প্রশ্নঃ ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের যে প্রতিফলন ঘটেছে তার পরিচয় দাও।

অথবা, “আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই” উপন্যাসের পটভূমি ঊনসত্তরের

উন্মাতাল সমাজ-রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ।”- উক্তিটির যথার্থতা বিচার কর।

উত্তরঃ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৯৪৩-১৯৯৭) বাংলা সাহিত্যের একজন প্রতিশ্রুতিশীল লেখক। বিশ শতকের ষাটের দশকের জাতীয়তাবাদী চেতনা ও স্বাধীকার আন্দোলনের পটভূমিকায় সাহিত্যের ক্ষেত্রে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের আবির্ভাব। জীবন ও সমাজ অনুসন্ধানের নিরীক্ষাধর্মী শৈল্পিক মনস্তত্তে অবগাহন করে তিনি ঐ সময়ের ও স্বাধীনােত্তর বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন প্রবাহকে ধারণ করে সাহিত্য রচনা করেন। গভীর জীবনবােধ তার রচনার প্রধান ভিত্তি। এই বাস্তববাদী লেখকের গল্প উপন্যাসের ভিত্তি সমকাল। সমকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পরিবর্তনশীল বাস্তবতাকে তিনি তার রচনায় উপস্থাপন করেছেন। ‘চিলেকোঠার সেপাই’ [১৯৮৬] উপন্যাসকে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উপন্যাসটির মধ্যে উনসত্তরের বিক্ষুব্ধ সমাজ রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ রূপায়িত হয়ে উঠেছে।

উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ওপর যেসব ইতিহাসগ্রন্থ রচিত হয়েছে, সে গুলােতে হয়তাে নির্ভুল তথ্য রয়েছে, কিন্তু সেগুলাে পাঠ করে কেউ সেই দিনগুলাের উত্তাল মুহূর্তগুলাে অনুভব করতে পারবে না। কারণ লিখিত বিবরণ কোনাে দিনই রক্তের দানায় দানায় ছড়িয়ে থাকা উত্তেজনা, উত্তাপ, আকাঙ্ক্ষা, ক্ষোভ, গ্লানি এবং আনন্দকে তুলে আনতে পারে না। বিশেষকরে প্রবন্ধ বা দলিল তাই বলে প্রবন্ধ বা দলিলের কোনাে উপযােগিতা নেই, এ কথা মূখ ছাড়া আর কেউ বলতে পারে না। কিন্তু আমরা ইতিহাস গ্রন্থাকারে যেসব দলিল হাতে পেয়েছি, সেগুলােতে সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে ইতিহাসকথিত মানুষের আরাে অনেককিছু চাওয়ার বিষয়টিকে। এ ব্যাপারটিকে ধরতে পেরেছিলেন ইলিয়াস। এই শূন্যতা থেকে মুক্তি খুঁজছিলেন, খুঁজছিলেন এমন একটি গ্রন্থ যেখানে ঊনসত্তরের মানুষের আত্মদান এবং আকাক্ষার সঠিক মাত্রাগুলাে উপস্থাপিত হয়েছে। পাননি। পাননি বলে নিজেকেই লিখতে হলাে তার। আর ঔপন্যাসিকের কলমে এবং উপন্যাসের আঙ্গিকে বেরিয়ে এলাে বাঙালির ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আন্দোলনের হৃদস্পন্দন ‘চিলেকোঠার সেপাই’।

উপন্যাসের প্রেক্ষাপটঃ ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময়ের প্রেক্ষাপটে রচিত হয়েছে এই উপন্যাসটি। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দুই বছর আগে বিপুল গণঅসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছিল। লেখকের কাছে তা আগের যে কোনাে আন্দোলনের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই উপন্যাসের সবচেয়ে বড়াে বৈশিষ্ট্য এর মনােবিশ্লেষণ ঊনসত্তর সালের প্রবল গণঅ্যুত্থানের যারা প্রধান শক্তি ছিল, সেই শ্রমজীবী জনসাধারণ কীভাবে আন্দোন পরবর্তী সময়টিতে প্রতারিত এবং বঞ্চিত হলাে, বামপন্থিদের দোদুল্যমানতা আর ভাঙনের ফলে, জাতীয় মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে যথাযথভাবে ধারণ করতে না পারার কারণে অজস্র রক্তপাতের পরও রাজনীতির ময়দান থেকে তাদের পশ্চাদপসরণ ঘটল, আওয়ামী লীগ প্রধান শক্তি হয়ে উঠল, উপন্যাসের উপজীব্য সেই ঐতিহাসিক সময়টুকুই।

বাস্তবের সােজাসাপ্টা বর্ণনায় ইলিয়াসের যে অনায়াস দখল তার স্মরণীয় পরিচয় আছে ২৩ নম্বর পরিচ্ছেদে। শহিদ আসাদুজ্জামানের শােকসভা ডেকেছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে অফিসের লােকজন বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। সেক্রেটারিয়েট থেকে লােকজন দল বেঁধে বেরিয়ে এলে আর অফিসার-গােছের কেউ কেউ মিছিলে যােগ দিলে বুঝা যায় আন্দোলন নতুন মাত্রা পাচ্ছে অবশ্য বাধভাঙা মানুষের জোয়ার এসবের অপেক্ষা না করেই ‘এত জনাকীর্ণ রাস্তাঘাট, এত মিছিল, এই রাগী শহর’ হয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে তােপখানা রােড, সচিবালয়ের গেট, আবদুল গণি রােডসহ গলি-উপগলিতে। আগুন লেগে যায় গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনায়, আইয়ুব খানের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আস্তানায়। ওসমান দেখে, দেখার চেষ্টা করে মাঝে মাঝে কিছু মন্তব্য-মূল্যায়নও করে আপন মনে। তাতেই পাঠকের জন্য তৈরি হতে থাকে এক নিখুঁত সাংবাদিক বয়ান। ব্যক্তির চোখ দিয়ে কিন্তু ব্যক্তিকে মুখ্য না করে তৈরি হওয়া সে বয়ান নিরাসক্ত পক্ষপাতহীনতা অক্ষুন্ন রেখে এক ধরনের দালিলিক মর্যাদা অর্জন করে। ইলিয়াসের এই বর্ণনা উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক বয়ানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ছাত্র-আন্দোলনের ইতিহাস-প্রণেতা মােহাম্মদ হাননান এ দিনের বিবরণে লিখেছেন-

“আসাদ নিহত হওয়ার খবর সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ার পর সঙ্গে সঙ্গে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয় … অশ্রুভারাক্রান্ত অবস্থায় ছাত্রছাত্রীরা তাৎক্ষণিকভাবে এক শােকসভায় মিলিত হয়।… শােকমিছিলের দৈর্ঘ্য প্রায় দুই মাইল। … ২১ জানুয়ারি …পল্টন ময়দানে জনসভারও আয়ােজন করা হয়েছিল। সেই জনসভায় ১৪৪ ধরা উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ আসাদের গায়েবানা জানাজায় অংশ নেয়। আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে বিরাট-দীর্ঘ মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে। ২২ জানুয়ারি সন্ধ্যায় মশাল মিছিলে লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হয়।”

কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনা এই আন্দোলনকে বিশেষভাবে বেগবান করেছিল। এক হিসাবে দেখা যায়, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ঢাকাসহ সারা দেশে অন্তত ৬১ জন নিহত হয়েছিল। এর মধ্যে আসাদুজ্জামান ছাড়া অন্তত আরাে দুটি মৃত্যুর ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য-১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হকের মৃত্যু আর ১৮ ফেব্রুয়ারি ড. শামসুজ্জোহার মৃত্যু। চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাসে এসব মৃত্যুর ঘটনা ঐতিহাসিক কালক্রম অক্ষুন্ন রেখেই ব্যবহৃত হয়েছে। যারা নিজ নামে গুরুত্বপূর্ণ আর যেসব মৃত্যু আন্দোলনের দৃশ্যমান গতি নিয়ন্ত্রণ করেছিল, তাদের বর্ণনা নৈর্ব্যক্তিকভাবেই দেওয়া হয়েছে। ইলিয়াস বাড়তি মনোেযােগ দিয়েছেন তাদের প্রতি যারা নামত ইতিহাসে উল্লিখিত হননি, কিন্তু প্রবল সক্রিয়তায় আন্দোলনের সাফল্য নিশ্চিত করেছেন। হাড্ডি খিজির তাদেরই প্রতিনিধি।

মৃত্যু গণআন্দোলনের ক্ষেত্রে সবসময়েই গুরুত্বপূর্ণ-মৃতের আত্মত্যাগের বিচারেও, আন্দোলনের গতিপ্রকৃতির নিয়ন্ত্রক হিসাবেও। ইলিয়াস মৃত্যুকে মহিমান্বিত করেছেন, নিহত ব্যক্তিদের জন্য পর্যাপ্ত পরিসর বরাদ্দ করেছেন। প্রায়শই এ পরিসরের একাংশ ব্যয়িত হয়েছে আন্দোলনের সামগ্রিক বয়ানের অংশ হিসাবে, অন্য অংশে ঠাঁই পেয়েছে মৃতের ব্যক্তিগত পরিসর- পারিবারিক-সামাজিক প্রতিক্রিয়া। যেমন- রঞ্জুর ভাই তালেবের ক্ষেত্রে পারভেজের কাচা-বাংলায় পাওয়া যায় নিম্নোক্ত বর্ণনা। ‘রাত্রে আমার ভাই বলল কে নীলক্ষেতে গুলি হয়েছে, আমার সিস্টারের হাজবেন্ড এসে বললাে, হাতিরপুলের পাওয়ার স্টেশনের এক এমপ্লয়ির তাে ডেথ হয়ে গেল। আমি ইমাজিন করতে পারলাম না কে, আমাদের তালেব-‘। এই বর্ণনা সামগ্রিক আন্দোলনের নির্বিশেষে পরিচয়। তালেবের ব্যক্তিগত পরিসরে বিশেষত পরিবারে তার মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া নিপুণভাবে দেখানাে হয়েছে প্রায় পুরাে উপন্যাস জুড়ে।

১৯৬৯ সালের পূর্ব বাংলা। কী এক জীবনস্পর্শী মন্ত্রের মুখে বিস্ফোরিত চারদিক। কেঁপে ওঠে নগর ঢাকা। কাঁপে শহর, বন্দর গঞ্জ, নিভৃত গ্রাম, এমনকি যমুনার দুর্গম চর এলাকা। কখনাে কঠিন বুলেটের আঘাতে, কখনাে ঘুম ভেঙে দেওয়া আঁখির ঝাপটায়। মিটিং আর মিছিল আর গুলি বর্ষণ আর কারফু ভাঙা আর গণআদালত সব জায়গায় ফেটে পড়ে ক্ষোভ ও বিদ্রোহ। সব মানুষেরই হৃদয়ের অভিষেক ঘটে একটি অবিচল লক্ষ্যে। মুক্তি। মুক্তি? তার আসার পথও একরকম নয়। কারাে স্লোগান, দিকে দিকে আগুন জ্বালাে, কারাে পদ্মা মেঘনা যমুনা।

ঐতিহাসিক বাস্তবকে ঔপন্যাসিক প্রতিবেদনে বদলে নেওয়ার ক্ষেত্রে ইলিয়াস কয়েকটি কার্যকর কৌশলের আশ্রয় নেন। একদিকে পরিসরের বিপুলতা অন্যদিকে, ব্যক্তির অন্তরঙ্গতা এই দুই আলাদা দাবি সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে পূরণের জন্য তাকে সতর্ক থাকতে হয়েছে। তার এক কৌশল ব্যক্তি ও সমষ্টির ন্যায্য হিস্যা রক্ষা করা; আরেক কৌশল ভিতর আর বাইরের বাস্তবতাকে নিপুণ অনুপাতে বিন্যস্ত করা। ব্যক্তিগত কি সামষ্টিক, অন্তরঙ্গ কি বহিরঙ্গ যে কোনাে চিত্রায়ণেই তিনি ক্লান্তিহীন। তৃতীয় পরিচ্ছেদে ওসমানের অফিসে যাওয়ার পথ ধরে স্ট্রাইকের পরিচ্ছন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। পুরােনাে ঢাকার গলি-উপগলি সমম্বিত ভূগােলের সাথে বিবরণগত আর রণকৌশলগত সমঝােতা রক্ষা করে গড়ে উঠেছে সে বয়ান। একথা এমনকি ঘন ঘাস রঙের হেলমেটের সঙ্গে ফিট করা পাঞ্জাবি, বালুচ ও বাঙালি সৈন্যদের খােলা জিপটির ক্ষেত্রেও প্রযােজ্য। গাড়িটি দাঁড়ায় ঠিক সেখানে যেখান থেকে কয়েকটি গলি ঠিকমতাে কাভার করা যায়। আর পায়ে দলে পথ চলা মানুষের থুথুতে সয়লাব রাস্তায় ক্রিকেট খেলুড়ে ‘ছােটো ছেলেরা’ আর তাদের অনুচর নামহীন গােত্রহীন ‘বেওয়ারিশ পিচ্চিরা’ খেলতে খেলতেই বা ইতস্তত মিছিল করতে করতেই নিপুণভাবে পিকেটিংয়ের কাজটি সারে- কখনাে সাইকেল বা রিকশার হাওয়া ছেড়ে দিয়ে, কখনাে-বা দোকান বন্ধ করতে বাধ্য করে।

এরকম এক খবর নিয়ে আসে পিচ্চিদের একটা দল- ‘লম্বু সালামের জিলাপির দুকান আছে না, অর বগলে সাইকেলের পাটসের দুকান আছে না, আছে না, ঐ বন্টু হালায় দুকান খুলছে।’ এরকমই করেন ইলিয়াস। নির্বিশেষ পরিচয়ের মােক্ষম এলাকায় মিশিয়ে দেন নির্ভেজাল বিশেষ বয়ান। তাতে ঐতিহাসিক সত্য আর ঔপন্যাসিক সত্যের নিখুঁত সমানুপাত তৈরি হয়। জমে ওঠে নির্জলা ব্যক্তিতার সঙ্গে সামষ্টিকতার সংঘাত, অন্তরঙ্গ অন্দরের সাথে কোলাহলময় সদরের মােলাকাত। পঁচিশ নম্বর পরিচ্ছেদে রিকশাওয়ালাদের মিছিল-মিটিং উপলক্ষ্যে খুব অন্তরঙ্গ একটা ছবি তৈরির চেষ্টা করেছেন ইলিয়াস। তাতে কেন্দ্রের রাজনীতির সাথে মাঠের রাজনীতির সম্পর্কটা বেশ গুছিয়ে প্রকাশ করতে পেরেছেন।

একাদশ পরিচ্ছেদে লেখক আন্দোলনকে আরাে স্পষ্ট করে আনেন। ভিক্টোরিয়া পার্কের সমাবেশে সর্বদলীয় মিটিং। তাই আন্দোলনে শরিক নানা পক্ষকে অন্তত জাতীয়তাবাদী আর বামপন্থি অংশকে মােটামুটি স্পষ্ট করে চেনা যায়। এখানেও ইলিয়াস স্থানটাকে চোখের সামনে ছবি আকারে ধরিয়ে দেন। সমবেত জনতার নানা ভাগ আর সামষ্টিক জটলাকে যথাসম্ভব মূর্তিমান করার চেষ্টা করেন। চেনা লােকগুলােকে মিটিঙের ভাঁজে ভাঁজে দাখিল করার ফাকে ফাকে মানহীন দুই বক্তার মূল কথাগুলাে বক্তৃতার আকারে শুনিয়ে দেন। তাতে দুই ভিন্ন মত পথের কথামালায় আমরা তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শও পরিষ্কার করে বুঝতে পারি। স্লোগান থেকেও অন্তত দুই গ্রুপের আলাদা অস্তিত্ব চেনা যায়। বামপন্থিরা স্লোগান দিচ্ছে দক্ষিণ দিকের গেটের পামগাছের নিচে’র জটলা থেকে আর জাতীয়তাবাদীরা বেদীর নিচের জটলা থেকে। এসব ফারাক অবশ্য একাকার হয়ে যাচ্ছে মাঝেমধ্যেই জালিম সরকারের দুঃশাসন আর পাকিস্তানি শােষণের বর্ণনায় শ্লোগানে। নামহীনভাবে আস্ত মিটিংটাকে এভাবে চিনিয়ে দেওয়ার পর লেখক চেনা এলাকায় প্রবেশ করেন। সেখানে আলাউদ্দিন মিয়া, আনােয়ার, ওসমান, আলতাফ, খিজির, মকবুল হােসেন মােটামুটি প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করে যায়।

পুরােনাে ঢাকায় আইয়ুব খানের অনুসারী মহাজন রহমতউল্লাহর বিল্ডিংয়ের চিলেকোঠার একমাত্র ঘরে ওসমানের বসবাস। সেখান থেকে সে দেখতে পায় বেবিট্যাক্সি, রিকশা, নারায়ণগঞ্জগামী বাসের পাশাপাশি হেঁটে চলা মানুষের ভিড় ও মিছিল। অফিসে যাওয়ার পথে বাহাদুর শাহ পার্কে জনসভা দেখে। পল্টনেও জনসভা দেখে। রেস্টুরেন্টে বসে রাজনৈতিক ভাবে সক্রিয় বন্ধুদের কাছে শােনে আন্দোলন সংগ্রামের কথা। কিন্তু নিজে থাকে ফেলে আসা বাপের চিন্তায়, এই বাড়ির দোতালার ভাড়াটের মেয়ে রানুর চিন্তায়, অন্য বন্ধুদের চিন্তায়। এমনও নয় যে সারা দেশে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে সে চিন্তিত নয়। বরং উল্টো চিন্তা সে অনেক করে। চিন্তা না করে যে উপায় নেই। কারণ এ সময়ের প্রচণ্ড ঘটনাবলি ঢাকাতে তাে বটেই সমগ্র পূর্ববঙ্গেও সকল সচেতন মানুষকে তীব্রভাবে নাড়া দিয়েছিল। সারা দিনতাে বটেই, রাতেও কোনাে বিরাম নেই ঘটনা ঘটার। সে কারণে এমনকি ১০০ বছরেরও আগে বিদ্রোহী সিপাহিদের ফাঁসি দেওয়ার জন্য নবাব আবদুল গনিকে দিয়ে পোঁতানাে পামগাছ সেসব পামগাছের বাচ্চারা মানুষের শ্লোগানে ভালােভাবে ঘুমাতে পারে না। ফলে ওসমানের ঘুমও কমে যায়। ঘুমের বদলে সে জেগে জেগে দিবাস্বপ্ন দেখতে থাকে। ধীরে ধীরে সেই স্বপ্ন আবার বেশির ভাগই পরিণত হয় দুঃস্বপ্নে। এই আন্দোলনের গন্তব্য কোনটা? এমন প্রশ্নও কেউ কেউ করে। আইয়ুব খান তথা পাকিস্তানিদের প্রতি মানুষের বিতৃষ্ণা এতটায় যে হােটেলের দেয়ালে আইয়ুব খানের ছবি ঝুলতে দেখলে মিছিলের মানুষ এসে সে ছবি গুড়িয়ে দিয়ে যায়। কিন্তু এ ঘৃণা মানুষকে কী এনে দিবে? নিছক আইয়ুব খানের অপসারণ? স্বায়ত্তশাসন? ছয়দফা? স্বাধীনতা? কিন্তু মানুষের আকাঙ্ক্ষা তাে আরাে বেশি। সেই আকাক্ষা আনােয়ারের প্রশ্নের মাধ্যমে উঠে আসে ভাষা, কালচার, চাকরি-বাকরিতে সমান অধিকার, আর্মিতে মেজর জেনারেল পদ পাওয়া- এগুলাে ভদ্র লােকের প্রবলেম। এই ইস্যুতে ভােটের রাইট পাওয়ার জন্য মানুষের এত বড়াে আপসার্জ হতে পারে?

সাধারণ মানুষ এসব প্রশ্নের কোনাে উত্তর না জেনেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে আন্দোলনে। সেই সাধারণ মানুষেরা জলজ্যান্ত প্রতিনিধি হাড্ডি খিজির। শহরে যেমন হাড্ডি খিজিররা ঝাপিয়ে পড়েছে, গ্রামে গ্রামে সেভাবেই ঝাপিয়ে পড়েছে চেংটু, করমালি, আলিবক্স। তাদের কর্মসূচি আরাে অগ্রসর। তারা অনেক দূরের আইয়ুব খান, পাকিস্তান বাহিনীর পিণ্ডির শশাষণ যেমন দেখতে পায়, চোখের সামনে খয়বার গাজী, আফসার গাজীদের ভূমিকা আরাে স্পষ্টভাবেই চিনতে শেখে। জানতে পারে খয়বার গাজীরা সেসব মানুষ যারা আইয়ুব খানের আঞ্চলিক প্রতিনিধি। আইয়ুব খানরা যদি দিগন্ত বিস্তারকারী বিশালদেহী জোঁক হয়, খয়বার গাজীদের মতাে লােকেরা সেই জোঁকের মুখ। সে মুখে লবণ দেওয়ার কাজটাও তারা করতে চায়। কিন্তু তাতে সমর্থন নেই আইয়ুববিরােধী ছয় দফার প্রবক্তা নেতাদের। কারণ তারাও আইয়ুব খানদের শ্রেণি উত্তরসূরি। কী করে খয়বার গাজীরা? তারা মানুষের নামে অহেতুক মামলা ঠোকে। ভিটেমাটি কেড়ে নেয়, কেউ প্রতিবাদ করলে তার লাশ পাওয়া যায় মাঠে-নদীতে। এমনকি হাজার হাজার মানুষের চেখের সামনে নিজের অবাধ্য কিষাণকে পর্যন্ত খুঁটির সাথে বেঁধে পড়িয়ে মারতে পারে। আদালতের মামলায় কোনােদিন খয়বার গাজীরা শাস্তি পায় না, মামলায় হারে না। কারণ সরকারের আদালত তাে তাদেরই আদালত। তাই আলিবক্স, করমালীরা গাজীরা গণআদালত বসাতে চায়। সেখানে বিচার করতে চায় খয়বার গাজীদের মতাে মানুষদের। বিচার করার কথা আসছে এত বছর পরে। কেননা পরিস্থিতি তাদের বাধ্য করেছে। মানুষ প্রস্তুত হয়েছে। যমুনা নদীতে ঘােড়ার ডাক শােনা যাচ্ছে। বড়াে ধরনের বালা-মুছিবত, সংকট, বিপদ আপদ, দুর্যোগ, বিপর্যয় সামনে থাকলে যমুনার মধ্যে দেড়শ দুইশ ঘােড়া সংকেত দেয়। সেই ফকির মজনু শাহের আমল থেকে দিয়ে আসছে। এইবার মুছিবত খয়বার গাজীদের। ডাকাত-চরের বাথান তার লুট হয়। তার প্রধান অনুচর হােসেন আলী নিহত হয় বিক্ষুদ্ধ জনতার হাতে। এখন গণআদালতে বিচার হবে তার। গ্রামের সংগঠিত মানুষ প্রত্যয় ঘােষণা করেছে, “এইবার বুঝবি মানুষের হাতে মরতে কেমন লাগে।” বেটা এখান থেকে কলকাঠি নাড়াে, মানুষের গরু চুরি করে তার কাছ থেকেই জরিমানা আদায় করাে। কারাে জমিতে তারা বর্গা দিতে না পারে তার ফন্দি আটো? সবাই এসে তােমার পায়ে পড়ক, তুমি ইচ্ছামতাে মানুষের ভিটাটুকু পর্যন্ত কবজা করে তাকে তােমার গােলাম বানাও। এইবার? এইবার ভেতর থেকে ভাঙ্গতে শুরু করেছে।, ওপরটা আপনা আপনিই ধ্বসে পড়তে কতক্ষণ?

উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আসল চেহারা তাে এইখানে, এ বৈরাগীর ভিটাই। মানুষ ভেঙে পড়েছে সেখানে। ভিড় দেখে মনে হবে, “গােটিয়া, তালপােতা, পদুমশহর, চিথুলিয়া, উত্তরের চন্দনদহ, দরগাতলা, কর্নিবাড়ি, পশ্চিমের কড়িতলা, দরগাতলা, কামালপুর, গােলাবাড়ি কোনাে গ্রামের পুরুষ আজ ঘরে নেই।” সেখানে, গণআদালত বসেছে। সেখানে সর্বসম্মতিক্রমে খয়বার গাজীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। বৃহস্পতিবারে রাতে বিচার বসেছে। সে সবার কাছে সময় চায়। আগামীকাল শুক্রবার জীবনের শেষ জুমার নামাজটি আদায় করার পর তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হােক। আনােয়ার বুঝে সে সময় চেয়ে নিচ্ছে। সময় পেরে ফাঁদ কেটে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। সুযােগ বের করে নেবে। ঠিকই। কিন্তু ঐ জুমার নামাজের বাসনা! এ মুহূর্তের মধ্যেই ভিজে যায় মানুষের মন। আহা তার জীবনের শেষ ইচ্ছাটা পূরণ করতে দেওয়া হােক। মানুষ খয়বার গাজীর মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারেও যেমন একমত, তেমনই তাকে শেষবারের মতাে জুমার নামাজ পড়ার সুযােগদানের ব্যাপারেও একমত। ফলাফল খয়বার গাজীর পালিয়ে যাওয়া। নিজের লােকদেরও গুছিয়ে নেওয়া প্রশাসনের সাহায্যে আলিবক্সকে এলাকা ছাড়া করা এবং চেংটুর মৃত্যু। তার পরই দেখা যায়, মানুষ নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে ফিরে গেছে। বিরােধী দলের নেতা হয়েছে খয়বার গাজীর লম্পট-মদারু ভাতিজা আফসার গাজী। ক্ষমতা রয় সেই সব আগের শ্রেণির মানুষের হাতেই।

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, ‘চিলেকোঠার সেপাই’ ইতিহাস নয়, উপন্যাস। বাংলা ভাষার গুটিকতক, সফল উপন্যাসের মধ্যে অন্যতম একটি উপন্যাস। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাসের জন্য আমাদের দ্বারস্থ হতে হয় সেই ‘চিলেকোঠার সেপাই’-এর। ঔপন্যাসিক তার বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং একজন গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে এ আন্দোলনের নানান দিক ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। তাই সার্বিক বিচারে বলা যায়- ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসের পটভূমি উনসত্তরের উন্মাতাল সমাজ-রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ।