সূচনা: চিন পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসার আগে চিনের সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতি প্রভৃতি সবকিছুই অন্তর্মুখী ও পশ্চাৎপদ হয়ে পড়েছিল।
[1] প্রেক্ষাপট: চিন আফিম যুদ্ধে (১৮৩৯-৪২ খ্রি.) ব্রিটেনের কাছে পরাজিত হওয়ার পর বিদেশি পুঁজিপতিদের কাছে চিনের দরজা খুলে যেতে থাকে। নানকিং-এর সন্ধি (১৮৪২ খ্রি.), ওয়াংসিয়ার সন্ধি (১৮৪৪ খ্রি.), হােয়ামপােয়ার সন্ধি (১৮৪৪ খ্রি.), টিয়েনসিনের সন্ধি (১৮৫৮ খ্রি.) প্রভৃতির মাধ্যমে বিদেশি পুঁজিপতিরা চিনে প্রবেশ করে চিনকে লুণ্ঠনের মৃগয়াভূমিতে পরিণত করে। বৈদেশিক ক্ষেত্রে চিনের ধারাবাহিক ব্যর্থতার ফলে সচেতন চিনারা উপলব্ধি করতে শুরু করে যে, আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা ও বিজ্ঞানচর্চা ছাড়া চিনের অগ্রগতি সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতিতে পাশ্চত্যের খ্রিস্টান মিশনারিরা চিনে আসতে শুরু করলে সেদেশের বহু স্বাধীনচেতা বুদ্ধিজীবী পাশ্চাত্য শিক্ষাকে স্বাগত জানায়।
[2] প্রথম পর্বের মিশনারি: খ্রিস্টান মিশনারিদের মধ্যে সর্বপ্রথম চিনে আসেন অ্যাংলাে-স্কটিশ রবার্ট মরিসন (১৭৮২-১৮৩৪ খ্রি.)। তিনি চিনে এসে (১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে) চিনা ভাষা শেখেন এবং এই ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করেন। আমেরিকার খ্রিস্টান মিশনারিদের মধ্যে সর্বপ্রথম চিনে। আসেন এলিজা কোলম্যান ব্রিজম্যান (১৮৩০ খ্রি.)। খ্রিস্টান সাহিত্য প্রসারের উদ্দেশ্যে তিনি চিনে মুদ্রণযন্ত্র স্থাপন করেন। আমেরিকার পিটার পার্কার চিনে এসে (১৮৩৫ খ্রি.) সেখানকার মানুষের চিকিৎসার উদ্দেশ্যে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। চিন প্রথম আফিমের যুদ্ধে (১৮৩৯-৪২ খ্রি.) ইংল্যান্ডের কাছে পরাজিত হয়ে নানকিং-এর সন্ধি (১৮৪২ খ্রি.) স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। এর দ্বারা চিন তার পাঁচটি বন্দর বিদেশিদের বাণিজ্যের জন্য খুলে দিতে বাধ্য হলে এসব স্থানে অবাধে খ্রিস্টান মিশনারিরা এসে তাদের সংগঠন গড়ে তুলতে থাকে। টিয়েনসিনের সন্ধির (১৮৫৮ খ্রি.) পর তারা চিনের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
[3] পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার: আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে চিনে ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম তুং ওয়েন কুয়ান বা বিদেশি ভাষা শিক্ষার কলেজ স্থাপিত হয়। এই কলেজে ইংরেজি, ফরাসি, রুশ, জার্মান প্রভৃতি ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে এই কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬৩। এই ১৬৩ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩৮ জন ইংরেজি, ২৫ জন ফরাসি, ১৫ জন রুশ, ১০ জন জার্মান ভাষা শিক্ষাগ্রহণ করে। এখানে গণিত, জ্যোতিষশাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, শারীরবিদ্যা, আন্তর্জাতিক আইন প্রভৃতি বিভিন্ন আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ করে। তুং ওয়েন কুয়ান কলেজটি ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে ‘ইম্পিরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়’-এর অন্তর্ভুক্ত হয়।
[4] অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: তুং ওয়েন কুয়ান কলেজের অনুকরণে ১৮৬৩-৬৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সাংহাই, ক্যান্টন, ফুচাও প্রভৃতি শহরে এরূপ বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। পশ্চিমের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গণিত, আন্তর্জাতিক আইন প্রভৃতি বিষয়ের বহু মূল্যবান গ্রন্থ চিনা ভাষায় অনুবাদ করা হয়। মিশনারিরা তাদের মুদ্রিত বাইবেল, ইতিহাস ও বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থগুলি চিনে ছড়িয়ে দেয়। তারা চিনে বহু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে এবং এগুলির উন্নতি ঘটায়। এর ফলে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পাশ্চাত্যের আদর্শ ও ধ্যানধারণা চিনাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
[5] মিশনারিদের অন্যান্য প্রয়াস: মিশনারিদের উদ্যোগে চিনে বহু বিদ্যালয়, গ্রন্থাগার, জাদুঘর প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের উদ্যোগে ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে চিনের সাংহাই শহরে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি বিষয়ক একটি সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়।
[6] কাং-ইউ-ওয়ের উদ্যোগ: অষ্টাদশ শতকের ইউরােপীয় দর্শন ও রাজনৈতিক আদর্শের অনুরাগী কাং-ইউ-ওয়ে চিনে খ্রিস্টান মিশনারিদের সংস্কার কর্মসূচির অন্যতম সহযােগীতে পরিণত হন। তিনি চিনে আগত টি. রিচার্ড, ইয়ং জে. অ্যালেন ও অন্যান্য মিশনারিদের লেখার দ্বারা প্রভাবিত হন। কাং-ইউ-ওয়ে এসব মিশনারিদের সঙ্গে মিলিতভাবে চিনে আধুনিক শিক্ষা প্রসারের কাজে নেমে পড়েন।
[7] মিশনারিগণ: চিনে সংস্কার আন্দোলনের প্রয়ােজনের প্রেক্ষাপটে খ্রিস্টান মিশনারি বা ধর্মপ্রচারকগণ সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ব্রিটেনের আলেকজান্ডার উইলিয়ামসন ও টি. রিচার্ড, আমেরিকার ইয়ং জে. অ্যালেন, ও এ. পি. মার্টিন প্রমুখ খ্রিস্টান মিশনারি চিনে সংস্কার আন্দোলনে বিশেষ উদ্যোগ নেন।
উপসংহার: দীর্ঘদিনের প্রয়াসে চিনে আগত মিশনারিরা বিভিন্ন সােসাইটি গড়ে তােলেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল লন্ডন মিশনারি সােসাইটি, আমেরিকান বাের্ড অব কমিশনার্স ফর ফরেন মিশনস, আমেরিকান রিফর্মড় মিশন, ব্যাপটিস্ট মিশন প্রভৃতি। তারা চিনে বেশ কয়েকটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে এবং পাশ্চাত্যের চিকিৎসা পদ্ধতি চালু করে। চিনের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উচ্চশিক্ষিত যুবকরা মিশনারিদের আধুনিক ভাবধারার দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হন।
Leave a comment