‘মিষ্টিসিজম্’ সেই বিশেষ ‘অপরোক্ষ’ অনুভব যা প্রজ্ঞালব্ধ। এই অনুভবের দুটি দিক—একদিকে এর মাধ্যমে দেশ-কাল নিরপেক্ষ অবিনাশী এবং সম্পূর্ণ সত্যের প্রশাস্তি উপলব্ধি সম্ভব; একটি ঐকাহিক স্বরসঙ্গতি আত্মস্বরূপের সঙ্গে বিশ্বরূপের, আবার বিশ্বচেতনার মধ্যে নিজেকে নিলীন করার পর সামগ্রিক আনন্দবোধ। তাই “Mysticism is immediate, intuitive relation with the absolute.” বস্তুতপক্ষে এই বোধে টেলিপ্যাথি, ক্লেয়ারভেন্স, প্রিকগনিশন ইত্যাদি ইন্দ্রিয়াতীত প্রত্যক্ষণ-নির্ভর বা Extra Sensory Perception নয়, যদিও ‘অষ্টাসিদ্ধি’র প্রকাশের মাধ্যমে কোন কোন ক্ষেত্রে Psycho Kinesis বা ইন্দ্রিয়াতীত ক্রিয়াশক্তির কিছু যোগ থাকতে পারে।

এই মিষ্টিসিজমের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য—অপরোক্ষানুভূতি। ‘অপরোক্ষ’ মানে সাক্ষাৎ অধিগত; যা পরোক্ষ নয়, অর্থাৎ পর দ্বারা শ্রুত বা অনুমিত নয়। অথবা অন্যভাবে বলা যায়, ‘অপরোক্ষ’ মানে অপর চোখ, যা দিয়ে বস্তুজগতের অতীত জগতের রূপ ও দৃশ্য দেখা যায়। বৌদ্ধ তান্ত্রিক অভিধায় এরই নাম স্ব-সংবেদন, চর্যাকারের ভাষায় ‘সঅ সংবেঅণ’। পাশ্চাত্য সমালোচক বলেন- “Mysticism is a science of self-evident reality” (Underhill) এই স্ব-সংবেদ্য অবস্থা সম্পর্কে কাহ্নপাদের ‘হেবজ্রতন্ত্রে’র ‘যোগরত্নমালা’ টীকার ব্যাখ্যা থেকে জানা যায়—“স্বসংবেদ্যম্ অপরপ্রত্যয়ং প্রত্যাত্মবেদ্যং স্বভাব ইতি” অর্থাৎ এটি প্রত্যাগাত্মার অপর প্রত্যয় বা আত্মপ্রত্যয়। সাধারণভাবে বলা যায়, নিজেকে নিজে অনুভব করার নামই স্ব-সংবেদনা – “অপণে অপা বুঝা নিআ মণ”।

চর্যাগীতির ‘মহাসুখ’ বা সহজ-তত্ত্বটি মিষ্টিক-ভাবাশ্রিত। যে অন্বয় সর্বব্যাপী নিত্য নির্বিশেষ তত্ত্ব মিষ্টিক অবরোধের মূল, ‘মহাসুখ’ সেই তত্ত্ব। সহজ মহাসুখ একটি নির্বিকল্প আনন্দ—সর্বশূন্য, গ্রাহ্য গ্রাহকবর্জিত, বর্ণ-চিহ্ন-রূপহীন বিজ্ঞান বা চৈতন্য। এ তত্ত্ব অলক্ষ্য লক্ষণহীন—“অলকখ লকখণ না জাই”; বাক্যে ব্যাখ্যারও অতীত— “বাকপথাতীত কাঁহি বখানী”, মনন অনুভব চেষ্টায় ইন্দ্রিয় হয় বিধ্বস্ত—“জানু মুনস্তে তুট্টই ইন্দিআল”। তবু দেহের চক্রে চক্রে বিশেষতঃ ‘মহাসুখচক্রে’ মহাসুখসঙ্গ লাভের জন্য সাধক একান্ত নিষ্ঠায় হন মগ্নপ্রাণ। এই সুখের সন্ধানে যাত্রা ও মিলনের লক্ষ্যেই তাঁর ঘটে মোক্ষলাভ। মন ও হৃদয় তখন এক, ভাব ও জ্ঞান যুক্ত, চেতন-বেদন বোধ বিলুপ্ত “চেঅণ ণ বেঅণ ভর নিদ গেলা”। এই আশ্চর্য যোগনিদ্রাবস্থায় “ছাড়িঅ ভয় ঘিণ, লোআচার” সুখ-দুঃখ, পাপ-পুণ্য সমজ্ঞানে সমরসে আপ্লুত হয় চিত্ত।

রূপান্তর বৈশিষ্ট্য : মিষ্টিক জ্ঞানের মধ্যে সত্তার রূপান্তর বা পরাবৃত্তি অর্থাৎ Retro version বা Involution লক্ষণীয়। চর্যাগানেও দেখা যায়, উপলব্ধির নিঃসঙ্গ মুহূর্তে সাধকের চিত্তের সব চঞ্চলতার হয় অবসান, সত্তা নিশ্চল, দৃঢ়, বজ্রোপম। এসময় আত্মপরবিভাগ (সপরাবিভাগ) যেমন হয় বিলীন, তেমনি দেখা যায় মহাকরুণামেঘ— “করুণামেহ নিরস্তর ফরিআ”।

অনির্বচনীয়তা : আপাতদৃষ্টিতে মিষ্টিক সংবেদন সর্বত্র ‘অনুত্তর’ ও ‘বাক্‌পথাতীত’ কিন্তু একথা ঠিক, কোনো মহভাবই শেষ পর্যন্ত নিরালম্ব বা শূন্যচরা বিষয় নয়। তাছাড়া তাকে সাধারণের প্রয়োজনে প্রকাশের দায়বৃত্ত স্বীকারে সাধক-কবির রূপকারী বিবেক উদ্বুদ্ধ হয় চিরকাল, সেই উপনিষদের যুগ থেকে শ্রীরামকৃষ্ণদেব পর্যন্ত। তাই চর্যাতেও দেখি ‘মহাসুখ’ তত্ত্ব আলোচনার চরমতম স্তরে “গুরু বোব সে সীসা কাল” জেনেও চর্যাকার রূপক-প্রতীকের আশ্রয়ে তাদের অনির্বাচ্য স্বসংবেদনকে প্রকাশের জন্য সচেষ্ট বলা বাহুল্য, ধর্মের সঙ্গে কাব্যের এখানেই সেতুবন্ধন। মিষ্টিকপন্থীদের ভাষা চিরকালই ছায়াময়, লৌকিক জ্যোতির্ময়ী আভা।

রূপকের বর্গবিভাগ— Evellyn Underhill তার “Mysticism” গ্রন্থে উদ্দেশ্যপ্রাণতার দিক থেকে নিখিল মিষ্টিকদের রূপকগুলিকে তিনভাগে ব্যাখ্যা করেছেন— Symbol of Pilgrimage, Symbol of Love, Alchemy Symbol. চর্যাগুলি মূলতঃ সাধন-প্রধান। তাই শুদ্ধিমূলক রূপকের সঙ্গে অভ্যাসপ্রকট মূলক রূপকের স্পষ্ট পার্থক্য হয়ত সর্বত্র নেই, তত্ত্বময় মহাসুখ বা মিলন রূপকের বিহ্বলতা হয়ত মিশেছে কোথাও। তবু অনেকক্ষেত্রেই রূপকগুলি উক্ত বৈশিষ্ট্যে স্বাতন্ত্র্যদীপ্ত।

(ক) Alchemic Symbol বা বিশুদ্ধিমূলক রূপকের আয়োজন করা হয় সত্তার দৈহিক এবং মানসিক রূপান্তর সাধনের প্রয়োজনে। সেইজন্য আছে অবিদ্যা-বিক্ষুব্ধ পুদগল, নাড়ী ও চিত্ত-শোধনের জন্য চিকন বাকলে মদ পরিশুদ্ধি প্রচেষ্টা। শুড়িনী তাই “চীঅণ বাকলঅ বারুণী বান্ধঅ”। কেননা এরপরই দেখা যাবে চৌষট্টি ঘড়ায় পূর্ণ সেই ঘরের কাছে এসে “পইঠেল গরাহক নাহি নিসারা।” অনুষঙ্গ রূপে আছে ডোম্বীর অসাধারণ নৃত্যের মুগ্ধ-মুহূর্ত, যেখানে একটি পদ্মের চৌষট্টি পাপড়ির উপর “তঁহি চড়ি নাচঅ ডোম্বী বাপুড়ী”, আছে দাবা খেলার ঘনীভূত একাগ্রতার প্রথমে পঞ্চপ্রকৃতি দমনের স্থির নিষ্ঠা—“গঅবরে তোলিআ পাঞ্চজনা ঘালিউ” তারপর জয়লাভের বা সিদ্ধির নাটকীয় চমক–“মতিএঁ ঠাকুরক পরিনিবিতা। অবশ করিআ ভববল জিতা ৷৷”

(খ) ঘরেও নয়, অথচ তীরেও নয় এমন অবস্থায় যাত্রার দূরত্ব আর জীবনাবেগ, গতি আর সঙ্কট বিশেষভাবে রূপ নেয় Symbol of Pilgrimage- এ, বৌদ্ধ তান্ত্রিক ব্যাখ্যায় যার নাম ‘প্রবাহভ্যাস’। চর্যায় দেখি, নদী বা সাগরের প্রান্তে জিনপুর বা সুখবতীপুরের সন্ধানে সাধকের যে যাত্রা, তা মূলতঃ নৌ-যানেই। এখানে একদিকে আছে ভারতবর্ষের দুই প্রধান নদী গঙ্গা-যমুনার সঙ্গে দেহের দুই প্রধান নাড়ীর প্রসিদ্ধ উপমা; অন্যদিকে দেখা যায় “সোণে ভরিতী করুণা নাবী” নিয়ে সাধকের কখনও নিঃসঙ্গ গগন-সমুদ্রে মহাসুখভিসার, কখনো-বা অনভিজ্ঞ যাত্রীর পারের কর্ত্রী বুড়ী মাতঙ্গীর প্রতি ব্যাকুল মিনতি—“বহি তু ডোম্বী, বাহ লো ডোম্বী বাটত ভইল উছারা।”

(গ) ঈশ্বরকে মানুষের প্রেমের মাধ্যমে অর্জনের কথা বহু আগে খ্রীস্টপূর্ব যুগের মানুষ প্লাটিনাসের মুখেই শোনা যায়। তারপর খ্রীস্টান ধর্মে সেন্ট থেরেসা, ক্যাথারিন, ম্যাডাম গোঁয়োন, জন অব দি ক্রশ কণ্ঠে শুনি তার প্রতিধ্বনি — “It may please Thee to unit me to Thyself”। মিষ্টিকপন্থী সুফীবাদীরাও (রুমি প্রমুখ) ভক্ত-ভগবানের সম্পর্কটিকে ‘মাসুক-আসেক’ অর্থাৎ প্রেমিক-প্রেমিকার উত্তপ্ত কামনাবেগ উপলব্ধিতে উৎসুক। কিন্তু চর্যায় Symbol of Love কিছু স্বতন্ত্র। অন্যান্য মিষ্টিকদের মত চর্যাচারীর মিলন পরমতত্ত্বের সঙ্গে সাধক-সত্তার নয়। মহাসুখ বা সহজানন্দ এই ধর্মের পরমতত্ত্ব ঠিকই, কিন্তু নৈরাত্ম্য দেবী বা দেহস্থ মধ্যমা নাড়ীর সঙ্গে করুণা চিত্তের মিলনেই সেই মহাসুখের উপলব্ধি। প্রতীকেও লক্ষণীয় সেই প্রবণতা— “সাধক তাই নৈরাত্মা যোগিনী বা বিশুদ্ধ মধ্যমা নাড়ীর ‘মুহ চুম্বী কমলরস পীবমী’র জন্য আকুল। আবার এই অবধৃতিকা ডোমনী বা শবরী অস্পৃশ্য নারী হয়ে সাধকের কাছে কখনও নৈরামণি দারী বা (প্রেমিকা ঘরনী রূপে) কখন-বা ‘চ্ছিণালী’ রূপেও কল্পিতা।”