অথবা, চর্যাপদ সন্ধ্যা ভাষায় রচিত বলতে কী বুঝ? এ সম্পর্কে তোমার পঠিত পদগুলোর ভিত্তিতে আলোচনা কর
অথবা, চর্যার ভাষাকে সন্ধ্যা ভাষা বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তোমার মতামত দাও।
উত্তর: চর্যাপদগুলো বৌদ্ধ সহজিয়াদের সাধন পদ্ধতিমূলক এক প্রকার গান। কিন্তু যে ভাষায় ঐ সাধন পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে সহসা তা বুঝবার উপায় নেই। ঐ ভাষাকে তাই নাম দেওয়া হচ্ছে সন্ধ্যা ভাষা। সর্বত্রই একটা অস্পষ্টতা কিছু বুঝা যায় কিছু বুঝা যায় না। সেজন্য অনেক টীকা টিপ্পনী ও ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়।
চর্যার ভাষাকে সন্ধ্যাভাষা বলা হয়েছে। এই ‘সন্ধ্যা ভাষা’ সম্পর্কে বলতে গিয়ে চর্যাগীতিকার আবিষ্কারক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছেন,
“………….. সহজিয়া ধর্মের সকল বইই সন্ধ্যা ভাষায় লেখা। সন্ধ্যা ভাষার মানে আলো আঁধারি ভাষা; কতক আলো, কতক অন্ধকার, খানিক বুঝা যায়, খানিক বুঝা যায় না, অর্থাৎ এই সকল উঁচু অঙ্গের ধর্ম কথার ভিতরে একটা অন্যভাবের কথাও আছে। সেটা শুনিয়া ব্যাখ্যা করিবার নয়।” [বৌদ্ধ গান ও দোহা]
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আরো বলেছেন, “যাঁহারা সাধন ভজন করেন তাঁহারাই সে কথা বুঝিবেন, আমাদের বুঝিয়া কাজ নাই।”- এ কারণে চর্যার ভাষা সন্ধ্যা ভাষা। কিন্তু তান্ত্রিকতায় যারা দীক্ষিত তাদের জন্য এ ভাষা তবে ‘সন্ধ্যাভাষা’ হতে যাবে কেন- তাদের কাছে তো এর সবকিছুই স্পষ্ট, বোধগম্য। পণ্ডিত বিধুশেখর শাস্ত্রী তাই ‘সন্ধ্যাভাষা’র অন্য রকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এ ভাষার সন্ধ্যা প্রকৃতি ব্যাখ্যায় তিনি একটি পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রবন্ধে অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য প্রচুর তথ্য ও যুক্তির দ্বারা প্রমাণ করেছেন যে,
“ভাষাটি মূলত সন্ধ্যা ভাষা নয়, এ হোল ‘সন্ধা ভাষা’ (সম্ + ধা)- অর্থাৎ একটা বিশেষ অভিসন্ধি বা অভিপ্রায় অনুযায়ী প্রযুক্ত ভাষা।” [উদ্ধৃত, ড. শশিভূষণ দাশগুপ্ত, অবস্কিউর রিলিজিয়াস কালট্স অব বেঙ্গল]
বিধুশেখরের মতে, সম্পূর্বক ‘ধা’ ধাতু ‘ও’ প্রত্যয় করে ‘সন্ধ্যা’ হয়েছে- তিনি মনে করেছেন অশিক্ষিত লিপিকরগণের প্রমাদ বশত ‘সন্ধ্যাভাষা’ পরবর্তীকালে ‘সন্ধাভাষা’য় পরিণত হয়েছে।
ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচীও বিধুশেখর শাস্ত্রীর এই মত সমর্থন করেছেন। এভাবে ব্যুৎপত্তি নির্ধারণ করলে ‘সন্ধা’ শব্দের অর্থ দাঁড়াবে- অভীষ্ট, উদ্দিষ্ট, আভিপ্রায়িক বচন। অর্থাৎ এই চর্যাসমূহ, সাধারণ অর্থে নয়, এমন এক অভীষ্ট অর্থে প্রযুক্ত যে কেবল তন্ত্রসাধকগণই এর মর্ম অনুধাবন করতে পারবেন।
সন্ধ্যাভাষার ব্যাখ্যায় ড. নীহাররঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙালির ইতিহাস’ (আদিপর্ব) গ্রন্থে লিখেছেন,
“যে ভাষার নাম ছিল সন্ধাভাষা (সন্ধিভাষা), যে ভাষা শুধু ‘মৌলিক’, ‘সম্পূর্ণ’, ‘নিগূঢ়’ সত্যের কথা বলে, কিন্তু যতো মৌলিক, সম্পূর্ণ নিগূঢ়ই হোক না কেন সে ভাষা, অদীক্ষিতজনের কাছে তাহা ছিল দুর্বোধ্য। এ ভাষায় যাহা ‘অভিপ্রায়িক’ অর্থাৎ আপাত সে অর্থ কোনো বাক্যের বা পদের, তাহাই তাহার নিগূঢ় অর্থাৎ মৌলিক, সম্পূর্ণ অর্থ নয়; মৌলিক, সম্পূর্ণ, উদ্দিষ্ট অর্থের দিকে তাহা ইঙ্গিত করে মাত্র। কাজেই, সে ভাষার মৌলিক উদ্দিষ্ট অর্থ ধরিতে পারা সহজ নয়।”
অর্থাৎ নীহাররঞ্জন রায়ও এ ভাষাকে সন্ধ্যাভাষা না বলে সন্ধাভাষা বা সন্ধিভাষা বলেছেন। কিন্তু একটি কথা এ প্রসঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন যে, তন্ত্র বিষয়ক প্রাচীন পুঁথিতে ‘সন্ধ্যাভাষা’ শব্দটিই সর্বত্র পাওয়া যায় ‘সন্ধাভাষা’ নয়। এ প্রসঙ্গে ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন,
“অনেক প্রাচীন পুঁথিতে ‘সন্ধ্যাভাষা’ই পাওয়া যায়;
সবগুলিই যে লিপিকর প্রমাদ তাহা মনে হয় না।”
[বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত]
কোনো কোনো গবেষক ও পণ্ডিত ব্যক্তি বলেছেন, ‘সন্ধ্যা’ শব্দটি ‘সন্ধাদেশ’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ১৯৪২ সালে পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “সন্ধ্যাভাষার অর্থ ‘সন্ধ্যা’ দেশের ভাষা। সন্ধ্যা অর্থাৎ আর্যাবর্ত এবং পূর্ব ভারতের মধ্যবর্তী অঞ্চল। কিন্তু এ ব্যাখ্যা কেউ মানেন নি। কেননা সন্ধ্যা দেশ পশ্চিম বাংলার অন্তর্গত রাঢ় অঞ্চল। এই অঞ্চলের সন্ধ্যাভাষা থেকে পরবর্তীকালে বাংলা ভাষার উদ্ভব। জৈন প্রাকৃতের ন্যায় এই সন্ধ্যাভাষাও একটি আলাদা ভাষা। সিদ্ধাচার্যদের দোহাবলির ভাষা সম্পর্কে পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের উক্তি প্রযোজ্য হতে পারে। কিন্তু চর্যাপদের ভাষা সন্ধ্যা দেশের ভাষা নয়।
ড. শশিভূষণ দাশগুপ্ত এ ভাষার ব্যাখ্যায় লিখেছেন, “বৌদ্ধতন্ত্রের এবং তাহাদের উপরে টীকা-টিপ্পনীর যেসব প্রাচীন পুঁথি দেখিয়াছি, তাহার সর্বত্রই সন্ধ্যাভাষা শব্দটিকে সন্ধ্যাভাযারূপেই পাইয়াছি। আমার মনে হয়, সন্ধ্যাভাষা কথাটিই পরবর্তীকালে আভিপ্রায়িক অর্থ হইতে অস্পষ্ট আলো-আঁধারি ভাষার একটা অর্থই গ্রহণ করিয়াছিল এবং এইভাবেই সন্ধ্যাভাষাতে রূপান্তরিত হইয়া গিয়াছিল।” [বৌদ্ধধর্ম ও চর্যাগীতি]
ড. শশিভূষণের এ বক্তব্য গ্রহণযোগ্য। তবে ‘সন্ধা’ বা ‘সন্ধ্যা’ ভাষা উভয়ই রহস্যময় ভাষা। এ ভাষার প্রচলন অতি প্রাচীনকাল থেকেই তন্ত্রে বিদ্যমান। তন্ত্রশাস্ত্রের ক্রমবিকাশের সাথে সাথে এই ধরনের ভাষা বা পারিভাষিক শব্দ প্রয়োগ ব্যাপকতা লাভ করে। তন্ত্রোক্ত সন্ধ্যাভাষার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য কতকগুলো বিশেষ বিশেষ শব্দের উপরে বিশেষ বিশেষ অর্থের আরোপ- এই আরোপিত অর্থসংকেত দীক্ষিতজন ব্যতীত অন্যের নিকট সহজবোধ্য নয়। বৌদ্ধ সহজিয়া সাধনার গূঢ় তত্ত্ব যাতে অন্যধর্মের লোকেরা বুঝতে না পারে তার জন্য স্কুল অর্থযুক্ত প্রতীক ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন- ‘আলি কালি’, ‘গঙ্গা’, ‘সবর’, ‘সবরী’, ‘ডোম্বী’, ‘বড়ি আ’, ‘জরিনী’, ‘সূজ’ ও ‘নাবী’ ইত্যাদি। এসব শব্দের মাধ্যমে সাধনগত রহস্যপূর্ণ ইঙ্গিত প্রকাশ পাচ্ছে। প্রশ্ন-৭, ‘চর্যাপদে’ অথবা, অথবা, বিধৃত Move to Archive × সমাজচিত্রের পরিচয় দাও। [জা. বি. ২০১৪, ২০১৬/ চর্যাপদ অবলম্বনে প্রাচীন বাংলার নিম্নশ্রেণির জীবনযাত্রার পরিচয় দাও। [জা. বি. ২০১২] সাথে সাথে প্রাচীন বাংলার নিম্নশ্রেণির মানুষের “চর্যাপদের পদকর্তারা কাব্যসাধনা ও ধর্মসাধনার জীবন যাপন প্রণালির নিখুত চিত্রও এঁকেছেন।”- বিশ্লেষণ কর। জা. বি. ২০১৭] চর্যাগীতিতে ব্যবহৃত কয়েকটি শব্দের সাধারণ অর্থ ও সন্ধ্যা অর্থ পাশাপাশি নিচে দেখানো হলো:
মূল শব্দ | সাধারণ অর্থ | সন্ধ্যা অর্থ |
আলি কালি | স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জনবর্ণ | প্রশ্বাস-নিঃশ্বাস |
গঙ্গা | একটি নদী | গ্রাম্য |
ডোম্বী | ডুমনী | নৈরাত্মা |
বড়িআ | দাবাড় বোড়ে | একশো ষাট প্রকৃতি |
এসব শব্দ ছাড়াও চর্যাগীতিতে কয়েকটি প্রখ্যাত চরণ রয়েছে যা সন্ধ্যাভাষায় দৃঢ় সংকেতের প্রকৃষ্ট নমুনা:
ক. জো সো চোর সোহি সাধী। (৩৩নং চর্যা)
খ. কাল বোবে সংবোহিঅ জইসা। (৪০নং চর্যা)
গ. সঅল সমাহিঅ কাহি করিঅই। (১নং চর্যা)
ঘ. মারি সাসু ননন্দ ঘরে সালী।
মাঅ মারি কাহ্ন ভইঅ কবালী । (১১নং চর্যা)
এ ধরনের রূপক সাংকেতিক বচন তথা ধাঁধা বা প্রহেলিকা সহজিয়া বাউলদের মধ্যে আজও চালু রয়েছে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে চর্যাগীতি দ্ব্যর্থবোধক রচনা। বিশেষ মানস সন্ধান করে বাণীর তাৎপর্য অনুধাবনও উপলব্ধি করতে হয় বলে এর ভাষার নাম সন্ধ্যা। সুতরাং সন্ধা বা সন্ধ্যা ভাষা অর্থে আমরা সাংকেতিক ভাষা বা রূপকের ভাষা বুঝব। এ ভাষা অর্থাৎ রচনার এ ভঙ্গি নতুন নয়, বরং সুপ্রাচীন। এত প্রাচীন যে তা মনুষ্য মানস সংস্কৃতির উদ্ভবের সমকালীন। কাজেই সন্ধ্যাভাষা বৌদ্ধ চর্যাকারকের সৃষ্টি •• চিরকাল ছিল এদেশে, তার প্রমাণ মুনি দত্তের টাকাতেই রয়েছে- সন্ধ্যাভাষা, সন্ধ্যা সংকেত, সন্ধ্যাবচন ও সন্ধ্যাব্যাজ প্রভৃতির উল্লেখ লক্ষণীয়।
চর্যাগীতি মূলত বৌদ্ধ সাধকদের সাধন সংগীত। শিবনাথ লাহিড়ী বলেছেন, “মহাযান বৌদ্ধ সাধন গীতি চর্যাগুলো তাদের ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশিষ্ট একটি ধর্মগত উদ্দেশ্যকেই বহাল রেখেছে।”
চর্যাগীতিসমূহ ‘মহাযান বৌদ্ধ সাধন গীতি’ কিনা তা আলোচনা সাপেক্ষ। তবে ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে এসব কবিতা যে একটি ধর্মগত বিশেষ উদ্দেশ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
পরিশেষে বলা চলে চর্যাপদের ভাষা অভিসন্ধিত বা অভিপ্রায়িক দ্ব্যর্থক। একটি অর্থ সাধারণ, অন্য অর্থ রহস্যময়, গূঢ়, বিশেষ সাধনার সংকেতবহ আর সেখানেই এটিকে সন্ধ্যা ভাষা বলার সার্থকতা।
Leave a comment