প্রশ্নঃ চার্জ কি? একটি চার্জে কি কি বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে?

উত্তরঃ চার্জ বা অভিযোগ (Charge) ফৌজদারী বিচার কার্যক্রমে চার্জ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর যা অনুসন্ধান (inquiry) এবং বিচার (trial) কে পৃথক করে। একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি কি ধরণের অপরাধ করেছে এবং কার বিরুদ্ধে অপরাধটি সংঘটিত হয়েছে তা চার্জ হতেই জানা যায়। ফৌজদারী কার্যবিধিতে চার্জের কোন সংজ্ঞা দেয়া হয়নি। শুধু ৪ ধারায় বলা হয়েছে যে, charge includes any head of charge when the charge contains more heads than one. তবে বিচার বিভাগীয় ব্যাখ্যা হতে এর অর্থ অনুধাবন করা যায়।

ভারতীয় আদালতের অভিমত, In short charge is the precise formulation of the specific accusation made against a person who is entitled to know its nature at the earlier stage. [ AIR (1935) 81] অর্থাৎ‍ সংক্ষেপে চার্জ হচ্ছে কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের সংক্ষিপ্ত বিবরণ যার প্রকৃতি সম্পর্কে অভিযুক্ত ব্যক্তি প্রাথমিক স্তরেই জানার অধিকারী। বাংলাদেশের আদালত বলেন, A Charge should state the offence committed by the accused and mention the specific name of the offence if any specific name has been given to it by law, If the law does not give any specific name of the offence, particular should be set out to give requisite notice to the accused. অর্থাৎ অভিযুক্ত ব্যক্তি যে অপরাধ সংঘটিত করেছে চার্জে তা বিবৃত থাকবে এবং আইনে যদি সেই অপরাধের নির্দিষ্ট নামকরণ থাকে তবে চার্জে তা উল্লেখ থাকতে হবে। নাম না থাকলে অপরাধের বিবরণ থাকতে হবে যেনো অভিযুক্ত ব্যক্তি তা বুঝতে সক্ষম হয়।

এ সকল মতামত হতে বুঝা যায় যে, চার্জ হচ্ছে একটি লিখিত বিবরণ যাতে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি কর্তৃক কৃত অপরাধের সময়, স্থান, প্রকৃতি, এবং যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে তা করা হয়েছে এবং আইনের যে ধারার অধীনে অভিযুক্ত করা হয়েছে তা উল্লেখ থাকে।

এ সকল সংজ্ঞা হতে বুঝা যায় যে, অভিযুক্ত ব্যক্তিকে যে বিচারের সম্মুখীন করা হচ্ছে সেটা সম্পর্কে তাকে বিস্তারিতভাবে জানানো যেনো আত্মপক্ষ সমর্থনে সে ব্যক্তি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। যদি অস্পষ্টভাবে চার্জ গঠন করা হয় যাতে অপরাধের প্রয়োজনীয় উপাদান অবর্তমান থাকে তাহলে সে চার্জ ত্রুটিযুক্ত হবে বলে আদালত অভিমত ব্যক্ত করেন (এ আই আর ১৯৪৫ এলাহাবাদ ৮১)

একটি চার্জে নিম্নোক্ত বিষয়গুলি অন্তর্ভুক্ত থাকবেঃ

১. ২২১ ধারার বিধান মতে প্রতিটি অভিযোগে নিম্নোক্ত বিষয় অন্তর্ভূক্ত থাকবেঃ-

ক. আসামীকে যে অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করা হচ্ছে তার বিবরণ।

খ. যে আইনের অধীনে অপরাধটি সংঘটিত হয়েছে সেই আইনে উক্ত অপরাধের নাম থাকলে সেই নাম।

গ. নাম না থাকলে বিবরণটা এমনভাবে থাকতে হবে যেন অভিযুক্ত ব্যক্তি তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ভালভাবে বুঝতে পারে।

ঘ. যে আইন ও ধারা বলে অপরাধটি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে তার উল্লেখ।

ঙ. অভিযুক্ত ব্যক্তি পূর্বে কোন অপরাধের জন্য দন্ডিত হবার কারণে পরবর্তী অপরাধের ক্ষেত্রে বর্ধিত দন্ড বা ভিন্ন প্রকৃতির দন্ডে দন্ডনীয় প্রতীয়মান হলে এবং পরবর্তী অপরাধের দণ্ড বৃদ্ধি বা প্রকৃতি পরিবর্তনের জন্য পুর্ববর্তী দণ্ড প্রমাণ করার প্রয়োজন হলে, অভিযোগে পূর্ববর্তী দণ্ডের ঘটনা, তারিখ ও স্থান উল্লেখ করতে হবে। এরূপ উল্লেখ করা না হয়ে থাকলে আদালত দণ্ডদানের পূর্বে যে কোন সময়ে তা যোগ করতে পারেন। কোন ক্ষেত্রে অভিযোগ প্রণয়ন করা হলে তা এই মর্মে বিবৃতি দেয়ার শামিল হয় যে, উক্ত বিশেষ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অপরাধটি সংঘটনের জন্য আইনতঃ যে সকল শর্ত রয়েছে তা পূরণ করা হয়েছে।

চ. ইংরেজী বা আদালতের ভাষায় অভিযোগ প্রণয়ন করতে হবে।

২. ক. ২২২ ধারার বিধান মতে, কথিত অপরাধের সময় স্থান এবং যার বিরুদ্ধে অপরাধ করা হয়েছে সেই ব্যক্তি (যদি থাকে) অথবা যে বস্তু সম্পর্কে অপরাধ করা হয়েছে সেই বস্তু (যদি থাকে) সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য অভিযোগে থাকবে।

খ. অপরাধমূলক বিশ্বাস ভঙ্গ বা অর্থ আত্মসাতের ক্ষেত্রে মোট অর্থের পরিমাণ এবং কোন সময়ের মধ্যে তা সংঘটিত হয়েছে তা উল্লেখ করলেই চলবে। বিভিন্ন তারিখের বিবরণ না দিলেও তা চলবে যদি প্রথম ও শেষ কৃত অপরাধের মধ্যে ১ বছর সময়সীমা অতিক্রম না করে থাকে।

৩. ২২৩ ধারায় বলা হয়েছে যে, যখন অপরাধটির ধরণ বা প্রকৃতি এমন যে, ২২১ ও ২২২ ধারা মতে উল্লেখিত তথ্যাবলী দ্বারা অভিযুক্ত ব্যক্তি তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পর্কে ঠিকমত বুঝতে পারে না, তখন চার্জে তথ্যগুলি এমনভাবে বিবৃত করতে হবে যেনো অভিযুক্ত ব্যক্তি তা ভালভাবে বুঝতে পারে।

৪. যে আইন অনুসারে অপরাধটি দণ্ডনীয় তা ২২৪ ধারা অনুসারে চার্জে উল্লেখ করতে হবে এবং আইনে উক্ত অপরাধের যেভাবে নামকরণ রয়েছে সেভাবেই অভিযোগে উল্লেখ করতে হবেঃ

৫. চার্জ বা অভিযোগে যদি কোন ভুল থেকে যায় কিংবা কিছু বাদ পড়ে যায় তবে ২২৫ ধারার বিধান অনুসারে তা মামলার যে কোন পর্যায়ে মারাত্মক হিসেবে গণ্য হবে না যদি না তা আসামীর বিভ্রান্তি সৃষ্টি ও ন্যায়বিচার ব্যাহত না করে।

৬. ২২৭ ধারা অনুসারে রায় ঘোষণার পূর্বে যে কোন সময়ে আদালত চার্জ পরিবর্তন বা সংযোজন করতে পারেন। এরূপ প্রতিটি পরিবর্তন বা সংযোজন সম্পর্কে আসামীকে অবহিত করতে হবে। (২২৬ ধারাটি ১৯৭৮ সালে বাতিল করা হয়েছে)।

৭. ২২৮ ধারায় বলা হয়েছে যে, আসামীর আত্মপক্ষ সমর্থন ও সরকার পক্ষের মামলা পরিচালনায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলে নতুন বা পরিবর্তিত চার্জকে মূল চার্জ হিসেবে গণ্য করে বিচার শুরু করতে পারেন।

৮. আদালত যদি মনে করেন যে, নতুন, পরিবর্তিত বা সংযোজিত চার্জের প্রকৃতি এমন যে, অবিলম্বে বিচার শুরু করলে আসামী বা বাদী পক্ষের ক্ষতির সম্ভাবনা আছে, তাহলে নতুন করে বিচার কার্যক্রম শুরু করতে পারেন অথবা প্রয়োজনীয় সময়ের জন্য বিচারটি মুলতবী রাখার আদেশ দিতে পারেন। (২২৯ ধারা)

৯. ২৩০ ধারায় বলা হয়েছে যে, নতুন পরিবর্তিত বা সংযোজিত চার্জে বর্ণিত অপরাধ যদি এমন প্রকৃতির হয় যে, ঐ মামলা চালানোর জন্য পুর্ব অনুমতির প্রয়োজন তবে সেই অনুমতি না হওয়া পর্যন্ত মামলা চালানো যাবে না। তবে যে সকল তথ্যের জন্য চার্জের পরিবর্তন করা হয়েছে, সে সকল তথ্য যদি নালিশে আগেই সন্নিবেশীত থাকে তবে সেক্ষেত্রে নতুন করে অনুমোদনের প্রয়োজন হয় না।

১০. বিচার শুরু হওয়ার পর আদালত চার্জের পরিবর্তন বা সংযোজন করলে অভিযোগকারীর বা আসামী পক্ষের যে সকল সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়েছে, তাদেরকে পুনরায় ডেকে ২৩১ ধারা অনুসারে পরিবর্তিত বা সংযোজিত জবানবন্দী সম্পর্কে জবানবন্দী গ্রহণ করা যায়। এছাড়া আদালত প্রয়োজনীয মনে করলে অতিরিক্ত সাক্ষী ও তলবের অনুমতি দিতে পারেন।

১১. ২৩২ ধারায় বলা হয়েছে যে, আপীল আদালত বা হাইকোর্ট বিভাগ যদি মনে করেন যে, চার্জে ভুল থাকায় দণ্ডিত ব্যক্তি আত্মপক্ষ সমর্থনে বিভ্রান্ত হয়েছে, তবে আদালত যা উপযুক্ত মনে করবেন তা করবেন অথবা নিম্ন আদালতকে নতুন বিচারের নির্দেশ দিবেন। এছাড়া হাইকোর্ট বিভাগ বা আপীল বিভাগ যদি মনে করেন যে, প্রমাণিত তথ্য অনুসারে আসামীর বিরুদ্ধে বৈধ চার্জ আনা যেতো না তাহলে তার বিরুদ্ধে প্রদত্ত দণ্ডাজ্ঞা বাতিল করে দিবেন।