চর্যার গান মূলত সাধন ভজন বিষয়ক তত্ত্বগ্রন্থ। সিদ্ধাচার্যেরা কবিত্ব শক্তির অধিকারী হলেও তাঁরা ছিলেন প্রধানতঃ সাধক। তবে কোনও কোনও সময়ে তত্ত্বগ্রন্থেও কবিত্বের রং লেগেছে, অস্পষ্ট হলেও রসের রসনায় স্বাদ সঞ্চারিত হয়েছে। তবে সমগ্র চর্যাপদে মূলত দুটি বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। এক বহিরঙ্গ চিত্রকল্প ব্যবহৃত হয়েছে, অপরটি হল গুরুমুখী সাধন সঙ্কেত, যা রহস্যময় বোধাতীত গুহাচারী। মূলত সিদ্ধাচার্যেরা তাঁদের গোপন গূঢ় তত্ত্বকথাকে কতকগুলি বাহ্যিক রূপক প্রতীকের মোড়কে ঢেকে আভাসে ইঙ্গিতে ওই পথের সাধককে বোঝাতে চেয়েছেন। অবশ্য যে কোনও রহস্যবাদী সাধনার এটাই লক্ষণ। বেদ উপনিষদের যুগ থেকে এই ধরনের বিশিষ্ট অভিপ্রায়যুক্ত ইঙ্গিতের সাহায্যে তত্ত্বকথার নির্দেশ দেওয়ার রীতি চলে আসছে। এই শ্রেণির সাধ্য সাধনা প্রায়ই বাহ্যিক ব্যাখ্যাতীত রসহ্যবাদী গূঢ় কৃত্য বিশেষ সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর মধ্যে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে। প্রত্যেক শ্রেণি ও সম্প্রদায়ের চিন্তা ভাবনা ও অনুশীলন পদ্ধতি সম্পূর্ণ পৃথক। চর্যাপদও আপন স্বাতন্ত্র্যে অভিষিক্ত।
চর্যাপদের সমস্ত গানগুলি অনুধাবন করলে দেখা যাবে, প্রত্যেকটি গানেই হয় কোনও ধর্মীয় শিক্ষা কিংবা সিদ্ধাচার্য প্রদর্শিত এবং আচরিত ধর্ম সাধনার প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে। এই জিনিসটি দেখাবার বা বোঝাবার জন্য তাঁরা স্বভাবতই লৌকিক জগতের বিভিন্ন বস্তু বা প্রাণীর যে সমস্ত বিশেষত্ব তাঁদের আধ্যাত্মিক শিক্ষাদানের পক্ষে উপযোগী হবে বলে তাঁরা মনে করেছেন, সেইগুলিকেই প্রতীক হিসাবে বেছে নিয়েছেন। মাটি, গাছ, ডাল পালা, ফুল, আকাশ, নদী, নদীর স্রোেত, নৌকা, ভাঁড়, ঘাট, পাটনী, অরণ্য, হরিণ হরিণী, ডোম্বী, মুষিক, কুঠার, থালা বাটি, বাসন, সোনা রূপা, শবরী, কাপালিক, ব্রাহ্মণ-সমস্তই এক একটা বিশেষ ধরনের আধ্যাত্মিক বিষয়বস্তুর উপমা ও রূপক হিসাবে চর্যাপদে ব্যবহৃত। যেমন ১নং চর্যাতে পাই মানুষ এবং মানুষের শরীরকে গাছের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। বৃক্ষের সঙ্গে মানবের আত্মীয়তা অতি প্রাচীন। মানব সভ্যতার আদিমতম স্তরে এই গাছই ছিল মানুষের সবচেয়ে পরিচিত মূক আত্মীয়। তাই এই চর্যাতে মানুষের দেহকে তুলনা করতে গাছকে বেছে নেওয়া হয়েছে। “কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল।” অর্থাৎ কায়া-তরুর পাঁচটি ডাল বলতে আমাদের শরীর একটি বৃক্ষ এবং এর পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় পাঁচটি শাখা। এই দেহ ও পঞ্চইন্দ্রিয়ই সাংসারিক আকর্ষণের মূল বিষয়। সেইজন্য আমরা নিরবধি দুঃখ ভোগ করি।
চর্যাপদে যে কটি রূপক, প্রতীক, চিত্রকল্প ব্যবহৃত হয়েছে তার মধ্যে নদীর রূপকটি সবচেয়ে মৌলিক, চর্যাপদের একাধিক শ্লোকে কবির চোখে পৃথিবী নদীর রূপকে ধরা পড়েছে। মানুষের জীবন এবং তার বিবিধ উত্থান পতন নিয়ে যে পৃথিবী, তার সঙ্গে নদীর স্রোত, নদীর জোয়ার ভাঁটা, নদীর গতি পরিবর্তন ইত্যাদির তুলনা অবশ্য কেবল চর্যাপদেই আছে তা নয়, পূর্ব ভারতের কাব্য সাহিত্যে তার নিদর্শন বহু জায়গায় ছড়িয়ে, নদ-নদী-খাল-বিলবহুল পূর্বভারতের কবিদের চোখেই পৃথিবী নদীর রূপকে বহুবার চিত্রায়িত। পৃথিবীর বন্ধন ছেড়ে পরলোকে যাওয়ার ব্যঞ্জনাও এই নদী পার হওয়ার মধ্য দিয়ে রূপায়িত। জীবনের পরপারে মৃত্যুর অন্ধকারে প্রস্থান করা সেটাও বাঙালি কবিদের চোখে বৈতরণী পার হওয়া বলে কথিত। “রাধে, পার কর” বলে বাঙালি কবি যখন প্রার্থনা করেন তখন এই ভবনদীর পারে যাওয়ার ব্যঞ্জনা ফোটে। শ্রীকৃষ্ণের নৌকা বেয়ে যাওয়া, নদীতে স্ত্রীলোকের সাঁতার দেওয়া সমস্তই বাঙালি কবিদের নদী এবং নদীর স্রোতকে পৃথিবী এবং পৃথিবীর গতির সঙ্গে এবং নদীতে সাঁতার দেওয়ার অর্থে পৃথিবীর মধ্যে সুখ দুঃখে বিজড়িত জীবন অতিবাহিত করা মেলে। এককথায় পূর্ব ভারতে কবিদের চোখে ভবকে নদী হিসাবে কল্পনা করার ঝোঁকটি সবচেয়ে প্রবল।
যাইহোক, চর্যার এই সকল তত্ত্বে প্রধানতঃ তিনটি ভাবধারা লক্ষিত হয়। যথা—
-
(১) কোনও কোনও আচার্য প্রত্যক্ষভাবে অর্থাৎ পারিভাষিক বা সাংকেতিক শব্দের সাহায্য ছাড়াই তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন—লুইপাদের ১ম চর্যা, ২৯ চর্যা, সরহপাদের ২২ চর্যা, ভাদেপাদের ৩৫ চর্যা। এই পদগুলিতে পারিভাষিক শব্দের জটিলতা নেই, যৌন প্রতীক ত্যাগ করে বিশুদ্ধ ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বের সাহায্যে নির্বাণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
-
(২) আবার কতকগুলি পদে তন্ত্রমন্ত্র ও যোগদর্শনের কিছু বাহুল্য ঘটেছে। যেমন— কাহ্নপাদের ১১ সংখ্যা পদে ‘নাড়িশক্তি’ ‘আলিকালি’ প্রভৃতি গূঢ় সাধন পদ্ধতির নানা ইঙ্গিত আছে। ভুসুকুপাদরে ২৭ সংখ্যক পদে ‘উষ্মীষ কোমল’ ‘বত্রিশযোগিনী’ প্রভৃতি পারিভাষিক শব্দ রয়েছে।
-
(৩) এছাড়া অন্য কয়েকটি পদে বাস্তব প্রতীক রূপকের সাহায্যে শূন্যবাদ ও মহাসুখ তত্ত্বের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। যেমন— কায়াতরু (১-চর্যা), শাশুড়ী বহুড়ী (২), শুস্তিনী (৩), যোগিনী (চর্যা-৪), হরিণ-হরিণী (৬), সোনা ভরিলি করুণা নাবী (৮), ডোম্বী-কপালী (১০), শাশুড়ী-ননদী (১১), দাবা খেলা (১২), বুদ্ধনাটক (১৭), কাহ্ন ডোম্বীর বিবাহ (১৯), যৌবনবতী রমণী (২০), চঞ্চল মুষিক (২১), তুলা ধোনা (২৬), শবর-শবরী (২৮), শবর-শবরীর আসবমত্ততা (৫০), ভুসুকুর চণ্ডালী বিবাহ করে বাঙালি হয়ে যাওয়া (৪৯) প্রভৃতি রূপকের ছলে বুদ্ধিগ্রাহ্য স্থূল চিত্রকল্পের সাহায্যে সূক্ষ্ম সাধনতত্ত্বের আভাস দেওয়া হয়েছে।
চর্যাপদে এই সকল রূপক উপমা ব্যবহৃত হলেও সেই রূপকগুলি এক ধরনের জিনিস বোঝাতেই ব্যবহৃত। যেমন— ডোম্বী, শবরী, হরিণী–এরা নৈরাত্ম্য দেবীর প্রতীক ; গগন সর্বদাই নির্বাণের ; বৃক্ষ–দেহের ; নৌকার দণ্ড – গুরুদণ্ড উপদেশের সোনারূপা—পার্থিব সম্পদের ; ঘর—দেহের ; নদী—পৃথিবীর রূপক, এগুলি ঘুরে ফিরে নানা কবিতার নানা রূপে প্রকাশিত, বৈচিত্র্যহীনতা তাতে আছে, সন্দেহ নেই, কিন্তু তা সত্ত্বেও এই রূপকগুলির ব্যবহারে কবি মনের যে কুশলতার পরিচয় পাওয়া যায় তা অস্বীকার করার নয়। হয়তো চর্যার ভাব ও ভাষা দূরূহ। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রশংসার বিষয় হল— দুরূহ বিষয়কে দুরূহতর করতে কবিগণ অপরিচিত বস্তুকে অবলম্বন করেন নি, সাধ্যমত তাঁদের চারিদিকের পরিচিত জগতের ছোট ছোট জিনিসগুলিই বেছে নিয়েছেন, এখানেও তাঁদের বাস্তবমুখীনতা এবং সুগভীর জীবনবোধের স্বাক্ষর সুস্পষ্ট।
Leave a comment