চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কি? চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল ও কুফল

বাংলাদেশের ভূমি সংস্কারের ঐতিহাসিক পটভূমি মুঘল আমল থেকে লক্ষ্য করা যায়। মুঘলদের পর আসে ইংরেজরা, এরপর পাকিস্তান, সর্বশেষ বাংলাদেশ। প্রতিটি সময়েই ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে। 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হলো একটি চুক্তি যার সাহায্যে জমিদারগণ জমির মালিক হন এবং জমিদাররা জমি ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বাংলার জনগণ ভূমিহীন কৃষকে পরিণত হয়।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত : 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন। লঙ কর্নওয়ালিস ১৭৮৯-৯০ সালে দশ বছরের জন্য জমিদারদের সাথে যে জমি বন্দোবস্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নামে পরিচিত।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদারগণ জমির মালিক, মালিক হিসেবে তারা জমি বিক্রয়; দান বন্ধক রাখতে পারবেন। রাজস্ব প্রাপ্তি বৃদ্ধি এবং নিশ্চয়তার গ্যারান্টি হিসেবে এই ব্যবস্থা চালু করা হয়। এর দ্বারা জমিদারগণ নির্দিষ্ট রাজস্বের বিনিময়ে ভূমিস্বত্বে বংশানুক্রমিক মালিকানা পায়। 

জমির মালিক কৃষকদের হাত থেকে জমিদারদের হাতে স্থানান্তরিত হয়। জমিদারগণ বছরের নির্দিষ্ট দিনের সূর্যাস্তের আগে রাজস্ব জমা দিতে না পারলে জমিদারি নিলামে বিক্রি দেয়া হতো। 

৪৭টি রেগুলেশন নিয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আইন গঠিত হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদারগণ সরকারের বিপদে আপনজন হিসেবে সমর্থন আদায় করেন।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজস্ব বৃদ্ধি ও নিশ্চয়তার গ্যারান্টি হিসেবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কৃষক জমির মালিকানা হারায়। 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সরকার রাজস্ব আদায়ের নিশ্চয়তা পাবেন। কৃষি উৎপাদন বেশি হবে এবং জমিদাররা জমির স্থায়ী উন্নয়নে তৎপর হবে। দেশের প্রভাবশালী গোষ্ঠী জমিদার শ্রেণিতে পরিণত হয় ।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল সমূহ

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হলো একটি চুক্তি। এই চুক্তির সাহায্যে জমিদাররা জমির মালিক হয়। জমিদাররা প্রজার কাছ থেকে খাজনা আদায় করে সরকারকে দিবেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বাংলার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্পকারখানা উন্নতি লাভ করে। 

সমাজে নতুন জমিদার শ্রেণির উদ্ভব হয়। বাংলার প্রজাদের আর্থিক ব্যবস্থার উন্নতি ঘটে। সরকার দেশের রাজস্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে বাজেট প্রণয়ন করে।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল : 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হলো একটি চুক্তি। এই চুক্তির ফলে জমিদাররা জমির মালিকানা লাভ করেন । বাংলার কৃষকরা ভূমিহীন কৃষকে পরিণত হয়। নিম্নে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল উল্লেখ করা হলো :

১. জমিদারের ক্ষমতা বৃদ্ধি : 

জমিদাররা যথেষ্ট হয়ে ওঠেন। নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনী গঠন করেন। এই বাহিনীর সাহায্যে প্রজাদের নিকট থেকে খাজনা আদায় করতেন। জমিদার মালিক টাকার বিনিময়ে জমি বিক্রি করতে পারতেন। তারা সমাজে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।

২. রাজস্ব বৃদ্ধি : 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদারদের রাজস্ব বৃদ্ধি পায়। জমিদারগণ কৃষকদের চাষাবাদে উৎসাহিত করেন। এছাড়া অনাবাদি জমি চাষযোগ্য করে তোলেন। 

জমির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সার ও ওষুধের ব্যবস্থা করেন। এছাড়া কৃষকদের দিয়ে অধিক মুনাফা অর্জনের জন্য অর্থকরী ফসল চাষাবাদ করান। ফলে জমিদারদের রাজস্ব বহুগুণ বৃদ্ধি পায় ।

৩. সরকার সমর্থন গোষ্ঠী : 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সরকার সমর্থনগোষ্ঠী গঠিত হয়। জমিদার যে লাঠিয়াল বাহিনী গঠন করে তা সরকারের সমর্থনে কাজ করেন। বিভিন্ন জায়গার বিদ্রোহ দমনে জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনী কাজ করে থাকে। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ দমনে জমিদার বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। …

৪. উন্নয়ন সাধন : 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বাংলার উন্নয়ন সাধিত হয়। জমিদাররা বাংলার রাস্তাঘাট সংস্কার করেন। পুকুর খনন করেন, স্বাস্থ্যখ্যাত উন্নয়ন করেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেন। চাষাবাদের জন্য অনাবাদি জমি সংস্কার করেন । কৃষকদের উন্নয়নে জমিদাররা সহায়তা করেন ।

৫. ক্ষুদ্র শিল্প স্থাপন : 

বাংলার উন্নয়নে জমিদার ক্ষুদ্র শিল্প স্থাপনের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা ক্ষুদ্র শিল্প স্থাপনে বিনিয়োগ করেন। এছাড়া আধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে ক্ষুদ্র শিল্পকারখানায় শ্রমিকদের কাজ করার সুযোগ দেন। ফলে শিল্প উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পায় ।

৬. দক্ষতা বৃদ্ধি : 

কোম্পানির কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। কোম্পানি কর্মচারীদের দ্বারা প্রজাদের নিকট থেকে রাজস্ব আদায় করা হয়। এছাড়া জমিদারদের কাজে কর্মচারীদের দক্ষ করে তোলা হয়।

৭. বাজেট প্রণয়ন : 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদারদের আয় বৃদ্ধি পায়। এর ফলে দেশের উন্নয়নের জন্য যে বাজেট ঘোষণা করা হয় তা সহজে বাস্তবায়ন করা হয়। সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় রাজস্ব অনুযায়ী বাজেট প্রণয়ন করা হয়। জমিদারদের দেওয়া রাজস্ব সরকারের অর্থভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বাংলার নতুন জমিদার প্রথার উদ্ভব হয়। জমিদার শ্রেণি প্রজাদের উপর অত্যাচার করে খাজনা আদায় করত। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদাররা জমির গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য কাজ করেন। 

অনাবাদি জমি সংস্কার করে চাষের জন্য উপযোগী করে তোলে। এছাড়া জমিদাররা তাদের যাতায়াতের জন্য রাস্তাঘাট নতুন করে তৈরি করেন ও পুরনো রাস্তাঘাট সংস্কার করেন। জমিদাররা উন্নত ফসল চাষের জন্য কৃষকদের উৎসাহিত করতেন।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কুফল সমূহ

ভারতবর্ষে ভূমি সংস্কারের ক্ষেত্রে যেসব আইন প্রণয়ন করা হয় তার মধ্যে অন্যতম আইন হলো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বাংলার জমির মালিক হলেন জমিদাররা। জমিদাররা প্রজাদের নিকট থেকে খাজনা আদায় করে কেন্দ্রীয় সরকারকে দিতেন। 

খাজনা আদায়ের জন্য জমিদাররা প্রজাদের উপর অত্যাচার- নির্যাতন করতেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বাংলার অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হয়।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কুফল : 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলার কৃষকদের ভূমিহীন কৃষকে পরিণত করে। জমিদাররা বাংলার কৃষকদের নিকট হতে জোরপূর্বক রাজস্ব আদায় করত । নিয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কুফল উল্লেখ করা হলো : 

১. কৃষকের তরুণ পরিণতি : 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কৃষকেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় । গোমস্তা ও নায়েবা রাজস্ব আদায়ের জন্য যে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করত। 

এরূপ অমানুষিক অত্যাচারের কোন প্রতিবাদ করার মতো শক্তি কৃষকরা পেত না। জমিদাররা শহরে থাকায় তার কাছে কৃষকরা তাদের অভিযোগ পেশ করতে পারত না ।

২. জমির উন্নয়ন ব্যাহত : 

কৃষকেরা জমির মালিক না হওয়ায় তারা জমির উন্নয়নে তেমন প্রচেষ্টা নিত না। ফলে কৃষি ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। জমিদার সরকার জমির স্থায়ী উন্নয়ন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচ ব্যবস্থার উন্নয়নে কোন পদক্ষেপ নেয়নি । কৃষকেরা দায় সাড়া মতো কৃষিকাজ করত। ফলে উৎপাদন হ্রাস পায়। 

৩. রাজস্ব থেকে বঞ্চিত : 

সরকার জমিদারদের জন্য রাজস্ব নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। জমি থেকে অতিরিক্ত আয় হলে জমিদার সরকারকে অতিরিক্ত আয়ের ভাগ দিত না। সরকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়। কোম্পানি সরকারকে রাজস্বের হার বৃদ্ধি করে দিলেও সরকার সঠিক রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়।

৪. জমির উপর চাপ সৃষ্টি : 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমির উপর চাপ বৃদ্ধি পায়। বিত্তশালীরা জমির মালিক হতে আগ্রহ হন। ফলে জমি ক্রয়-বিক্রয়ের হার বৃদ্ধি পায়। জমির মালিকানা নিয়ে অনেক মামলা-মোকদ্দমা হয়। ফলে মামলা মোকদ্দমা নিয়ে কৃষকরা ঝামেলায় পড়ে।

৫. নায়েব-গোমস্তাদের অত্যাচার : 

জমিদাররা উন্নত জীবনযাপনের জন্য নায়েব-গোমস্তাদের উপর দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ফলে রাজস্ব আদায়ে তারা কৃষকদের অত্যাচার করতেন। ফলে কৃষকদের দুর্ভোগ বহুলাংশে বেড়ে যায়। কৃষকরা নায়েব-গোমস্তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বিদ্রোহ করেন । 

৬. শিল্পায়ন ব্যাহত: 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এদেশের শিল্পায়নকে ব্যাহত করে। জমিদার ও সম্পদশালীরা তাদের অর্জিত আয় স্থাবর সম্পত্তিতে ব্যয় করতে সক্ষম হয়। ফলে ঝুঁকি নিয়ে শিল্প স্থাপনে কেউ আগ্রহী হয় না। 

এতে বাংলার শিল্প উৎপাদন কমে যায়। বিত্তবানরা শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে জমি ক্রয়ের উপর বেশি জোর দেন।

৭. ঋণে জর্জরিত : 

কৃষকরা ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়ে। কোন বছর শস্যহানি হলেও কৃষক খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য থাকতো। এ অবস্থায় কৃষক মহাজন বা অন্য কোনো ব্যক্তির কাজ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ গ্রহণ করে। উৎপাদন ভালো না হওয়ায় কৃষকেরা ঋণ পরিশোধ করতে পারে না।

পরিশেষে বলা যায় যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলার কৃষকদের জন্য অভিশাপস্বরূপ ছিল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কৃষির উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে। এই বন্দোবস্তের ফলে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। 

জমিদারগণ প্রজাদের নিকট হতে অতিরিক্ত খাজনা আদায় করার জন্য প্রজাদের উপর চাপ দেন। এর ফলে বাংলার সমাজে অশান্তি ও বিশৃংখলা দেখা যায়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কিছু জমিদার সর্বস্বান্ত হয়।