সূচনা: অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে চিন ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির আধা উপনিবেশে পরিণত হয়। চিনে ইউরােপীয় শক্তিগুলির মধ্যে সর্বাধিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে ব্রিটেন। বিদেশি আধিপত্যের যুগে চিনের সাধারণ মানুষের দারিদ্র্য ও দুর্দশা ছিল সীমাহীন। এর সুযােগ নিয়ে ইউরােপের বিভিন্ন ঔপনিবেশিক শক্তি চিন থেকে অসংখ্য শ্রমিক সংগ্রহ করে চুক্তির ভিত্তিতে বহির্দেশে বিভিন্ন উপনিবেশে বিভিন্ন উৎপাদনমূলক কাজে নিয়ােগ করে।

[1] শ্রমিক রপ্তানির সূচনা: নানকিং-এর সন্ধির (১৮৪২ খ্রি.) পর দক্ষিণ-পূর্ব চিনে ব্রিটিশদের আধিপত্য যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। এই সময় থেকে ব্রিটিশরা চিনের স্থানীয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে চিন থেকে শ্রমিক সংগ্রহ করে তাদের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে তাদের বিদেশে কাজে পানাে শুরু করে। উনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে চিনের ব্যাপক সংখ্যক চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক বিভিন্ন দেশের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয়। অবশ্য চিনের কিং বংশ (১৬৪৪-১৯১২ খ্রি.)-এর শাসকদের আইন মেনে এই শ্রমিকদের বিদেশে পাঠাতে হত।

[2] চুক্তি সম্পাদন: বিদেশি এজেন্সি সংস্থার মাধ্যমে চিনের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শ্রমিক সংগ্রহ করে বিদেশে পাঠানাে হত। বিদেশে কাজের উদ্দেশ্যে যাওয়ার বিষয়ে এই শ্রমিকরা এজেন্টদের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হত। এই চুক্তিতে শ্রমিকদের গন্তব্যস্থল, কাজের মেয়াদ, প্রাপ্য মজুরি, চিকিৎসার সুবিধা দান প্রভৃতির উল্লেখ থাকত। চিনের চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকরা ৫ থেকে ৮ বছরের মেয়াদে বিদেশে কাজে যাওয়ার চুক্তিতে আবদ্ধ হত। ক্রীতদাসপ্রথা নিষিদ্ধ হলে ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন উপনিবেশে আখ চাষ, চিনি উৎপাদন ও অন্যান্য শ্রমসাধ্য কাজে লােকের অভাব দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার চিনের শ্রমিকদের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে সেখানে পাঠাত।

[3] শ্রমিক প্রেরণের স্থল: ব্রিটিশ উপনিবেশ ট্রিনিদাদে জনসংখ্যা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার চিন-সহ এশিয়ার বিভিন্ন স্থান থেকে সেখানে শ্রমিক পাঠানাের সিদ্ধান্ত নেয়। ট্রিনিদাদ ছাড়াও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল, আমেরিকা, লাতিন আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, কিউবা প্রভৃতি অঞ্চলে চিনের শ্রমিকদের প্রেরণ করা হত। চিনের রাজার আপত্তিতে এবং ব্রিটিশদের পক্ষে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের প্রেরণ খুব ব্যয়বহুল হয়ে যাওয়ায় ব্রিটিশ সরকার ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে চিন থেকে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের আমদানি বন্ধ ঘােষণা করে।

[4] পেশা: ব্রিটিশ সরকার চিন থেকে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের পাঠিয়ে আফ্রিকান ক্রীতদাসদের অভাব পূরণ করার চেষ্টা করে। চিনের চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের অধিকাংশই বিদেশে চিনি উৎপাদনের কাজে নিযুক্ত হত। অবশিষ্ট শ্রমিকরা অন্যান্য কৃষিকাজ, পরিকাঠামাে উন্নয়ন, অট্টালিকা নির্মাণ, কারিগরি কাজ প্রভৃতিতে নিযুক্ত হত। চিনের শ্রমিকরা ট্রিনিদাদে ভয়ানক অবস্থার মধ্যে বসবাস করত। কিছু কিছু শ্রমিক চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও স্বদেশে ফিরতে না পেরে দীর্ঘকাল ধরে সেখানে বসবাস করতে বাধ্য হত। যারা ট্রিনিদাদে থেকে যেত তারা দোকানদার, কই, ছুতাের, মালি প্রভৃতি পেশা গ্রহণ করে জীবনধারণ করত।

[5] যাত্রার বিভিন্ন পর্যায়: চিনের চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকরা মূলত তিনটি পর্যায়ে বিদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।

  • প্রথম পর্যায়: প্রথম পর্যায়ে চিনের ম্যাকাও, পেনাং, ক্যান্টন প্রভৃতি স্থান থেকে ২০০ জন চিনা শ্রমিক সংগ্রহ করা হয়। তাদের ফরটিচিউড নামক জাহাজে করে ট্রিনিদাদে পাঠানাে হয়। এর মধ্যে ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দের ১২ অক্টোবর প্রথম ধাপে ট্রিনিদাদে পৌঁছােয় ১৯২ জন। চুক্তির মেয়াদ পূরণ হওয়ার পর ১৯২ জনের মধ্যে ২৩ জন ট্রিনিদাদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং অবশিষ্ট শ্রমিকরা ফরটিচিউড জাহাজে করে ফিরে আসে।

  • দ্বিতীয় পর্যায়: দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৮৫৩ থেকে ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে চিনের গুয়াংডং প্রদেশের বহু শ্রমিককে বিদেশে পাঠানাে হয়। এই পর্বে ট্রিনিদাদ ছাড়াও আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা প্রভৃতি দেশে চিনের শ্রমিকদের পাঠানাে হয়।

  • তৃতীয় পর্যায়: চিনা শ্রমিক প্রেরণের তৃতীয় পর্যায় শুরু হয়। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় চিন থেকে ফ্রান্স ১ লক্ষ ৪০ হাজার শ্রমিক আমদানি করে। ১৯২০-৪০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে শ্রমিকদের রপ্তানি যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। এই পর্বে শ্রমিক ছাড়াও প্রচুর ব্যবসায়ী, দোকানদার প্রভৃতি পেশার মানুষও লাভের আশায় বিদেশে পাড়ি জমায়।

উপসংহার: মাঝেমধ্যে চিনা শ্রমিকদের বিদেশে প্রেরণ বন্ধ থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে চিন থেকে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক বিদেশে রপ্তানি করা হয়। শেষ পর্বে শ্রমিক ছাড়াও প্রচুর ব্যবসায়ী, দোকানদার প্রভৃতি পেশার মানুষও ছিল। বিদেশে চিনা শ্রমিকরা সীমাহীন দুর্দশার শিকার হত। আর্নল্ড জে. মিঘার চিনের চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের এক প্রকার ক্রীতদাসদের অবস্থার সঙ্গে তুলনা করেছেন। শেষপর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চিনে বিদেশিদের আধিপত্য হ্রাস পেলে শ্রমিক প্রেরণও হ্রাস পেতে থাকে।