অথবা, চর্যাপদের রূপক ও রূপকল্পগুলো জীবন থেকেই গৃহীত – তোমার পঠিত পদ থেকে যথোপযুক্ত দৃষ্টান্তসহ মন্তব্যটির সার্থকতা আলোচনা কর।

উত্তর: প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাগীতিগুলো বৌদ্ধজ্ঞানের সিদ্ধাচার্যদের লেখা মরমি গীত। তত্ত্বপ্রধান এই গানগুলো সান্ধ্যভাষায় রচিত। গুরুপদেশ ব্যতীত সেগুলোর মর্ম উদঘাটন করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। এগুলোতে, ধর্মীয় অনুভূতি প্রকাশ পেলেও এর সাহিত্য মূল্য অনস্বীকার্য। চর্যাকারগণ সচেতনভাবেই এগুলোকে কবিতা হিসেবে রচনা করেন নি; কিন্তু তাদের বিশেষ রহস্যবাদী সম্প্রদায়ের গূঢ় ভজনাবলি হলেও এতে স্বতঃস্ফূর্ত রসের আবেদন এবং বাক নির্মিতির শিল্পকৌশল বর্তমান থেকে একে কাব্যের পর্যায়ে উন্নীত করেছে। এতে সাধকদের হৃদয়ভাব সার্থকভাবে বিধৃত হয়েছে এবং তা সাহিত্যিক মূল্যবান সমৃদ্ধ কাব্য বলে স্বীকৃতিলাভে ধন্য হয়েছে।

চর্যাপদে বজ্রযান ও সহজযানের গূঢ়ধর্ম, সাধন প্রণালি ও দর্শনতত্ত্বের নানা ধরনের রূপক প্রতীক ও চিত্রকল্পের দ্বারা আভাস ইঙ্গিতে ব্যাপ্ত ও ব্যঞ্জিত হয়েছে। বৌদ্ধধর্মের মহাযান মত কালক্রমে নানা উপধর্মে বিভক্ত হয়ে যায়। সে উপধর্মগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বজ্রযান, কালচক্রযান, মন্ত্রযান, সহজযান ইত্যাদি। কিন্তু সাধন তত্ত্বে এদের নানা মতপার্থক্য থাকলেও নির্বাণ সম্বন্ধে এরা সকলেই এক লক্ষ্যে আসীন ছিলেন। বাস্তব জীবনের জরামরণ ও পুনর্জন্মের বিষচক্র পার হয়ে নির্বাণ লাভই বৌদ্ধধর্মের মূলমন্ত্র। এরা অর্থাৎ চর্যাকারেরা সেই পথের যাত্রী। তবে সেই পথে পৌঁছাতে গিয়ে পদকর্তারা নানাপ্রকার গূঢ়তান্ত্রিক আচার আচরণের উল্লেখ করেছেন, যা অবলম্বন করলে সাধক অতি সহজে নির্বাণে পৌঁছাতে পারেন। এরা সাধন ভজনের তত্ত্বকথা বললেও অল্পবিস্তর কবি প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

চর্যার পদকর্তাগণ ভাষা, ছন্দ, অলংকার, চিত্রকল্প, রূপক, উপমা ও রূপনির্মিতিতে যে খুব সুদক্ষ ছিলেন তা অনস্বীকার্য। বুদ্ধিগ্রাহ্য দার্শনিকতা । ও রহস্যময় আচার আচরণকে অনেক স্থলে এরা কাব্যলোকে উন্নীত করেছেন। নির্বাণ তত্ত্বকে কোনো কোনো পদকর্তা নিজেকে দয়িতারূপে বর্ণনা করেছেন। তাই নির্বাণ লাভের আকাঙ্ক্ষা কাব্যমন্ত্রে পরিশুদ্ধ হয়ে প্রিয়মঙ্গল কামনায় রক্তিম হয়ে উঠেছে। সর্বোপরি, চর্যাপদের এসব পদের মধ্যে তৎকালীন সাধারণ বাঙালির প্রতিদিনের ধূলিমলিন জীবন চিত্র, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার টুকরো টুকরো রেখাচিত্র জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ভাষাতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, দর্শন এবং আদি বাংলা সাহিত্যের সার্থক দৃষ্টান্ত হিসেবে চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ একটি স্মরণীয় গ্রন্থ। এটি আবিষ্কৃত না হলে আদিযুগের বাংলা ভাষা অজ্ঞাতই থেকে যেত।

বাংলাদেশের বাউল-ফকির প্রভৃতি সম্প্রদায়ের ধর্মের ইতিহাস বুঝতে গেলে চর্যাপদের আলোচনা অপরিহার্য। এগুলোর ধর্মতাত্ত্বিক মূল্য ছাড়াও সাহিত্যিক মূল্য রয়েছে। ভাবের দিক থেকে চর্যাপদের স্থানে স্থানে বাহ্যভাবে শৃঙ্গার রসের পরিচয় পাওয়া যায়। এই পদগুলোতে পরমতত্ত্ব শূন্যকে শূন্যতা বা নৈইরামণি (নৈরাত্মা) বলে তাকে যোগিনী (সাধনসঙ্গিনী), দারী (গণিকা), ডোম্বী (ডুমনী বা নটী), মেহেরী (মহিলা) রূপে কল্পনা করা হয়েছে। এতে মূলত আদিরস দৃষ্ট হয়েছে। দৃষ্টান্তরূপ বলা যেতে পারে-

জোইনি তই বিনু ঘনহিন জীবনি।

তোঁ মুহ চুম্বী কমলরস পীবমী। ।

তিঅ ধাউ খাট পড়িয়া সবরো মহাসুখে সেজি ছাইলী।

সবরো ভুঅঙ্গ নইরামণি দারী পেক্ষ রাতি পোহাইলী।।

হিঅ তাবোলা মহাসুখে কাপুর খাই।

সূন নৈরামণি কণ্ঠে লহআ মহাসুখে রাতি পোহাই।। (শবর পা)

চর্যাপদের উপরের অংশটুকু সরল অনুবাদ করলে তার মানে দাঁড়ায় এমন- রে যোগিনী, তুই বিনা ক্ষণকাল বাঁচি না, তোর মুখ চুমিয়া কমল রস পান করি। ত্রি ধাতু খাট পড়িল, শবর মহাসুখে শয্যা বিছাইল। শবর লম্পট, নৈরাত্মা, গণিকা, প্রেমে রাত্রি পোহাইল। হিয়া তাম্বুলে মহাসুখে কপূর খায়, শূন্য নৈরাত্মা কণ্ঠে লইয়া মহাসুখে রাত্রি পোহায়।

চর্যাগীতিতে যে ধর্ম সাধনার ইঙ্গিত আছে তা প্রধানত সহজযান বৌদ্ধধর্মের। এই ধর্ম সাধনাকে ‘সহজ’ নামে অভিহিত করার দ্বিবিধ সার্থকতা আছে। প্রথমত, এই ধর্ম সাধনার সাধ্যও সহজ, দ্বিতীয়ত, সাধন পদ্ধতিও সহজ। একদিকে সাধনার মাধ্যমে তাঁরা যা পেতে চান তাও সহজানন্দ, অন্যদিকে তাদের সাধনপদ্ধতিও বক্র নয়, সহজ দেহ। সাধারণভাবে অন্যান্য সাধকেরা যখন দেহের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিগুলো রোধ করে ধ্যান, সমাধি জপতপ শাস্ত্রপাঠের মাধ্যমে মুক্তির সন্ধান করেন তখন তাঁর সহজ দেহের সহজ প্রবৃত্তিগুলো উপেক্ষা করে বক্রপথে বিচরণ করেন। চর্যাগীতিতে অন্যান্য ধর্মের এই বক্রগামিতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রবলভাবে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। চর্যাগীতির। প্রথম গানেই লুই ধ্যান সমাধির ব্যর্থতা ঘোষণা করে বলেছেন-

সঅল সমাহিঅ কাহি করিঅই।

সুখদুখেতে নিচিতি মরিঅই।

গঠনগত দিক দিয়ে আমরা দেখতে পাই চর্যাপদগুলো গীত। তাতে পটমঞ্জরী, গুর্জরী, দেশাক্ষ, কামোদ, বনসী, রামত্রী, বরাড়ী, মল্লারী, মালশী, বঙ্গাল, শবরী, কাহ্নগুর্জরী প্রভৃতি ভাগ আছে। প্রতি পদের শেষে ভণিতা আছে। যেমন-

‘ভনই লুই আমহে ঝানে দীঠা।

ধমন চমন বেনি পীন্তি বইঠা’। (লুইপা)

চর্যাগীতি বাংলা সাহিত্যের উপরে সুদূরপ্রসারী প্রভাব। ফেলে। আমরা দ্বাদশ শতকের কবি জয়দেবের গীতিগোবিন্দে এরকম ভণিতার প্রয়োগ দেখি। তার আগে আর কোনো সংস্কৃত কবি ভণিতা ব্যবহার করেনি। গীতিগোবিন্দের গীতগুলোকে আমরা মালব, মুর্জরী, বসন্ত, রামকিরী, কর্নাট, বরাড়ী, ভৈরবী, বিভাস প্রভৃতি রাগের প্রয়োগ দেখি।

আলোচনার শেষে বলা যায়, জয়দেবের পূর্ববর্তী সংস্কৃত কাব্যের ছন্দে মিলনের কোনো স্থান নেই। অথচ সমস্ত গীতিগোবিন্দের প্রত্যেক শ্লোকে আমরা মিল দেখি। ভণিতা ও মিলের এ রীতি জয়দেব কোথা থেকে পেলেন এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় তিনি চর্যাপদ থেকে পেলেন। তা বৈষ্ণব পদাবলীকেও প্রভাবিত করে। চর্যাপদের উপমা, রূপকের প্রভাব বাংলা সাহিত্যে এখনো বর্তমান।