‘চুয়াচন্দন’ গল্পটি যেন পাঁচশত বছর পুরোনো নবদ্বীপের ইতিহাসের একটুকরো ধূসর পৃষ্ঠা-আলোচনা করো।

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিহাসরস সমৃদ্ধ কাহিনী রচনায় সিদ্ধহস্ত। বঙ্কিমচন্দ্রের পরে এক্ষেত্রে তিনিই নিজ প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর ‘কালের মন্দিরা’, ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ’, ‘গৌড়মল্লার’, ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ প্রভৃতি উপন্যাসে এবং ‘অমিতাভ’, ‘রক্তসন্ধ্যা’, ‘মরু ও সংঘ’, ‘শঙ্খকঙ্কন’, ‘চুয়াচন্দন’ প্রভৃতি ছোটগল্পে শরদিন্দুর মুনশিয়ানা ইতিহাসের ধূসর পৃষ্ঠাগুলি রঙীন বর্ণময় হয়ে উঠেছে।

‘চুয়াচন্দন’ ঐতিহাসিক গল্প। বাংলার ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণ গল্পটিতে মূর্ত হয়ে উঠেছে। প্রায় পাঁচশত বৎসর পূর্বের নবদ্বীপের ঘটনা বর্ণিত গল্পে। ঐতিহাসিক চরিত্র নিমাই পণ্ডিত অর্থাৎ শ্রীচৈতন্য গল্পটির অন্যতম প্রধান চরিত্র এবং ধারকও বটে। গল্পটি বলতে গিয়ে শরদিন্দু সমাজচিত্রের কিছু কিছু টুকরো ছবি মাঝে মাঝেই তুলে ধরেছেন পাঠকের সামনে। শ্রীচৈতন্য অর্থাৎ নিমাইয়ের প্রসঙ্গ আসা, চুয়ার ঘটনা এবং চন্দনের অবস্থা সবেতেই সমাজচিত্রের এক একটি দিক উন্মোচিত হয়েছে। নবদ্বীপের তৎকালীন অবস্থা, সংস্কার, ধর্মান্ধতা, নিমাই পণ্ডিতের মহত্ত্ব সবকিছুকেই পরিস্ফুট করার মধ্য দিয়ে শরদিন্দু দেখান তৎকালীন বাংলাদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক রাজনৈতিক অবস্থা। আমাদের সামনে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হল অতীত বাংলার ইতিহাসের জীর্ণ অথচ উজ্জ্বল এক পৃষ্ঠা।

যে ‘কৌতুকপ্রদ অভিনয়ের মধ্য দিয়ে গল্পের কাহিনীর সূচনা। সেই কাহিনীর প্রেক্ষাপট নবদ্বীপের স্নানঘাট। এবং লেখক যে প্রাচীন বাংলার কাহিনী বুনতে শুরু করেছেন এই গল্পে তাও গল্পটির প্রথমার্ধে জানিয়ে দেন – “যে যুগের কথা বলিতেছি, তাহা আজ হইতে চারি শতাব্দীরও অধিককাল হইল অতীত হইয়াছে।”

প্রাচীন বাংলার নবদ্বীপই লেখকের গল্পের পটভূমি। তিনি লিখেছেন— “ভাগীরথীর পূর্বতটে নবদ্বীপ। স্নানের ঘাটও অতি বিস্তৃত—এক গঙ্গাঘাটে লক্ষ লোক স্নান করে।”

গঙ্গাঘাটের এই বিস্তৃতি সম্পর্কে এই ধারণাই আছে, অত্যন্ত বিশ্বস্ত চৈতন্যজীবনীকাব্য ‘চৈতন্যভাগবত’-এ। এ কাব্যের লেখক বৃন্দাবন দাস বলেছেন—

“নবদ্বীপ সম্পত্তি কে বর্ণিবারে পারে। 

এক গঙ্গাঘাটে লক্ষ লোক স্নান করে।।”

স্নান-ঘাট অতি বিস্তৃত হওয়া এবং যেখানে লক্ষ লোকের নিত্যদিন স্নান সমাপন করার মধ্য দিয়ে ষোড়শ শতকে নবদ্বীপ যে একটি বিখ্যাত জনপদ হিসেবে গড়ে উঠেছিল এবং সারাদেশে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। তার একটা ইঙ্গিত সুস্পষ্টভাবে পাওয়া যায়।

গল্পের শুরুতেই লেখক বাংলার তৎকালীন রমণীদের বেশভূষা ও সাজসজ্জার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সেকালে বাঙালি মেয়েদের বক্ষাবরণী পরবার রীতি ছিল না তাও উল্লেখ করেছেন গল্পকার–“সেকালে বাঙালী মেয়েদের দেহলাবণ্য গোপন করিবার সংস্কার বড় বেশি প্রবল ছিল না; গৃহস্থ কন্যাদের কাঁচুলি পরিবার রীতিও প্রচলিত হয় নাই।”

একটা কথা এখানে প্রাসঙ্গিক—ভারতবর্ষে প্রাচীনকাল থেকে নারীরা পুরুষের সম মর্যাদার অংশীভূত ছিলেন। মুসলিম আক্রমণের পর থেকে হিন্দু রমণীরা ধীরে ধীরে পদার্নসীন হয়ে পড়েন, নিজেদের ধর্ম ও দেহগত পবিত্রতার সংস্কার, মর্যাদা ও সম্মান রক্ষার্থেই তাঁরা নিজেদের দেহকে অবগুণ্ঠনের আড়ালে নিয়ে গেলেন। মুসলমান রমণীরাও পর্দানসীনই ছিলেন। ফলে ওঁদের সংস্কৃতির একটা ছোঁয়া এসে লাগাটা আশ্চর্যের কিছু নয় যে সময়ের কথা গল্পে বর্ণিত তখন বাংলাদেশে ‘রাজশক্তি পাঠানের হাতে’ হলেও প্রাচীন ভারতীয় আচার রমণীদের মধ্যে কিছুটা প্রকট থাকার দরুনই তাঁরা ‘দেহলাবণ্য গোপন করিবার সংস্কার’কে তখনও মজ্জায় গ্রহণ করতে পারেননি। নারীদের বেশভূষা ও সাজপোশাক পরবার ধরনের একটুকরো ছবিকে তুলে ধরে তৎকালীন সমাজের চিত্রকে খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন শরদিন্দুবাবু।

গল্পের প্রথমেই শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তৎকালীন সমাজ ও ইতিহাস চেতনার একটা আভাস দিয়েছেন—“তখন বাংলার ঘোর দুর্দিন যাইতেছিল। রাজশক্তি পাঠানের হাতে ধর্ম ও সমাজের বন্ধন বহুযুগের অবহেলায় গলিত রজ্জু বন্ধনের ন্যায় খসিয়া পড়িতেছে। দেশও যেমন অরাজক, সমাজও তেমনি বহুরাজক।”

নিমাই পণ্ডিতের সমসাময়িক সময় গল্পের উপজীব্য। সেই সময় বাংলার শাসনভার পাঠানের হাতে ছিল অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষেরা তখন অত্যাচারিত ও নিপীড়িত হচ্ছিল। বাংলার শাসনকর্তা ছিলেন সৈয়দ হোসেন শাহ। হোসেনশাহী বংশের রাজত্বকালেই শ্রীচৈতন্যের প্রভাব বেড়ে ওঠে। বাংলাদেশে এই বিধর্মীর শাসনে যে অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তার দিকেও অঙ্গুলী সঙ্কেত করেছেন গল্পকার। বিভিন্ন জনপদে বহুরাজকে শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই গল্পে আমরা যেমন দেখতে পাই প্রভাব প্রতিপত্তিশালী জমিদার ও তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র মাধব সর্দারকে।

প্রায় পাঁচশত বৎসর পূর্বের বাংলাদেশের সামাজিক পরিস্থিতি যে ধর্মতন্ত্রের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ক্লেদাক্ত বিষময়তার মধ্যে আবদ্ধ ছিল তা অত্যন্ত বিশ্বস্তভাবে তুলে ধরেছেন লেখক। “ধর্ম ও সমাজের বন্ধন বহুযুগের অবহেলায় গলিত রজ্জু বন্ধনের ন্যায় খসিয়া পড়িতেছে।….মৃত বৌদ্ধধর্মের শবনিগলিত তন্ত্রবাদের সহিত শাক্ত ও শৈব মতবাদ মিশ্রিত হইয়া যে বীভৎস বামাচার উত্থিত হইয়াছে তাহাই আকণ্ঠ পান করিয়া বাঙালী অন্ধ-মত্ততায় অধঃপথের পানে স্খলিতপদে অগ্রসর হইয়া চলিয়াছে। সহজিয়া সাধনার নামে যে উচ্ছৃঙ্খল অজাচার চলিয়াছে, তাহার কোনও নিষেধ নাই। কে কাহাকে নিষেধ করবে? যাহারা শক্তিমান, তাহারাই উচ্ছৃঙ্খলতায় অগ্রবর্তী। মাতৃকাসাধন, পঞ্চ মকার উদ্দাম নৃত্যে আসর দখল করিয়া আছে। প্রকৃত মনুষ্যত্বের চর্চা দেশ হইতে যেন উঠিয়া গিয়াছে।”

বাংলার এই চরম সাংঘাতিক দিনে গল্পের সূচনা। হীন অন্ধতায় বাঙালি জাতি সমাচ্ছন্ন। আমরা জানি অন্ধতায় আবদ্ধ এই বাঙালি জাতিকেই আলোর পথযাত্রী করে তুলেছেন শ্রীচৈতন্য বা মহাপ্রভু। নিপীড়নের অর্গলকে ভেঙে প্রেমের বন্যা বইয়ে দিলেন তিনি। জাত-পাতের বেড়া ভেঙে, সংস্কারের অন্ধতাকে দূরীভূত করে প্রেমরসে মজিয়ে দিলেন বাঙালিকে। কিন্তু গল্পকার নিজেই স্বীকার করেছেন— “নদের নিমাই তখনও ব্যাকরণের টোলে ছাত্র পড়াইতেছেন ও নানাপ্রকার ছেলেমানুষি করিতেছেন। তখনও সেই হরিচরণশ্রুত প্রেমের বন্যা আসে নাই—বাঙালীর ক্লেদ কলুষিত চিত্তের বহু শতাব্দী সঞ্চিত মলামাটি সেই পৃত প্রবাহে ধৌত হইয়া যায় নাই।”

নিমাই তখন ঈশ্বরপুরীর কাছে দীক্ষা নিলেও কেশবভারতীর কাছে সন্ন্যাসধর্মে দীক্ষা নিয়ে শ্রীচৈতন্যদেব হয়ে ‘কলুষিত চিত্তের বহু শতাব্দী সঞ্চিত মলামাটি’ ধৌত করে দিতে পারেননি। কিন্তু তার আভাস দিয়েছেন। চুয়া উদ্ধার এবং চন্দনের সঙ্গে বিবাহ দেবার কাজে তিনি সাহায্য করেছেন চন্দনকে। আর্তকে উদ্ধার ও সং কার্যে সাহায্য করে ঔদার্যের পরিচয় দিয়ে মহাপ্রভুর পরবর্তী কর্মের ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন নিমাই পণ্ডিত।

“মৃত বৌদ্ধধর্মের শবনির্গলিত তন্ত্রবাদের সহিত শাক্ত ও শৈব মতবাদ মিশ্রিত হইয়া যে বীভৎস বামাচার উত্থিত” হয়েছিল তা নিয়ে আমরা একটু আলোচনা করব— ‘বাংলার তন্ত্রসাধনা’ শীর্ষক প্রবন্ধে (উদ্বোধন ১০০ : শতাব্দী জয়ন্তী নির্বাচিত সংকলন) স্বামী হিরন্ময়ানন্দ বলেছেন যে—প্রাচীন ভারতে যাগ, যজ্ঞ, ক্রিয়া, মতবাদ, তত্ত্ব, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয় বোঝানোর জন্য ‘তন্ত্র’ শব্দের প্রয়োগ করা হয়েছে। সাংখ্য দর্শনের গ্রন্থাদির নাম ছিল ‘ষষ্ঠিতন্ত্র শাস্ত্র’। সেইভাবে ন্যায়তন্ত্র, ধর্মতন্ত্র, ব্রয়তন্ত্র প্রভৃতির উল্লেখ প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে পাওয়া যায়। কিন্তু কালক্রমে ‘তন্ত্র’ শব্দের সংকীর্ণতর ক্ষেত্রে প্রয়োগ দেখা যায়।

স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ বহু মনীষীর মতে বৌদ্ধরাই তন্ত্রের স্রষ্টা। হিন্দু সমাজ চিরদিনই বহিঃসংস্পর্শব্যাবর্তক। কাজেই হিন্দুধর্মের বা সমাজের মধ্যে আর্যেতর মতের অনুপ্রবেশ সহজসাধ্য ছিল না। কিন্তু নবীন বৌদ্ধধর্ম ছিল প্রচারধর্মী। বহু নব নবজাতি তাদের আচার ব্যবহার, সংস্কৃতি পরিবহন করে বৌদ্ধধর্মে অনুস্যূতি লাভ করে। এই সুযোগে তাতার, মঙ্গল প্রভৃতি জাতিও বৌদ্ধধর্মের কুক্ষিগত হয়। নবদীক্ষিত এইসব অনার্যজাতির বহু আচার ব্যবহার এইভাবেই বৌদ্ধধর্মে প্রবেশ লাভ করে।

বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠা নৈতিকতার দৃঢ়ভূমির ওপর। সর্বপ্রকার গুহ্যসাধন বা বিস্তৃতি লাভাদির বিরোধী ছিল এই ধর্ম। কিন্তু বহির্ভাবধারার অনুস্যুতির ফলে নানা ক্রিয়াকলাপ, বিভৃতি প্রভৃতির অনুপ্রবেশ বৌদ্ধধর্মে ঘটে। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীর গ্রন্থ ‘মঞ্জুশ্রীমূলকল্প’ পাঠে দেখা যায় কীভাবে ক্রিয়াকলাপাদি ধীরে ধীরে বৌদ্ধধর্মে প্রবেশ করেছিল।

এ ছাড়া খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে বৌদ্ধসঙ্ঘের ভিতর ‘একাভিপ্পায়ী’ বলে একটি মতবাদের অভ্যুত্থান হয়। বুদ্ধশিষ্য আনন্দের আবেদনে বুদ্ধদেব ইচ্ছার বিরুদ্ধে সঙ্ঘে নারীজাতির স্থান দিয়েছিলেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কঠিন বিধিনিষেধের দ্বারা সঙ্ঘস্থ স্ত্রী-পুরুষের মেলামেশাকে নিয়ন্ত্রিতও করেছিলেন। তৎসত্ত্বেও প্রকৃতির সহজপ্রবণতা বিধি-নিষেধের দ্বারা অবদমিত হয়নি। এরই ফলে এবং নবদীক্ষিত জাতিসমূহের অনৈতিক প্রথার সংমিশ্রণে একাভিপ্পায়ী মতের উদ্ভব। এই মতবাদে স্ত্রী-পুরুষের সাহচর্যে নিশাকালে নানারূপ গুহ্য সাধনার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের বৌদ্ধগ্রন্থ গুহা সমাজতন্ত্রে বামাচার তন্ত্রের সকল লক্ষণই পাওয়া যায়। এর অষ্টাদশ অধ্যায়ে প্রজ্ঞাভিষেকের উল্লেখ আছে। এই প্রজ্ঞাভিষেকের মূলকথা শক্তিগ্রহণ। গুরু, শিষ্যের অভিলষিতা সুন্দরী, যোগপরিদর্শিনী শক্তির সঙ্গে শিষ্যকে মিলিত করবেন। এই বিদ্যাগ্রহণ বা শক্তিগ্রহণ ব্যতিরেকে বুদ্ধত্ব প্রাপ্তির অন্য উপায় নেই।

যখন বৌদ্ধধর্ম ধীরে ধীরে হিন্দুধর্মের সঙ্গে মিলিত হয়েছিল তখন পূর্বোক্তহীন বৌদ্ধতান্ত্রিক আচার হিন্দুধর্মে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে হিন্দুতন্ত্রের সৃষ্টি করেছিল।

তন্ত্রসাধনার এই ইতিহাসটিই গল্পে প্রযুক্ত হয়েছে। গল্পের মাধব চরিত্র এই তন্ত্রমন্ত্রের সাধক। মাধব যে হীন পাষণ্ড ও বামাচারী সাধক তার প্রমাণ মেলে শরদিন্দুবাবুর লেখনীতে— “কেহ কেহ লুকাইয়া পাপাচরণ করে। কিন্তু ধর্ম ও সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়া পাশবিক বলে প্রকাশ্যভাবে পাপানুষ্ঠান করিতে যাহারা অভ্যস্ত, তাহাদের অপরাধ ক্লান্ত জীবনে এমন অবস্থা আসে, যখন কেবলমাত্র রমণীর সর্বনাশ করিয়া আর তাহারা তৃপ্তি পায় না। তখন তাহারা পাপাচারের সহিত ধর্মের ভণ্ডামি মিশাইয়া তাহাদের দুষ্কার্যের মধ্যে একপ্রকার নতুন রস ও বিলাসিতা সঞ্চারের চেষ্টা করে।”

মাধব যে এই শ্রেণীর একজন অতি হীন কদর্য ব্যক্তি তা স্পষ্টই বলে দেন গল্পকার—“মাধব এই শ্রেণির পাপী”।

গল্পকার স্বীকার করে নিয়েছেন বৌদ্ধধর্মের শবনিগলিত তন্ত্রবাদের সঙ্গে শাক্ত ও শৈব মতবাদ মিশ্রিত হয়ে ‘বীভৎস বামাচার’-এর সৃষ্টি হয়েছিল।

এক্ষেত্রে স্বামী হিরন্ময়ানন্দের যে ব্যাখ্যা তা হল—শিবতত্ত্ব ও শক্তিতত্ত্ব বস্তুগত পৃথক নয়। শিবতত্ত্বকে বলা হয় উন্মনীশক্তি—“যত্রগত্বা তু মনসো মনস্ত্বং নৈব বিদ্যতে”—যেখানে গিয়ে মনের মনত্ব থাকে না। সেখানে অহম্ বোধমাত্র থাকে। আর শক্তিতত্ত্বের নাম সমনীশক্তি—“মনঃ সহিতত্বাংসমনা”—মনের সঙ্গে যা থাকে।

উপরিউক্ত যে শিবতত্ত্ব ও শক্তিতত্ত্বের কথা বলা হয়েছে তাই অবলম্বন করে শাক্তমতবাদ এবং শক্তির পূজা প্রতিষ্ঠিত। বাংলার তন্ত্রসাধক তাই কালীকুলের সাধক।

“ভারতের শক্তিসাধনা ও শাক্তসাহিত্য” নামক শশিভূষণ দাশগুপ্ত প্রণীত বিখ্যাত গ্রন্থে কালীপূজার ইতিহাস ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন—“বাংলাদেশে কালীপূজার ইতিহাস আলোচনা করিলে দেখিতে পাই, কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ সঙ্কলিত সুপ্রসিদ্ধ ‘তন্ত্রসার’ গ্রন্থে কালীপূজার বিধান সংগৃহীত হইয়াছে।”

এই কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ ব্যক্তিটি যে চৈতন্যদেব-এর সমসাময়িক কিংবা তাঁর পরবর্তীকালের একজন তাও বলেছেন শশিভূষণ দাশগুপ্ত—“প্রচলিত মতে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশকে চৈতন্যদেবের সমসাময়িক মনে করিয়া ষোড়শ শতকের লোক বলিয়া ধরা হয়। কিন্তু পণ্ডিতগণ এই কালকে স্বীকার করেন না; তাঁহারা কৃষ্ণানন্দের ‘তন্ত্রসার’ নামক তন্ত্রশাস্ত্রের সার সঙ্কলন গ্রন্থকে পরবর্তীকালের গ্রন্থ বলিয়া মনে করেন।”

গল্পের মাধব যে তন্ত্রমন্ত্র এবং শাক্তসাধক তা বুঝিয়ে দেন লেখকই—“আগামী অমাবস্যার রাত্রিতেই চুয়াকে দৈবকার্যে উৎসর্গ করিতে হইবে—সেজন্য যেন সে প্রস্তুত থাকে। অনুষ্ঠানের যাহাতে কোনও ত্রুটি না হয়, এজন্য মাধব নিজেই সমস্ত বিধান দিয়া গিয়াছে। অমাবস্যার সন্ধ্যার সময় চুয়া গঙ্গার ঘাটে গিয়া স্নান করিবে; স্নানান্তে রক্তবস্ত্র, জবামাল্য ও রক্তচন্দনের ফোঁটা পরিয়া ঘাট হইতে একেবারে সাধনস্থলে অর্থাৎ উদ্যান বাটিকায়। উপস্থিত হইবে। সঙ্গে ঢাক-ঢোল ইত্যাদি বাজিতে বাজিতে যাইবে।”

তন্ত্রসাধকদের জন্য যে সকল আচার নির্দিষ্ট হয়েছে তা কুলানবতন্ত্রের মতে সাতটি—(১) বেদাচার, (২) বৈয়াবাচার, (৩) শৈবাচার, (৪) দক্ষিণাচার, (৫) বামাচার, (৬) সিদ্ধাস্তাচার, (৭) কৌলাচার।

এগুলির মধ্যে প্রথম ৪টি বেদপর এবং শেষ তিনটি আচার অবৈদিক ভাবপূর্ণ। সাধারণত প্রথম চারটি আচার হিন্দুধর্মের বিশেষ করে বাংলাদেশের মর্মে মর্মে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে বাঙালির ধর্মসাধনাকে প্রাণবন্ত করেছে।

কিন্তু বামাচার প্রভৃতি—যা গোপনে অনুষ্ঠিত প্রক্রিয়াদির সহযোগে অনুষ্ঠিত হয়—তা অনৈতিক ভিত্তিভূমির উপর স্থাপিত। এই সকল আচারে পঞ্চ ‘ম’ কারে অনুষ্ঠানে মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা এবং স্বকীয়া বা পরকীয়া স্ত্রীগ্রহণ করা হয়।

স্বামী বিবেকানন্দ এক জায়গায় বলেছেন— “যে জঘন্য বামাচার তোমাদের দেশকে নষ্ট করে ফেলছে অবিলম্বে তা ত্যাগ কর। তোমরা ভারতবর্ষের অন্যান্য স্থান দেখনি। দেশের পূর্বসঞ্জিত জ্ঞানের যতই বড়াই কর না কেন, যখন আমি দেখি আমাদের সমাজে বামাচার কী ভয়ানকরূপে প্রবেশ করেছে, তখন উহা আমার অতি ঘৃণিত নরকতুল্য স্থান বলে বোধ হয়। এই বামাচার সম্প্রদায় আমাদের বাংলাদেশের সমাজকে ছেয়ে ফেলেছে আর যারা রাত্রে বীভৎস ব্যভিচারে লিপ্ত থাকে তারাই আবার দিনের বেলা উচ্চকণ্ঠে আচারের কথা বলে।”

আমরা ‘চুয়াচন্দন’ গল্পটিতেও মাধবের ক্ষেত্রে বিবেকানন্দের কথার সত্যতাকেই ফুটে উঠতে দেখেছি। মাধব জমিদারের ভ্রাতুষ্পুত্র, সমাজে গণ্যমান্যদের একজন কিন্তু সেই আবার হীন বামাচারী তন্ত্রসাধক। চুয়ার রূপে মোহিত হয়ে সে তাকে পাবার জন্য বামাচারী সাধনার পথে এগোতে থাকে— “মাধব বলিল, এ মেয়ের বিবাহ দেওয়া হইবে না, ইহাকে দৈবকার্যের জন্য মানত করিতে হইবে। ষোল বছর বয়স পর্যন্ত কুমারী থাকিবে, তারপর মাধব আসিয়া তাহাকে লইয়া যাইবে। তান্ত্রিক সাধনায় উত্তরাধিকার স্থান অধিকার করিয়া কন্যার ষোল বছরের কৌমার্য সার্থক হইবে।”

এই তন্ত্র সাধনা যে হীন বামাচারী নারীসঙ্গলিঙ্গা তা বুঝতে কারও বাকি থাকে না—“তান্ত্রিক সাধনার গূঢ় মর্মার্থ বুঝিতে কাহারও বাকি রহিল না।”

সহজিয়া সাধনার উচ্ছৃঙ্খলতা রুখতে বৈয়বীয় সাধন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন লেখক। তাই বামাচারী মাধবের বিরুদ্ধে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন প্রেমধর্মের প্রতিভূ নিমাই। আর্ত অনাথা নারীকে প্রেমের স্বাদে বলবর্তী করে চন্দনের দয়িতা করে তুলেছেন লেখক। হীন কুৎসিৎ আচারের বিপরীতে প্রেমধর্মের জয়ধ্বজাকে উড্ডীন করেছেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। শাক্তসাধনার প্রধান উপকরণ রক্তচন্দনের বিপরীতে চুয়াচন্দন কথাটি প্রয়োগ করে বৈষুবীয় ধর্মান্দোলনের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে চেয়েছিলেন শরদিন্দুবাবু।

সেকালে বাঙালিরা যে ব্যবসা বাণিজ্যে অত্যন্ত গরিমার অধিকারী ছিলেন তা আমরা ‘মনসামঙ্গল’-এর চাঁদ সদাগর ও ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এর ধনপতি সদাগরের আখ্যানের মধ্য দিয়ে জানতে পারি। বাঙালি বানিয়ারা যবদ্বীপ সিংহল প্রভৃতি দেশে যেতেন আমদানী রফতানি করার জন্য। এই গল্পেও চন্দনদাস বিদেশ থেকে ব্যবসা বাণিজ্য করেই বঙ্গদেশের অগ্রদ্বীপে ফিরছিল, পথিমধ্যে নবদ্বীপে বিশ্রামের জন্য নৌকার নোঙর ফেলে। চন্দনের প্রথম পরিচয়েই লেখক বাঙালির ব্যবসায়ী ও সওদাগরী দিকটির প্রতি অঙ্গুলী সঙ্কেত করেছেন—“চন্দনদাস অগ্রদ্বীপের প্রসিদ্ধ সওদাগর রূপচাদসাধুর পুত্র।”

প্রায় পাঁচশত বৎসর পূর্বের নবদ্বীপের একটুকরো সমৃদ্ধ পরিস্ফুট হয়েছে শরদিন্দুর লেখনীগুণে—“সে সময় নবদ্বীপের সমৃদ্ধির বিশেষ খ্যাতি ছিল। পথে পথে নাট্যশালা, পাঠশালা, চূর্ণ-বিলোপিত দেউল, প্রতি গৃহচূড়ায় বিচিত্র ধাতুকলস, প্রতি দ্বারে কারু খচিত কপাট; বাজারের এক বিপণীতে লক্ষ তঙ্কার সওদা কেনা যায়। পথগুলি সংকীর্ণ বটে, কিন্তু তাহাতে নগরশ্রী আরও ঘনীভূত হইয়াছে। রাজপথে বহুলোকের ব্যস্ত যাতায়াত নগরকে সজীব ও প্রাণবন্ত করিয়া তুলিয়াছে।”

সেকালে ‘একঘরে’ বা জাতিচ্যুত হবার একটা প্রথা ছিল। গল্পের নায়িকার পরিবার সমাজে পতিত ছিল কেননা সমাজের বড়লোকের ভাইপো তাঁর প্রতি কামুক দৃষ্টি দিয়েছে ফলে বৃহতের সঙ্গে পেরে না উঠে দুর্বলের ওপর অত্যাচার। এটা সর্বযুগেই বহমান।

সে যুগের সমাজ বিপ্লবের একমাত্র কর্ণধার শ্রীশ্রীচৈতন্যদেব ওরফে নিমাই পণ্ডিত এ গল্পে গল্পকাহিনী ও ইতিহাস কাহিনীর মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। রোমান্সরস ও ইতিহাসরসের গাঁটছড়া তাঁর পূত হস্তের মাধ্যমেই ঘটেছে।

প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত গল্পকে ইতিহাসরসাশ্রিত রোমান্সে সে বেঁধে রেখেছেন তিনি। এ হেন ইতিহাসপ্রসিদ্ধ কিংবদন্তী চরিত্র যে গল্পকাহিনীর মধ্যমণি, সেই গল্প অবশ্যই ইতিহাস নির্ভর। তাই বলা যায় ‘চুয়াচন্দন’ গল্প কেবল এই একটিমাত্র ঐতিহাসিক চরিত্রের উপস্থিতিতে ইতিহাসগন্ধী হয়ে উঠেছে। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপূর্ব রোমান্টিক কল্পনাশক্তি ও প্রবল ইতিহাসপ্রীতি ‘চুয়াচন্দন’ গল্পে পরিলক্ষিত হয়। তৎকালীন বাস্তব সমাজ ধর্মচিত্র অত্যন্ত বিশ্বস্তভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন গল্পকার শরদিন্দু।