অথবা, “চারটি সূত্র থেকে সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি হয়েছে”- জিন্সবার্গ। উক্তিটি বিশ্লেষণ কর।
ভূমিকাঃ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষাপটে সমাজবিজ্ঞানের বৈজ্ঞানিক সূত্র প্রদানের চেষ্টা শুরু হয়েছিল। ফলশ্রুতিতে সমাজবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক চিন্তা নানাভাবে পরিপুষ্টতা ও বৈচিত্র্যতার সৃষ্টি হয়েছে। পাশ্চাত্য দেশগুলােতে সমাজবিজ্ঞানের ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে তিনটি ঐতিহাসিক ধারা লক্ষ্য করা যায়। সমাজবিজ্ঞান ইতিহাস, দর্শন ও সামজিক প্রকৃতি বিজ্ঞানে ভূমিকা গ্রহণ করেছিল ধারণা করা হয় চারটি মুখ্য বৈদিক পূর্বসূরি এর বিকাশের জন্য মৌলিকভাবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। আলােচ্য উক্তি অনুসারে জিন্সবার্গ মূলত চারটি বৃদ্ধিভিত্তিক ধারাকে সমাজবিজ্ঞান বিকাশের অন্যতম কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। নিম্নে আলােচ্য উক্তিটি ব্যাখ্যা করা হলাে:
(১) রাষ্ট্রীয় দর্শন সম্পর্কিত ধারণাঃ রাষ্ট্রীয় দর্শনের বিকাশের সাথে সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। প্লেটো এবং এরিস্টটলকে রাষ্ট্রিয় দর্শনের প্রধান গুরু হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। খ্রিষ্টপূর্ব চার শত বছর পূর্বে প্লেটো তার Republic গ্রন্থে এবং তারই শিষ্য এরিষ্টটল তার Politics এবং Ethics গ্রন্থে সমাজ ও সামাজিক সাম্যবাদ সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা করা করেন। ক্রুসেডের যুদ্ধে খ্রিষ্টানদের মুসলমানরা পরাজিত করে। তারপর মুসলমানরা তৎকালীন ব্যবসা-বাণিজ্যের একমাত্র মাধ্যম ভূমধ্যসাগরীয় জলপথ বন্ধ করে দেয়। ফলে খ্রিষ্টান বণিকেরা বিশ্বের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল। তারা অনেক ভৌগােলিক অঞ্চল আবিষ্কারে সক্ষম হয় এবং একই সাথে জ্ঞান অর্জন করে। কৃষক ও দাসরা সামন্ত প্রভুর পীড়ন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শহরের কলকারখানা কাজ শুরু করেছিল। ফলে দ্রুত শিল্পবিল্পব শুরু হয়। এসময়ের গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনগুলো হলো-
(ক) অতিপ্রাকৃতের পরিবর্তে প্রাকৃতিক ধারণার সৃষ্টিঃ অতিপ্রাকৃতের পরিবর্তে প্রাকৃতিক ধারণার সৃষ্টি হয়। প্রাকৃতিক আইন দ্বারা স্বর্গীয় আদেশের ধারণার পরিবর্তন হয় এবং ধর্মীয় যাজকদের স্থানে দার্শনিকদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
(খ) সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে যৌক্তিক ধারণার পরিবর্তনঃ উন্নত ও যৌক্তিক ধ্যান-ধারণার সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিকসহ সকল ধরনের সমস্যা সমাধানের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়।
(গ) মানুষ ও সমাজের পূর্ণতাঃ তারা বিশ্বাস করতে মানুষ ও সমাজের পূর্ণতা যুগের কল্যাণ বয়ে আনবে।
(ঘ) অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধঃ মানুষের অধিকার বিশেষ করে শশাষণ, বঞ্চনা ও দুর্নীতিপরায়ণ সরকারকে উচ্ছেদের জন্য এরা ঐক্যবদ্ধ হয়। এর ফলে ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হয়। এ বিপ্লবে প্রগতিশীলরা জয়ী হয়। কিন্তু তারা তাদের প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেনি। পরবর্তী পর্যায়ে অগাষ্ট কোঁৎ তাদের দল থেকে বেরিয়ে ১৮২২ সালে Physical Science নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। ১৮৩৯ সালে তিনি Positive Philosophy গ্রন্থে চতুর্থ খণ্ডে Sociology শব্দটি ব্যবহার করে সমাজবিজ্ঞানের সূত্রপাত ঘটান।
(২) ইতিহাসের দর্শন সম্পর্কিত ধারণাঃ ইতিহাস দর্শন সমাজবিজ্ঞানের বিকাশের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ইতিহাস নিজস্ব গতিধারার জন্য স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দ্বারা আবৃত। ঐতিহাসিক তথ্য ও ঘটনাবলি বৈজ্ঞানিক আকারে বিশ্লেষণ করাই হচ্ছে ইতিহাস দর্শনের কাজ। ইতিহাস দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা মনীষীদের মধ্যে Saint Pleree, Vico, Ibn Khaldun নাম উল্লেখযােগ্য।
পাশ্চাত্যে প্রথম ইতিহাস দর্শনের বৈজ্ঞানিক আলােচনার ভিত্তি স্থাপন করেন Vico. তিনি এর নাম দেন New – Science। এ গ্রন্থে ইতিহাসের গতি প্রকৃতির বৈজ্ঞানিক আলােচনার সূত্রপাত করেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে একটি পৃথক পরিচ্ছন্ন ও স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাসের যাত্রা শুরু হয়। উল্লেখ্য উনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই ইতিহাস দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক ধারা Hegel এবং Saint Simon এর মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছিল। মানবীয় ব্যাপারেও তারা গবেষণা করেছিলেন। Marx এবং Comte তাদের দ্বারা প্রভাবিত হলেও তাদের ধারণাকে মেনে নেয় নিই। মূলত তাদের | প্রগতি সম্পর্কিত ধারণা থেকেই সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি।
জীববিজ্ঞানের বিবর্তন সম্পর্কিত ধারণাঃ সমাজতত্ত্বের উৎপত্তির পেছনে জীববিজ্ঞানে ব্যবহৃত দর্শন তত্ত্বের এক বিশেষ ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়। আপাত দৃষ্টিতে যদিও মনে হতে পারে যে, প্রাণীজগৎ কোনাে আইনের মাধ্যমে পরিচালিত হয় না। কিন্তু বিশ্লেষণে দেখা যায় প্রাণী বিবর্তন সূত্রের মাধ্যমে বিকশিত হয়। স্পেন্সারের সমাজ বিবর্তনের তাত্ত্বিক আলােচনা মূলত জৈব বিবর্তনের সাথে সম্পৃক্ত। তিনি সমাজের উদ্ভব, বিকাশ এবং পরিবর্তন ইত্যাদিকে বিশ্লেষণের জন্য যে উপমা ব্যবহার করেন, সেটি তার বিখ্যাত জৈবিক সাদৃশ্য তত্ত্ব নামে পরিচিত। তবে শুধু স্পেন্সারই নন, সমাজ বিবর্তনের ধারা বিশ্লেষণের জন্য বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্ন ধরনের সাদৃশ্য বা প্রত্যয় খুঁজে বেড়ান প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে। স্পেন্সারও ছিলেন তেমনি প্রথমদিককার একজন সমাজবিজ্ঞানী যিনি সমাজ বিকাশের ধারাটিকে বিশ্লেষণ করার জন্য জৈব বিকাশের ধারার সাথে তুলনা করেন।
অগাস্ট ক্যোঁৎ-এর লক্ষ্য ছিল প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ধারায় সমাজের একটি বিজ্ঞান গড়ে তােলা যাতে মানব সমাজের অতীত এবং ভবিষ্যৎ বিকাশ সম্পর্কে পূর্বাহ্নে ভবিষ্যদ্বাণী করা যাবে। সাথে সাথে কি করে একটি বিশেষ ঐতিহাসিক মুহূর্তে সমাজের স্থিতিশীলতা রক্ষা করা যায় সে সম্পর্কেও গবেষণা করেন। তাই তিনি সমাজের গতিশীলতা (Social) এবং স্থিতিশীলতা কিংবা বলা যায় প্রগতি এবং স্থিতি বা পরিবর্তন এবং পরিবর্তনশীলতা এই দুই স্তম্ভ নিয়েই তার আলােচনা চালিয়ে যান।
তিনি লক্ষ্য করেন যে, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানেও নিউটনের পর হতে এক ধরনের পরিবর্তন এসেছে। এখন আর বিজ্ঞানীরা কেবল চূড়ান্ত বা শেষ কারণ অনুসন্ধান করেন না বরং পর্যবেক্ষণ ও গভীর চিন্তার ওপর নির্ভর করেন এবং এভাবে প্রকৃত জ্ঞান লাভ করা যায়। প্রত্যেক বিজ্ঞানসম্মত তত্ত্বই পর্যবেক্ষণকৃত ঘটনাবলির ওপর ভিত্তি করে তৈরি হতে হবে কিন্তু সাথে সাথে একথাও সত্য যে, কোনাে ঘটনা তত্ত্বের তত্ত্বাবধান ছাড়া পর্যবেক্ষণ করা যায় না। এভাবে ক্যোঁৎ যে বিজ্ঞানটি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন তান নাম দিলেন Social Physics কিন্তু তিনি যখন দেখলেন যে, তার এই প্রত্যয়টি একজন বেলজীয় সমাজ পরিসংখ্যানবিদ চুরি করেছেন, তখন ১৮৩৯ সালে Positive Philosophy নামক পুস্তকের ৪র্থ খণ্ডে তার বিজ্ঞানটির নতুন নামকরণ করেন Sociology।
সামাজিক জরিপঃ সামাজিক জরিপ সমাজবিজ্ঞান বিকাশের আরেকটি উৎস। ইউরােপের বৈপ্লবিক পরিবেশ ও সামাজিক পরিবর্তনের এক ক্রান্তিলগ্নে সমাজবিজ্ঞান একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে জন্মলাভ করেছিল। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত বা প্রকৃতিরই খেয়াল- মানুষের এই সম্পর্কিত ধারণা শিল্প বিপ্লবের পরে দূর হয়। মালিকগুলাে অধিক মুনাফা লাভের জন্য সদা কাজ করে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে রয়েছে শ্রমিকদের জীবনে দারিদ্র, রােগ, জরাব্যাধি ধরনের সমস্যা নিত্য নৈমিত্তিক। শিল্পায়িত অঞ্চলে জরিপ চালিয়ে সমাজ গবেষকরা শ্রমিকদের দারিদ্র্যের কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। তাদের মধ্যে ধারণা জন্মে যে, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে সবকিছু মাপজোখ করা যায় অনুরূপ মানুষের সমস্যাবলি সম্পর্কেও গবেষণা পরিচালনা করা হয়। Charles Booth এর লেখা Life and Cabonr of the Pepole in London উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রাখে জরিপের ক্ষেত্রে।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, জিন্সবার্গ উপযুক্ত চারটি সূত্রকেই সমাজবিজ্ঞান বিকাশে অন্যতম কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তবে তার এই ধারণা নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। অনেকের মতে শুধুমাত্র এই চারটি উপাদান নয় অন্যান্য সূত্রও সমাজবিজ্ঞান বিকাশের সাথে জড়িত রয়েছে। সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে সমাজবিজ্ঞানে তার এই ধারণার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে।
Leave a comment