সূচনা: উনবিংশ ও বিংশ শতকে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জাপান প্রভৃতি ইউরােপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি চিনকে বিভিন্ন যুদ্ধে পরাজিত করে এবং নিজেদের অর্থনৈতিক ও সামরিক আধিপত্যের প্রসার ঘটিয়ে তার ওপর বেশ কয়েকটি একতরফা শােষণমূলক চুক্তি চাপিয়ে দেয়। এই চুক্তিগুলি সাধারণভাবে ‘অসম চুক্তি’ বা ‘বৈষম্যমূলক চুক্তি’ নামে পরিচিত।
[1] নানকিং-এর চুক্তি
-
যুদ্ধ: প্রথম ইঙ্গ-চিন যুদ্ধ বা প্রথম অহিফেন যুদ্ধে (১৮৩৯-৪২ খ্রি.) পরাজিত হয়ে চিন ব্রিটিশদের সঙ্গে নানকিং-এর সন্ধি (১৮৪২ খ্রি.) স্বাক্ষরে বাধ্য হয়।
-
সন্ধির শর্তাবলি: নানকিং-এর সন্ধির দ্বারা- [a] ক্যান্টন, সাংহাই, অ্যাময়, ফুচাও, নিংপােচিনের এই পাঁচটি বন্দর ইউরােপীয় বণিকদের বাণিজ্য ও বসবাসের জন্য খুলে দেওয়া হয়। [b] হংকং বন্দর চিরকালের জন্য ইংরেজদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। [c] ক্যান্টন বন্দরের বাইরে অবস্থান করে কোন নামে বণিকদের মাধ্যমে চিনের সঙ্গে ব্রিটিশদের বাণিজ্য করার প্রথা বাতিল হয়।
[2] বগ-এর চুক্তি: নানকিং-এর সন্ধির কিছুকাল পর ব্রিটিশ সরকার চিনের ওপর বগ-এর সন্ধি (১৮৪৩ খ্রি.) চাপিয়ে দেয়। এই সন্ধির দ্বারা ব্রিটেন চিনে কিছু ‘অতি রাষ্ট্রিক অধিকার’ (Extra-Territorial Rights) লাভ করে। এই চুক্তির দ্বারা一
-
[i] চুক্তি বন্দর পুলিতে বসবাসকারী চিনা ও ব্রিটিশ অধিবাসীদের ওপর চিনের আইন ও প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ লুপ্ত হয়। তারা ব্রিটিশ আইন ও বিচারব্যবস্থার অধীনে আসে।
-
[ii] চিন অন্য কোনাে বিদেশি রাষ্ট্রকে ভবিষ্যতে যেসব সুযােগসুবিধা দেবে সেগুলি ব্রিটেনকেও দিতে প্রতিশ্রুতি দেয়।
[3] ওয়াংঘিয়ার চুক্তি: অন্যান্য ইউরােপীয় শক্তিগুলি চিনের কাছ থেকে বেশ কিছু বাণিজ্যিক সুবিধা আদায় করলে দুর্বল চিন আমেরিকার সঙ্গে ওয়াংঘিয়ার চুক্তি (১৮৪৪ খ্রি., ৩ জুলাই) সাক্ষর করে। এই চুক্তির দ্বারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিনে বিভিন্ন অতি রাষ্ট্রিক সুবিধা লাভ করে।
[4] হােয়ামপােয়ার চুক্তি: ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দের ২৪ অক্টোবর ফ্রান্স চিনের ওপর হােয়ামপােয়ার চুক্তি চাপিয়ে দেয়। চিনের কাছ থেকে ব্রিটেন ইতিমধ্যে যেসব সুযােগসুবিধা আদায় করেছিল ফ্রান্সও হােয়ামপােয়া চুক্তির দ্বারা সেসব সুযােগসুবিধা আদায় করে। এই সন্ধির দ্বারা一
-
[i] চিনের নতুন পাঁচটি বন্দর ফরাসি বণিকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
-
[ii] ফরাসি নাগরিকরা চিনে অতি-রাষ্ট্রিক সুবিধা লাভ করে।
-
[iii] চিন ও ফরাসি বণিকদের মধ্যে বণিক-শুল্ক নির্দিষ্ট হয়।
[5] আইগুন-এর সন্ধি: ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের কাছে দ্বিতীয় অহিফেন যুদ্ধে চিন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সেই সুযােগে চিনের ওপর রাশিয়া আইগুন-এর সন্ধি (১৮৫৮ খ্রি. ২৮ মে) চাপিয়ে দেয়। এই সন্ধির দ্বারা—
-
[i] চিনের উত্তরাংশের বেশ কিছু এলাকায় রাশিয়ার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
-
[ii] চিনের আমুর, উসুরি ও সংঘুয়াজিয়াং নদীতে একমাত্র রাশিয়া ও চিনের নৌ-চলাচল স্বীকৃত হয়।
[6] টিয়েনসিনের চুক্তি: ইউরােপীয় শক্তিগুলি চিনে আরও সুবিধা পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে।
-
যুদ্ধ: ব্রিটেন ও ফ্রান্স চিনকে দ্বিতীয় অহিফেন যুদ্ধে (১৮৫৬-৫৮ খ্রি.) পরাজিত করে টিয়েনসিনের সন্ধি (১৮৫৮ খ্রি. জুন) স্বাক্ষরে বাধ্য করে।
-
সন্ধির শর্তাবলি: টিয়েনসিনের সন্ধির শর্তানুসারে, [i] চিন সরকার ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সকে প্রচুর ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়। [ii] বিদেশি বণিকদের জন্য চিনের আরও ১১টি বন্দর খুলে দেওয়া হয়। [iii] রাজধানী পিকিং-এ বিদেশি দূতাবাস স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
[7] পিকিং-এর সন্ধি: চিন সরকার টিয়েনসিনের চুক্তি অনুমােদনে টালবাহানা করলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। শেষপর্যন্ত ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের ২৪ অক্টোবর চিন আরও কিছু সুযােগসুবিধা দিয়ে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সঙ্গে পিকিং-এর সন্ধি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়।
[8] শিমােনাসেকির সন্ধি: চিনের কোরিয়ার ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে চিন-জাপান যুদ্ধ (১৮৯৪-৯৫ খ্রি.) শুরু হয়। এই যুদ্ধে হেরে চিনের ওপর জাপান শিমােনােসেকির সন্ধি (১৮৯৫ খ্রি.) চাপিয়ে দেয়। চিনে জাপানের সাফল্যে আতঙ্কিত হয়ে ইউরােপীয় শক্তিগুলি চিনের বিভিন্ন অংশে নিজ নিজ ‘প্রভাবাধীন অঞ্চল’ গড়ে তােলে। ঐতিহাসিক হ্যারল্ড ভিনাক এই অবস্থাকে ‘চিনা তরমুজের খণ্ডীকরণ’ বলে অভিহিত করেছেন। শিমােনােসেকির সন্ধির শর্তানুসারে一
-
[i] কোরিয়াকে চিন স্বাধীনতা দেয়।
-
[ii] চিনের কাছ থেকে জাপান পেস্কাডােরেস, তাইওয়ান, লিয়াও টুং উপদ্বীপ ও পাের্ট আর্থার লাভ করে।
-
[iii] জাপানকে চিন ২৩০ মিলিয়ন কিউপিং টেল ক্ষতিপূরণ দেয়।
-
[iv] চিন তার বেশ কয়েকটি বন্দর জাপানের জন্য খুলে দেয়।
[9] বক্সার প্রােটোকল
-
বক্সার বিদ্রোহ: চিং (বা কিং) বংশের (১৬৪৪-১৯১২ খ্রি.) শাসনকালে চিনে বিদেশি শক্তিগুলির শােষণ, নির্যাতন ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে চিনে বক্সার বিদ্রোহ (১৮৯৯-১৯০১ খ্রি.) শুরু হয়।
-
শান্তি চুক্তি: শেষপর্যন্ত বিদেশি সম্মিলিত বাহিনী বিদ্রোহ দমন করে এবং চিনের ওপর ‘বক্সার প্রােটোকল’ (১৯০১ খ্রি., ৭ সেপ্টেম্বর) নামে এক চুক্তি চাপিয়ে দেয়। বক্সার প্রােটোকলের শর্তানুসারে一
-
[i] বিদ্রোহের সঙ্গে যুক্ত ১২ জন রাজপুরুষের প্রাণদণ্ড এবং শতাধিক রাজপুরুষকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়।
-
[ii] চিনের ওপর বিরাট অঙ্কের ক্ষতিপূরণের বােঝা চাপানাে হয়।
-
[iii] পিকিং-এর বিদেশি দূতাবাসগুলি রক্ষার জন্য সেখানে স্থায়ীভাবে বিদেশি সেনা মােতায়েন করা হয়।
-
[iv] চিনের ২৫টি দুর্গ ভেঙে ফেলা হয় এবং ১২৫টি রেলস্টেশন ইউরোপীয় সেনাদের দখলে রাখা হয়।
উপসংহার: চিনে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও আমেরিকা যেসব অতিরাষ্ট্রিক সুযােগসুবিধা লাভ করেছিল তা অন্তত ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বজায় থাকে। চিনের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটেন ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে হংকং-এর ওপর এবং পাের্তুগাল ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে ম্যাকাও-এর ওপর তাদের দাবি ত্যাগ করে।
Leave a comment