একটি বৈধ চুক্তি গঠনের জন্য আবশ্যকীয় উপাদানগুলি আলোচনা কর |
প্রশ্নঃ চুক্তির সংজ্ঞা দাও। একটি বৈধ চুক্তি গঠনের জন্য আবশ্যকীয় উপাদানগুলি আলোচনা কর।
চুক্তির সংজ্ঞাঃ বাংলাদেশে প্রযোজ্য ১৯৭২ সালের চুক্তি আইনের ২(জ) ধারায় চুক্তির সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, আইনে বলবৎযোগ্য সম্মতি হচ্ছে চুক্তি। (An Agreement enforceable by law is a Contract.)
বৃটিশ কমন ল’য়েও অনুরূপ সংজ্ঞা দেখা যায়। স্যামন্ডের (Salmond) মতে, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলির দায় দায়িত্ব সৃষ্টি করে ও নির্ণয় করে এমন সম্মতিকে (Agreement) বলে। ( A contract is an agreement creating and defining obligations between the praties.)
স্যার ফ্রেডারিক পোলকের (Pollock) সংজ্ঞানুসারে, আইনে বলবৎযোগ্য প্রতিটি সম্মতি ও প্রতিশ্রুতিকে চুক্তি বলা যেতে পারে। (Every agreement and promise enforceable at law is a contract.)
এ্যনসন (Anson) তার চুক্তি আইন গ্রন্থে এই মর্মে বর্ণনা করেনঃ চুক্তি হলো দুই বা ততোধিক ব্যক্তির মধ্যে প্রতিষ্ঠিত এমন এক অঙ্গীকার যা আইনের দ্বারা বলবৎ করা যায় এবং যার ফলে এক বা একাধিক ব্যক্তি অপর ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক কোন কাজ করা বা করা হতে বিরত রাখার অধিকার অর্জন করে। (A contract is an agreement enforceable at law made between two or more persons ich rights are acquired by one or more to act or forebearance on the part of the other.)
এই সংজ্ঞাগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, দুটো বৈশিষ্ট্যের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এগুলি হচ্ছে যে, পক্ষগণের মধ্যে মতৈক্য বা সম্মতি থাকতে হবে এবং সেই সম্মতি আইনের দ্বারা বলবৎযোগ্য হতে হবে।
একটি বৈধ চুক্তির জন্য অপরিহার্য উপাদানগুলি নিম্নে প্রদত্ত হলোঃ
(১) দুই বা ততোধিক পক্ষ (Two or more parties): কোন ব্যক্তি তার নিজের সাথে চুক্তি করতে পারে না। তাই চুক্তি গঠনের জন্য অন্য দুই ব্যাক্তির প্রয়োজন এবং তাদের মধ্যে একটা আইনগত সম্পর্ক সৃষ্টির সাধারণ অভিপ্রায় থাকতে হবে। যে সম্পর্কে আর্থিক লেনদেন জড়িত থাকে কিংবা আর্থিক মানদন্ডে যা নিরূপণ করা যায় এবং যার দ্বারা আইনগত দায় দায়িত্ব ও অধিকারের সৃষ্টি হয় তা আইনগত সম্পর্ক। দুই ব্যক্তি যদি একত্রে গান গাইবার জন্য সম্মত হয়, তাদের এই সম্মতি আর যে কোন অভিপ্ৰায় হোক.. না কেন আইনগত সম্পর্ক সৃষ্টির জন্য নয়। কিন্তু গান গেয়ে অর্থ উপার্জন এবং সে অর্থ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিবার জন্য যদি তারা সম্মত হয় তবে সে সম্মতি আইনগত সম্পর্ক সৃষ্টির অভিপ্রায়ে তা বলা যায়।
(২) বৈধ প্রস্তাব ( Lawful offer): চুক্তি আইনের (ক) ধারা মতে যখন এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তির সম্মতি পাবার উদ্দেশ্যে কোন কাজ করার বা কাজ করা হতে বিরত থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করে তুখন সে ব্যক্তি প্রস্তাব করেছে বলা যায়। এই প্রস্তাব সুস্পষ্ট ও ব্যক্ত হতে হবে এবং আইনের দৃষ্টিতে বৈধ হতে হবে। প্রস্তাব গৃহীত হলে তা প্রতিশ্রুতিতে পরিণত হয় এবং প্রস্তাবকারীকে প্রতিশ্রুতিদাতা (Promisor) বলে। শুধু মাত্ৰ অভিপ্ৰায় প্রকাশ করলে তা প্রস্তাব হয় না, পক্ষসমূহের মধ্যে কিছু আইনগত অধিকার ও বাধ্যবাধকতার সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য থাকতে হবে।
(৩) প্রস্তাব গ্রহণ (Acceptance of the offer): যে পক্ষের নিকট উপরোক্ত প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে সে পক্ষ যদি শর্তহীনভাবে তা গ্রহণ করে তবে চুক্তি আইনের ২(খ) ধারা মতে প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হয়েছে বলা যায়, প্রস্তাব গ্রহণের সাথে সাথে অঙ্গীকারের সৃষ্টি হয়। প্রস্তাব গ্রহণকারীকে প্রতিশ্রুতিগ্রহীতা (Promisee) বলে। গ্রহণ সুস্পষ্ট হতে হবে। মানসিক সম্মতি যথেষ্ট নয়। গ্রহণ সংবাদ প্রস্তাব দাতার নিকট প্রেরণ করতে হবে। প্রদত্ত প্রস্তাব বলবৎ থাকাকালে গ্রহণ করতে হবে এবং প্রস্তাব দাতার নির্দেশ মত স্বীকৃতি জ্ঞাপন করতে হবে।
(৪) বৈধ প্রতিদান (Lawful consideration): অঙ্গীকারের প্রতিদান চুক্তির জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। চুক্তি আইনের ২(ঘ) ধারায় প্রতিদানের সংজ্ঞা নিম্নোক্তভাবে দেয়া হয়েছেঃ
প্রতিশ্রুতিদাতার ইচ্ছানুযায়ী যখন প্রতিশ্রুতিগ্রহীতা বা অন্য কেউ কোন কাজ করে থাকে কিংবা কাজ করা হতে বিরত থাকে, অথবা কোন কাজ করে কিংবা কাজ করা হতে বিরত থাকে অথবা কোন কাজ করার জন্য কিংবা কাজ করা হতে বিরত থাকার জন্য প্রতিশ্রুতি দেয়, তখন সে কাজ বা নিবৃত্তি অথবা প্রতিশ্রুতিকে প্রতিদান বলে। কিন্তু প্রতিটি কাজ, নিবৃত্তি বা প্রতিশ্রুতিই প্রতিদান হিসেবে গণ্য হয় না যদি তা বিধি সম্মত না হয়ে থাকে এবং বৈধ না হয় । কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে প্রতিদান অবৈধ হয় তার বিবরণ চুক্তি আইনের ২৩ ধারায় দেয়া হয়েছে । উক্ত ধারা মতে নিম্নোক্ত প্রতিদানগুলি অবৈধঃ
(ক) যে সকল কাজ আইনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
(খ) প্রচলিত আইনের কোন বিধানের পরিপন্থী কোন কাজ।
(গ) প্রবঞ্চনামূলক কাজ।
(ঘ) যে কাজ অন্যের শরীর বা সম্পত্তির ক্ষতিসাধন করে।
(ঙ) যা নৈতিকতা বা জননীতির বিরোধী।
(৫)পক্ষগণের যোগ্যতা (Capacity of the parties): চুক্তি আইনের ১১ ধারায় বিধান প্রদান করা হয়েছে যে, প্রত্যেক ব্যক্তিই চুক্তি করার যোগ্য, যদি সে সাবালক, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন এবং অন্যভাবে অযোগ্য না হয়ে থাকে। তাই নাবালক, পাগল বা অসুস্থ মস্তিষ্কপন্ন ব্যক্তি ও অন্য আইনে অযোগ্য ঘোষিত ব্যক্তি কর্তৃক গঠিত চুক্তি বৈধ নয়। সুস্থ চিত্তের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নাবালক ও অপ্রকৃতিস্থ ব্যক্তির চিত্ত সুস্থ থাকে না। ফলে চুক্তির উপকারিতা বা অপকারিতা সম্বন্ধে সঠিক ধারণা নেয়া তাদের পক্ষে সম্ভবপর হয় না।
(৬) পক্ষগণের স্বাধীন সম্মতি (Free consent of the parties): পক্ষগণের অবাধ ও স্বাধীন সম্মতির উপরই চুক্তি গঠিত হবে । চুক্তি আইনের ১৩ ধারায় বলা হয়েছে যে, যখন দুই বা ততোধিক ব্যক্তি একই অর্থে মতৈক্যে পৌঁছে তখন তারা সম্মতি দিয়েছে বলা যায়। বল প্রয়োগ (conrcion), অবাঞ্ছিত প্রভাব (undue influence), ভ্রান্তি (mistake), প্রতারণা (fraud) ও মিথ্যা বর্ণনার (misrepresentation) দ্বারা যদি কোন পক্ষের সম্মতি আদায় করা হয়, তবে সে সম্মতিকে স্বাধীন ও স্বেচ্ছামূলক বলা যাবে না এবং এরূপ সম্মতির ভিত্তিতে গঠিত চুক্তি বৈধ হবে না। ক্ষেত্র বিশেষে এ সকল চুক্তি বৈধ, বাতিল বা বাতিলযোগ্য হতে পারে। তবে নির্দোষ পক্ষের ইচ্ছানুযায়ী বাতিলযোগ্য হতে পারে, অর্থাৎ সে ইচ্ছা করলে তা বৈধ রাখতে পারে অথবা বাতিল করতে পারে। দোষী পক্ষ কখনো তার ইচ্ছা প্রয়োগ করে বাতিল করতে পারে না।
(৭) বৈধ উদ্দেশ্য (Lawful object): চুক্তির উদ্দেশ্য বৈধ হতে হবে। চুক্তির উদ্দেশ্য বলতে পক্ষগণের অভিপ্রায় বা মোটিভ বুঝায় না, কিংবা চুক্তির বিষয়বস্তুও বুঝায় না। উদ্দেশ্য বলতে চূড়ান্ত লক্ষ্য বা চূড়ান্ত ফলাফল বুঝায়। চুক্তির উদ্দেশ্য যদি প্রচলিত আইনের বা জননীতির পরিপন্থী হয় বা নৈতিকতা বিরোধী হয়, তবে তা বৈধ হতে পারে না।
(৮) আইনের প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করা চলবে না (Must not be in abuse of legal process): যে সকল চুক্তি আইনের প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে তাকে বৈধ চুক্তি বলা যায় না। নিম্নবর্ণিত চুক্তিগুলি আইনের প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করেঃ
(ক) বিবাহে বাধ্যতামূলক চুক্তি (Agreement in restraint of marriage)
(খ) ব্যবসায় বাণিজ্যে বাধ্যতামূলক চুক্তি (Agreement in restraint of trade)
(গ) আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্যতামূলক চুক্তি (Agreement in restraint of legal procee- dings)
(ঘ) বাজীমূলক চুক্তি (Agreement by way of wager)
(৯) লিখন ও নিবন্ধন ( Written and registration): চুক্তি মৌখিক, লিখিত বা নিবন্ধনকৃত হতে পারে। কোন আইনে যদি চুক্তির নিবন্ধনের নির্দেশ থাকে, তবে সে নির্দেশ পালন না করলে চুক্তিটি বলবৎ করা যায় না। অনুরূপভাবে যে সকল চুক্তি প্রণয়নের জন্য কোন বিশেষ বিধান বা পদ্ধতি রয়েছে সে ক্ষেত্রে ঐ চুক্তির বৈধতার জন্য এ সকল বিধান বা পদ্ধতি অবশ্য পালন করতে হবে।
অতএব দেখা যায় যে, পক্ষপণের মধ্যে সম্মতি বা মতৈক্য হলেই চুক্তি হবে না। সম্মতির জন্য মাত্র তিনটি উপাদানের প্রয়োজন, কিন্তু সেই সম্মতিকে চুক্তির মর্যাদা দিতে হলে উপরোক্ত উপাদানগুলি বিদ্যমান থাকতে হবে। তাই বলা হয় যে, সকল চুক্তি সম্মতি, কিন্তু সকল সম্মতিই চুক্তি নয়। (All contracts are agreements but all agreements are not contracts.)
Leave a comment