[1] পরিচিতি: মাও-সে-তুঙ-এর নেতৃত্বে চিনা কমিউনিস্টরা ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে চিনের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের কমিউনিস্টদের সঙ্গে যােগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে দক্ষিণ-পূর্ব চিনের কিয়াং-সি প্রদেশ থেকে উত্তরে শেনসি পর্যন্ত যে দীর্ঘ ৬০০০ মাইল পদযাত্রা করেছিলেন, চিন তথা বিশ্বের ইতিহাসে তা ‘লং মার্চ’ (১৬ অক্টোবর, ১৯৩৪ খ্রি.১৯ অক্টোবর, ১৯৩৫ খ্রি.) নামে খ্যাত।

[2] পটভূমি: কিয়াং-সি ও তার নিকটবর্তী এলাকায় কমিউনিস্টরা প্রচণ্ড শক্তিশালী হয়ে উঠলে প্রজাতন্ত্রী চিনের কমিউনিস্ট বিরােধী রাষ্ট্রপতি চিয়াং কাই-শেক তাদের দমন করার জন্য সেনা পাঠান (১৯৩৪ খ্রি.)। ঠিক এই সময় জাপান মাধ্রিয়া দখল করে উত্তর চিনের জোহাল পর্যন্ত ঢুকে পড়ে। কিন্তু চিয়াং জাপানের এই আগ্রাসনের কোনাে প্রতিকার না করে কমিউনিস্ট-নিধনে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। এই কারণে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই পদযাত্রাকারী কমিউনিস্টগণ তাদের পরিবার-পরিজনসহ কিয়াং-সি ত্যাগ করে উত্তর চিনে পীত নদীর বাঁকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ শেনসি প্রদেশ অভিমুখে দীর্ঘ পদযাত্রা শুরু করেন।

[3] পদযাত্রায় অংশগ্রহণকারীগণ: মাও-সে-তুঙ এবং চু-তের মিলিত প্রচেষ্টায় কমিউনিস্টদের ঐক্যবদ্ধ করে শুরু হয় লং মার্চ বা দীর্ঘ পদযাত্রা। লং মার্চ বা দীর্ঘ পদযাত্রায় প্রায় এক লক্ষ চিনবাসী অংশগ্রহণ করেন। পদযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৮৫ হাজার জন ছিলেন সেনা (যারা এই আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন) এবং ১৫ হাজার জন ছিলেন সরকারি ও কমিউনিস্ট দলের কর্মী। এঁদের মধ্যে ৩৫ জন ছিলেন মহিলা।

[4] পদযাত্রার বর্ণনা: ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ১৬ অক্টোবর কিয়াং-সি প্রদেশ থেকে শুরু হওয়া ওই পদযাত্রা শেষ হয় পরের পছর ১৯ অক্টোবর। দীর্ঘ ওই ৩৭০ দিনের প্রবল দুঃখদুর্দশার মধ্যে ১৮টি গিরিশ্রেণি, ২৪টি নদনদী অতিক্রম করে যখন তারা শেনসি প্রদেশের ইয়েনানে এসে পৌছেন ততদিনে ১ লক্ষ মানুষের মধ্যে ৯২ হাজারই মৃত্যুবরণ করেছেন। ৬হাজার মাইলের ওই দীর্ঘ পথে সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করতে করতে তাঁরা কোয়াং টুং,হুনান, কোয়াং-সি, কোয়ােইচো, য়ুনান, সিকাং, জেকুরান, কানসু, শেনসি প্রভৃতি ১১টি চিনা প্রদেশ অতিক্রম করেন।

[1] অভিজ্ঞতায়: দীর্ঘ পদযাত্রায় কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দের কাছে নতুন করে ধরা দেয় তাদের দেশ, দেশের মানুষ ও বিভিন্ন জাতিগােষ্ঠী। ভবিষ্যৎ দেশগঠনের ক্ষেত্রে এই অভিজ্ঞতা তাঁদের দারুণভাবে সাহায্য করে।

[2] কষ্টসহিয়ুতায়: দীর্ঘ পদযাত্রার ওই অসহ্য পরিশ্রম চিনা কমিউনিস্টদের কষ্টসহিয়ুতা ও নিয়মানুবর্তিতা সম্বন্ধে নতুন করে শিক্ষা দেয়, যা পরে কুয়ােমিনতাং বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে তাদের শক্তি জুগিয়েছিল।

[3] অপ্রতিদ্বন্দ্বী মানসিকতা গঠনে: যে-কোনাে প্রতিরােধ বা বাধাকে তুচ্ছ করে অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌছােনাে যায় দৃঢ় মানসিকতার সাহায্যে, তার উজ্জ্বল নিদর্শন এই পদযাত্রা। চিনের মাটিতে লালফৌজ যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী এ কথা প্রমাণিত হয়।

[4] সহানুভূতি লাভে: দীর্ঘ ওই পদযাত্রায় কমিউনিস্টরা সাধারণ মানুষের কাছে আন্তরিকভাবেই সহানুভূতি ও সাহায্য লাভ করে। যা ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রগঠনের ক্ষেত্রে তাদের বিশেষ সাহায্য করেছিল।

[5] দক্ষতা ও আস্থা অর্জনে: লং মার্চ-এর ওই বিশাল সাফল্যের শেষে চিনা কমিউনিস্টরা যে-কোনাে সংকটকে অতিক্রম করার মতাে দক্ষতা ও আস্থা অর্জন করেছিল। এডগার স্নাে-র মতে—লং মার্চ শুধুমাত্র নিরাপদ স্থানে পৌছােনাের প্রচেষ্টা ছিল না, তা ছিল একসঙ্গে দেশ, দেশবাসী এবং আরও অনেক কিছুকে নতুনভাবে আবিষ্কারের অভিযান।