আধুনিককালের সমাজব্যবস্থা বিভিন্ন চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত। চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলির সরকারী ক্ষমতা দখলের আগ্রহ থাকে না। সরকার গঠন করা এদের উদ্দেশ্য নয়। সমস্বার্থের ভিত্তিতে গঠিত চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি সরকারী নীতির পরিবর্তন এবং সরকারী সিদ্ধান্তকে নিজেদের গোষ্ঠী স্বার্থের অনুকূলে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে থাকে। এদের উদ্দেশ্য হল সরকারের উপর প্রভাব খাটিয়ে গোষ্ঠী স্বার্থকে যথাসম্ভব সরকারী নীতির মধ্যে প্রতিফলিত করা এবং সরকারী ক্ষমতার সুযোগ গ্রহণ করা। তবে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই, বিশেষত পশ্চিমী গণতন্ত্রে, চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে। গোষ্ঠীস্বার্থ সাধনের জন্য এই গোষ্ঠীগুলি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যে কোন উপায়ে সরকারী সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। অ্যালমণ্ড ও পাওয়েল এর মতে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীসমূহ তাদের স্বার্থ সম্পর্কিত দাবি-দাওয়াগুলি রাজনীতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ সরকারের কাছে পেশ করে। Comparative Politics শীর্ষক গ্রন্থে তাঁরা বলেছেন: “We call the process by which individuals and groups make demands upon the political decision makers interest articulation.”
চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর পদ্ধতিগত পার্থক্য:
দেশভেদে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর পদ্ধতিতে পার্থক্য দেখা যায়। আবার একই দেশে রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানের কাঠামোগত পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে গোষ্ঠীর পদ্ধতিও পরিবর্তিত হয়ে থাকে। তাই চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর পক্ষে কোন স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। বস্তুত চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি গোষ্ঠীগত প্রভাব বিস্তারের উদ্দেশ্যে নানা পদ্ধতি অবলম্বন করে এবং বিভিন্ন স্তরে গোষ্ঠীগত কাজকর্ম পরিচালনা করে। তবে সাধারণত কোন্ স্তরে কোন্ চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী তার দাবি পেশ বা প্রভাব বিস্তারের ব্যাপারে উদ্যোগী হবে তা কতকগুলি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। এই সমস্ত বিষয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর সংগঠন, সদস্য সংখ্যা, গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য, সরকার ও সাধারণ মানুষের সংবেদনশীলতা প্রভৃতি।
(১) চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি শাসন বিভাগের উপর প্রভাব বিস্তার:
উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি সরকারী সিদ্ধান্তকে প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করার ব্যাপারে বিশেষভাবে উদ্যোগী হয়। এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য হল শাসন-বিভাগ বা আইন-বিভাগ অথবা উভয় বিভাগকেই প্রভাবিত করা। অ্যালান বল তাঁর Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “Pressure group methods in liberal democracies are mainly concerned with influencing the decision-making processes at the executive and the parliamentary levels…..” বর্তমান জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থায় শাসন-বিভাগের কার্যক্ষেত্র এবং ক্ষমতার পরিধি অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিক জটিলতার কারণে সরকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কার্যত রাজনীতিক শাসক এবং শাসন বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের হাতে এসে পড়েছে। অর্থাৎ সাম্প্রতিককালের উদারনীতিক গণতান্ত্রিক শাসন বিভাগের ক্ষমতা ক্রমসম্প্রসারণশীল। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলিও তাদের প্রভাব বিস্তারের কেন্দ্রের পরিবর্তন করেছে। বর্তমানে তাই প্রশাসনিক ক্ষেত্রে গোষ্ঠীগত ক্রিয়াকলাপের উপর বিভিন্ন গোষ্ঠীর সামগ্রিক স্বার্থ বহুলাংশে নির্ভরশীল। বিশেষত আর্থনীতিক চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীসমূহের স্বার্থ প্রশাসনিক কার্যকলাপের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। এই কারণে প্রশাসনিক পর্যায়েই এ ধরনের চাপসৃষ্টিকারী বিশেষভাবে আত্মনিয়োগ করে এবং সর্বাধিক তৎপরতা দেখিয়ে থাকে। বল বলেছেন: “As a general rule, with the increase in executive power and area of responsibility in the twentieth century at the expense of the legislature, pressure groups will attempt to concentrate their activities at administrative levels, …” বল আরও বলেছেন: “It is the most powerful economic interest groups that are likely to have access to government and their civil servants…” চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলির কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ ও সহযোগিতা লাভের ব্যাপারে সরকারী দপ্তরগুলি আগ্রহ দেখায়। তেমনি সরকারী দপ্তরসমূহের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার ব্যাপারেও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি তৎপর থাকে। তার ফলে সরকারী নীতি ও সিদ্ধান্ত শক্তিশালী চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর মতামতের দ্বারা প্রভাবিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন প্রভৃতি গণতান্ত্রিক দেশে এ রকম বহু নজিরের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়।
চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি আমলাতন্ত্রের উপর প্রভাব বিস্তার:
আমলাতন্ত্র ও রাজনীতিক প্রশাসকের সমন্বয়ে গঠিত হয় শাসন বিভাগ। চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি সাধারণত আমলাতান্ত্রিক স্তরেই অধিক সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আমলাতন্ত্র রাষ্ট্রপতি ও কংগ্রেসের প্রভাব থেকে বহুলাংশে মুক্ত। তাই গোষ্ঠীগুলির পক্ষে আমলাদের প্রভাবিত করা সহজে সম্ভব। তা ছাড়া সরাসরি রাষ্ট্রপতিকে প্রভাবিত করা সহজসাধ্য নয়। তাই চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি সরকারের স্থায়ী কর্মচারীদের প্রভাবিত করতে উদ্যোগী হয়। সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় কিন্তু গোষ্ঠীগুলি প্রশাসনের রাজনীতিক ও অ-রাজনীতিক উভয় অংশকেই সমভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে থাকে। অর্থাৎ চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী শাসন-বিভাগের উপর প্রভাব বিস্তারের জন্য রাজনীতিক শাসক বা আমলা শাসন-বিভাগের কোন্ অংশকে বেছে নেবে তা সরকারের কাঠামোর উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল।
(২) চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি সরকারের সংস্থাসমূহের প্রতিনিধি প্রেরণ:
চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি সরকারের বিভিন্ন সংস্থায় নিজেদের প্রতিনিধি পাঠিয়ে স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা করে। ব্রিটেনে বিভিন্ন স্থায়ী পরামর্শদাতা কমিটিতে বিভিন্ন চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর প্রতিনিধি গৃহীত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে শিক্ষক শিক্ষণ ও সরবরাহ সংক্রান্ত জাতীয় উপদেষ্টা সংস্থা’ (National Advisory Council on the Training and Supply of Teachers)-র কথাও বলা যায়। অনুরূপভাবে ফ্রান্সের ‘বাণিজ্য ও শিল্পসংস্থা’ (Chamber of Commerce and Industry)-র কথাও উল্লেখযোগ্য। সরকারী ও বে-সরকারী উভয় স্তরেই গোষ্ঠীগুলি সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখার চেষ্টা করে থাকে। নিজেদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে অনেক সময় তারা সরকারী বিভাগের কাছে বক্তব্য পেশ করে। বস্তুত ব্রিটেনে শাসন-বিভাগের সঙ্গে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর সম্পর্ক একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ধারণ করেছে। বল বলেছেন: “…..cooperation between government and organised groups is institutionalised in Britain through a wide variety of permanent advisory committees on which sit groups representatives alongside civil servants….”
(৩) চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি আইনসভার উপর প্রভাব বিস্তার:
সরকারের আইন-বিভাগীয় কার্যকলাপের উপরও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি প্রভাব বিস্তার করে থাকে। গোষ্ঠীস্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বিল উত্থাপন বা আলোচনার সময় চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি নিজেদের বক্তব্য আইনসভার সদস্যদের জানায় এবং তাদের উপর চাপ সৃষ্টি করে। বিভিন্ন স্বার্থের প্রতিনিধিরা সাধারণত আইনসভায় নির্বাচিত হয়ে থাকেন। বিভিন্ন চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী এই সমস্ত সদস্যের মাধ্যমে গোষ্ঠীগত বক্তব্য আইনসভায় পেশ করার ব্যবস্থা করে। এইভাবে তাদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। গোষ্ঠীগুলি স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আইনসভার বিভিন্ন কমিটির কাছে নিজেদের আরজি পেশ করে। ‘লবিং’ এক্ষেত্রে একটি সুপরিচিত পদ্ধতি। তবে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি এ বিষয়ে অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন দলীয় সদস্যদের সহযোগিতা ও আনুকূল্য লাভের ব্যাপারে বিশেষভাবে তৎপর হয়ে থাকে। ম্যাকার্থির মতানুসারে লবিস্টরা বিভিন্ন স্বার্থের প্রতিভূ হিসাবে বিভিন্ন উপায়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। ব্যক্তিগতভাবে আবেদন নিবেদন, লেনদেন, আইনসভার বিভিন্ন কমিটির কাছে বক্তব্য পেশ, আইনসভার সদস্যদের কাছে ব্যক্তিগতভাবে বক্তব্য পেশ প্রভৃতি উপায়ে আইনসভার সিদ্ধান্তকে তারা গোষ্ঠীস্বার্থের অনুকূলে আনার চেষ্টা করে। বল বলেছেন: “Bribery is still used at legislative levels. The Natural Gas bill of 1956 was defeated in the American Senate because of bribery allegations.” মার্কিন রাজনীতিক ব্যবস্থায় লবিং হল একটি অত্যন্ত প্রচলিত পদ্ধতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গোষ্ঠীগুলি কমিটিসমূহের মাধ্যমে কংগ্রেসের কার্যকলাপকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। মার্কিন কংগ্রেস কমিটিগুলি বিল উত্থাপন করতে পারে। এই কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী মার্কিন কংগ্রেসের কমিটিগুলির উপর প্রভাব বিস্তারের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীসমূহ সাধারণত গোপনে তাদের কাজকর্ম পরিচালনা করে থাকে। কিন্তু আইন-বিভাগের উপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে গোষ্ঠীগুলি গোপনীয়তা বজায় রাখার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায় না। বরং ক্ষেত্র বিশেষে প্রচারের মাধ্যমে তাদের কার্যসিদ্ধি হয়। এ প্রসঙ্গে বল বলেছেন: “Pressure group activity at parliamentary levels is generally more spectacular and less secretive, but it is doubtful whether the publicity it receives is always commensurate with its importance.”
(৪) চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি বিচার বিভাগের উপর প্রভাব বিস্তার:
বিচার-বিভাগের উপরও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি বিভিন্নভাবে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে থাকে। তবে বিচার-বিভাগকে প্রভাবিত করার ব্যাপারে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলির ক্ষমতা বিশেষভাবে সীমাবদ্ধ। তবুও প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলি বিচারক নিয়োগের ব্যাপারে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করে থাকে। তা ছাড়া গোষ্ঠীগুলি ব্যক্তিগত যোগাযোগের ভিত্তিতে গোষ্ঠীস্বার্থ সংক্রান্ত বিষয়ে বিচারপতিদের সিদ্ধান্তকে সাধ্যমত প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। বিচারপতিদের নিয়োগের ব্যাপারে আমেরিকা বার এ্যাসোসিয়েশনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া বিভিন্ন গোষ্ঠী নানাভাবে ও যোগাযোগের ভিত্তিতে বিচারপতিদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে থাকে। বল বলেছেন: “…in America, unlike other liberal democracies pressure groups have more opportunities of attempting to influence the judiciary.” অনেক সময় চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি পরীক্ষামূলকভাবে মামলা দায়ের করে এবং গোষ্ঠীস্বার্থের পক্ষে বিভিন্ন নজির পেশ করে বিচারপতিদের প্রভাবিত করতে উদ্যোগী হয়। বল বলেছেন: “Pressure groups will attempt to influence the selection of judges who usually have a politically active background, they can also use test cases and undertake public campaigns to influence particular decisions.” যাইহোক এ বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই যে সাধারণভাবে বিচার বিভাগের উপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। কারণ বিচারপতিরা চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীসমূহের চাপ প্রতিহত করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে সহায়ক উপাদান হিসাবে কতকগুলি বিষয় উল্লেখযোগ্য। এই বিষয়গুলি হল: বিচার বিভাগের সুদীর্ঘকালীন ঐতিহ্য, বিচারপতিদের কার্যকাল সম্পর্কিত নিরাপত্তা, নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে দায়বদ্ধ না থাকা প্রভৃতি। এতদ্সত্ত্বেও এ কথা ঠিক যে সামগ্রিক বিচারে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীসমূহের প্রভাব থেকে বিচার-বিভাগও পুরোপুরি মুক্ত নয়।
(৫) চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি বিক্ষোভ ও হিংসাত্মক আন্দোলন:
উপরিউক্ত অপেক্ষাকৃত অপ্রত্যক্ষ পদ্ধতিগুলির কথা বাদ দিলেও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি গোষ্ঠীস্বার্থ সংরক্ষণের স্বার্থে বিভিন্ন স্তরে বিক্ষোভ-আন্দোলনের সামিল হয়। বিক্ষোভ প্রদর্শনের সঙ্গে সঙ্গে গোষ্ঠীগুলি হিংসাত্মক কাজকর্মেরও আশ্রয় নেয়। বিক্ষোভ ও হিংসাত্মক আন্দোলনের মাধ্যমে গোষ্ঠীগুলি নিজেদের স্বার্থ সাধনের জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করে থাকে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে আসামে ‘আসু’-র নেতৃত্বে বিক্ষোভ ও হিংসাত্মক আন্দোলনের কথা বলা যেতে পারে। তা ছাড়া ব্রিটেন, ভারত প্রভৃতি উদারনীতিক গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন, ছাত্র সংগঠন ও বিভিন্ন বৃত্তি বা পেশাভিত্তিক গোষ্ঠীগুলি এই পদ্ধতিতে দাবি আদায়ের চেষ্টা করে।
(৬) জনমত গঠনের মাধ্যমে:
চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি স্বার্থ সংশ্লিষ্ট অভাব-অভিযোগ ও দাবি দাওয়ার ব্যাপক প্রচারের উদ্দেশ্যে গণসংযোগের মাধ্যমগুলিকে ব্যবহার করে থাকে। জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে গোষ্ঠীগুলি গোষ্ঠীস্বার্থের অনুকূলে জনমত সংগঠিত করতে উদ্যোগী হয়। এইভাবে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি নিজেদের দাবি-দাওয়া আদায়ের চেষ্টা করে থাকে।
(৭) জনস্বার্থের বাহক গোষ্ঠীগুলিকে সরকার উপেক্ষা করে না:
আইনসভায় প্রস্তাবিত আইন সম্পর্কে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি তাদের মতামত জানায়। তার ভিত্তিতে সরকার সমাজের বিভিন্ন অংশের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অবহিত হতে পারে। আবার এই গোষ্ঠীগুলির কাছ থেকে পাওয়া তথ্যাদির ভিত্তিতে আইন-বিভাগ শাসন-বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এইভাবে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি শাসন-বিভাগ ও আইন-বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখার ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। প্রকৃতপক্ষে এবং সামগ্রিক বিচারে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি দেশ ও দেশবাসীর বিভিন্ন ধরনের স্বার্থ ও আশা-আকাঙ্ক্ষাকেই সর্বসমক্ষে তুলে ধরে। গোষ্ঠীগুলি এইভাবে জনগণ ও সরকারের মধ্যে সংযোগ সাধন করে। এই কারণে সরকার চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলির বক্তব্য উপেক্ষা করার মত হঠকারিতা করে না।
(৮) জাতীয় স্বার্থের জিগির তুলে:
চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি অনেক সময় সংকীর্ণ গোষ্ঠীস্বার্থের প্রচেষ্টাকে আড়াল করার উদ্দেশ্যে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের কথা বলে। কারণ সংকীর্ণ গোষ্ঠীস্বার্থের পক্ষে প্রচার চালিয়ে সফল হওয়া মুশকিল। এই কারণে গোষ্ঠীগুলি জাতীয় স্বার্থ ও দাবি-দাওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যমূলক সম্পর্ক স্থাপনের মনোভাব ব্যক্ত করে। এবং এইভাবে নিজেদের অনুকূলে জনমত গঠনের চেষ্টা করে থাকে। বল বলেছেন: “National campaigns are the most conspicuous methods of pressure group activity and unless accompanied by activity at other levels are an indication of political weakness.”
(৯) চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি রাজনীতিক দলের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার:
চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি অনেক সময় রাজনীতিক দলের মাধ্যমে সরকারের কাছে নিজেদের দাবি-দাওয়া পেশ করে এবং তা আদায়ের চেষ্টা করে। কোন রাজনীতিক দল প্রকাশ্যে কোন চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর সঙ্গে সাধারণত যোগাযোগ রাখে না। তবে পরোক্ষভাবে বা রাজনীতিক দলের কোন শাখা সংগঠনের মাধ্যমে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির চেষ্টা করে। যেমন, ব্রিটেনে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি রাজনীতিক দলের সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে সরকারী সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। তা ছাড়া নির্বাচনের প্রাক্কালে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি রাজনীতিক দলের সঙ্গে নানাভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা করে। দল নির্বাচনে জয়ী হলে এবং সরকার গঠন করলে সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক দলের সমর্থক গোষ্ঠীগুলি স্বাভাবিকভাবে সরকারী সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার সুযোগ পায়।
(১০) চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার:
আবার ক্ষেত্রবিশেষে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি ব্যক্তিগত সম্পর্ক ব্যবহার করে সরকারের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে উদ্যোগী হয়। রাজনীতিক ক্ষেত্রে প্রাধান্যকারীদের কাছে দাবি-দাওয়া পেশ করার ক্ষেত্রে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর তরফে ব্যক্তিগত যোগাযোগ একটি কার্যকর মাধ্যম হিসাবে বিবেচিত হয়। চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি বিশিষ্ট প্রভাবশালী ও বাছাই করা ব্যক্তিদের মাধ্যমে সরকারের কাছে গোষ্ঠীগত স্বার্থের বক্তব্য পেশ করে এবং সরকারী সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে উদ্যোগী হয়। ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব, যোগাযোগ, আত্মীয়তা প্রভৃতির মাধ্যমে গোষ্ঠীগুলি নিজেদের কার্যোদ্ধারের চেষ্টা করে। এই কারণে গোষ্ঠীগুলিকে সরকারের কর্মকর্তা ও উচ্চপদস্থ আমলাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা ও বন্ধুত্ব স্থাপনের চেষ্টা করতে দেখা যায়। শাসন-বিভাগীয় এবং আইন-বিভাগীয় উভয় স্তরেই প্রভাবশালী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতিনিধিত্বের সুফল গোষ্ঠীগুলি পেয়ে থাকে। সাধারণত অসংগঠিত চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীসমূহ ব্যক্তিগত যোগাযোগের বা প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের প্রতিনিধিত্বের সুযোগ গ্রহণের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। বাস্তবে কিন্তু গোষ্ঠীস্বার্থ সাধনের জন্য সকল চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী অল্পবিস্তর এই পথে পা বাড়ায়।
উপসংহার: সকল সমাজব্যবস্থায় প্রত্যেক চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর প্রভাব-প্রতিপত্তি একরকম হয় না। বিশেষত ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় আর্থনীতিক বিচারে প্রতিপত্তিশালী চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলিই সরকারী নীতি ও সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার ব্যাপারে অধিক সাফল্য লাভ করে। তা ছাড়া চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি উদারনীতিক গণতন্ত্রের খোলামেলা সমাজব্যবস্থাতেই স্বাধীনভাবে কাজ করার অধিক ও অনুকূল সুযোগ পায়। উদারনীতিক গণতন্ত্রে বা ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বিভিন্ন পরস্পর-বিরোধী শ্রেণী ও স্বার্থের অস্তিত্ব বর্তমান। তাই এই ধরনের রাজনীতিক কাঠামোতে বহু চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী থাকে এবং তাদের গুরুত্বও থাকে। অপরপক্ষে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। তারপর বিভিন্ন ধরনের শ্ৰেণী, শ্ৰেণী-স্বার্থ, শ্ৰেণী-দ্বন্দ্ব প্রভৃতি থাকে না। এ ধরনের সমাজব্যবস্থায় বিভিন্ন স্বার্থ থাকে না। তাই বিভিন্ন গোষ্ঠীও থাকে না। এই কারণে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অনুভূত হয় না। তাই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটিমাত্র রাজনীতিক দল থাকে। আর একদলীয় ব্যবস্থায় চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর অস্তিত্ব গুরুত্বহীন। বল মন্তব্য করেছেন: “Pressure group activity in the liberal democratic sense is almost absent from autocratic and socialist systems.”
Leave a comment