অথবা, ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে দেখাও-চর্যাপদের ভাষা বাংলা।

অথবা, চর্যাপদের ভাষা বাংলা কিনা এ সম্পর্কিত তোমার অভিমত যুক্তিসহ উপস্থাপন কর।

অথবা, ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রমাণ করা যায় যে- চর্যাপদের অধিকাংশ পদই প্রাচীন বাংলা ভাষায় রচিত।- উক্তিটি ব্যাখ্যা কর।

উত্তরা: ভূমিকা: বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবারের পুথিশালা থেকে চর্যাপদ আবিষ্কার করেন এবং ১৯১৬ সালে তা প্রকাশ করেন। চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকে এর প্রাচীনত্ব নিয়ে কোনো বিরোধ না থাকলেও এর-ভাষা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিস্তর মতপার্থক্য দেখা যায়। বৌদ্ধধর্মের নির্বাণতত্ত্ব-মহাসুখের স্বরূপ ও তা লাভের পন্থা চর্যাপদে কখনো প্রহেলিকা, ভাষায়, কখনো দার্শনিক ভাষায়, কখনো যোগসাধনের পরিভাষায়, কখনোবা তান্ত্রিক কায়াসাধনের গূঢ় সংকেতের মাধ্যমে ব্যক্ত হয়েছে। আর এই বক্তব্য প্রকাশের জন্য তখনকার সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত ভাষার সহায়তা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে চর্যাপদে বাংলা, শৌরসেনী, অপভ্রংশ প্রাচীন হিন্দি, মৈথিলী, উড়িয়া ও অসমিয়া শব্দের বাহ্য ও আংশিক ব্যবহার লক্ষ করেই কেউ কেউ চর্যাপদের ভাষা সম্পর্কে নানা মত প্রকাশ করেছেন। একই গোষ্ঠীজাত বলে এসব নব্য ভারতীয় আর্যভাষার সঙ্গে চর্যাপদের ভাষার সাদৃশ্য বিদ্যমান।

উল্লেখ্য, উড়িষ্যা, বিহার, আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে নিজ নিজ ভাষা ও সাহিত্যের আদি নিদর্শন হিসেবে চর্যাপদ বিবেচিত এবং ভাষা সাহিত্যের পাঠ্য হিসেবে সূচিভুক্ত। চর্যাপদকর্তাগণ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে আবির্ভূত হয়েছিলেন বলে সকলের ভাষা একরূপ হতে পারে না; প্রাচীনত্বের জন্য গৌড় অপভ্রংশের প্রভাবও এতে রয়ে গেছে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আর্যদেবের ভাষা উড়িয়া, শান্তিপার ভাষা মৈথিলি এবং কাহ্নপা, সরহপা, ভুসুকুপার ভাষা প্রাচীন বাংলা বঙ্গকামরূপী বলে সিদ্ধান্ত করেছেন। ১৯২৬ সালে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব ও ছন্দের ভিত্তিতে বিচার করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, চর্যার পদসংকলনটি আদিমতম বাংলা ভাষায় রচিত।

বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন ‘চর্যাপদ’ এর গানগুলো হেঁয়ালি ধরনের সাংকেতিক ভাষায় লেখা। এ প্রহেলিকাময় পদগুলো প্রতীক ও রূপকাশ্রিত। পদগুলোর বাইরের অর্থ অনেকটা সরল ও বোধগম্য হলেও সেগুলোর আড়ালে রয়েছে ধর্মীয় নানা আধ্যাত্মিক অর্থ। সে অর্থ বেশ জটিল ও দুর্বোধ্য। চর্যার গভীরতর অর্থের নেপথ্যে বিরাজিত সাধন তত্ত্বের রূপকার্থই প্রধান। সন্ধ্যার মতো আলো-আঁধারের অস্পষ্টতায় রহস্যময় বা হেঁয়ালিপূর্ণ বলে এগুলোকে বলা হয় ‘সন্ধ্যাভাষা’ বা আলো- আঁধারী ভাষা। এ প্রসঙ্গে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছেন:

“সন্ধ্যার ভাষা মানে, ‘আলো-আঁধারী ভাষা’। কতক আলো,

কতক আঁধার, খানিক বুঝা যায়, খানিক বুঝা যায় না।”

তবে, ‘সন্ধ্যা’ অভিধাটি নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। পণ্ডিত প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও বিধুশেখর শাস্ত্রীর মতে, এ ভাষার নাম ‘সন্ধাভাষা’ বা ‘সন্ধ্যাভাষা’ নয়। সম্+ধা-এ ব্যুৎপত্তি অনুসারে ‘সন্ধা’ কথাটি দিয়ে এমন ভাষা বুঝানো যায়, যার বিশেষ অভিসন্ধি বা অভিপ্রায় আছে। তাঁদের মতে, ‘সন্ধা’ নামটিই অধিকতর গ্রহণযোগ্য। কেননা, সিদ্ধাচার্যদের অভিপ্রায় বা অভিসন্ধি চর্যাগানের ভাবের মধ্যে নিহিত রয়েছে।

চর্যাপদের ভাষা-জিজ্ঞাসা: চর্যাপদের ভাষা বাংলা কী না- এই জিজ্ঞাসার গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর পূর্বে নিম্নলিখিত বিষয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করা আবশ্যক।

ক. চর্যাগীতিকা পুথির লিপিকাল কোন শতকের তা নির্ধারণ করা এবং এর লিপি প্রকৃতপক্ষে ব্রাহ্মী লিপি না কি নাগরী লিপি তা সিদ্ধান্ত হওয়া জরুরি।

খ. চর্যাগীতিগুলো কোন ভাষায় রচিত; উড়িয়া, মৈথিলি, বাংলা, অসমিয়া- এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া।

গ. চর্যাপদে উল্লিখিত পদসমূহের ভাষা একই সময়ের ও অভিন্ন কী না?

ঘ. চর্যাকারদের জীবনকাল ও জন্মস্থান নির্ণয় করা।

ঙ. ব্যাকরণগত বিশ্লেষণ।

চ. চর্যাগীতিতে বিধৃত সমাজ-সংস্কৃতির সাথে বাঙালি বা অন্যান্য ভাষাভাষির সাদৃশ্য কতটুকু?

চর্যাপদের ভাষা-বিষয়ক জিজ্ঞাসার যুক্তি-তথ্য-মতামত

প্রথমত, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চর্যাগীতর ভাষাকে ‘বঙ্গ- কামরূপী’ বলে চিহ্নিত করার পক্ষপাতী। ড, সুকুমার সেন মনে করেন, ‘চর্যাগীতির ভাষা বাংলার প্রত্নমূর্তি অবহঠের সদ্যোনির্মোকমুক্ত রূপ এবং চর্যার ভাষায় অবশ্যই একাধিক উপভাষার মিশ্রণ রয়েছে।’

দ্বিতীয়ত, আহমদ শরীফ তাঁর ‘বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘এই পুথি বঙ্গাক্ষরে লিপীকৃত বলে বাঙালি বিদ্বানদের ধারণা এবং এই ধারণা নিঃসন্দেহে যথার্থ। কিন্তু লিপিকাল বারো শতক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কেননা ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে লিপিকৃত ‘পঞ্চাকার’ নামের পুথির লিপির সঙ্গে চর্যার লিপির অনেক সাদৃশ্য রয়েছে।

তৃতীয়ত, চর্যাপদের ভাষা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বড়ো সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত চর্যাপদকর্তাদের জীবনকাল এবং জন্মস্থান নির্ণয়-বিষয়ক। অধিকাংশ চর্যাগণের পরিপূর্ণ এবং স্পষ্ট তথ্য না থাকার কারণেও ভাষা বিষয়ে স্পষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না।

চর্যাপদের ভাষা-বিষয়ে বিভিন্ন পণ্ডিতদের মতামত: চর্যাপদের ভাষা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সুকুমার সেন বলেন, “নিজ নিজ প্রাদেশিক ভাষায় গৌরব বাড়াইতে গিয়া বাংলার প্রতিবেশীরা এখন চর্যাগীতি লইয়া রীতিমত মামলা বাধাইয়াছেন। হিন্দি ভাষী, মৈথিলী ভাষী, উড়িয়া ভাষী, আসামি ভাষী, চর্যাপদ তাদের নিজ নিজ ভাষায় রচিত বলে দাবি করিয়াছেন।”

উড়িয়া কী না: বিজয় চন্দ্র মজুমদারের মতে চর্যার গানে অনেক শব্দ অবাধে গৃহীত হলেও এর মূল ভাষাগত কাঠামো উড়িয়া। চর্যার ভাষায় বাংলা শব্দের অস্তিত্ব উড়িয়া বা মৈথিলী শব্দের অস্তিত্বের মতোই আংশিক ও আকস্মিক। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেছেন, ওত সংখ্যক গানের ‘হাড়িত ভাত নাহি’ বিশুদ্ধ বাংলা, কিন্তু ঐ গানের অপর পদাংশ ‘দুহিল দুধু’ হয় হিন্দি নয় উড়িয়া, এবং ‘যামায়’ নিঃসন্দেহে উড়িয়া পদ। এছাড়া চর্যাভাষায় তিনি আর যেসব উড়িয়া লক্ষণ পেয়েছেন তা এই রকম: জঁহি, তঁহি, এটু, এ্যথু অধিকরণ পদ- চান্দরে বিষয়রে; ক্রিয়াপদ অছ, কএল্লা, ফিটিলি; অন্যান্য বিশিষ্ট উড়িয়া পদ ঘড়িএ (ক্রিয়া বিশেষণ) চিখিল, ডুলি, বেনি।

হিন্দি কী না: রাহুল সাংকৃত্যায়ন, কাশীপ্রসাদ জয়সোয়াল প্রমুখ হিন্দি প্রেমিক পণ্ডিতরা মনে করেন যে চর্যার ভাষা প্রাচীন হিন্দি।

হিন্দিভাষার সপক্ষে যুক্তি: চর্যাপদ হিন্দি ভাষায় রচিত কী না এর পক্ষে কিছু যুক্তি আছে। যুক্তিগুলো নিম্নরূপ:

১. চর্যার শব্দরূপ হিন্দি শব্দরূপের অনেক কাছাকাছি,

২. চর্যা হিন্দির চির অভ্যস্ত দোহাছন্দে রচিত,

৩. চর্যার কবিরা হিন্দি ভাষী বিহারের অধিবাসী।

এই যুক্তির সমালোচনা:

(ক) চর্যায় পশ্চিমা অপভ্রংশ পদের প্রাচুর্য থাকায় চর্যার ভাষাকে হিন্দির কাছাকাছি মনে হতে পারে, কারণ পশ্চিমা অপভ্রংশ থেকেই হিন্দির বিকাশ। চর্যায় পশ্চিমা অপভ্রংশ শব্দের প্রাচুর্য থাকলেও তাতে তার ভাষাগত মূল কাঠামোটির কোনো পরিবর্তন হয়নি। এই কাঠামোটি হিন্দির অনুরূপ নয়, বরং বাংলারই কাছাকাছি;

(খ) চর্যায় দোহা ছন্দের প্রয়োগ থাকলেও তা অত্যন্ত সীমাবদ্ধ;

৩) চর্যার সব কবিই বিহারের অধিবাসী নন এবং যাঁরা বিহারের অধিবাসী বলে অনুমিত হন তাঁরা এক বৃহৎ প্রত্নবঙ্গভাষী এলাকার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

মৈথিলী কী না: ড. জয়ন্তকর মিত্রের গ্রন্থে চর্যাগুলো মৈথিলী সাহিত্যের আদি নিদর্শনরূপে চিহ্নিত এবং দিবাকর সম্পাদিত গ্রন্থে চর্যাভাষা রূপে অভিহিত।

মৈথিলী ভাষার সপক্ষে যুক্তি: চর্যাপদ যে মৈথিলী ভাষায় রচিত এর পক্ষে যে যুক্তি রয়েছে তা নিম্নরূপ:

১. চর্যার অধিকাংশ কবি মৈথিলী ভাষী।

২. চর্যার ধ্বনিতত্ত্ব ও রূপতত্ত্ব বহুলাংশে মৈথিলী সদৃশ-

ক. চর্যায় নাসিক্য ধ্বনির উপস্থিতি এবং দন্ত শিধ্বনির প্রাচুর্য এর মৈথিলী সাযুজ্যের সমর্থক।

খ. কারণে এ তে এবং সম্বন্ধে ক বিভক্তির প্রয়োগ,

গ. বিভিন্ন সর্বনামীয় শব্দরূপ; যথা: হাঁউ, মো, মোত্র, তো, তোহোর, তোরা, সে, কাহি প্রভৃতি মৈথিলীর অনুরূপ;

ঘ. প্রথম পুরুষ একবচনে তি, থি, কর্মবাচ্য ইঅ-এগুলো মৈথিলী ভাষার অনুরূপ;

৩. চর্যায় ব্যবহৃত শব্দাবলি মৈথিলী ভাষায় ব্যবহৃত, যেমন টাঙ্গী, সামু, কোঠা, ভাত, বাড়ী ইত্যাদি;

৪. চর্যায় ব্যবহৃত অনেক ইডিয়ম ও প্রবচন এখন মৈথিলীতে ব্যবহৃত হয়।

সমালোচনা : (১) চর্যার যেসব কবিকে বিহারবাসী বলে অনুমান করা হয় তারা তখন এক বৃহৎ প্রত্ন বঙ্গভাষী এলাকার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, (২) ধ্বনিতত্ত্ব ও রূপতত্ত্বের সেসব বৈশিষ্ট্যের জন্য চর্যাভাষাকে প্রাচীন মৈথিলী বলে দাবি করা হয়, সেগুলো ঐতিহ্যসূত্রে বাংলাভাষা ও প্রাচীন বৈশিষ্ট্য বলে গণ্য হতে পারে; (৩) চর্যায় যেসব শব্দ মৈথিলী বলে দাবি করা হয় সেগুলো বাংলাভাষার শব্দভাণ্ডারেরও অন্তর্গত, (৪) মৈথিলী বলে অনুমিত চর্যার ইডিয়ম ও প্রবচনগুলো প্রাচীন বাংলার ইডিয়াম ও প্রবচন বলে গ্রহণ করতেও ভাষাতাত্ত্বিকের অসুবিধা নেই।

বাংলা কী না: উপরিউক্ত যতটা প্রাদেশিক আত্মশ্লাঘা প্রসূত ততটা ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নির্ভর নয়। কেননা, চর্যায় কিছু কিছু ভিন্ন শ্রেণির নব্য ভারতীয় আর্যভাষার শব্দ, পদ ও বাক্যাংশ ব্যবহৃত হলেও ঐসব ভিন্ন জাতীয় উপাদানের পাশাপাশি প্রাচীন বাংলায় যেসব নিজস্ব পদ ও প্রবাদ-প্রবচন ব্যবহৃত হয়েছে। তার অনুপাত ভিন্ন জাতীয় উপাদানের চেয়ে অনেক বেশি। এ থেকে বুঝা যায় যে, ভিন্নজাতীয় উপাদানগুলো আগন্তুক মাত্র, চর্যাভাবায় নিজস্ব সম্পদ নয়। চর্যাপদে খাঁটি বাংলা শব্দের প্রয়োগ দেখে বুঝা যায় চর্যাপদের ভাষা বাংলা। যথা:

ক.

  • ‘ইল’ প্রত্যয় যোগে অতীতকালের ক্রিয়াপদ ও বিশেষণ। যথা: কানৈচ চোর নিল [চর্যা-২], মইল রঅনি [চর্যা-২৩]
  • ইব’ প্রত্যয় যোগে ভবিষ্যৎকালের ক্রিয়াপদ; যথা: তো এসম করিব মো সাঙ্গ [চর্যা-১০), মই ভাইব কীস (চর্যা-১৯]
  • ‘ইয়া’ ‘ইলে’ যোগে অসমাপিকা; যথা: রাগ দেস মোহ লইআ ছার [চর্যা-১১], সাঙ্কমত চড়িলে.. [চর্যা-৫]
  • ষষ্ঠীর চিহ্ন হিসেবে ‘এর’ ও ‘র’ বিভক্তির ব্যবহার; যথা : হরিণা হরিণির নিলয় ন জানি [চর্যা-৬]
  • তৃতীয়ায়’ তে’ (তে) বিভক্তি; যথা: সুখে দুঃখতে নিশ্চিত মরি অই [চর্যা-১]
  • কারকে বিভক্তির পরিবর্তে অনুসর্গের ব্যবহার; যেমন- চারি বাঁসে গড়িলারে দিআঁ চঞ্চলী [চর্যা-৫০]
  • থাকা অর্থে আহ্ এবং থাক ধাতুর ব্যবহার; যেমন- কাহারে যিনি মিলি আছহু কীস [চর্যা-৬]
  • কই শব্দ দুইবার ব্যবহার করে বহু বচনের অর্থ প্রকাশিত হয়েছে; যথা: উল্কপাবত তহি বসি সবরী বালী [চর্যা- ২৮]
  • বাগধারা ও শব্দগুচ্ছের ব্যবহার চর্যায় দেখা যায়। যথা : হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী [চর্যা-৩৩]
  • আধুনিক বাংলার মতোই চর্যাতেও বহুত্ববাচক প্রত্যয়ের পরিবর্তে বহুত্ববোধক শব্দের ব্যবহার লক্ষ করা যায়; যেমন- ছড়গই সঅল সহাবে সুধা (ন)
  • আধুনিক বাংলার সন্ধির সূত্র চর্যাতেও প্রযুক্তি হতে দেখা যায়; যেমন- ভাবাভাব (ভাব + অভাব)
  • শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে এমন কয়েকটি বিশিষ্ট প্রয়োগ এখানে লক্ষ করা যায় যেগুলো বাংলা ছাড়া অন্যত্র দেখা যায় না। যেমন- ভান্তি ন বাসসি [চর্যা-১৫] কহন নাজাই (চর্যা-১০] ইত্যাদি ।

খ. লিঙ্গ: চর্যাপদে ব্যবহৃত বাংলা ভাষায় পুংলি Move to Archive X স্ত্রীলিঙ্গ ব্যবহারের নিয়ম অপভ্রংশের প্রভাবে নিয়ন্ত্রিত। বিশেষ্য স্ত্রীলিঙ্গ হলে বিশেষণটিও স্ত্রীলিঙ্গ হয়েছে। যেমন- নিশি আন্ধারী।

গ. সমাস: আধুনিক বাংলা ভাষায় প্রচলিত সব রকমের সমাসের ব্যবহার চর্যাপদে পাওয়া যায়। যথা:

তৎপুরুষ- কমল রস, কাহ্ন বিলসত আসব মাতা।

কর্মধারয়- মহামহ সাঙ্গে।

দ্বন্দ্ব সমাস- চান্দসুজ বেণী শাখা কাল।

ঘ. কারক ও বিভক্তি: আধুনিক বাংলার মতো চর্যাপদেও কারক বিভক্তির প্রয়োগ দুর্লক্ষ নয়। যেমন- চর্যাপদে একাধিক কারকে শূন্য বিভক্তির ব্যবহার-

কর্তৃকারকে- কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল। (১)

কর্মকারকে- দিঢ় করি মহাসুহ পরিমাণ। (২)

অধিকরণ কারকে ‘এ’ ব্যবহার- ননদ ঘরে সালী। (১১)

সম্বন্ধ পদে ‘আ’ ব্যবহার- আপনা মাংসে হরিণা বৈরী (৬)

৩. বিষয় পরিবেশ: বিষয় পরিবেশের দিক থেকে চর্যাকে বাংলা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। কারণ পদকর্তাদের পদগুলোতে বাংলার রূপই পরিস্ফুট।

৪. শব্দগত আলোচনা: চর্যাপদের শব্দপুঞ্জ বাংলা ভাষার পরিচয় বহন করে। যেমন- হেরি যে কাহ্ন। তাছাড়া বিভিন্ন দেশজ শব্দেরও প্রচুর পরিচয় পদগুলোতে পাওয়া যায়। যেমন- মাদল, হাড়ি, পিঁড়ি, টাঙ্গি, জউতুক, কাঁকন ইত্যাদি। শব্দ ব্যবহার ক্ষেত্রে এমন কয়েকটি বিশিষ্ট প্রয়োগ এখানে লক্ষণীয় যা বাংলা ছাড়া অন্যত্র দেখা যায় না। যেমন- তা দেখি, করণ ন জাই, আহার কএলা, শুনি আ প্রভৃতি আধুনিক বাংলার মতো চর্যাপদেও বহুত্ববোধক শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। যেমন- সঅল সমাহিঅ। (১) ছড়গই সঅল। (৯) ইত্যাদি।

একই শব্দের দু’বার ব্যবহার- উষ্ণা উষ্ণা পাবত। (২৮)

৫. বাগধারা : বাংলা ভাষায় নিজস্ব বাগধারার পরিচয়ও চর্যাপদে পাওয়া যায়। প্রবচন জাতীয় এই শব্দ সমষ্টি বাংলার ঐতিহ্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়। যথা:

ক. আপনা মাংসে হরিণা বৈরী। (৬)

খ. হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী। (৩৩)

গ. বর সুণ গোহালী কি মো দুঠ বলদে (৩৯)

চর্যাপদের ভাষা-বিষয়ক সমস্যার সমাধানঃ পাল রাজারা ছিলেন বঙ্গদেশীয়, সেজন্য তাঁদের রাজধানীর সন্নিহিত উপভাষা হিসেবে বঙ্গীয় উপভাষা তখন সমগ্র মাগধীয় নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছিল। বিশেষত তখনকার সেই সামন্তযুগের অখণ্ড রাজানুগত্যের কালে এটাই স্বাভাবিক ছিল। এই কারণে চর্যার ভাষায় বঙ্গীয় উপভাষার উপাদান এত বেশি। যাঁদের চর্যায় এসব উপাদান ব্যবহৃত হয়েছে তাঁরা সকলেই যে বঙ্গদেশীয় ছিলেন এমন নাও হতে পারে; বঙ্গীয় উপভাষার সামাজিক গুরুত্বের জন্য অন্য এলাকার বাসিন্দা হয়েও তাঁরা বঙ্গীয় উপভাষার উপাদান ব্যবহার করেছেন বা করতে বাধ্য হয়েছেন। চর্যাপদের ভাষায় বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম, মৈথিলী, অপভ্রংশ বিভিন্ন ভাষার কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান; তাছাড়া এসব ভাষা-ভাষী অঞ্চলের সমাজ-সংস্কৃতি এবং জীবন- জীবিকার রূপরেখা খুঁজে পাওয়া যায়। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ বাংলাভাষী মানুষের জীবনচিত্র এবং ব্যাকরণিক বৈশিষ্ট্যের সাথে। চর্যার ভাষা অসমিয়া কিংবা হিন্দি বা অপভ্রংশ নয়- কারণ নব্য ভারতীয় আর্য ভাষার পূর্ববর্তী স্তর অপভ্রংশ। অন্যান্য ভাষার কিছু লক্ষ্মণ চর্যাগীতিকায় বিদ্যমান থাকলেও- সে কারণে তাকে ঐ ভাষাগোষ্ঠীর বলে দাবি করা যৌক্তিক নয়- এটাই যৌক্তিক যে চর্যাপদের ভাষা বাংলা।

উপসংহার: সমস্ত দিক বিবেচনা করে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, চর্যাপদ মৈথিলি, হিন্দী, উড়িয়া, আসামী কিংবা অপর কোনো ভাষায় রচিত নয়- বাংলা ভাষায় বিরচিত। তাই সর্বতোভাবে বলা যায়, বিশেষ ব্যাকরণগত বৈশিষ্ট্যসহ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সুপ্রাচীন স্তরের সাক্ষ্য এসব চর্যায় বিদ্যমান। তাই চর্যাপদের ভাষা নিঃসন্দেহে বাংলা ভাষাই।