচন্দন’ গল্পে অপ্রধান চরিত্রগুলি গল্পের ঘটনা সংস্থাপনে কী ধরনের ভূমিকা নিয়েছিল তা আলোচনা করো।
সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা যেমন— উপন্যাস, গল্প কিংবা নাটক প্রভৃতিতে নায়ক-নায়িকা, কিংবা প্রতিনায়ক চরিত্রের পাশাপাশি এমন কিছু গৌণ চরিত্র থাকে যাঁরা উপন্যাস, গল্প ও নাটকের ঘটনার গুরুত্ব, ঘটনাসংস্থাপন কিংবা কেন্দ্রীয় ও নায়ক চরিত্রের মর্যাদাকে আরও প্রস্ফুটিত করে। সাহিত্যের আলোচনায় এই চরিত্রগুলির ভূমিকাও কম নয়।
আলোচ্য গল্পটিতেও এমন কিছু গৌণ চরিত্র রয়েছে যাঁরা কাহিনীটির সম্যক আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চুয়াচন্দন’ গল্পটি শুধুমাত্র তাঁর লেখা অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প নয়, এটি বাংলা সাহিত্যেরও একটি বিখ্যাত ছোটগল্প। এই গল্পের নায়ক বণিক-তনয় চন্দনদাস। নায়িকা নবদ্বীপের কন্যা চুয়া। এই গল্পে এই দুই নায়ক-নায়িকার চরিত্র ছাড়াও ঐতিহাসিক চরিত্র হিসেবে গল্পে অতীব প্রাসঙ্গিক চরিত্র রূপে উঠে এসেছেন স্বয়ং নবদ্বীপের গোরাচাঁদ শচীনন্দন নিমাই পণ্ডিত।
এই তিন প্রধান চরিত্র ছাড়াও নবদ্বীপের বিখ্যাত পণ্ডিত কাণভট্ট শিরোমণি, চুয়ার পিতার মাসী বৃদ্ধা আয়ি বা ঠান্দি, জমিদারের ভ্রাতুষ্পুত্র লোভী, হিংস্র চুয়ার নির্যাতনকারী তন্ত্রসাধক মাধব, চুয়াকে পাহারাদাত্রী হিসেবে নিয়োজিত চাপা এবং পরমমমতাময়ী এক বঙ্গবন্ধু হিসেবে উঠে এসেছেন নিমাই পত্নী বিন্নুপ্রিয়া এরা সবাই এই গল্পে গৌণ চরিত্র হিসেবে গণ্য হয়ে ‘চুয়াচন্দন’ গল্পটির ঘটনার ঘনঘটাকে বাড়িয়ে তুলেছে।
গল্পটি শুরু হয়েছে আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগের নবদ্বীপের পটভূমিকায়। শ্রীচৈতন্যদেবের সমসময়ের নবদ্বীপের বিশ্বস্ত চিত্র গল্পটিতে যথাসম্ভব ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। গল্পের প্রথমেই নবদ্বীপের গঙ্গা ঘাটে ওইখানকার অধিবাসীদের নিত্যকার স্নানের দৃশ্য বর্ণিত হয়েছে। ঠিক এই সময়ই অগ্রদ্বীপের প্রসিদ্ধ বণিক রূপচাদসাধুর পুত্র চন্দনদাস বিশাল বাণিজ্যতরী নিয়ে সাগরের দিক থেকে উজানের দিকে আসার সময় নবদ্বীপের ঘাটের নিকটে এলে বিশাল জলতরঙ্গের সৃষ্টি হয় গঙ্গাবক্ষে ফলে নবদ্বীপের বিখ্যাত পণ্ডিত কাণভট্ট শিরোমণি মহাশয় ডুবে যান। পরে নিমাইয়ের তৎপরতায় তিনি বেঁচে যান।
কাণভট্ট শিরোমণি এই ঐতিহাসিক চরিত্রটি গৌণ অথচ গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ‘চুয়াচন্দন’-এ মূর্ত হয়ে উঠেছেন। তিনি গঙ্গাবক্ষে ডুবে গিয়েছিলেন। নবদ্বীপের সাহসী পণ্ডিত তরুণ নিমাই তাঁকে বাঁচান। তিনি তীরে উঠে ডুবে যাওয়ার ধাক্কা কাটিয়ে উঠে প্রথমে যে বাক্যটি বলেন তা হল—”কে-নিপাতনে সিদ্ধ? ডুবে গিয়েছিলুম-না? তুমি বাঁচালে?” এই কথাটি গল্পের ক্ষেত্রে তো বটেই, ইতিহাসের বাস্তবতায়ও এই কথাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ব্যাকরণের সন্ধির এক প্রকার নিয়ম ‘নিপাতনে সিদ্ধ’। এই প্রকার সন্ধি ব্যঞ্জন-বিসর্গ কিংবা স্বরসন্ধির মতো নিয়ম মেনে হয় না। এবং এই নিপাতনে সিদ্ধ’ তে কোনো নিয়ম খাটেও না। ব্যাকরণের এই সূক্ষ্ম মোচড়ের মধ্য দিয়ে শিরোমণি মহাশয় নিমাই পণ্ডিতের চরিত্রকে যেন সর্বসমক্ষে এনেছেন। নিমাইও কোনো নিয়মে ধরা দেয় না। যুগযুগ ধরে লালিত জাতপাতের বেড়া সে অচিরেই ভেঙে ফেলেছে। যাগ-যজ্ঞ নিয়মতন্ত্রের ধর্ম সে মানে না। প্রেম-ঔদাৰ্য্য সততাকেই নিমাই প্রাধান্য দেয় বেশি। পরবর্তীকালে তিনি শ্রীচৈতন্যদের হয়ে কণ্ঠে নিয়েছেন ‘হরিনাম’ নামক পুতধ্বনি আর অর্গলমুক্ত করেছেন পীড়নের পাথর মানুষের মন থেকে। নিয়মের জাঁতাকলে না থেকে ‘নিপাতনে সিদ্ধ’ নামের মর্যাদাকে রাখতে পেরেছেন।
শিরোমণি মহাশয়ের এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে নিমাই চরিত্রের যথার্থস্বরূপ উদ্ঘাটন ও নিমাইয়ের প্রতি তার স্নেহ এই ভাবটিও পরিস্ফুট হয়েছে। শিরোমণি বয়োজ্যেষ্ঠ এবং নবদ্বীপের অগ্রগণ্য এক পণ্ডিত কিন্তু তবুও অহংকারের জড়রাশির অন্তরাল থেকেও কনিষ্ঠ পুত্রবৎ নিমাইয়ের প্রতি স্নেহকেই উজাড় করে দিয়েছেন। ঐ ক’টি কথা যেন তার ইঙ্গিত দেয়।
শিরোমণি মশাই কনিষ্ঠ নিমাইকে তাঁর প্রাণ বাঁচানোর বিনিময়ে আশীর্বাদ দানে ধন্য করে কয়েকটি কথা বলেছেন যা ‘ঐতিহাসিক দিক দিয়ে সর্বৈব ভাবে সত্য – “বিশ্বত্তর, এতদিন জানতাম তুমি নিপাতনেই সিদ্ধ, কিন্তু এখন দেখছি প্রাণদানেও তুমি কম পটু নও। আশীর্বাদ করি, এমনিভাবে মজ্জমানকে উদ্ধার করেই যেন তোমার জীবন সার্থক হয়।”
পদস্খলিত নর-নারী, শোষিত, হতভাগ্য, নিপীড়িত মানুষ ক্লেদপঙ্কে নিমজ্জিত হয়েই ছিল। নিমাই বা শ্রীচৈতন্যদেবই তাঁদের কানে মধুর প্রেমলীলা ও হরিধ্বনি শুনিয়ে মুক্তির একটুকরো বাতাস এনে দেন। শাসকের প্রতিরোধকে প্রেমের বন্যায় ভাসিয়ে, জাতপাতের অর্গলকে ভেঙে যবন হরিদাসকে বুকে জড়িয়ে সমস্ত মজ্জমান মানুষকে যিনি পরিত্রাণ করেছিলেন তিনি নদীয়া নাগর মহাপ্রভুই। এ কথা ইতিহাস প্রসিদ্ধ। শিরোমণি মশাইয়ের এই আশীর্বচন পরবর্তী ইতিহাসের স্মারক স্বরূপ হয়ে ওঠে। এদিক দিয়ে ছোট্ট ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েও গল্পে এক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যের ধারক ও বাহকরূপে তিনি যেন উপস্থাপিত হন। শরদিন্দুর লেখনীর গুণে কাণভট্ট গৌণ চরিত্র হয়েও কাহিনীর ঘটনা সংস্থাপনের কারিগর হয়ে ওঠেন।
গল্পের নায়িকা চরিত্র চুয়া। তার পিতা কাঞ্চনদাসের মাসী বৃদ্ধা ঠানদি বা বুড়ি আয়ি তার অভিভাবিকা। গল্পের এই বৃদ্ধা চরিত্র গৌণ হলেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। চুয়ার এই ঠান্দি দোকানে বেসাতি করে জীবিকা নির্বাহ করে। চন্দনদাস তাকে প্রথম দেখতে পায় নবদ্বীপের গলির ভেতর এক দোকানেই— “আদা, মরিচ, হলুদ, চই ছোট ছোট ধামাতে সাজানো আছে; একজন বৃদ্ধা স্ত্রীলোক বেসাতি করিতেছে।”
এই বৃদ্ধা যে অত্যন্ত রসিক তাও জানিয়ে দেন গল্পকার—“যে বৃদ্ধা বেসাতি করিতেছিল, তাহার দেহ-যষ্টিতে বিন্দুমাত্র রস না থাকিলেও, প্রাণটা তাজা ও সরস ছিল।” এই ‘সরস বৃদ্ধা টি অত্যন্ত বুদ্ধিমতী ছিল। এবং চন্দনদাসকে তার বাড়ির চারপাশে ঘোরাঘুরি করতে দেখে ধরে ফেলেছিল চন্দন টুয়াকে দেখার জন্যই অধীর হয়ে উঠছে। এরপর বুড়ি আয়ি চন্দনদাসের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে তার নিবাসস্থল, ঠিকানা, জাতি, গোত্র সব জেনে নেয়। আসলে তার “একটি নাতনী আছে, আর সব মরে হেজে গেছে” এই উদ্দেশ্যেই চন্দনদাসের সব নাড়িনক্ষত্র জানা। এই নাতনী আর কেউ নয় চন্দনের দেখা হতভাগ্য চুয়া। তাই বুড়ি আয়ি বুদ্ধি করে সব জেনে নেয় নাতনীর উদ্দেশ্যেই।
চুয়াকে মায়ায় মমতায় তিল তিল করে বড়ো করে তুলেছেন বলেই বৃদ্ধা ঠান্দির দুরাচার মাধবের হাতে নাতনীকে তুলে দিতে মন চায়নি। অহোরাত্র শুধু পরিকল্পনা করেছেন কীভাবে সর্বনাশের বেড়াজাল থেকে চুয়াকে উদ্ধার করবে। নিরুপায় হয়ে একবার নাতনীকে নিয়ে পালানোর চেষ্টাও করেছিল অর্থাৎ বিপরীত পরিস্থিতির বিরুদ্ধে নিয়ত সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েও কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি। এই দুঃখের কথা সবই তিনি ভরসা করে চন্দনদাসকে বলেছেন। তাই চুয়ার সর্বনাশের আগে আকস্মিকভাবে চুয়া কিনতে আসা চন্দনদাসের আবির্ভাবকে সে কোনোভাবেই অপব্যবহার করেনি। জীবনযুদ্ধে হারতে হারতেও ঠান্দি যেন ‘A Drowning man catches at a straw’ অর্থাৎ চন্দনকে ধরে চুয়ার মুক্তির শেষ চেষ্টা করেছে এবং সফলও হয়েছে—এটাই তার জীবনের সবচেয়ে বড়ো সার্থকতা। নিমাই পণ্ডিত চুয়াচন্দনের মিল ঘটিয়েছেন ঠিকই কিন্তু ঠান্দি সেই মিলনের পরিবেশ পরিস্থিতি গড়ে দিয়েছে। সর্বোপরি চুয়াচন্দন রোমান্টিক জুটির নামের অর্থগত সামগ্রস্য প্রকাশ পেয়েছে এই ঠান্দি চরিত্রটির সান্নিধ্যে এসে। সেদিক থেকে চরিত্রটি অপ্রধান হয়েও গুরুত্বপূর্ণ।
সাহিত্যের নানা মাধ্যমে যেখানে ‘গল্প বলা’ প্রধান ভূমিকা নেয়, সেখানে নায়ক-নায়িকা চরিত্র লাগে গল্পটাকে দানা বাঁধতে গেলে আবার এদের পাশাপাশি প্রতিনায়ক চরিত্রও প্রাধান্য না পেলে গল্পের ঘনঘটা জমাট বাঁধে না। অর্জুন-যুধিষ্ঠির-এর পাশাপাশি দাপুটে দুর্যোধন বাহিনী ছিল বলেই ‘মহাভারত’-এর কাহিনী অত জমজমাট। রামায়ণ-পুরাণে দেবকল্প মানুষ চরিত্রের পাশাপাশি রাবণেরা ছিল বলেই কাহিনীর এত টান, জমিয়ে তোলা আখ্যান। এই গল্পেও সেভাবে চন্দন-চুয়া-নিমাই পণ্ডিত-এর পাশাপাশি মাধব নামে দুরাচারীর আবির্ভাব ঘটে কাহিনীর জটিলতা ও আবেশ সাসপেন্স ও থ্রিলিংধর্মী হয়েছে। গল্পে মাধবের প্রবেশ ঘটে বুড়ি আয়ির দুঃখের অতীত স্মৃতিচারণায়— “দুর্দান্ত জমিদারের মহাপাষণ্ড ভাইপো মাধবের নাম শুনিয়া দেশের লোক তো দূরের কথা, কাজিসাহেব পর্যন্ত থরথর করিয়া কাপে। রাজার শাসন-সমাজের শাসন কিছুই সে মানে না। জাতিতে ব্রাক্ষ্মণ হইলে কি হয়, স্বভাব তার চণ্ডালের মতো।….”
এহেন মাধব যে একজন ঘৃণ্য নরপিশাচ তা জানাতে ভোলেননি শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়— “তান্ত্রিক সাধনায় উত্তরসাধিকার স্থান অধিকার করিয়া কন্যার ষোল বছরের কৌমার্য সার্থক হইবে। সাধক — স্বয়ংমাধব।”
লোভী, লালসাপরায়ণ মাধব যে চুয়াকে শয্যাসঙ্গিনী করবার নিমিত্তই ষোল বছর বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করতে রাজি ছিল তা স্পষ্ট।
তন্ত্রমন্ত্র বিশিষ্ট মধ্যযুগের সমাজব্যবস্থার অঙ্গ হল এই মাধব। সমগ্র মধ্যযুগ ধরে দেখা যায় যে একদল মানুষ তান্ত্রিক সাধনাকে অবলম্বন করেই তাদের আর্থিক লোভ, নারী লোলুপতাকে চরিতার্থ করত। মাধব এই পাপিষ্ঠ অত্যাচারী মানব শ্রেণির যোগ্য প্রতিনিধি। মারধর, মদ্যাসক্তি, নারী লোলুপতা তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। সুন্দরী চুয়াকে দেখামাত্রই লোভে চক্চক্ করে ওঠে তার অন্তর।
প্রাচীনযুগে দেবদাসী প্রথা প্রচলিত ছিল। এই দেবদাসীদের দেবতার উদ্দেশে উৎসর্গ করলেও ভোগকর্তা ছিল পুরোহিত ও সাধকগণ। মাধব শক্তিসাধনার সাধক, তার ওপর আবার জমিদারের ভাইপো সুতরাং চুয়ার ওপর তার অধিকার সবার আগে। ক্ষমতার অপব্যবহার সে যুগের সামাজিক লক্ষণ। এ গল্পও তার ব্যতিক্রম নয়। অত্যাচারী মাধবের কানে যখন খবর পৌঁছায় যে ঠান্দির এক দূর সম্পর্কের নাতি আনাগোনা করছে চুয়ার আশেপাশে, তখন মাধব ‘শিকার’ হাতছাড়া হবার ভয়ে সদলবলে এসে উপস্থিত হয়েছে চুয়ার বাড়িতে। সেখানে বাক্বিতণ্ডার পরেই খণ্ডযুদ্ধ বেঁধে গেছে, চন্দনের এক ঘুসিতেই মাধব ধরাশায়ী। সবচেয়ে মজার কথা হল এত দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী মানুষ মাটিতে পড়ে গিয়ে আস্ফালনই করেছে। শত্রুকে তাড়া করেও চন্দনের প্রত্যুৎপন্নমতির কাছে হেরে গেছে সে। গল্পকার মাধব চরিত্রের এই নিষ্ফল আস্ফালনের মধ্য দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন মিথ্যাচারী, পাপিষ্ঠ ব্যক্তি দৈহিক শক্তিতে ও বুদ্ধির যুদ্ধে সততই পরাজিত। মাধবের দুরাচারকে নিষ্ক্রিয় করতে ‘দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন’—এই আপ্তবাক্যকেই নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন শরদিন্দুবাবু। মাধব পাপী, লোভী, মদ্যপ, অসৎ চরিত্র ঠিকই কিন্তু নিষ্ক্রিয় নয়। গল্পের কথাশরীরে মাধবের দুরাচারের পাপাতঙ্ক বজায় রেখে কাহিনীকে টান টান উত্তেজনায় বেঁধে রেখেছে। ফলে চরিত্রটি পাপী অসাধু শয়তান গোত্রীয় হয়েও অসম্ভব গুরুত্বও পেয়েছে।
চন্দনদাস যখন বাণিজ্যতরী থেকে নেমে নবদ্বীপ নগরটি ঘুরে ঘুরে দেখছিল ঠিক তখনই চুয়াকে গঙ্গার ঘাটে স্নান করতে যেতে দেখে এবং তার সঙ্গে ‘সঙ্গিনী স্ত্রীলোক’-কেও দেখেছিল। তার রূপটি গল্পে শরদিন্দুবাবু এভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন—“মেয়েটির সঙ্গে যে সহচরী রহিয়াছে, তাহাকে সহচরী না বলিয়া প্রতিহারী বলিলেই ভালো হয়। সে যেন চারিদিক হইতে তাহাকে আগলাইয়া চলিয়াছে। তাহাকে দেখিলেই বুঝা যায়, বিগত যৌবনা ভ্রষ্টা স্ত্রীলোক। আঁটসাঁট দোহারা গঠন, গোলাকৃতি মুখ, কলহপ্রিয় বড় বড় দুইটা চোখ যেন সর্বদাই ঘুরিতেছে।” এই ‘বিগতযৌবনা ভ্ৰষ্টা স্ত্রীলোক’-বৃদ্ধা ঠান্দির সম্বোধনে জানা যায় তার নাম চাপা। এই চাপা-ই মাধবের কথামতো বৃদ্ধা ও তার নাতনী চুয়াকে পাহারা দেয়। এই চরিত্রটির অবস্থান সংক্ষিপ্ত। কিন্তু স্বভাব বৈগুণ্যে উল্লেখ্য চরিত্র এটি। মাধবের দাসী হবার সুবাদে চাঁপা, চুয়াকে মাধবের শয্যাসঙ্গিনী হবার অন্যতম ষড়যন্ত্রী। যেমন—বিশ্রী তার চেহারা তেমনি খারাপ তার স্বভাব। গল্পকার নিজেই বলেছেন—’বিগত যৌবনা স্রষ্টা স্ত্রীলোক’।
চুয়া, চুয়ার ঠান্দি, চৈতন্যঘরণী বিন্নুপ্রিয়া চরিত্র অঙ্কন করে নারীত্বের চিরন্তন গৌরবকে মহিমান্বিত করেছেন শরদিন্দু। অপর দিকে চাঁপা চরিত্র উপস্থাপনা করে নারীত্বের নেতিবাচক দিকগুলি উদ্ঘাটন করে নারী চরিত্রের বৈপরীত্য দেখিয়েছেন।
গল্পে কেবলমাত্র উল্লেখের মধ্যে দিয়ে চৈতন্য-পত্নী বিষ্ণুপ্রিয়ার শান্ত, নম্র, ত্যাগ, তিতিক্ষার মূর্তিময়ী রূপটির আভাস আমরা পেয়ে যাই। প্রথর মধ্যাহ্নে চন্দনদাস নিমাইয়ের বাড়িতে এসে আলোচনা করে, সে অভুক্ত শুনে নিজের মধ্যাহ্ন ভোজের থালা পতির অনুরোধে জলের ছড়া দিয়ে আসন পেতে আদর করে অতিথিকে আপ্যায়ন করেছেন। নিজে অভুক্ত অবস্থায় কেবল জল খেয়ে কাটিয়েছেন। অতিথিপরায়ণা, পতিব্রতা এই নারী যুগে যুগে নমস্যা। বাঙালি সতী লক্ষ্মী রমণীর স্বভাব বৈশিষ্ট্যের প্রতি আলোকপাত করতেই বোধহয় এই গল্পে শরদিন্দুবাবুর বিষ্ণুপ্রিয়া চরিত্রসৃষ্টি। ক্ষণিকের আবির্ভাবেই কাহিনীটি তাঁর দ্যুতিতে আলোকিত হয়ে উঠেছে। গল্পের একটি অংশে বিষ্ণুপ্রিয়ার এই অত্যুজ্জ্বল ছবিটি ধরা পড়ে স্বয়ং নিমাই-এর দৃষ্টির মধ্য দিয়ে—“এই নীরব কর্মপরায়ণা অনাদৃতা বধূটি ক্ষণকালের জন্য নিমাই পণ্ডিতের মন হইতে লক্ষ্মীদেবীর স্মৃতি মুছিয়া দিল।”
‘চুয়াচন্দন’ গল্পটি এইভাবেই নানান গৌণ চরিত্রের ও নায়ক-নায়িকা চরিত্রের সমন্বয়ে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। গল্পের ঘটনার সংস্থাপনে মুখ্য চরিত্রগুলির পাশাপাশি গৌণ চরিত্রগুলির গুরুত্বও কিছুমাত্র কম নয়। মাধব, বৃদ্ধাঠান্ন্দি, চাপা, বিষ্ণুপ্রিয়া সর্বোপরি কাণভট্ট মহাশয়ের উজ্জ্বল উপস্থিতি ‘চুয়াচন্দন’কে বিশিষ্ট গল্পে উত্তোলিত করেছে।
Leave a comment