সূচনা: সুবিশাল দেশ চিন ছিল বিভিন্ন খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদের বিপুল ভাণ্ডার। চিনের বিভিন্ন স্থানে কয়লা, খনিজ তেল, লােহা, সােনা। ও অন্যান্য খনিজ সম্পদ পাওয়া যেত। চিনের মাঞ্চুরিয়া, বেজিং, সিন ও চিয়াং, সানজি, হেইলংজিয়াং, লিয়াওনিং, জিনিন, হেবেই, শানডং, ইউনান, কোয়াংসি, কোয়াং টুং প্রভৃতি স্থানে বিভিন্ন খনিজ সম্পদের বিশাল ভাণ্ডার ছিল। এই প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ কাজে লাগিয়ে চিনের ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনা থাকলেও বাস্তবক্ষেত্রে চিন এই সম্পদের সদ্ব্যবহার করতে পারেনি। এই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন বহিরাগত সাম্রাজ্যবাদী শক্তি চিনের খনিজ সম্পদ হস্তগত করে নিজেদের দেশে রপ্তানি করতে থাকে।
[1] আধিপত্যের সূত্রপাত: প্রথম আফিম যুদ্ধের পর চিনের ওপর ইংল্যান্ড নানকিং-এর সন্ধি (১৮৪২ খ্রি.) চাপিয়ে দেয়। এরপর থেকে বিদেশিদের কাছে রুদ্ধ চিনের অভ্যন্তরে প্রবেশের পথ সহজ হয়ে যায়। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, আমেরিকা, রাশিয়া, জাপান প্রভৃতি বিভিন্ন দেশ চিনের বিভিন্ন অঞ্চলে নিজেদের প্রভাবাধীন অঞ্চল গড়ে তােলে এবং সেখানে নিজেদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।
[2] খনিজ সম্পদ রপ্তানি: চিনে নিজেদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে বিদেশি শক্তিগুলি সেখানকার খনিজ সম্পদের ওপর নিজেদের দখলদারি প্রতিষ্ঠা করে। তা ছাড়া বিদেশি জাতিগুলি বিপুল পরিমাণ অর্থ উৎকোচ দিয়ে চিন সম্রাটের কাছ থেকে সেখানকার বিভিন্ন খনিজ সম্পদ উত্তোলন করার অধিকার অর্জন করে এবং কয়লা, লােহা ও অন্যান্য ধাতুর আকরিক প্রভৃতি সংগ্রহ করে তা নিজেদের দেশে রপ্তানি করতে থাকে।
[3] রেলপথের ব্যবহার: চিনের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলি থেকে খনিজ সম্পদ সংগ্রহ করে তা নিজেদের দেশে রপ্তানির উদ্দেশ্যে বিদেশি শক্তিগুলি চিনে রেলপথের প্রসার ঘটায়। রাশিয়া রেলপথের মাধ্যমে চিনের সেন্ট পিটার্সবার্গ-এর সঙ্গে উত্তর সীমান্তের ভ্লাডিভস্টক বন্দরকে এবং ট্রান্স-সাইবেরীয় রেলপথের সঙ্গে পাের্ট আর্থার বন্দরকে যুক্ত করে। খনিজ সম্পদ উত্তোলনের পর তা রেলের মাধ্যমে চিনের বিভিন্ন বন্দরে এবং বন্দরগুলি থেকে বিদেশের শিল্প কারখানায় চলে যায়।
[4] অসম সন্ধির ভূমিকা: বৈদেশিক শক্তিগুলি চিনের ওপর বিভিন্ন অসম সন্ধি চাপিয়ে দিয়ে সেখানকার খনিজ সম্পদের ওপর দখলদারি কায়েম করে। জাপানের কাছে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে শিমােনােসেকির সন্ধি (১৮৯৫ খ্রি.) স্বাক্ষরে বাধ্য হলে চিন বিভিন্ন বিদেশি রাষ্ট্রের সহায়তা লাভের আশা করে। এই সুযােগে ফ্রান্স চিনের ইউনান, কোয়াংসি এবং কোয়াং টুং অঞ্চলের খনিজ সম্পদের অধিকার লাভ করে। ফ্রান্স ইন্দেচিনের আনাম থেকে চিনের অভ্যন্তর ভাগ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিত রেলপথ নির্মাণের অধিকার পায়। এই রেলপথের মাধ্যমে চিনের ইউনান, কোয়াংসি, কোয়াং টুং প্রভৃতি অঞ্চলের খনিজ সম্পদকে রপ্তানির উদ্দেশ্যে বন্দর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার সুযােগ তৈরি হয়। অর্থনীতির সাংবাদিক মার্টিন জ্যাক (Martin Jacques) তার হোয়েন চায়না রুলস্ দ্য ওয়ার্ল্ড গ্রন্থে বলেছেন যে, “অষ্টাদশ শতকেও চিন এবং ইংল্যান্ডের জীবন প্রায় একরকম ছিল। কিন্তু নিউ ক্যাসল খনিতে কয়লাপ্রাপ্তি, সমুদ্র বাণিজ্যই তফাত গড়ে দিয়েছিল। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স তখন এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ তৈরি করে সেখানকার জমি, কৃষিজ ও খনিজ সম্পদ দখল করেছিল।”
উপসংহার: চিনের খনিজ সম্পদ দীর্ঘকাল ধরে বিদেশে রপ্তানি হতে থাকলে এর বিরুদ্ধে চিনে ক্ষোভ দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে মাঞ্চু শাসকগণ বিদেশি বণিকদের বাণিজ্যের লাইসেন্স প্রদান সংকুচিত করেন। চিনের নতুন খনি থেকে সম্পদ উত্তোলনে বিদেশিদের দাবি প্রত্যাখ্যান করা হয়। অবশ্য কিছু কিছু প্রত্যন্ত ও পিছিয়ে-পড়া অঞ্চলে খনিজ সম্পদ উত্তোলনে চিনে সম্রাট অনুমতি দেন। চিনের খনিজ সম্পদ বিদেশে রপ্তানির বিরুদ্ধে বিংশ শতকের শুরুতে ক্ষোভ তীব্রতর হয়। ফলে চিনের খনিজ সম্পদে বিদেশি শােষণ কমতে থাকে।
Leave a comment